প্রস্থান — ৭ম পর্ব।

0
681

প্রস্থান — ৭ম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

সুব্রত দরজা খুলে দেখল, সুলতানা দাঁড়িয়ে আছে। হাতে চায়ের কাপ। সবেমাত্র ঘুম ভেঙেছে তাঁর। দুই চোখ ঘোলাটে লাগছে। তার উপর গভীর রাত অব্দি কাজ করেছে কম্পিউটারে। মাথা ব্যথা করছে খুব। সুলতানাকে দেখে সে মৃদুস্বরে বলল, “কী ব্যাপার সুলতানা? তুমি আবার?”
“আমি না ভাইজান।” যেন ভয় পেয়ে গেল সুলতানা। সে সরে গিয়ে চিত্রাকে সামনে টেনে আনলো।
চিত্রা সুব্রতর সামনে দাঁড়িয়ে উজ্জীবিত কণ্ঠে বলল, “আসসালামু আলাইকুম, সুব্রত ভাই। কেমন আছেন আপনি?”
সুব্রত চমকে উঠল। চোখ জোড়া আরও কিছুটা সক্রিয় করার চেষ্টা করে বলল, “ওয়ালাইকুমুস সালাম। ভালো। কিন্তু তুমি কে?”
আশ্চর্য হলো চিত্রা! এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেল? লোকটার ভুলে যাওয়ার বিমারি আছে নাকি? সে একরাশ দুঃখ নিয়ে বলল, “কী সুব্রত ভাই, আপনিও না! এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলে চলবে? আপনার ভবিষ্যৎ তো অন্ধকার।”
মেয়েটাকে এবার চিনতে পারল সুব্রত। ফিরোজের বউ। বিয়ের পরে একজন মেয়ের মধ্যে কিছু পরিবর্তন আসে। সেদিন দেখেছিল-ভীতসন্ত্রস্ত, লাজুক আর বাচ্চা স্বভাবের একটা মেয়েকে। আর আজ যে দাঁড়িয়ে আছে, সে দায়িত্বশীল একটা মেয়ে। সে জানে, এখন সে নিজের বাড়িতে দাঁড়িয়ে আছে। তাই লজ্জা-ভয় কিছুই নেই ওর মধ্যে। উল্টো ভীষণ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। মেয়েটার প্রশ্নের জবাবে সুব্রত বলল, “দুটো নেগেটিভ মিলে কখনো পজেটিভ হতে দেখেছ?”
“দেখেছি না? বলে কী! দুটো মায়নাসে তো প্লাস হয়৷” চিত্রা সুর টেনে বলল, “কী সুব্রত ভাই, আপনি দেখি অংকে খুব দুর্বল! নাকি ভুলে গেছেন ওই বিমারির কারণে!”
সুব্রতর মুখ শক্ত হলো। মেয়েটা যে এত বকবক করতে জানে, সেটা ওইদিন বোঝা যায়নি। ওইদিন যে কেঁদে দিয়েছিল মেয়েটা, সেটা তাঁর মনে পড়ল হঠাৎ করে। তাঁর অপরাধবোধ হয়নি একবারও। তবুও সেই ঘটনার প্রভাবে আজ কিছুটা শান্ত থেকেই বলল, “আমার অতীত আর বর্তমান, দুটোই অন্ধকার! তাই ভবিষ্যৎ আলোকিত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
“নেই বুঝি?” মর্মাহত ভঙ্গিতে শব্দ দুটো উচ্চারণ করল চিত্রা৷ পরক্ষণেই আবার আনন্দ মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “আছে সুব্রত ভাই, আছে। আপনি এই চা খান৷ আমার বানানো এই চা খেলে আপনি সব পরিষ্কার দেখবেন। ভবিষ্যৎও সুন্দর মনে হবে। এছাড়া এই চা-তে এমন একটা গুণ আছে, যা আপনাকে ভুলে যাওয়ার বিমারি থেকে মুক্ত করবে।”
সুব্রত চোয়াল টানটান করে বলল, “তুমি কি এখানে চায়ের বিজ্ঞাপন দিতে এসেছ?”
