প্রস্থান — ৪২তম পর্ব।

0
664

প্রস্থান — ৪২তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

৫৬.
ভোরবেলা তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরোলো জাকির। সিঁড়ির পর্যন্ত আসতেই দেখল, কনা নিজের ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, দুই হাত পিছনে নিয়ে; হয়তো তাঁরই অপেক্ষায়। মেয়েটাকে দেখে তাঁর চলায় পথরোধ হলো।
কনাও কিছুটা এগিয়ে এলো জাকিরের দিকে। পিছনের হাত সামনে আনতেই দেখা গেল, একটা নতুন-চকচকে স্টিক। সাথে সাথে ওটা এগিয়ে দিয়ে সে বলল, “এটা আপনার জন্য।”
জাকির বিস্মিত হয়ে বলল, “আমার জন্য? হঠাৎ?”
“শুনেছি আপনি আজ চলে যাবেন। তাই গতকাল বিকেলেই কিনে এনেছিলাম।”
“ওহ্।” মৃদু হেসে স্টিকটা হাতে নিলো জাকির। অন্য হাতের পুরোনো স্টিকটার দিকে তাকাল একবার।
কনা বলে উঠল, “ওটা আমাকে দিন।”
চমকে উঠল জাকির! কৌতূহলী দৃষ্টিতে তাকিয়ে, জানতে “এটা দিয়ে আপনি কী করবেন?”
“কিছু না।” ঠোঁট টিপে, নির্বিঘ্নে কাঁধ ঝাঁকাল কনা। হেসে বলল, “রেখে দিবো যত্ন করে৷ একসাথে দুটোর নিশ্চয়ই প্রয়োজন নেই আপনার।”
চমকিত দৃষ্টিতে পুরোনো স্টিকটার দিকে তাকাল জাকির। কয়েক সেকেন্ড অপলক ভাবে তাকিয়ে থাকার পর ওটা বাড়িয়ে দিলো কনার দিকে। মুখে বলল, “এটা যত্ন করে রাখার মতো কিছু না। বরং আমি কথা দিতে পারি, আপনার এই উপহার আমি খুব যত্ন করে রাখব।”
পুরোনো স্টিকটা নিজের হাতে নিলো কনা। মলিন সুরে বলল, “আমার জন্য নাহয় এটাই আপনার দেওয়া উপহার।”
কিছু বলল না জাকির। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল কনার দিকে।
কিছুক্ষণ পর কনা নিজেকে সামলে, প্রাণবন্ত হয়ে জানতে চাইল, “আবার কবে আসবেন এই দেশে?”
জাকির হঠাৎ শব্দ করে হাসল! কনা আশ্চর্য হয়ে, ভুরু কুচকালে; সে নিজের হাসি থামিয়ে বলল, “আবার আসতে হলে কোনো কারণ চাই। কোনো কারণ আছে কি?”
হালকাভাবে মাথাটা ঝাঁকাল কনা; ‘না’ সূচক! তা দেখে জাকির আবার হেসে দিয়ে বলল, “তবে কেন আসবো?” একটু সময় নিয়ে জাকির আবার বলল, “যাই হোক, ভালো থাকবেন। বয়সে আপনি আমার অনেক ছোট। তবুও গত দুই-তিন দিন আমাকে সঙ্গ দিয়েছেন। সত্যিই খুব আনন্দের কেটেছে মুহূর্তগুলো। মনে হচ্ছিল, বহু বছর পর দেহে প্রাণ ফিরল!”
কনা কাতর হয়ে বলল, “ফিরে গিয়ে এই অসমবয়সী বন্ধুকে মনে করবেন তো?”
জাকির হাসল। প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, “অসমবয়সী বন্ধু! দারুণ বললেন তো! সম্পর্কের একটা নাম পাওয়া গেল৷ আসি তবে।”
হঠাৎ ব্যস্ত হয়ে উঠল জাকির; জবাবের অপেক্ষা না করে সিঁড়ি দিয়ে নামতে শুরু করল দ্রুত পায়ে। এদিকে কনা ছলছল চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। কী তীব্র মায়া! দূরত্ব যত দীর্ঘ হচ্ছে, ভেতরে শূন্যতা তত প্রখর হচ্ছে!
