প্রস্থান — ৮ম পর্ব।

0
695

প্রস্থান — ৮ম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

১১.
সেই ঘটনার পর প্রায় দশ-বারো দিন কেটে গেল এরপর। চিত্রা ঘর থেকেই খুব একটা বেরোলো না এর মধ্যে। এই কয়দিন ভয়াবহ এক মানসিক অশান্তিতে ভুগছিল সে। সেদিন ফিরোজের কাছে রুশার কথা শোনার পর থেকেই একপ্রকার বিষণ্ণতায় ছেয়ে গিয়েছিল তাঁর অন্তর। মাথায় যেন একটা বোঝা চেপে বসেছিল। সেখানে অধিক পরিমাণে ভয়-শঙ্কাও বিরাজমান ছিল। না চাইতেও যেন বারবার রুশার জায়গায় নিজেকে কল্পনা করেছে সে। আর যখনই এইসব ভাবছে, তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে আসছে। বুক ধুকপুক করছে। কিছুতেই ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছে না সে। প্রথম দুই-তিন দিন তো সে রাতে ঘুমাতে পারেনি। ফিরোজকেও ঘুমাতে দেয়নি সেই ক’দিন। তাঁর জন্যই জেগে থাকতে হয়েছে বেচারাকে। এখন ফিরোজের অফিস শুরু হয়েছে। তাই এখন চিত্রা ইচ্ছে করেই ওকে যন্ত্রণা দিতে চায় না। তাঁর ঘুম না এলেও সে ঘুমের অভিনয় করে, যেন ফিরোজ তাঁর ঘুমের আভাস পেয়ে নিজে স্বস্তিত্বে ঘুমাতে পারে। চিত্রা একাকী সময় প্রায়ই ভাবে, সত্যিই সে রুশার মতো দূর্ভাগ্যবতী নয়৷ খুব সৌভাগ্যবতী সে। না-হলে ফিরোজের মতো একজন স্বামীকে পাশে পায় কীভাবে? ফিরোজ যেন অসাধারণ এক পুরুষ। হাজার নারীর স্বপ্নের রাজকুমার। আর সেই রাজকুমারকে সে পেয়েছে, এমনটা মনে করে তাঁর গর্ব হয় সবসময়। যতক্ষণ সে না ঘুমায়, ততক্ষণ মানুষটা জেগে থাকে। একটা হাত তাঁর মাথায় নিচে রাখে, অন্য হাত দিয়ে চুলগুলোতে আলতো করে আদর করে। হাত ব্যথা হলেও কিছু বলে না ও। আর সে আরামদায়ক অনুভব করে। ভালোবাসার মানুষের যত্ন যেন বিশ্বের অন্যান্য সমস্তকিছুর উর্ধ্বে, এ-কথা এখন সে উপলব্ধি করতে পারে প্রতিক্ষেত্রে।

আজ একটা জরুরি কাজে ফিরোজকে অন্য শহরে যেতে হয়েছে। আসতে রাত হবে। চিত্রা বাধা দেয়নি, জরুরি কাজ কী-না! বাড়িতে এখন তাঁরা তিনটে মেয়ে শুধু। শ্বাশুড়ি আর কনা নিজেদের ঘরে। আর সে নিজের ঘরে, একাকীত্ব উপভোগ করছে। এ নিঃসঙ্গতা এমন এক একাকীত্ব, যা ভালোলাগার! পছন্দের মানুষদের নিয়ে ভাবা যায় এই একাকীত্বের ভেতরে। নিজেকে নিঃসঙ্গ-দুঃখী মনে হয় না তাঁর। বরং উপভোগ করে এই সময়টা। কতকিছু ভাবতে পারে সে। ফিরোজ পাশে থাকলে শুধু তাকে নিয়েই ভাবতে হয়। এখন সবাইকে নিয়ে ভাবা যায়। তপ্ত দুপুরে নিজের ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে সে। বাইরে জ্বলন্ত আগুনের ন্যয় রোদ। শরীর যেন পুড়ে যেতে চায়। তাঁর ব্যালকনিটা ছায়া-যুক্ত। সামনে গ্রিল, উপরে ছাদ। তাই শেষ দুপুর কিংবা বিকেলের রোদ ছাড়া তেমন রোদ পড়ে না এক জায়গায়। যেটা পড়ে, তা মিষ্টি এক অনুভূতি জোগায়৷ আরামদায়ক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাই সে বিকেলের অধিকাংশ সময় ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে আজ দুপুরেই এসে দাঁড়িয়েছে। কেন যেন ব্যালকনিটা তাঁর মন টানছিল খুব করে।