“না। ঠিক তা না। আসলে আমি আপনাকে চা দিতে এসেছি। বাড়ি থেকে মা শিখিয়ে দিয়েছিল, অন্তত রোজ সকালে চা-টা নিজের হাতে বানাবি। এরপর বাড়ির সবাইকে চা দিবি নিজের হাতে। সেটাই করছি আসলে। আপনি তো এই বাড়িরই লোক।”
সুব্রত মাথা ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে ঘরের মাঝখানে চলে গেল। তাচ্ছিল্যের সাথে একটা কথা বলে বিছানায় বসে পড়ে ল্যাপটপটা কোলের উপর তুলে নিলো। সে বলল, “বাড়িটা এক। কিন্তু পরিবার আলাদা। তুমি বোধহয় ভুলে গেছ, এই পরিবারের সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি এই বাড়িতে আমার অংশটুকুতে বসবাস করি। বাইরে খাই। তাছাড়া সকালে চা খাওয়ার অভ্যাসটা আমার নেই।”
চিত্রা হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। সুলতানা সুযোগ পেয়ে বলে উঠল, “ভাইজান, আপনিই কিন্তু বলেছিলেন আপনাকে যেন চা না দেওয়া হয়। সেজন্যই আমি দিতাম না। আপনার কথা না মানলে তো আবার বকতেন।”
সুব্রত বিরক্ত হয়ে বলল, “উফ! তোমরা যাও তো এখান থেকে। অনেক কাজ আছে আমার।”
চিত্রা এক পা ভিতরে এনে বলল, “সুব্রত ভাই, চা খেলে কিন্তু মাথাটা হালকা লাগবে। আপনার কাজ করতে সুবিধা হবে।”
সুব্রত নির্বিকার! চিত্রা আবার অনুনয় করে বলল, “প্লিজ সুব্রত ভাই। অনেক শখ করে বানিয়েছি সবার জন্য। আপনি চা-টা না খেলে আমার খুব মন খারাপ হবে।”
হাল ছেড়ে দিয়ে এবার দাঁত খিঁচিয়ে ওঠে এলো সুব্রত। চিত্রার সম্মুখীন হয়ে বলল, “আজকেই শেষ। আর যেন আমার জন্য কিছু আনতে না দেখি৷ ঠিক আছে?”
মুখ টিপে হেসে মাথা ঝাঁকালো চিত্রা। যদিও তাঁর মনে আরেক! সে সুলতানার হাত থেকে প্লেটটা নিয়ে সামনে দিকে এগিয়ে দিলো।
সুব্রত একটা কাপ তুলে আবার বিছানার কাছে গিয়ে বলল, “এবার যাও দুজনে। আমাকে একা থাকতে দাও।”
“আরও একটা আছে, সুব্রত ভাই।”
“আমার একটাতেই হবে। দয়া করে যাও এবার।” নিজের চায়ের কাপটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে আবার ল্যাপটপটা টেনে নিলো সুব্রত।
চিত্রা বলল, “অন্তত চা খেয়ে বলেন কেমন হয়েছে। আপনার চা খাওয়া শেষ হওয়া অব্দি আমি এখানেই থাকবো। এই চা-টা বরং আমি খাই, এখানে দাঁড়িয়েই।”
সুব্রত মাথা তুলে তাকালো দরজার দিকে। দেখল, চিত্রা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিতো শুরু করেছে। ওর পরণে একটা হলুদ থ্রিপিস। চুলগুলো খোলা। হাতে কতকগুলো চুড়ি। চা খাওয়ার জন্য হাত উপর-নীচ করায় চুড়িগুলোতে ঝুনঝুন শব্দ হতে শুরু করেছে, যা এখান থেকেই শুনতে পাচ্ছে সে। সে হঠাৎ রাগান্বিত হয়ে চিত্রার সামনে গিয়ে দাঁড়াল আবার। কয়েক সেকেন্ড ক্রোধান্বিত চোখে তাকিয়ে থাকার পর ঠাস করে দরজাটা আটকে দিলো।
আঁতকে উঠল চিত্রা, হঠাৎ যেন বিকট আওয়াজ করেই দরজাটা বন্ধ হলো। তাঁর শরীর চমকে ওঠায় চায়ের কাপ থেকে বেশ কিছুটা চা নিচে এবং হাতে পড়েছে। চা আর আগের মতো গরম নেই। তাই জ্বালা হলো না তেমন। তবে রাগ হলো সুব্রত ভাইয়ের উপর। এভাবে কেউ মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়? যদি লেগে যেতো!