জাকির অদৃশ্য হলে ঘুরে দাঁড়াল কনা, তখনই দেখতে পেলো সুব্রত ভাই নিজের ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকেই তাকিয়ে আছে, একভাবে। ভীষণ অস্বস্তির স্বীকার হলো সে। কুণ্ঠাবোধ হলো প্রবল!
সুব্রত এগিয়ে এলো কনার দিকে। তাঁর ধূসর রঙের চোখগুলো স্থির; অথচ শান্ত। হাত দুটো পকেটে৷ পরণে স্যুট। হাঁটতে হাঁটতে কনার ঠিক সম্মুখে এসে দাঁড়ালো।
কনা নিচের দিকে তাকিয়ে, আমতাআমতা করে বলল, “কি-কিছু বলবে?”
কিছুক্ষণ নির্বাক থাকার পর সুব্রত ক্ষীণ আওয়াজে জানতে চাইল, “তুমি কি জাকিরকে পছন্দ করো?”
সুব্রতর সরাসরি প্রশ্নে আরও অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল কনা! জড়োসড়ো হয়ে বলল, “না না। ছি!” এরপর সামান্য দৃঢ় গলায় বলল, “ভদ্রলোক আমার কত্তো বড়!”
সুব্রত আগের মতোই গম্ভীরমুখে বলল, “সত্যি করে বলো।”
কনা চুপ হয়ে রইল; নতমুখে।
সুব্রত আবার বলল, “কী হলো? বলো।”
কনা তবুও মুখ কালো করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। কী জবাব দেবে সে?
কনার এমন নীরবতায় সুব্রত কপালের ভাজগুলো হারিয়ে গেল এবার। শ্বাস ছেড়ে বলল, “কখন এইরকম মনে হলো?”
হঠাৎ কনা কাতর গলায় বলল, “উনার জীবনে কত কষ্ট! কেউ নেই উনার। নিজেও অসম্পূর্ণ। যখন দেখলাম স্টিক হাতে দাঁড়িয়ে আছে, খুব ক্লান্ত, আমার বড্ড মায়া হলো। এরপর ভাবির মুখে সব শুনলাম। কান্না পাচ্ছিল আমার!” শেষের দিকে কনার গলা জড়িয়ে এলো।
সুব্রত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কনার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “তুমি জানো এটা লি?”
মাথা তুলল কনা, চোখ পিটপিট করে তাকাল।
সুব্রত আবার বলল, “সহানুভূতি! তুমি কোমল হৃদয়ের একজন মানুষ। সেজন্য ওর প্রতি তোমার সহানুভূতি জন্মেছে। তবে এটাকে একপাক্ষিক বাড়তে দিও না। তোমার জীবন মাত্র শুরু। প্রতিটি মানুষকে দুটো দিক নিয়ে বাঁচতে হয়। একটা নরম দিক, একটা শক্ত দিক। তোমার মধ্যে শুধু একটাই আছে। সাবধান!”
কনা অকস্মাৎ সাহসী হয়ে বলল, “তোমার মধ্যেও একটা আছে? শুধুই কাঠিন্য?”
সুব্রত অবাক চোখে দেখল কনাকে। কিছুক্ষণ পর ওর মাথায় একবার হাত রেখে চলে গেল। তাঁর ঠোঁটের কোণে উপহাস্য!
জাকির বেরোলো ৮টার দিকে। সুব্রত ওকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিতে গেল।

৫৭.
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে চিত্রাকে খুঁজতে লাগল ফিরোজ। ওকে পাওয়া গেল কনার ঘরের সামনে। সে তড়িঘড়ি করে ওর হাত ধরে ঘরে নিয়ে গেল।
“আরে আরে, কী করছ?” চিত্রা বলল আঁতকে ওঠে। ফিরোজের এইরকম আচরণে হতবিহ্বল সে!
ঘরে এসে চিত্রাকে জোর করে বিছানায় বসিয়ে দিলো ফিরোজ। নিজেও পাশে বসে পড়ল তৎক্ষনাৎ। এরপর পকেট থেকে মোবাইল বের কর কিছু ছবি দেখাল৷
ছবি দেখে চিত্রার ভুরু কুঞ্চিত হলো! একটা ফ্ল্যাটের ছবি। বড় ড্রয়িংরুম। দুটো বড়বড় বেডরুম। কিচেন, ডাইনিং, বলা যায় একটা পরিবারের জীবনযাপনের সবকিছুই আছে।
চিত্রাকে মোবাইল স্ক্রিনে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফিরোজ জানতে চাইল, “কেমন?”
