প্রস্থান — ৪১তম পর্ব।

0
613

প্রস্থান — ৪১তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

সেদিন একটা প্রজেক্টের কাজে শহরের বাইরে যেতে হয়েছিল সুব্রতকে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় ৯টা। সে নিজের ঘরে গিয়ে দেখল, ঘরময় অন্ধকারে আচ্ছন্ন। বেশ অবাক হলো ঘটনাটাতে। কেন না রুশাকে কখনো ঘরের আলো নেভাতে দেখেনি সে। সারারাত আলো থাকতো ঘরে। আজই প্রথম ঘর অন্ধকার পাওয়া গেল।
সুব্রত ঘরে ঢুকে প্রথমেই সুইচবোর্ডের কাছে গিয়ে লাইট অন করল। মুহূর্তেই আলোয় পরিপূর্ণ হয়ে ঘরের উঠল সব কোনা। সাথে সাদৃশ্য হলো রুশা; ঘরের এক কোণায়, মেঝেতে হাটু মুড়িয়ে বসে আছে ও। চুলগুলো সামনে চলে আসায় মুখটা দেখার উপায় নেই। রুশা আজ এতটা বিপর্যস্ত দেখে বেশ ঘাবড়ে গেল সে। কাঁধ থেকে ব্যাগ নামিয়ে রুশার দিকে এগিয়ে গেল। কাছে যেতেই শুনলো রুশার নাক টানার আওয়াজ। প্রতিদিনের মতো আজও কাঁদছে মেয়েটা।
সুব্রত ঝুঁকে বসল রুশার সামনে। কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর সহসা ডাকল, ‘রুশা’ বলে। রুশা চমকে উঠল সাথে সাথে।
সুব্রতর এতটা কাছে দেখে রুশা নিজেকে আরও গুটিয়ে নিলো। হাঁটু বুকের সাথে ঠেকিয়ে বসে রইল। তাঁর চোখ থেকে ঝর্ণার ন্যয় পানি ঝরছে।
সুব্রত বাকরুদ্ধ! আজ উনাকে ভয়ংকর দেখাচ্ছে! লম্বা দীঘল আলো চুলগুলো আজ বড্ড অগোছালো। কাঁদতে কাঁদতে মুখের অবস্থা করেছে মারাত্মক! সে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “কী হইছে, রুশা?”
সুব্রত জানতে চাওয়ার সাথে সাথে রুশার কান্নাতে শব্দ হলো; এবং তা ক্রমেই বাড়তে লাগল। সুব্রত ব্যাকুল হয়ে পড়ল রুশার কান্না দেখে। সে একটা হাত বাড়াতে চাইল, কিন্তু নিজের সীমাবদ্ধতার কথা ভেবেই আবার থমকে গেল। অসহায় মুখ করে বসে রইল আগের মতো।
রুশা কাঁদছে। জোরে জোরে কাঁদছে এখন। কোনো প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে নাম অঝোর ধারায় কেঁদে যাচ্ছে শুধু। এতটা মর্মাহত ওকে আগে লাগেনি। এদিকে সুব্রত অনবরত প্রশ্ন করে যাচ্ছে। “রুশা, প্লিজ বলো আমাকে; কী হয়েছে তোমার? আজ এতটা কাঁদছ কেন? তোমার বাড়ির লোকেরা এসেছিল? তাঁরা কিছু বলেছে? প্লিজ, একটু খুলে বলো আমাকে।”
অনেকক্ষণ পর রুশা কান্নারত ভাবে শুধু বলল, “সর্বনাশ হয়ে গেছে। সবকিছু শেষ হয়ে গেছে।”
ভয়ে সুব্রতর মুখও শুকিয়ে এলো ক্রমশ। রুশাকে শান্ত করার জন্য কিছুই করতে পারছে না সে। হাত বাড়ির ছোঁয়ার সামর্থ্যও নেই তাঁর। অদূরে বসে চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে শুরু জানতে চাচ্ছে, “রুশা, বলো আমাকে। ভয় পেও না, আমি তো আছি। কীসের সর্বনাশের কথা বলছ তুমি? কী শেষ হয়ে গেছে।”
“দীপ্ত-দীপ্ত।” কাঁপা গলায় বলল রুশা।
সুব্রতর চোয়াল শক্ত হলো এবার। শান্ত হয়ে, অথচ গম্ভীর গলায় জানতে চাইল, “কী হয়েছে দীপ্তর?”
