প্রিয়দর্শিনীর খোঁজে পর্ব ১০

0
640

#প্রিয়দর্শিনীর_খোঁজে❤
|| পর্ব – ১০ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

ফজরের আজান দেওয়া মাত্রই তাহনা উঠে নামাজ পড়ে নিল। অনুকেও ডেকে তুললো। দুজন মিলে বোরকা পড়ে অনিকের জন্য অপেক্ষা করছিল। অনিক তখন ঘুমে ছিল। তাহনার মামি এসে অনিককে ডাক দিতেই উঠে সেও নামাজ পড়ে নিল। সবাই মিলে হালকা কিছু মুখে দিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়লো সিএনজি স্টেশনের দিকে।

যেতে যেতে অনিক বললো,

‘ফ্যামিলি নিয়ে যেতাম, তাহলে এত ঝামেলা হতো না। এখন ৫ কিলোমিটার দূরে যেতে যেতে না সূর্য উঠে যায়।’

তাহনা নিকাবের আড়াল থেকে বললো,

‘আপনি কি বিরক্ত? ঘুরতে নিয়ে না গেলে বলুন যাবো না।’

অনিক থেমে গেল। কিঞ্চিৎ রেগে গিয়ে বললো,

‘এই মেয়ে, বেশি বুঝো? চুপচাপ সাথে চলো। নইলে ডাকাতের হাতে তুলে দিব। জানো এখন ডাকাতের আনাগোনা বেশি? শুধু মাত্র তোমাদের জন্য এতটা রিস্ক নিচ্ছি।’

অনিক হাটতে শুরু করে, তাহনার ভিষণ ভয় লাগা শুরু হলো। যদি সত্যিই ডাকাতের হাতে তুলে দেয় অনিক? ভয়ে ভয়ে অনিকের পিছু হাটতে লাগলো তাহনা।

অনিক একটা সিএনজি ভাড়া করে নিল। তিনজন পিছনেই বসলো। সামনে নাকি বসা যাবে না সিএনজি ড্রাইভার বললো। অনিক এক পাশে, অনু মাঝখানে আর তাহনা অন্যপাশে বসলো। গন্তব্য এখন নীলাচল।

সিএনজি চলছে তার গন্তব্যে। এদিকে তাহনা মুগ্ধ হয়ে বাইরে দেখছে। সারি সারি পাহাড় পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকেই বিশাল পাহাড় দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতি এতটা সুন্দর কেন? সৃষ্টিকর্তা কত সুন্দর করে এসব সৃষ্টি করেছেন। পাহাড় দেখলেই তাহনার মন জুঁড়ে যায়। মূলত পাহাড় আর মেঘ ছুতেই আসা এই বান্দরবান এ। তাহনা বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে শুধু। সিএনজি খুব দ্রুত চলছে। তাহনার ভয়ও করছে। তাহনা অনিককে বলে,

‘ভাইয়া, এতো দ্রুত যাচ্ছে কেন? অ্যাকসিডেন্ট হয়ে যাবে তো।’

অনিক তাহনার কথা শুনে ড্রাইভারকে আস্তে চালাতে বলে, কিন্তু ড্রাইভার ব্যাটা বজ্জাত। সে দ্রুত চালাচ্ছে, যেন ওদের চেয়ে তার যাওয়াটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। অনিক তাহনাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,

‘এইতো, কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর। আমরা টাইগার পাড়ায় গেলেই চলবে।’

তাহনা চুপ করে বসে রইলো অনুর হাত ধরে।

অনেক্ক্ষণ পর তারা টাইগার পাড়ায় পৌঁছায়। গুণে গুণে ১০০০ টাকা নিয়েছে ড্রাইভারটা। অনিক তর্ক না করে তাহনা আর অনুকে নিয়ে ওখান থেকে প্রস্থান করলো। নীলাচলের দিকে হেটে যাচ্ছে। ওখানে দু হাজার ফুট উপরে পাহাড়ে তাদের উঠতে হবে।