চিত্রা হঠাৎ দেখল, রাস্তা দিয়ে দ্রুতবেগে সুব্রত ভাইয়ের গাড়িটা আসছে। গাড়িটা দেখে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকালো সে! লোকটার সাথে তাঁর দেখা হয় না অনেকদিন হয়ে গেল। সন্ধ্যার আগে যখন উনি আসে, তখন সে ঘরেই থাকে, ফিরোজের অপেক্ষায়! আবার যখন সকালে বেরিয়ে যায়, তখনও সে ঘরে থাকে; ফিরোজও সেসময় তৈরি হয়ে অফিসের জন্য বের হয়, সেজন্য! বাড়ির কারোর সাথে বসে সুব্রত ভাইকে আজ অব্দি খাবার খেতে দেখেনি সে। দু’মিনিট বসে কথা বলতেও দেখেনি৷ সেদিনের পর আর দেখা হয়নি। জানাও হয়নি, চা-টা কেমন হয়েছে; ভুলে যাওয়ার বিমারি থেকে মুক্ত হয়েছে কী না!
গাড়িটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল। চিত্রা গোল গোল চোখ করে দেখল, সুব্রত ভাইয়ের সাথে একটা মেয়েও গাড়ি থেকে নামছে। নেমে সামনে এগোতে চাইলো মেয়েটা, তখনই তাঁর কানে ভেসে এলো সুব্রত ভাইয়ের কথা।
“জুলি, তুমি এখানেই থাকো। আমি এক মিনিটে ফাইল নিয়ে আসছি।”
মেয়েটার নাম যে জুলি, তা শুনতে পেলো চিত্রা। সাথে এটাও লক্ষ্য করল, সুব্রত ভাইয়ের এই কথার জন্য মেয়েটা প্রস্তুত ছিল না। বেশ ভড়কান আর অসন্তুষ্ট দেখালো ওকে, সহসাই! বোধহয় সে ভেবেছিল, ‘সুব্রত ভাই তাকে ভিতরে নিয়ে বসতে বলবে!’ মনের কথা যেন চাপা দিয়ে মেয়েটা মলিন হেসে বলল, “ঠিক আছে সুব্রত ভাই। আমি এখানেই অপেক্ষা করছি। আপনি যান।’
সুব্রত অভ্যাসবশত পায়ে ঠকঠক আওয়াজ করে দ্রুতবেগে ভেতরে ঢুকে গেল। সাজ সেই একই। ইন করা কালো শার্ট। প্যান্টও কালো আজ। গলায় টাই ঝুলানো। এইসব তাঁর বাড়িতে আসার কথা না। কিন্তু ইদানীং একটা প্রজেক্ট নিয়ে সে খুব ব্যস্ত সময় পাড় করছে। এই মেয়েটা সেই প্রজেক্টের জন্য তাঁর সহযোগী হিসেবে নিযুক্ত আছে। জরুরি ফাইল নিতে এসেছে বাড়িতে। এরপর ওকে নিয়ে ছুটতে হবে দূরের একটা ফ্যাক্টরিতে।
সুব্রত চলে যেতেই মেয়েটা খুব বিরক্তি নিয়ে বলল, “আজব কাণ্ড! প্রথমবার বাড়িতে এলাম, এতদিন ধরে কাজ করছি, এক কাপ চায়ের অফার পর্যন্ত করল না।”
উপর থেকে কথাটা শুনে চিত্রার হাসি পেলো। নিজের মুখ চেপে ধরল সে।
এরপর প্রায় মিনিট পাঁচেক কেটে গেল। সুব্রত ভাই আসলো না। মেয়েটা যেন ক্রমেই অধৈর্য হয়ে উঠছে। পায়চারি করছে গাড়ির আশপাশ দিয়ে৷ পরণে একটা ফতুয়ার মতো শার্ট আর টাইট জিন্স। মুখে কড়া মেকাপ। ঠোঁটে লিপস্টিক। চুলগুলো সোনালি রঙের। রোদের ঝকঝকে আলোয় যেন আরও রঙিন দেখাচ্ছে ওগুলো! খারাপ না, ‘আপনমনে বলল সে।’
হঠাৎ রশ্মিকে দেখতে পেলো চিত্রা। গাড়ির পাশ দিয়েই ধীর গতিতে হেঁটে যাচ্ছে। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। যেন ভূত দেখছে। এমনসময় সুব্রত ভাই সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে মেয়েটার সামনে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে রশ্মির পায়ের গতিও বেড়ে গেল আচমকা। দ্রুত নিজের বাড়িতে ঢুকল ও। চিত্রা বিস্ময় মাখা চোখে আবার সুব্রত ভাই আর মেয়েটার দিকে তাকালো। কথা শুনতে চেষ্টা করল।
সুব্রত ফাইলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, “তোমাকে দেরি করালাম। ফাইলটা পেয়েছি। এবার চলো।”
“জি ভাইয়া।” মলিন সুরে সম্মতি জানালো মেয়েটা।