রুশা ফোঁপাতে ফোঁপাতে বলতে লাগল সুব্রতকে।

আসলে ঘটনাটা হলো, আজ যখন রুশা বাড়িতে ফিরছিলাম, তখন রাস্তায় দীপ্তর মা-কে দেখতে পায় সে। উনি ফুটপাতে বসে ভিক্ষা করছিলেন। রুশা যখন উনাকে চিনতে পেরে কাছে গেল, উনি তখনই দাঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলেন। রুশাও তা লক্ষ্য করে দৌড়ে গেল ভদ্রমহিলার কাছে। গিয়ে বলল, “আন্টি, আপনি এখানে কী করছেন? আপনার এই অবস্থা কেন? দীপ্ত কোথায়? ওকে অনেকদিন ধরে খুঁজছি আমি।”
রুশা কথা শুনে উনি কাঁদতে শুরু করলেন। রুশা আবার জিজ্ঞেস করল, “আপনি কাঁদছেন কেন?”
উনি তখন কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “দীপ্ত আর নাই, মা। ও আর এই পৃথিবীতে নাই। তুমি ওরে আর কোনোদিন খুঁইজা পাইবা না।”
রুশা অবাক হয়ে বলে, “আপনি এইসব কী বলছেন, আন্টি?”
উনি তখন কাঁদতে কাঁদতে রাস্তায় বসে পড়লেন। হাউমাউ করে কেঁদে বললেন, “মইরা গ্যাছে আমার পোলা। তোমার লিগা আমার পোলা গলায় দড়ি দিছে। আমারে একা কইরা দিয়া চইলা গ্যাছে। আমার পোলাডা সবসময় কইতো, ‘মা চাকরি হইলে তোমারে এইডা কিনা দিমু, ওইডা কিনা দিমু।’ মইরা গেল আমার পোলা। সর্বনেশে মাইরারে নিয়া ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখছাল আমার পোলা। এহন মইরা গেছে। তুমি তো ভালাই আছো। বড়লোক জামাই।”
দীপ্তর মায়ের কথা শুনে রুশার শ্বাস থমকে যায়। তাঁর বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে।
দীপ্তর মা শোকে কাতর হয়ে বলতে থাকে, “সেদিন আমার পোলা কইলো, ‘মা, ঢাকা শহরে আর থাকুম না। এইহানে আমাগো কোনো মূল্য নাই।’ আমি ভাবলাম ছেলে।মশকরা করে। কিন্তু না, ছেলে দেখি সক্কাল সক্কাল টেরাক নিয়া আইলো। আমারে কইলো, মা উঠো। আমি ভাবলাম কাম পাইছে ছেলে। তাই আমি উঠলাম। আমারে নতুন বাড়িতে নিয়া গেল। ওমা! সেদিন রাতে হঠাৎ কইরা আমার পা জড়াইয়া ধইরা কয়, ‘মা, আমি রুশারে ছাড়া বাঁচুম না। আইজকা ওর বিয়া হইয়া গেছে, মা। ও আর আমার নাই। আমি ওরে ছাড়া বাঁচুম না, মা। আমি মইরা যামু।’ পোলারে অনেক বুঝাইয়া ঘরে পাঠাইলাম আমি। কিন্তু সকালে গিয়া দেহি, পোলা আমার ফ্যানের লগে ঝুঁইলা আছে। জিব্বায় কামড় দিয়া, চোখ বড় চোখ কইরা চাইয়া আছে। কীমুন মা আমি? পোলায় ছটফট কইরা মইরা গেল, বাঁচাইতে পারলাম না।”

দীপ্তর আত্মহত্যার কথা বলে রুশা হু হু করে কাঁদতে থাকে। ওদিকে হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইল সুব্রত। সে কল্পনাও করেনি, দীপ্ত এইরকম কিছু করতে পারে। সে নিশ্চিত ছিল, রুশাকে তাঁর থেকে বেশি কেউ ভালোবাসে না। কিন্তু দীপ্তর এই ত্যাগ তাকে বেশ বড়সড় একটা ধাক্কা দিলো।
রুশা কাঁদছে। ওর কান্নার আওয়াজ নিশ্চয়ই পাশের ঘরের লোকজনের কানে গেছে। সুব্রত অসহায় হয়ে তাকিয়ে থাকল রুশার দিকে। এর মধ্যে আপনা-আপনিই হাতটা চলে গেল রুশার মাথায়, সান্ত্বনা দেওয়ার উদ্দেশ্যে। কিন্তু হঠাই রুশা খপ করে তাঁর হাত ধরে ফেলল। কপালে হাত ঠেকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “বলুন, কী দোষ আমার? আমার সাথেই কেন এমন হয়? আমাকে হারিয়ে দীপ্ত জীবন দিলো। আর আমি?”