সূর্য এখনো পুরোপুরিভাবে আলো ফোটায়নি। মানুষের আনাগোনা কিছুটা আছে। তাহনাকে সামনে রেখে অনুকে পিছনে নিয়ে অনিক পাহাড়ের উপর উঠতে থাকে। তাহনা ভয়ে একদম জমে গেছে। অনিক বারবার বলেছে, তাহনা যেন তার হাত না ছাড়ে। তাহনাও খুব শক্ত করে অনিকের হাত ধরে আস্তে আস্তে উপরে উঠছে। আস্তে আস্তে করে সময় নিয়ে তারা পাহাড়ের চুড়ায় নীলাচলে উঠতে সক্ষম হলো। তাহনা উঠেই অনুকে জড়িয়ে ধরলো ভয়ে।

নীলাচলে এসে তাহনার অনেক ভালো লাগছে। প্রকৃতির এত সুন্দর একটা রুপ দেখতে পেরে তাহনা খুব খুশী। তার মন প্রশান্তিতে ভরে গেল। তাহনা ওখান থেকে দূরে চোখ মেলে তাকালো। শুধু পাহাড় আর পাহাড়। দূর থেকে অনেক জায়গাই সে দেখতে পারছে। বুঝতে না পেরে অনিককে জিজ্ঞেস করলো,

‘ভাইয়া, ওই যে দূরে দেখা যাচ্ছে ওটা কোন জায়গা?’

অনিক ভালো করে তাকিয়ে বলে,

‘কক্সবাজার।’

তাহনা রীতিমতো অবাক। বান্দরবানে এসে সে কক্সবাজারের দৃশ্য দেখতে পারবে কল্পনাও করেনি। অনিক আরো বলে,

‘নীলাচল থেকে বান্দরবান শহরকে পুরোপুরি দেখতে পারবে। মেঘমুক্ত আকাশ থাকলে কক্সবাজারের সামুদ্র সৈকতের অংশ বিশেষ দেখা যায়।’

তাহনা দুহাত মেলে ধরে। প্রকৃতির সুমধুর হাওয়া গায়ে মাখে। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য নিকাবটা মুখ থেকে সরিয়ে নিয়েছে আগে থেকেই। তারা যেই পাশে আছে ওখানে লোকজন নেই। অনিক তার ক্যামেরাটা নিয়ে এসেছিল। তাহনার আনন্দ মুহুর্তটা সে চট করেই ক্যামেরা বন্ধি করে নিল। তাছাড়া অনু আর তাহনার বেশ কিছু ছবিও সে তুলেছে। তিনজন মিলে অনিকের মোবাইলে সেল্ফিও তুলেছে। দূর পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকা তাহনার ছবি অনিক আড়ালেই তুলেছে৷ পাহাড়ের এবং আশেপাশে যা দেখা যায় সবকিছুই ক্যামেরাবন্দি করেছে অনিক। তাহনা বললো,

‘ভাইয়া মেঘ? মেঘ দেখা যায় না কেন?’

অনিক হেসে বললো,

‘বর্ষা, শরৎ আর হেমন্তের সময়ই মেঘ হাতের কাছে খেলা করে।’

‘এখন তো শরতের শেষ আর হেমন্তের শুরু। তাহলে দেখা যাচ্ছেনা কেন?’

তাহনার কথা শুনে অনিক তাহনার দিকে এগিয়ে আসে। তারপর তাহনার কাছে এসে হাতের আঙুল দিয়ে ইশারা করে নিচে তাকাতে বলে,

তাহনা অনিকের ইশারায় চোখ রাখলো নিচের দিকে। কয়েক ফুট দূরে মেঘ ভাসছে। অনেক গুলো মেঘের ভেলা একসঙ্গে ভেসে যাচ্ছে এদিক ওদিক। তাহনা খুশি হাত বাড়ালো নিচের দিকে৷ তা দেখেই অনিক দ্রুত তাহনার হাত ধরে টেনে নিয়ে আসে। তাহনা অনিকের দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। অনিক রাগ দেখিয়ে বলে,

‘এই মেয়ে, চোখের কি মাথা খেয়েছ? কোন সাহসে তুমি নিচে হাত বাড়ালে? পড়ে গেলে কি হতো?’