সুব্রত ভাইয়ের গাড়িটা বেরিয়ে যেতেই চিত্রা ব্যালকনি ত্যাগ করল।

ড্রেসিং টেবিলের সামনে একটা টুল পেতে বসল রশ্মি। তাঁর পরণে একটা হালকা সবুজ রঙের জামা। চুলগুলো খোলা। পিঠ দিয়ে নেমে গেছে কোমর অব্দি। আধভেজা হয়ে আছে ওগুলো। মাত্রই গোসল করেছে সে। সচরাচর সে সাজুগুজু করে না। একেবারে সাধারণ ভাবে, ছেলেদের মতো সিম্পল ভাবে থাকে, কোথাও যাওয়ার হলে শুধু চুলগুলো আঁচড়িয়ে বেরিয়ে পড়ে। কিন্তু আজ বড্ড সাজতে মন চাচ্ছে তাঁর। কেন মন চাচ্ছে, তা সে নিজেও জানে না। অনেকবার নিজেকে বারণ করেছে ‘রশ্মি, তোকে সাজে মানায় না। লোকে হাসবে তোকে সাজতে দেখলে। তুই যেমন সাধারণ আছিস, তেমনই থাক। মুখে মেকাপ দিলে তোকে সাদা ভূতের মতো দেখাবে। ঠোঁটে লিপস্টিক দিলে দেখাবে রক্তচোষা রাক্ষসীর মতো!’ এইসব ভেবে নিজের মনের সাথে খুব লড়াই করেছে এতক্ষণ; সেই দুপুরে শুরু হয়েছিল এই লড়াই। সমুদ্রের ঢেউয়ের কাছে যেমন নদীর ঢেউ ফিকে, তেমনি তাঁর মনের কাছে তাঁর বাহির সত্তা ফিকে প্রমাণিত হয়েছে। ফলে শেষমেশ পরাজয় স্বীকার করে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসল।
গোসল করায় বেশ স্নিগ্ধ লাগছে তাকে। চুলগুলো শুকিয়ে বাতাসে উড়তে শুরু করেছে ইতোমধ্যে। গালগুলো মসৃণ দেখাচ্ছে। সে গালে হাত রাখল আলতো করে। কী কোমল! ঠোঁট জোড়া ঈষৎ কালচে দেখাচ্ছে। সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস হয়েছে কী-না! সে ঠোঁটে হাত রাখল। রুক্ষ নয়, নরমই মনে হলো তাঁর। হালকা মেকাপের সাথে বোধহয় গালকা লিপস্টিক দিকে ভালো দেখাবে। কিন্তু চুল? এগুলো কীভাবে বাঁধবে? ভাবতে ভাবতে সাজের জিনিসপত্র বের করল সে। এমনসময় হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠল। সে ওঠে দরজা খুলতে গেল।
চিত্রা দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে। হাস্যজ্বল, প্রণবন্ত একটা মেয়ে। দেখলে মনে হয় নিষ্পাপ এক কিশোরী। তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে। মনে হয় ওর ভিতরের আত্মাটা শুধুই সাদা, পরিষ্কার; যেখানে শুধু মানুষের জন্য ভালোবাসা আছে, কোনো ঝামেলা নেই, রাগ-ক্ষোভ, হিংসা-বিদ্বেষ কিছুই নেই।
রশ্মি ভেতরে আহ্বান করল চিত্রাকে। “এসো এসো। অবশেষে এলে তাহলে। কয়েকদিন তো তোমার একেবারে দেখাই নেই। ভাবলাম বাবার বাড়িতে চলে গেছ। ফোন দিবো দিবো করে দেওয়া হচ্ছিল না।”
“তাই নাকি? আমি তো ভেবেছিলাম ভুলে গেছ আমাকে। ফোন দিবে বলেও দাওনি। কতদিন পেরিয়ে গেল বলো তো। আর ক’দিন পর মাস হয়ে যাবে বিয়ের।” কথাগুলো বলে হাসিমুখে ড্রয়িংরুমে এসে দাঁড়াল চিত্রা। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে উজ্জীবিত হয়ে বলল, “বাহ্! খুব গোছানো তো। আন্টি বাড়িতে নেই?”
“না। এসো, আমার ঘরে এসো।” সে চিত্রার হাত ধরে নিজের ঘরে নিয়ে এলো। বলল, “বসো। কী খাবে বলো?”
চিত্রা মুচকি হেসে, ভুরু নাচিয়ে বলল, “কী খাওয়াবে শুনি?”
লজ্জা পেলো রশ্মি। মাথা নুইয়ে লাজুক কণ্ঠে বলল, “আসলে আমি তেমন কিছু রাঁধতে পারি না৷ ডিম ভাজতে পারি শুধু। ফ্রিজে কিছু আছে হয়তো। গরম করে দিতে পারব।”
চিত্রা হাসল সশব্দে। এতে আরও লজ্জা পেলো রশ্মি। নাক-মুখ কুঁচকে গেল, “দেখো কত অযোগ্য আমি! সামান্য চা পর্যন্ত করে খাওয়াতে পারব না তোমাকে। কী লজ্জার ব্যাপার! তোমার বন্ধু হওয়ার কোনো যোগ্যতা নেই আমার।” ভীষণ আপসেট দেখাল তাকে।
রশ্মির অবস্থা দেখে চিত্রা আরও জোরে জোরে হেসে বলল, “কেমন হাস্যকর একটা কথা বললে বলোতো! ভালো চা বানানোর সাথে ভালো বন্ধুর কীসের সম্পর্ক? যার মন যত সুন্দর, সে তত ভালো বন্ধু হয়। তুমি জানো তোমার মন কতটা সুন্দর?”
রশ্মি নিচের দিকে তাকিয়েই ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, “আমি জানি না।”
“বেশ, এখন জানতে হবে না তোমাকে। সঠিক সময় এবং সঠিক পরিস্থিতিতে তুমি নিজেই উপলব্ধি করতে পারবে, তোমার আত্মা কতটা শুদ্ধ!”