রুশার অশ্রুতে সুব্রতর হাত ভিজে গেল। সে ধরা গলায় বলল, “কেঁদো না, রুশা। যা হওয়ার ছিল, তা-ই হয়েছে। তোমাকে বাঁচতে হবে। দীপ্তকে ভুলতে হবে।”
রুশা সুব্রতর হাত আরও শক্ত করে চেপে ধরে, উচ্চস্বরে বলল, “কী-করে ভুলবো আমি? আমাকে ভালোবেসেই তো ও জীবন দিলো। ওর না ঢাকায় ভিক্ষা করে জীবনযাপন করছে আজ। এইসব তো আমার জন্যই হয়েছে।”
সুব্রতর গলার স্বরও আচমকা বেড়ে গেল। সে বলল, “না রুশা। তুমি নিজেকে দোষারোপ করতে পারো না। দীপ্ত এখন আর নেই। ওর কথা ভেবে তুমিও পিছিয়ে থাকলে চলবে না। তোমাকে জীবনে এগোতে হবে। বাঁচতে হবে। দীপ্তকে ভুলতে হবে তোমার।”
সুব্রতর এই কথা শেষ হতেই অকস্মাৎ দাঁড়িয়ে গেল রুশা। সুব্রতকে ধাক্কা মেরে দূরে ঠেলে দিয়ে বলল, “কী চান আপনি? আমাকে? আমার শরীর চান? আপনার ব্যাস আমার শরীর হলেই হবে?”
রুশার এইরকম আচরণে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল সুব্রত! অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল সে!
সুব্রত নির্বাক দেখে এগিয়ে এলো রুশা। আগের মতোই হুংকার ছেড়ে বলল, “চুপ করে আছেন কেন? চলুন কী চাই আপনার? কী পেলে দীপ্তকে ভুলে যেতে বলবেন না। আপনি বললেন, আর আমি ওকে ভুলে যাব? আমার সারা শরীরে যার ছোঁয়া লেগে আছে, তাকে আমি এত সহজে ভুলে যাব?”
এই সময় সুব্রত হঠাৎই নিজের প্রতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রুশার গালে থাপ্পড় মেরে দেয়। সাথে সাথে ঘৃণার স্বরে বলে, “ছি!”