তাহনা ভয়ে চুপসে যায়।

‘সরি ভাইয়া।’

‘দাঁড়িয়ে থাকো। ভাগ্যে থাকলে মেঘ ছুতে পারবে।’

তাহনা কিছু বললো না। মুহুর্তে মধ্যেই তাহনার মাথার উপর শীতল কিছু অনুভব করলো। মাথায় হাত দিতেই পানির মতো কিছু লাগলো। তাহনা উপরে তাকিয়ে দেখে এক টুকরো মেঘ ওর হিজাবের সাথে বারি খেয়েছে। তাহনার খুশি দেখে কে। সেই সাথে অনুও মেঘ ছুঁয়েছে। অনিক ওদের ছবি তুলে দিয়ে গেলেই মেঘ হাওয়া হয়ে যায়।

লোকজন আসছে দেখে অনিক তাহনা আর অনুকে নিয়ে নেমে যেতে লাগলো। এবার অনুকে সামনে রেখে আর তাহনাকে পিছনে রাখলো অনিক।
তারা এখন নেমে রেস্টুরেন্টে যাবে। কিছু খেয়ে আবারো রওনা দিবে বান্দরবান সদরে। অনিকের কিছু কাজ আছে।

.
কলেজে রাইশাকে সবার সামনে সরি বলে সেই ছেলেটা। নিজের ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চায়। রাইশা ছোট করে বলে ক্ষমা করে দিয়েছে। সেদিনের ঘটনা জিগ্যেস করতেই ছেলেটা বলে,

‘আপনাদের কলেজ আর আমাদের ভার্সিটি পাশাপাশি। আমার একটা ফ্রেন্ড আমায় বললো তাকে এই কলেজের একটা মেয়ে অনেক অপমান করেছে। আর বললো সে নাকি বেগুনি ড্রেস পড়া আর আপনিও বেগুনি ড্রেস পড়েছিলেন সেদিন। তাই ভুলে থাপ্পড়টা আপনাকে দিয়েছি।’

‘ইট’স ওকে। খেয়াল রাখবেন এরপর থেকে।’

রাইশার বান্ধবী দীপ্তি ছেলেটার সামনে এসে বললো,

‘হায়, আপনার কি কোনো গার্লফ্রেন্ড আছে?’

রাইশা দীপ্তির হাত ধরে বলে,

‘কি বলছিস তুই। ক্লাসে চল।’

ছেলেটা হেসে বলে,

‘নাহ্। নেইতো। কেন? আপনার বুঝি আমার গার্লফ্রেন্ড হওয়ার শখ?’

রাইশা দীপ্তিকে টেনে নিয়ে আসে ওখান থেকে।

ছেলেটার বন্ধুরা এসে ছেলেটাকে বলে,

‘কিরে রাফি? এতো শান্তভাবে একটা মেয়ের সাথে কথা বললি? তাও তুই! অবিশ্বাস্য!’

রাফি হেসে বললো,

‘এখানে দোষ আমার। তাই ভদ্রতা বজায় রাখছি। আর মেয়েটার সাথে পরিচিত না তাই আপনি বলেছি।’

রাফির এক বন্ধু রাফিকে ধাক্কা দিয়ে বলে,

‘যাই হোক মামা। মেয়েটা কিন্তু খারাপ না। পটায় ফেল।’

রাফি চোখ রাঙ্গীয়ে ওখান থেকে প্রস্থান করে।


সন্ধ্যায় নিজের রুমে বসে ক্যামেরায় এক রমণীর ছবি দেখছিল অনিক। একটার পর একটা ছবি দেখছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। অনু পিছন থেকে পা টিপে টিপে অনিকের কাছে আসছিল। অনিক কিছুটা আন্দাজ করে পিছনে তাকিয়ে দেখে অনু। চট করেই ক্যামেরাটা লুকিয়ে রাখে। অনু রাগ দেখিয়ে বলে,

‘লুকিয়ে লাভ নেই। কি দেখছিলে দেখাও? কার ছবি দেখো তুমি? প্রেম করা না?’

অনিক আমতা আমতা করে বলে,

‘কি বলছিস? আমি প্রেম করিনা।’

অনু কোমরে হাত দিয়ে বলে,

‘তাহলে নিশ্চয়ই কাউকে পছন্দ করো, দেখিতো কে সে। দাও ক্যামেরাটা আমাকে। একদম চালাকি করার চেষ্টা করবে না।’

‘কিছু নেই অনু।’

অনু অনিকের কথায় পাত্তা না দিয়ে অনিকের সাথে ধস্তাধস্তি শুরু করে দেয়। বেচারা অনিক পারলো না ক্যামেরাটা নিজের কাছে রাখতে। অনু সেটা নিয়েই নিল। অনু ক্যামেরাটা অন করতেই অনিক চোখ বন্ধ করে নিল। অনু ক্যামেরায় থাকা এক রমণীর ছবি দেখে স্থির হয়ে রইলো। তারপর অনিকের দিকে তাকিয়ে বললো,

‘পছন্দ করো ভাইয়া?’