চিত্রা মোবাইল থেকে চোখ সরিয়ে বিস্মিত গলায় বলল, “চমৎকার! কিন্তু এটা কার বাড়ি?”
ফিরোজ চঞ্চল হয়ে বলল, “শীঘ্রই আমাদের হবে, ইনশাআল্লাহ। আজকেই দেখে এলাম। ব্যাংকে লোনের জন্য কথা বলে এসেছি।”
চিত্রা স্তব্ধ হয়ে গেল ফিরোজের কথা শুনে। কোনোরকমে বলল, “কী বলছ এইসব?”
“যা শুনছো, তাই।” ফিরোজ সাবলীল।
“কিন্তু আমাদের তো বাড়ি আছেই। তবে এটার কী প্রয়োজন?”
“প্রয়োজন আছে।” ফিরোজ গম্ভীর হয়ে এলো হঠাৎ। বলল, “গতকাল রাতের কথা মনে নেই?”
চিত্রার চমকিত মুখ এবার ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ক্ষীণ গলায় বলল, “তাহলে এটাই তোমার সেই সিদ্ধান্ত।”
“হ্যাঁ।” মাথা ঝাঁকাল ফিরোজ। “এবার তোমার সিদ্ধান্ত বলো।”
“কিন্তু।”
চিত্রাকে থামিয়ে দিয়ে ফিরোজ বলে উঠল, “আমি মতামত চাইনি। শুধু সিদ্ধান্ত জানতে চেয়েছি।”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল চিত্রা। নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, “এইসব করে তুমি এই পরিবার থেকে আমাকে আলাদা করে দিতে চাইছো? বিশেষ করে সুব্রত ভাইয়ের থেকে?”
ফিরোজ কিছু বলল না। তাঁর চোখ-মুখ শক্ত।
চিত্রা ডিটেকটিভ ভঙ্গিতে বলল, “কোনোভাবে এখানে তোমার মায়ের বুদ্ধি নেই তো?”
কথাটা শুনেই ওঠে দাঁড়াল ফিরোজ। রুক্ষ গলায় বলল, “মা এখনো গতকালকের ঘটনা জানে না। এমনকি এই ফ্ল্যাটের ব্যাপারটাও না। এটা আমার একার সিদ্ধান্ত। তাছাড়া আমি বুঝতে পেরেছি, সমস্যা যেহেতু আমাদের মধ্যে, এখানে মা কিছু করতে পারবে না। এখন থেকে আমাদের কোনো সমস্যার কথা মা-কে বলব না। কারণ মা আমার পক্ষই নিবে সবসময়। এ-কথা আমি মা-কেও বলেছি।”
“যদি আমি ওখানে না যাই?”
ফিরোজ হাসল। আবার চিত্রার দিকে তাকিয়ে বলল, “তবে আমি একাই থাকব ওখানে। এতে অবশ্য আমাদের সম্পর্কের শুধু অবনতিই হবে। একদিন হয়তো ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে সবকিছু।”
দরজায় টোকা পড়ল হঠাৎ। দুজনের কথপোকথনে বিঘ্ন ঘটতেই তাকালো দরজার দিকে। ফিরোজ ঈষৎ ধমক সুরে বলল, “কে?”