নীরব থাকল রশ্মি। সে চিরকালই নিজেকে ঘৃণা করে এসেছে। নিজের কাছে নিজেই অপছন্দের একটা মেয়ে সে। এভাবেই বড় হয়েছে। তাই আজ এইসব কথা তাকে যতটা চমক দিচ্ছে, ততটাই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে।
চিত্রা বিছানায় বসেছে। রশ্মি দাঁড়িয়ে আছে তাঁর সামনে। সহসা ড্রেসিং টেবিলের উপর চোখ পড়তেই সে দেখতে পেলো সাজের জিনিসপত্র। অবাক হয়ে বলল, “বাহ্! কোথাও যাচ্ছ নাকি? এত সাজের জিনিসপত্র বের করেছ যে?”
বিব্রতবোধ করল রশ্মি। মুখ কালো করে মেকাপের জিনিসপত্র লুকোতে লাগল।
চিত্রা ঘাবড়ে গেল ওর কাণ্ড দেখে! চেঁচিয়ে বলল, “আরে আরে, কী করছ?”
রশ্মি জানে না সে কী করছে। এমন বিড়ম্বনায় সে বোধহয় আগে কোনোদিন পড়েনি! মুখটা চুপসে গেছে একেবারে। দরজা খোলার আগেই এগুলো আড়াল করা উচিত ছিল!
রশ্মির থেকে কোনো জবাব না পেয়ে হঠাৎ ওর হাতটা ধরে ফেলল চিত্রা। রশ্মি তাকালো তাঁর দিকে। সে চোখে চোখ রেখে বলল, “কী ব্যাপার রশ্মি? এমন আচরণ করছ কেন?”
রশ্মি মুখটা অসহায়ের মতো করে বলল, “না মানে।” তাঁর গলা কাঁপছে। “এগুলো আমার না। মায়ের। বোধহয় সকালে অফিসে যাওয়ার আগে মা বের করেছিল। আর ভিতরে রাখেনি।”
“আন্টি এতসব মেকাব ব্যবহার করে অফিসে গিয়েছে?”
“কী জানি!” আড়ষ্টতায় রশ্মির মুখ শুকিয়ে গেছে। কেন জানি ভীষণ লজ্জা লাগছে তাঁর৷ চিত্রা যদি একবার বুঝতে পারে সে নিজের জন্য এগুলো বের করেছে, তাহলে খুব হাসবে। হয়তো মনেমনে বলবে, ‘গোটা মেকাপ মুখে ঢাললেও তুমি সুন্দরী হতে পারবে না রশ্মি।’ হয়তো বাইরে গিয়ে সবাইকে বলে বেড়াবে।
রশ্মির অবস্থা দেখে চিত্রারই মন খারাপ হলো কিছুটা। মেয়েটা এত ছেলেমানুষ! এত আবেগী! ভীতুও বটে! না-হলে সামান্য মেকাপের কারণে এভাবে চুপসে যায়? সে কিছুক্ষণ নির্বাক থাকার পর বলল, “এগুলো সব তোমার মেকাপ, তাই না?”
ছোট করে শ্বাস ফেলে মাথাটা সামান্য ‘হ্যাঁ’ সূচক ঝাঁকালো রশ্মি।
চিত্রা আবার বলল, “সাজতে মন চাচ্ছে?”
মিনমিনে গলায় সে বলল, “না। এমনিই বের করে দেখছিলাম। আমার কখনোই সাজতে ইচ্ছে করেনি৷ আজও করছে না। আসলে সাজুগুজু আমার একদমই পছন্দ না।”
চিত্রা মিটমিট করে হেসে বলল, “রূপচর্চা করো না, অথচ এত সরঞ্জাম। এগুলো দেখলে মনে হয় খুব সাজুগুজু করো তুমি।”
নীরব থাকল রশ্মি। রূপবতী, গুণবতী বলে নিজেকে অস্বীকার করতে পারলেও একজন নারী বলে সে নিজেকে কখনোই অস্বীকার করতে পারে না। তাঁর দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাকে প্রতি মুহূর্তে জানান দেয়, সে একজন নারী! সেজন্যই এইসব।
রশ্মির মুখের দিকে তীক্ষ্ম রেখে চিত্রা বলল, “আগে কখনো সাজতে ইচ্ছে না করলেও আজ তোমার বড্ড সাজতে ইচ্ছে করছে৷ আমি জানি।”
“মিথ্যে!”
“উঁহু। এটাই সত্যি। সুব্রত ভাইয়ের সাথে যে মেয়েটা এসেছিল, সেই মেয়েটাকে দেখার পরই তোমার মনে এই ইচ্ছার জন্ম হয়েছে। মেয়েটা খুব সেজেগুজে, আধুনিক ভাবে এসেছিল। তোমারও মন চাচ্ছে সেরকম হয়ে সুব্রত ভাইকে দেখাতে। তাই না?”
রশ্মির মুখ ভয়াবহ আকার ধারণা করল। তাঁর মসৃণ মুখশ্রী এখন কঠোর হতে শুরু করেছে। গালের রঙ একেবারে পালটে গেছে। মনেমনে ভাবছে, ‘এইসব কী বলছে মেয়েটা? আমি কেন সুব্রত ভাইকে দেখানোর জন্য সাজতে যাবো? উনি তো আমার কেউ হন না। তাহলে?’ প্রতিবাদ করতে যেতেও থমকে গেল রশ্মি। করতে পারল না কেন জানি। তাঁর হৃদয় যেন তাঁর বিরুদ্ধে, এবং চিত্রাকে পূর্ণ সমর্থন করতে চাইছে! দ্রিমদ্রিম অনুভূতি হচ্ছে ওখানে!
সন্দিহান ছিল চিত্রা; তখন ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রশ্মিকে দেখে যতটা বুঝেছিল, তাতে নিশ্চিত হতে পারছিল না যে, সুব্রত ভাইয়ের সাথের মেয়েটাকে দেখে ওর হিংসে হচ্ছিল। অমন টানটান চোখ করে তাকিয়েছিল মেয়েটার দিকে, তবুও। এখন সুনিশ্চিত হলো!
চিত্রা রশ্মিকে স্বাভাবিক করতে বলল, “তোমাকে সাজিয়ে দিই?”
“তুমি দিবে?” যেন আকাশ থেকে পড়ল রশ্মি, এমন অবাক হলো!
চিত্রা একগাল হেসে মাথা ঝাঁকিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলল।
রাজি হলো রশ্মি। মৃদু হাসি ফুটলো তাঁর ঠোঁটের কোণে।