পিছন ফিরে হাঁটতে হাঁটতে চিত্রা সুলতানার কাছে জানতে চাইলো, “সুব্রত ভাই কী প্রথম থেকেই এইরকম?”
সুলতানা জবাব দিলো, “হ্যাঁ। আমি যখন এসেছিলাম, তখন থেকেই দেখেছিলাম উনি সবার থেকে আলাদা হয়ে থাকতেন। কারোর সাথে তেমন কথা বলতেন না। তবে আমার সাথে উনার সম্পর্ক ভালো ছিল। কনা আপাও উনাকে ভাই ভাই বলে ডাকতো তখন। ফিরোজ ভাই-ও। আমাকে প্রাইমারি পর্যন্ত উনিই তো পড়াশোনা করিয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর এমন একটা ঘটনা ঘটল যে, সব এলোমেলো হয়ে গেল। ফিরোজ ভাইজান, কনা আপা, সবাই উনাকে অপছন্দ করতে শুরু করল। আমারও একটু ভয় ভয় করতো উনাকে। তাই কাছে যেতাম না। এরপর তো উনি চলেই গেলেন। আমার পড়াশোনাও বন্ধ হয়ে গেল।”
“চলে গেলেন মানে? কোথায় গেলেন? আর কী ঘটনা ঘটেছিল?”
“কাউকে বললেন না তো, যে আমি বলেছি?” ফিসফিস আওয়াজ করে সবদিকে একবার চোখ বুলালো সুলতানা।
আচমকা থেমে গেল চিত্রা, নিজের ঘরের কাছে এসে। সে উত্তেজক ভঙ্গিতে বলল, “না না, কাউকে বলবো না। তুমি বলো প্লিজ।”
সুলতানা কিছুক্ষণ ভেবে হঠাৎ চেহারা ম্লান করে বলল, “না ভাবী, আমি পারব না। কেউ জানলে আমার খবর হয়ে যাবে। আমি বরং যাই।” এ-কথা বলে ছুটে চলে গেল মেয়েটা।
চিত্রা মুখ ‘হা’ করে কিছুক্ষণ একভাবে দাঁড়িয়ে থাকলো। এরপর ঘরে ঢুকার জন্য বাঁ-দিকে ঘুরলো। দরজার কাছে দেখল, ফিরোজ দাঁড়িয়ে আছে। দৃষ্টি তাঁর দিকেই, বেশ কটকটে চাহনি! সে ভয়ে কথা বলতে পারল না প্রথমে।
ফিরোজ চিত্রার চোখের দিকে একরাশ বিরক্তি নিয়ে তাকিয়ে বলল, “সেই তুমি আমার কথার অমান্য করলে।”
অনুশোচনা হলো চিত্রার। ফিরোজকে সে কথা দিয়েছিল ওই ঘরে আর যাবে না। তবে কথা সে পুরোপুরি ভাঙেনি এখন পর্যন্ত। সহসা সে মাথা তুলে বলল, “কিন্তু আমি ঘরের ভিতরে যাইনি। বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
বড় একটা শ্বাস ফেলল ফিরোজ। বিছানার কাছে যেতে যেতে বলল, “তুমি শোধরাবার নও।”
চিত্রা পিছন পিছন গিয়ে বলল, “বিশ্বাস করো, আমি শুধু চা দিতে গেছিলাম। তাছাড়া একা না, সুলতানাকে সাথে নিয়ে গেছিলাম।”
ফিরোজের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো চিত্রা। ফিরোজ ওর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে, টেবিলের উপর থাকা নিজের কাপটার পাশে রেখে দিলো। এরপর আলতো করে ওর হাত দুটো ধরে বিছানায় বসাল। নিজেও বসল খুব কাছে। অপলক চোখে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল ওর মুখের দিকে। দোষ করলেও যেন মেয়েটাকে নিষ্পাপ দেখায়। খুব একটা বকতে ইচ্ছে করে না।