থাপ্পড়ের তীব্রতা একটু বেশিই ছিল বোধহয়, রুশা অনেকটা ছিটকে পড়েছিল খাটের উপর। ঠিক তখনই ঘরে প্রবেশ করে ফিরোজ, এরপর বাকি সদস্যরা। কনা ছুটে যায় রুশার কাছে। ওকে জড়িয়ে ধরে। ফিরোজ রাগান্বিত হয়ে তেড়ে আসতেই সুব্রত ওকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিয়ে, ‘স্টাডি’ রুমে ঢুকে যায়। এরপর ভেতর থেকে ছিটকানি আটকিয়ে দেয়। ওই মুহূর্তে সে ভাবতেও পারেনি, তাঁর এই একটা থাপ্পড় রুশাকে কতটা দিশেহারা করে তুলেছিল; কতটা উদভ্রান্ত, কতটা উন্মাদ করে দিয়েছিল রুশাকে। সে বুঝতে পারেনি, তাঁর মনের উপর দিয়ে যে ঝড় বইছে, তার থেকেও হাজারগুন তীব্র প্রলয় বইছে রুশার মনের ভিতর। এই একটা থাপ্পড় রুশার চোখ খুলে দেয়নি, বরং ওকে আরও আশ্রয়হীন করে তুলেছিল। এইসব কিছুই সে তখন বুঝতে পারেনি।
সুব্রতর যখন বোধ হলো, তখন সে ওই রুমটা থেকে বেরিয়ে এলো। ইতোমধ্যে ঘণ্টা খানিক পেরিয়ে গেছে। সে ঘরের চারিদিকে তাকাল। কিন্তু রুশাকে কোথাও দেখতে পেলো না। হঠাৎ ড্রেসিং টেবিলের উপর দেখটা কাগজ নজরে এলো। সে বিস্মিত হয়ে ওটা তুলতেই দেখল, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অক্ষরে কিছু লেখা।
ওই চিঠিতে লেখা ছিল, “সুব্রত সাহেব, এইরকম একটা পরিস্থিতিতে এসে স্বার্থপরের মতো আমি জীবনযাপন করতে পারব না। এই জীবনে আমি আর কখনোই সুখী হবো না। আমার জন্য অনেক করেছেন আপনি। আগে বুঝতে পারিনি। আপনি যখন থাপ্পড় মারলেন, তখন বোধ হলো, সত্যিই আমি বড্ড খারাপ মেয়ে। প্রথমে দীপ্ত, এরপর আপনি। কারোর জীবন নিয়ে খেলা করার অধিকার আমার নেই। আর আমার অপরাধ আমাকে শান্তিতে বাঁচতে দিবে না। যে ভালোবাসাকে হারিয়ে দীপ্ত জীবন ত্যাগ করতে পারে, সেই ভালোবাসাকে হারিয়ে আমি কেন পারব না? এই পৃথিবীতে আমার আর প্রয়োজন নেই। কেউ নেই আমার। আমি আজ বড্ড একা। তাই চলে যাচ্ছি, এই মুহূর্তে। আপনি এখন থেকে মুক্ত।
চলে যাওয়ার আগে এই কথাগুলো লিখছি কারণ, আমার মৃত্যুর পর সবাই আপনার দিকে আঙ্গুল তুলতে পারে। দীপ্তর কথা আমি আর কাউকে বলতে পারব না। আমি চাই, আমার মৃত্যুর পর আপনিই এই চিঠি দেখিয়ে সবাইকে বলুন, আমি কতটা ক্ষতিকারক ছিলাম!
আমার মৃত্যুর জন্য আপনি কোনোভাবেই দায়ী নন, সুব্রত সাহেব।

চিঠি পড়ে সুব্রত থমকে যায়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে চিঠিটা হাতের মুঠোয় মুচড়িয়ে যায়। এরপর এদিক-ওদিক তাকায় সে। ছুটে যায় বারান্দায়। রেলিং আঁকড়ে ধরে রাস্তা দিয়ে যতদূর চোখ যায় সে তাকায়। সহসাই ছাদের দিকে তাকিয়ে দেখতে পায়, রুশা রেলিংএর উপর দাঁড়িয়ে আছে। সে কিছু বলার আগেই আর্তচিৎকার দিয়ে লাফিয়ে পড়ে রুশা। মুহূর্তেই নিচে পড়ে থিতলে যায় ওর মাথা, শরীর। চিঠিটাও নিচে পড়ে যায় সাথে সাথে। রুশা তখনও জীবিত ছিল। তাকে দেখছিল। কিন্তু সে এক চুল পরিমাণও নড়তে পারছিল না। কেউ যেন তাঁর পা শক্ত করে ধরে রেখেছিল। একটু পর ফিরোজকে ওখানে দেখা যায়। এরপর আরও কেউ কেউ আসে৷ রুশা তখনও সচেতন। সম্পূর্ণ অসাড় হওয়ার আগে সুব্রতর দিকে হাত বাড়িয়ে কিছু বলতে চাচ্ছিল। হয়তো বলতে চাচ্ছিল, ‘আমাকে বাঁচান, সুব্রত সাহেব!’ মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তে সবাই বাঁচার চেষ্টা করে। রুশাও বোধহয় শেষ সময়ে বাঁচার আকাঙ্খা করেছিল। কিন্তু ভাগ্য তাঁর সঙ্গী হয়নি।