মুখে হালকা করে মেকাপ দিয়ে দিচ্ছিল চিত্রা, সে রশ্মির সামনে অন্য টুলে বসেছে। হঠাৎ বলল, “তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করব, রশ্মি?”
“কী কথা?”
“রাগ করা যাবে না কিন্তু।”
রশ্মি ফিক করে হাসল। মুখে বলল, “তুমি আমার একমাত্র বন্ধু৷ রাগ করে তোমাকে কষ্ট দিবো?”
মুখে মেকাপ দেওয়া শেষ হলে রশ্মির পিছনে বসল চিত্রা। চুলগুলো আঁচড়াবে এবার। সে আয়নার রশ্মির মুখটার দিকে তাকিয়ে বলল, “তুমি কি সুব্রত ভাইকে পছন্দ করো?”
রশ্মি হতবিহ্বল! তাঁর গলা দিয়ে কথা বেরোলো না। চিত্রা আয়নায় দেখল, রশ্মির ঠোঁট জোড়া খুব কাঁপছে। সে কিছুক্ষণ প্রতিক্রিয়ায় অপেক্ষা করার পর নিরাশ হয়ে প্রশ্ন পাল্টালো। “আচ্ছা, তোমার কি মনে হয়, রুশা ভাবীর মৃত্যুর জন্য পুরোপুরি ভাবে সুব্রত ভাই দায়ি?”
“তুমি জানো পুরোটা?” রশ্মির আয়নায় চিত্রার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল জবাবের আশায়।
চিত্রা বলল, “হ্যাঁ। ফিরোজের কাছে শুনেছি।”
“ওহ্।”
“আমার প্রশ্নের জবাবটা কিন্তু এখনো পাইনি।”
“জেল যখন হয়েছিল, তখন নিশ্চয়ই উনি অপরাধী। আদালত তো আর একটা নির্দোষ মানুষকে ৫বছর জেল খাটাবে না।”
“আমি তোমার কথা জানতে চেয়েছি, রশ্মি। তোমার কী মনে হয়? সুব্রত ভাই সত্যিই অতটা নিষ্ঠুর ছিল? অত খারাপ ছিল?”
“জানি না। তবে উনাকে দেখলে আমার খুব রাগ মাঝেমধ্যে।”
“কেন?” ভারী আশ্চর্য হলো চিত্রা!
রশ্মি বলল, “ওই মেয়েটাকে যদি পছন্দই না হয়ে থাকে, তাহলে বিয়ের জন্য রাজি হয়েছিল কেন? বিষয়টি তো খামখেয়ালির ছিল না। উনাকে আমি অনেক বুঝদার মানুষ হিসেবে জানতাম। কিন্তু সেই উনিই কী-না অমন বোকামি করলেন!”
“ফিরোজ বলে, উনি আসলে অসুস্থ।”
রশ্মি কিছু বলল না। এই ব্যাপারে কিছু বলতে আগ্রহী নয় সে। জন্মের পর থেকেই ওই মানুষটাকে দেখে আসছে সে। একটু ভিন্নতা লক্ষ্য করলেও কখনো অসুস্থ মনে হয়নি।