চিত্রা বিস্মিত হলো অকস্মাৎ! ফিরোজের চোখে কোনো রাগ দেখতে পাচ্ছে না এখন। শান্ত-কোমল চাহনি ওর। কিছুক্ষণ আগের রুক্ষতা যেন হারিয়ে গেল কোথাও। এখন আদর আর স্নেহ নজরে পড়ল। হালকা করে চোখে বার কয়েক পলক ফেলল সে। এরপর জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ওই চোখ দুটোর দিকে। কী যেন আছে মানুষটার চোখে! কেমন করে নিজের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে গেল তাকে। সে যেন ঘোরের মধ্যে ডুবে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। সেই সাথে তাঁর ভয়টাও উধাও হলো।
ফিরোজ হঠাৎ দৃষ্টি সরিয়ে গম্ভীর সুরে বলতে লাগল, “ভেবেছিলাম তোমাকে এইসব বলব না। কী দরকার এইসব পুরোনো কথা বলার? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তোমার ভালোর জন্যই সবটা তোমাকে বলতে হবে।”
ঢোক গিলল চিত্রা। বিশ্বাস হচ্ছে না মুহূর্তটা। যে সত্যিটা জানার জন্য সে বারবার সুব্রত ভাইকে নিয়ে ভেবেছে, তাঁর আশেপাশে গেছে, সেই সত্যিটা খুব শীঘ্রই ফিরোজের কাছ থেকে শুনতে যাচ্ছে সে৷ উত্তেজনায় সহসাই তাঁর হার্টবিট বেড়ে গেল। শ্বাস নিতে কষ্ট হলো।
চিত্রার হাত দুটো কোলে রেখে ফিরোজ বলতে লাগল পুরো ঘটনাটা।

“তখন ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষ করে বাড়িতে এলো সুব্রত। রেজাল্ট খুব ভালো হয়েছিল। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে লেকচারার হিসেবে যোগদান করল খুব তাড়াতাড়িই। কিন্তু শিক্ষক পেশার প্রতি ওর তেমন আগ্রহ ছিল না। বিজ্ঞানের ছাত্র ছিল। নিজের মতো করে কিছু করতে চেয়েছিল৷ সেজন্য ওই চাকরিটা ছেড়ে দিলো। এরপর একটা প্রাইভেট গবেষণা কেন্দ্রে যোগ ছিল। কারোর সাথে কথা বলতো না তেমন। সারাদিন পড়তো। সেসময় ওর ঘরে যাতায়াত ছিল আমাদের সবার। আমরা দেখতাম, ও যতটা সময় পড়তো, ঠিক ততটা সময় ভাবতো। অযথা সময় নষ্ট করতো না। স্টাডি রুমে পড়ে থাকতো সারাক্ষণ। খাওয়া-দাওয়া সব ভুলে গিয়েছিল। আমরা সবাই ধরেই নিয়েছিলাম, ও হয়তো জগৎ সংসার থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। না কোনো বন্ধুবান্ধব ছিল, না কোনো মানুষের সাথে ভালো সম্পর্ক৷ একেবারে ভিন্ন প্রজাতির একজন প্রাণী মনে হতো ওকে দেখে। কিন্তু একদিন হঠাৎ করে এক ঘটক হাজির হলো বাড়িতে। আমরা নিশ্চিত ছিলাম, ও এই মুহূর্তে বিয়ে করবে না। ঘটক দেখলে হয়তো রেগে যাবে। তাই ঘটককে বলেছিলাম চলে যেতে। কিন্তু ঘটক একটু ত্যাড়া ছিল। সে বলল, যাই হোক, ওর সাথে দেখা করবেই৷ ওকে জানালাম আমরা। আমাদের অবাক করে দিয়ে ও কাজ ফেলে ঘটকের সাথে দেখা করার জন্য ড্রয়িংরুমে চলে এলো। ঘটক ওকে একটা মেয়ের ছবি দেখালো। ও ছবিটা দেখল কী দেখল না, তা আমরা বুঝতে পারার আগেই বলে উঠল, বিয়ে করলে এই মেয়েটিকেই বিয়ে করবে। এরপরই হনহন চলে উপরে চলে গেল। যাওয়ার