এর পরের ঘটনাগুলো খুব তাড়াতাড়িই ঘটে যায়। আসলে সমাপ্তিতে সবাই-ই বড্ড তাড়াহুড়ো করে। সে হোক একজন পরিক্ষার্থী, কিংবা একজন লেখক! সুব্রত তবুও সবাইকে বলে, সে নির্দোষ। কিন্তু এর পক্ষে কোনো প্রমাণ সে দিতে পারে না। শুরু থেকেও সব সত্যি প্রকাশ করতে পারে না সে। দীপ্ত রুশাকে ভালোবেসে জীবন দিতে পেরেছে। সে কেন রুশার সম্মান রক্ষার্থে সামান্য ৫বছর জেল খাটতে পারবে না? সে-ও তো একদিন নিজেকে শ্রেষ্ঠ প্রেমিক বলে দাবী করেছিল! বলেছিল, রুশাকে তাঁর মতো করে কেউ ভালোবাসতে পারবে না। সেজন্যই এই নীরবতা। হয়তো ভালোবাসার ডেফিনেশন সে জানে না, কিন্তু এইটুকু জানে, ভালোবাসলে ত্যাগ স্বীকারের সক্ষমতা থাকতে হবে!

৫৫.
দরজাটা খুলে গেল। চিত্রা চমকে ওঠে তাকাল দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল, সুব্রতর ভাই দাঁড়িয়ে আছে। অস্বাভাবিক তাঁর চাহনি৷ দুলছে। একটা বিদঘুটে গন্ধও বেরোচ্ছে মুখ থেকে। সাথে সাথে সে-ও দাঁড়িয়ে গেল। হাত থেকে ডায়েরিটা নিচে পড়ল।
সুব্রত ভিতরে এসে, নিভু নিভু চোখে তাকিয়ে বলল, “চিত্রা, তুমি এখনো এই ঘরে?”
চিত্রা নির্বিকার। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, এই অন্য কোনো জগতে আছে এই মুহূর্তে। ধ্যানমগ্ন ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইল।
সুব্রত আবার বলল, “ঘড়ি দেখেছ, ক’টা বাজে? রাত প্রায় ১২টা।”
সুব্রত নেশা করেছে। তবুও সময়টা ঠিক ধরতে পারল। অথচ চিত্রা সময়ের ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিল। ডায়েরি মুহূর্ত থেকে এখনো বেরোতে পারেনি সে। রুশার মৃতদেহ চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে।
কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকার পর হঠাৎ হাঁটতে লাগল চিত্রা। ধীর পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। নিজের ঘরের কাছাকাছি আসতেই ফিরোজের মুখোমুখি হলো।
চিত্রাকে দেখে ফিরোজ দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল, “কোথায় ছিলে তুমি?”
চিত্রা নিশ্চুপ। ‘থ’ মেরে দাঁড়িয়ে আছে।
ফিরোজ আরও ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “তখন বললে রশ্মিদের বাড়িতে যাচ্ছ। ফিরছ না দেখে ভাবলাম আজকে ওখানেই থাকবে। রাত হলো। ঘুম আসছিল না বলে ফোন করলাম তোমাকে। অথচ ফোন ঘরেই রেখে গেছ। রশ্মির মোবাইলে ফোন করে জানলাম, তুমি অনেক আগেই ওদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছ। এখন বেরোলো সুব্রতর ঘর থেকে। তুমি বলো চিত্রা, আজকের ঘটনার কী ব্যাখ্যা দিবে?”
চিত্রা শান্ত গলায় বলল, “আমি তোমাকে বলব, ফিরোজ। যদি তুমি প্রথম থেকেই আমার পাশে থাকতে, তবে আমি তোমাকে অনেক আগেই বলতাম।”
“কী বলবে তুমি? স্বামীর বড় ভাইয়ের ঘর থেকে মাঝরাত্রিতে বেরোনোর পিছনে কী কারণ থাকতে পারে?”