রশ্মিকে সাজানো শেষে চিত্রা হঠাৎ বলল বলল, “কোথাও ঘুরতে যাবে? চলো যাই। অনেকদিন বাড়ির বাইরে যাইনি।”
অনাগ্রহ প্রকাশ করল রশ্মি। “আমার ইচ্ছে করছে না এখন ঘুরতে যেতে। রাস্তাঘাটে এত ধুলোবালি। ভালো লাগে না একদম।”
“তাহলে আমাদের বাড়িতে চলো। বিকেলবেলা ছাদে সময় কাটাতে ভালো লাগে। রোদ থাকে না, অথচ খুব বাতাস থাকে। ঠাণ্ডা পরিবেশে ভালোই লাগে।”
‘না’ করতে পারল না রশ্মি। বলল, “তাহলে আমি মুখটা ধুয়ে আসি।”
“ওমা! মুখ ধুতে যাবে কেন? দেখো তো, কত মিষ্টি দেখাচ্ছে তোমাকে! এইটুকু সাজ তো আমিও সেজেছি।”
আয়নায় নিজের মুখটা দেখল রশ্মি। ভীষণ অস্বস্তি বোধ হচ্ছে তাঁর, এভাবে ঘর থেকে বেরোতে৷ কিন্তু চিত্রার জোড়াজুড়িতে বেরোতে হলো শেষমেশ।

৮ম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=826908494920519&id=100028041274793

বি:দ্র: ছোট হয়ে গেল বোধহয়। রোজা রেখে দিনের বেকা বেশি বড় করে পর্ব লিখতে মন চায় না আসলে। আর রাতে এত দুর্বল লাগে, কী বলব!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here