আগে শুধু বলল, আমরা যেন খুব শীঘ্রই এই মেয়ের সাথে বিয়ের সম্মন্ধ করি। ওর কথা শুনে তো আমি, বাবা-মা, আমরা সবাই একেবারে হতভম্ব! আকাশ থেকে পড়েছিলাম আমরা! বাবা যেন খুশিও হয়েছিল। আমরাও খুশি হয়েছিলাম এটা ভেবে, এবার অন্তত ওর দেখাশোনার জন্য একজন বাড়িতে থাকবে। নাহলে ও যে পথে হাঁটছিল, যেভাবে জীবন-যাপন করছিল, এটা সুনিশ্চিত ছিল যে, অচিরেই ওর চিকিৎসার প্রয়োজন হবে। এরপর মেয়েটার পরিবারের সাথে কথা বলল বাবা। ওরা রাজি হলো বিয়েতে। বিয়ের তারিখ ঠিক হলো, এবং বিয়েও হয়ে গেল। এরপরই শুরু হলো ভয়ংকর কিছু। সুব্রত আগে থেকেই প্রচুর পরিমাণে সিগারেট খেতো। কিন্তু সেদিন, মানে বাসর রাতে আমি ওর অন্য রূপ দেখলাম। আমি দেখলাম, ও নিজের বারান্দায় দাঁড়িয়ে মদ খাচ্ছে! হাতে পুরো একটা মদের বোতল। রাত তখন খুব গভীর। আমি বাইরেই ছিলাম। নিচ থেকে ওকে দেখে ফোন করলাম। তখন ঘরে চলে গিয়েছিল; আমি ফোনে জিজ্ঞেস করলাম, কী ব্যাপার, কী হচ্ছে এইসব। ওর বলল, কিছু হয়নি৷ কিন্তু আমার এখনো মনে আছে, আমি ফোনের এপাশ থেকে স্পষ্ট শুনলাম নতুন বউয়ের কান্নার আওয়াজ। আমি বুঝে গেলাম, ও মাতাল হয়ে মেয়েটার সাথে খারাপ কিছু করেছে। আমি দ্রুত বাবা-মাকে বললাম ঘটনাটা। সব শুনে মা তো রেগে একাকার। আমরাও রেগে ছিলাম। বিয়ের প্রথম দিনই যদি এমন হয়, তাহলে বাকি জীবন একসাথে থাকবে কীভাবে?

বাড়িতে অনেক লোকজন ছিল। তাই কোনো হৈচৈ না করে, একেবারে নিঃশব্দে আমরা ওর ঘরের সামনে গিয়ে দরজায় আওয়াজ করলাম। কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে গেল। নতুন বউই দরজাটা খুলল। আমরা দেখলাম, নতুন বউয়ের সারা মুখ চোখের জলে ভিজে আছে। আমাদের দেখে চোখ মুছে ঘোমটা টেনে দিলো। মাথা নিচু করে ফেলল। খেয়াল করলাম, মেয়েটা বারবার চোখ মুছছে। ভিতরে গিয়ে দেখলাম, সুব্রত স্টাডি রুমের টেবিলের উপর মাথা রেখে শুয়ে আছে। ঘুমিয়ে পড়েছিল ততক্ষণে। মদের বোতলটা ভেঙে নিচে পড়ে আছে।

সেদিন আর কোনো কথা বাড়ায়নি আমরা। মা নতুন বউয়ের জামা চেঞ্জ করিয়ে কনার ঘরে নিয়ে গেল। বাসর রাতে মেয়েটা কনার ঘরেই থাকলো। পরদিন কী হলো জানি না, বউভাতের অনুষ্ঠানের পর হঠাৎ সুব্রত বলল, এখন শ্বশুর বাড়ি যাবে না। ওর এক বন্ধু বিয়ে উপলক্ষে ওদের দুটো প্লেটের টিকিট দিয়েছে৷ ওরা হানিমুনে যাচ্ছে। ফ্লাইট পরদিন সকালেই৷ কথা শুনে তো আমাদের মাথায় হাত। এইসব কবে, কীভাবে হলো? আমরা কেউ রাজি ছিলাম না৷ কিন্তু মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করতেই বলল, সে যাবে। সুব্রত কীভাবে যেন ওর পরিবারকেও রাজি করিয়ে ফেলল। সবটাই অদ্ভুত লাগল আমাদের কাছে। চোখের সামনে যা ঘটছিলো, সবটাই যেন ধোঁয়াশা! আমাদের