“বলব আমি। সব বলব। শুধু আমাকে একটু সময় দাও। এবার সবটা বলতেই হবে। তোমাদের সবার ভুল ভাঙাতে হবে। এখনই সময়।”
ফিরোজ কিছুক্ষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল চিত্রার দিকে। এরপর বলল, “আশা করি এবার একটা সঠিক সিদ্ধান্তে আসার সময় হয়েছে। এভাবে আর কতদিন?”
চিত্রা বলল, “ঠিক আছে। তোমার যা করার করো, আমার যা করার আমি করব। এখনই সময়।” কথাগুলো বলে ফিরোজকে পাশ কাটাল চিত্রা৷
চিত্রার কথাগুলো ফিরোজকে আরও ক্ষুব্ধ করে তুলল। নাক-মুখ খিঁচিয়ে ঘুরে দাঁড়াল সে। হঠাৎই চোখে পড়ল, সুব্রতর বন্ধু জাকিরকে। সিঁড়ির দিয়ে উপরে ওঠে দাঁড়িয়ে আছে। তাকে দেখেই মৃদু হাসল।
ফিরোজ গম্ভীর গলায় বলল, “কেমন আছেন?”
জাকির মৃদুস্বরে বলল, “ভালো আছি। তুমি কেমন আছো, ছোটভাই?”
“ভালো আছি।” ফিরোজ মলিন সুরে জবাব দিলো।
জাকির আবার বলল, “অনেক বছর আগে দেখেছিলাম তোমাকে। তখন বেশ ছোট ছিলে।”
ফিরোজ নীরব। জাকির আবার বলল, “কাল চলে যাচ্ছি। বেশ সকালে বেরোবো। আর হয়তো আসা হবে না।”
এবারও নীরব, ফিরোজ। জাকির পাশ কাটিয়ে যেতে গিয়েও আবার দাঁড়িয়ে গেল। ফিরোজের মুখোমুখি হয়ে, কাঁধে হাত রেখে বলল, “সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার মূলমন্ত্র হলো আন্ডারস্ট্যান্ডিং। যদি এটা না থাকে, তবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা মুশকিল। আর হ্যাঁ, আমি আর সুব্রত একটু বেরিয়েছিলাম। রাতের ঢাকা দেখে এলাম। এইমাত্র ফিরলাম দুজনে, একসাথে।” শেষের কথাটা একটু গাঢ় স্বরে বলল জাকির। এরপর চলে গেল।

সুব্রত দাঁড়িয়ে ডায়েরিটা দেখছিল। একদম শেষ পাতা। চিত্রার এমন স্তম্ভিত হওয়ার কারণ এবার বুঝতে পারল। টেবিলের উপর থেকে একটা কলম তুলে নিলো সুব্রত। ডায়েরির শেষ পাতায় লিখল, “চিত্রা মেয়েটা অদ্ভুত! আমার অতীত জানার জন্য এতদিন ছটফট করেছে। আজ জানতে পেরে কথা হারিয়ে ফেলেছি। মেয়েটা কী সুন্দর করে ‘সুব্রত ভাই’ বলে ডাকে, সারাক্ষণ। আমি ওর এই ডাকের মায়ায় পড়ে গেছি। সেজন্য ওর উপর রাগ করতে পারি না। কখনো ভাবিনি, ডায়েরিটা কাউকে পড়তে দিবো, কাউকে জানতে দিবো গোপন কথাগুলো। কিন্তু চিত্রাকে জানতে দিয়েছি। মায়ার কারণেই হয়তো। আমি বিশ্বাস করি, আমার মৃত্যু হলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট চিত্রাই পাবে। বাকিরা হয়তো অচিরেই ভুলে যাবে আমাকে। কিন্তু চিত্রা সারাজীবন মনে রাখবে।”
কথাগুলো লিখে ডায়েরি বন্ধ করল সুব্রত। ঘর থেকে জাকিরের ডাক আসতেই সে বলল, “আসছি।” এরপর ডায়েরি লুকিয়ে রেখে ‘স্টাডি’ রুম থেকে বেরোলো।

৪১তম পর্ব এখানেও সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=855689778709057&id=100028041274793

বি:দ্র: চেক দিতে পারিনি। ভুলগুলো ধরিয়ে দেওয়ার অনুরোধ রইল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here