অনিক শান্ত হয়ে বললো,

‘কাকে?’

অনু ক্যামেরাটা দেখিয়ে বললো,

‘ওকে পছন্দ করো তুমি?’

অনিক অনুর হাত ধরে বলে,

‘প্লিজ তুই কাউকে বলিস না এটা। নিজের মধ্যেই রাখ।’

অনু অনিকের হাত এক ঝটকায় সরিয়ে দেয়। আর বলে,

‘কি পেয়েছ ভাইয়া? দুনিয়ায় আর মেয়ে নেই? তুমি জানো না ওর সম্পর্কে? বেছে বেছে ওকেই তোমার পছন্দ হতে হলো?’

‘তুই এতো রাগ করছিস কেন?’

‘কিছু না। কাল তোমার জন্মদিন। তাই আম্মু আর আব্বু ঠিক করেছে সন্ধ্যায় একটা ছোটখাটো পার্টি দিবে।’

অনিক মুখ ঘুরিয়ে বলে,

‘আমি এসব পছন্দ করিনা।’

‘আম্মু বলছে কাল তোমার বিয়ের কথা উঠাবে ওখানে।’

‘হোয়াট? আমাকে না জানিয়ে এসব করতে কে বলেছে?’

‘আমি জানিনা কিছু। এখন কোনো ঝামেলা করো না। কাল আমার কিছু বান্ধবী আসবে, আর তোমার বন্ধুদের বলো আসতে। আমাদের কিছু রিলেটিভ আসবে, তাই কোন সিন ক্রিয়েট করো না।’

অনু ওখান থেকে প্রস্থান করে। অনিক ভাবতে থাকে। বিয়ের কথা যদি উঠে, তাহলে সেও তার পছন্দের কথা বলে দিবে।’

.
রাইশার কাছে কিছু ছবি এসেছে। তাহনাই পাঠিয়েছে। নীলাচলের কিছু ছবি। রাইশা রিদের রুমে এসেই রিদকে তাহনার পাঠানো ছবিগুলো দেখায়। এদিকে রিদ তাহনার পাশে একটা ছেলেকে দেখে তার কেমন যেন বুকে ব্যথা অনুভব হয়। সে রাইশাকে জিজ্ঞেস করে।

‘ছেলেটা কে?’

রাইশা জবাব দেয়।

‘দেখালাম তাহনা আপুকে, আর তুমি পড়ে আছো ছেলেটা কে সে-ই নিয়ে!’

‘যেটা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দে।’

রাইশা যেন অন্য এক রিদকে দেখছে। হুট করে এতটা রুড বিহেভ করছে কেন তার ভাই সেটাই বুঝছে না সে।

‘তাহনা আপুর কাজিন বোধয়।’

রিদ রেগে বলে,

‘ওর কাজিন কই থেকে আসবে?’

রাইশা হা করে তাকিয়ে রিদের আচরণ দেখছে।

‘ভাইয়া, তোমার মাথা পুরোটাই গেছে। কি বলছ তুমি এসব? আপুর কাজিন থাকতে পারে না? সে তার মামার বাসায় গেছে, তো তার কাজিন থাকাই স্বাভাবিক। তুমি এত উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছ কেন সেটাই বুঝলাম না।’

‘তাহনার নাম্বার তোর কাছে আছে?’

‘হ্যাঁ আছে, কিন্তু কেন?’

‘দে আমাকে।’

‘এই তুমি কল দিয়ে আবার উল্টোপাল্টা কথা বলবে না তো? দেখো, ওর পার্সোনাল লাইফ নিয়ে তুমি কিছু বলবে না।’

‘তোকে দিতে বলছি দিবি।’

রাইশা ভয়ে তাহনার নাম্বার দেয় রিদকে। রিদ সেটা সেভ করে রাখে। রাইশা চলে যায়। কিন্তু রিদ ফোন দেয়না। সে এখন ভিশন ক্লান্ত। কাল সকালেই তাহনার খবর করবে রিদ৷ তাহনা সে থাকতে অন্য ছেলের সাথে মিশবে কেন?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here