মন সায় দিচ্ছিল না কিছুতেই। কিন্তু সুব্রতর জোড়াজুড়ি আর মেয়েটার বাড়ির লোকদের পূর্ন ইচ্ছাতে আমরা ওদের ছাড়তে বাধ্য হলাম। এয়ারপোর্টে নামিয়ে দিয়ে আসলাম আমি। এরপর হঠাৎই দুজন একেবারে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। কোনোরকম যোগাযোগ রাখল না আমাদের সাথে। সুব্রতর থেকে এমনকিছু পাওয়া আমাদের জন্য অস্বাভাবিক ছিল না। ও এমনিতেও কারোর সাথেই তেমন কথাবার্তা বলতো না। কিন্তু অবাক হলাম তখন, যখন শুনলাম মেয়েটাও ওর পরিবারের কারোর সাথে যোগাযোগ করেনি।”
“উনারা দুজন কী আর একসাথে ফিরে আসেনি?” রুদ্ধশ্বাস হয়ে স্বামীর কথা শুনছিল চিত্রা, এবার থাকতে না পেরে কথা বলল হঠাৎ। তাঁর চেহারায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। ভয়ে মুখ ফেকাসে হয়ে গেছে। ঠোঁট দুটো দেখলে মনে হবে রক্তশূন্যতায় ভুগছে! লাল ঠোঁট জোড়া সাদা হয়ে এসেছে।
ফিরোজ মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “এসেছিল। এক সপ্তাহ পর ফিরে এসেছিল ওরা। যখন এলো, মেয়েটাকে আমরা চিনতেই পারছিলাম না। সেই বিয়ের সময় দেখা মেয়েটা আর বিয়ের ৭দিন পরের মেয়েটার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য ছিল। চোখ ফোলা ফোলা। চোখের নিচে কালচে দাগ। মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিল খুব। হাঁটার ভঙ্গি, কথা বলার ভঙ্গি দেখে মনে হয়েছিল, ওর উপর দিয়ে অনেক বড় ঝড় হয়ে গেছে। ঠিক মতো খাওয়াদাওয়া-ও যে করেনি, সেটা ওর দুর্বল শরীর দেখেই বুঝে গিয়েছিল সবাই। আমার বাবা-মা বহুবার জিজ্ঞেস করেছে, ‘ওখানে গিয়ে কেন যোগাযোগ করেনি?’ মেয়েটা জবাবে বলেছিল, ‘বিদেশে গিয়ে আর সিম কিনেনি কেউই। অনলাইন থেকেও দূরে ছিল। রিলাক্স করার জন্যই ওখানে গিয়েছিল কী-না!’ কিন্তু বিশ্বাস করো, মেয়েটাকে দেখে একটা বারের জন্যও মনে হয়নি গত এক সপ্তাহ ও সামান্য রিল্যাক্স করেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল স্বামীর নির্যাতনের স্বীকার হওয়া এক অসহায় নারী। এরপর বহুবার মেয়েটাকে কাঁদতে দেখেছি আমরা। কনা ওর সাথে খুব মিশত। কিন্তু কোনো কথা বের করতে পারেনি ও। যখনই ঘরে যেতো, ও দেখতো মেয়েটা হয় কাঁদছে, নাহয় মনমরা হয়ে বসে আছে। বাবা-মা জিজ্ঞেস করলে বলতো, ‘বাড়ির জন্য মন খারাপ লাগছে।’ অথচ বিয়ের পর যে দু’মাস ও আমাদের বাড়িতে ছিল, একবারও নিজের বাড়িতে যায়নি। কখনো যাওয়ার কথাও বলেনি। যেন শ্বশুর বাড়িই ওর সব। সবসময় বলতো, ‘সুব্রত এখন ব্যস্ত। পরে যাবো।’ বাড়ি থেকে ওর মা এলেও খুব একটা কথা বলতো না। এছাড়াও আমরা খেয়াল করতাম, সুব্রতকে দেখলেই মেয়েটা কেমন অদ্ভুত আচরণ করতো! যেন খুব ভয় পায় ওকে। এদিকে মেয়েটার হাল দিনকে-দিন খারাপ হচ্ছিল। কয়েকবারে অজ্ঞান হয়ে পড়েও গিয়েছিল। ডাক্তার এসেছিল বাড়িতে। তিনি জানালেন, প্রচুর অনিয়ম, আর শরীরের প্রতি অযত্নের কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে। এছাড়াও মানসিক অশান্তিতে ভুগছে মেয়েটা। শুধু যে মানসিক নয়, প্রতিনিয়ত শারীরিক অত্যাচারিতও হচ্ছিল মেয়েটা, তা আমরা অনুমান করেছিলাম প্রথম দিন থেকেই। কিন্তু একদিন স্ব-চোক্ষে দেখলাম।

তখন রাত ৮টা কী ৯টা বাজে। হঠাৎ চেচামেচির আওয়াজ শুনে আমরা সবাই দৌড়ে ওই ঘরে যাই। দরজা খোলা ছিল। আমি ভিতরে ঢুকতে ঢুকতে দেখলাম, আমার সামনেই সুব্রত নিজের স্ত্রীর গালে একটা থাপ্পড় মারল। মেয়েটা যেন ছিটকে পড়ল আরেক জায়গায়। আমি নিজেকে সামলাতে পারিনি। ওকে ধাক্কা দিয়ে দেয়ালে ঠেকিয়ে মারতে গেলাম। তখনই বাবা-মা উপস্থিত হলো। আমাকে থামিয়ে দিলো। ওকে দেখলাম শুধু ফোঁসফোঁস করতে করতে ‘স্টাডি রুমে’ গিয়ে দরজা আটকে দিলো।
বাবা আর ধৈর্য ধরতে পারলেন না। পরিচিত এক সাইকিয়াট্রিস্ট কে ফোন করে সময় নিয়ে নিলো। যেভাবেই হোক, সুব্রতকে সুস্থ করে তুলতে হবে। আসলে কিছু মানুষ একা থাকতে থাকতে খুব মারাত্মক হয়ে ওঠে। ওর রোগটা কী আমাদের জানা ছিল না। কিন্তু এটা বুঝতে পারছিলাম, এইসময় ওকে সঠিক চিকিৎসা না দিলে ভবিষ্যতে ও আমাদের আরও ভয়ংকর কোনো রূপ দেখাবে। সেই ভবিষ্যৎটা যে ওইদিন গভীর রাতই ছিল, তা ঘূনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি আমরা। রাত তখন প্রায় ১১টা। জেগেই ছিলাম আমি। ঘরে বসে ভাবছিলাম কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা নিয়ে। বাইরে তখন ঝড়ের পূর্বাভাস ছিল। মেঘ ডাকছিল ঘমঘম করে। বিজলি চমকাচ্ছিল খুব। হঠাৎ একটা মেয়ের চিৎকারের আওয়াজ হলো। সাথে সাথে যেন কেঁপে উঠল আমাদের পুরো বাড়ি। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে শুধু দেখলাম, রুশা মেয়েটা বাড়ির সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। দৌড়ে নিচে গেলাম আমি। বাবা-মা, আমরা সবাই নিচে গিয়ে দেখলাম, পুরো জায়গাটা রক্তে লাল হয়ে আছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে রুশার মাথা থেকে। অনেকটা থেতলে গিয়েছিল মাথা। তখন নড়ছিল ও। কী যেন বলতে চেষ্টা করছিল খুব। কিন্তু পারেনি। পর-মুহূর্তেই নিস্তেজ হয়ে যায় ও, ওর শরীর। শ্বাসও থেমে যায়। ততক্ষণে আশেপাশের লোকজন সবাই বেরিয়ে এসেছিল। উপরের দিকে তাকিয়ে দেখা গেল, সুব্রতকে। বিজলি চকমকানোর আলোয় পরিষ্কার হয়ে আবার অন্ধকার হয়ে যাচ্ছিল ওর মুখটা। ও বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল তখন। আর নিচে রুশার মৃত দেহ!

এরপর পুলিশ এসে লাশ আর সুব্রতকে নিয়ে যায়। আমরাও ততক্ষণে সুব্রতকে ঘৃণা করতে শুরু করেছি। সুব্রত বারবার বলছিল ও রুশাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়নি। ও বারান্দায় ছিল, আর রুশা পড়েছে ছাদ থেকে। কথাটা বিশ্বাসযোগ্য ছিল অবশ্য। বারান্দা থেকে পড়লে অন্তত শরীরের সব হাড়গোড় ভেঙ্গে যেতো না। কিন্তু রুশার পোস্টমর্টেম করে জানা যায়৷ ওর শরীরের অবস্থা একেবারে খারাপ। ভিতরে সব গুড়ো গুড়ো হয়ে গিয়েছিল। আর মাথাটাও একেবারে থেতলে গিয়েছিল। রুশার পরিবার মামলা করেছিল এই অভিযোগে করে যে, তাঁর মেয়েকে প্রতিনিয়ত নির্যাতন করেছে ও। সেজন্যই হয়তো ও আর এইসব সহ্য করতে না পেরে জীবন দিয়েছে। আমরাও মিথ্যা বলিনি। সত্যই সমস্ত কিছু। সততার থেকে বড় কিছু নেই। রুশা বেঁচে ছিল না ঠিকই, তবে ওকে ন্যয় বিচার পাইয়ে দিয়েছিলাম। সুব্রতর জেল হয়েছিল ৫ বছরের। ৫ বছর পর বাড়িতে ফিরে আসে ও। প্রায় ১ বছর হয়ে গেছে জেল খেটে ও এসেছে। বাবা ওকে ক্ষমা করে দিলেও আমরা দিইনি। আজও ওকে ঘৃণা করি খুব। এ জীবনে আর ওকে ক্ষমা করা আমাদের পক্ষে সম্ভব না। অন্তত আমার দ্বারা তো অসম্ভব!”
একনাগাড়ে কথাগুলো শেষ করে ফিরোজ চিত্রার দিকে তাকিয়ে দেখল, অঝোর ধারায় কাঁদছে চিত্রা।! সে এগিয়ে গিয়ে চিত্রাকে বুকে টেনে ধরল।
চিত্রা স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “প্রত্যেক নারী হাজারটা স্বপ্ন নিয়ে নিজের শৈশব-কৈশোর কাটানো জায়গা, নিজের পরিবার-বন্ধুবান্ধবকে রেখে স্বামীর ঘরে আসে। আর সেই স্বামী কী-না এভাবে একটা মেয়ের সব স্বপ্ন ভেঙে তাঁর জীবনটা শেষ করে দেয়।”
মেয়েটার তখনকার মানসিক অবস্থার কথা চিন্তা করে হু হু কেঁদে উঠল চিত্রা। কাঁদতে কাঁদতে সে কাশতে শুরু করল। তাঁর শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে গেল হঠাৎ। অস্থির হয়ে উঠল সে। ফিরোজের অনুতাপ হলো, ‘একসাথে পুরোটা বলা উচিত হয়নি চিত্রাকে। বেচারি সহ্য করতে পারছে না। নিকে একজন নারী বলেই হয়তো। মেয়েটার মতোই তো সমস্ত কিছু ছেড়ে, অনেক স্বপ্ন নিয়ে অন্যের ঘরে এসেছে।”

৭ম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=826268521651183&id=100028041274793

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here