সঙ্গে সঙ্গে বাইরে থেকে জবাব এলো, “ভাইজান, আমি সুলতানা। খালু আপনাদের নিচে ডাকছেন। জরুরি কথা আছে।”
“তুই যা, আমরা আসছি।” ফিরোজ বলল উঁচু গলায়।
সুলতানা চলে যাওয়ায় পর চিত্রা ঘর থেকে বেরোতে অগ্রসর হলে ফিরোজ ওর হাত ধরে ফেলল। সহসা কোমল হয়ে বলল, “এটা খুব জরুরি, চিত্রা। আমি তোমাকে ভালোবাসি। তোমার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই। আমাদের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝি হচ্ছে। আর এই বাড়িতে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। সেজন্য এটা জরুরি। আমি তোমার জবাবের অপেক্ষায় থাকবো।”
চিত্রার চোখের কোণা বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল হঠাৎ। হাতের তালু দিয়ে সেই পানি মুছে, সে বলল, “তুমি আমার মন ভেঙছ। আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আমাদের সাথে সুখ কখনোই থাকবে না; যদি একে অপরের প্রতি বিশ্বাসে, ভরসা আর আস্থা না থাকে।”

চিত্রা আর ফিরোজ নিচে এসে দেখল, ড্রয়িংরুমে বাবার সাথে একজন কোট-টাই পরা লোক বসে আছে। লোকটাকে ফিরোজ চিনে ফেলল সহজেই, উকিল। বাবার অফিসে প্রায়ই দেখতো।
ফিরোজ গিয়ে মায়ের পাশে বসল। চিত্রা আর কনা দাঁড়িয়ে রইল কিছুটা দূরে। খালেদ সাহেব বসে আছেন উল্টো দিকের সোফায়, পাশেই উকিল।
খালেদ সাহেব জানতে চাইলেন, “সুব্রত কোথায়? ও এখনো অফিস ফেরেনি?”
কনা বলল, “না।”
ঘড়ি দেখলেন খালেদ সাহেব। বললেন, “সময় তো হয়ে গেছে। আচ্ছা। যাই হোক, আমরা কাজ শুরু করি। ও এখন থাকলে আরও কথা বাড়বে। ওর সাথে আলাদা কথা বলতে হবে এই ব্যাপারে।”
“যা বলার তাড়াতাড়ি বলো তো। এত রহস্য রেখে দিও না।” দীপালি বেগম অধৈর্য হয়ে বলে উঠলেন হঠাৎ।
খালেদ সাহেব বিরক্ত হলেন স্ত্রীর প্রতি। মুখ বিকৃত করে বললেন, “একটু চুপ করে বসো তো।”
বাইরের লোক থাকায় আর কথা বাড়ালেন না দীপালি বেগম। মুখ গুমোট করে বসে রইলেন একভাবে।
খালেদ সাহেব স্ত্রীর দিক থেকে চোখ সরিয়ে উকিলের উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনিই বলুন।”
উকিল সাথে সাথে মাথা ঝাঁকিয়ে বলতে লাগলেন, “খালেদ সাহেব নিজের সমস্ত সম্পত্তি কয়েকটা ভাগ করেছেন। উনার বয়স হয়েছে। শরীরও ভালো যাচ্ছে না। সেজন্য উনি আমাকে ডেকে উইল করেছেন। এখানে যে চারজনের নাম আছে, তাঁরা হলো দীপালি, ফিরোজ, সুব্রত আর কনা।”
উকিল এইটুকু শেষ করতেই দীপালি বেগম হঠাৎ উগ্র গলায় বলে উঠলেন, “থামুন আপনি।” উকিল থামতেই তিনি স্বামীর দিকে রুক্ষমূর্তি ভঙ্গিতে তাকিয়ে আবার বললেন, “এখানে সুব্রতর নাম আসলো কোত্থেকে?”
খালেদ সাহেব চোখ বুজলেন স্ত্রীর কথা শুনে। কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে বললেন, “আমি জানতাম সবার আগে তুমিই এই কথা বলবে। এতদিন ধরে সংসার করছি, আর তোমাকে চিনবো না।”
ফিরোজ মা-কে সঙ্গ দিলো তৎক্ষনাৎ, “প্রশ্নটা আমারও, বাবা। তোমার সম্পত্তির ভাগ আমি, কনা আর মা পেতে পারি। কিন্তু এই মধ্যে ও আসলো কোত্থেকে?”
ছেলের প্রশ্নের জবাবে খালেদ সাহেব বললেন, “এটা ওর হক। এই শেষ সময়ে এসে অন্তত ওকে ওর হক থেকে দূরে ঢেলে দিবো না আমি। এই বাড়ির ছেলে ও।”
ফিরোজ বাবার কথার জবাবে বলল, “সেই ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি তুমি সবকিছুতে আমাকে আর সুব্রতকে এক পাল্লায় মেপেছ৷ আজ সম্পত্তির ভাগাভাগির সময়েও তুমি আমাদের একভাবে দেখছ। সবসময় এমনটা কেন হয়, বাবা? ও কীভাবে আমাদের সম্পত্তির ভাগীদার হয়? শুধুমাত্র বড় আব্বা ওকে তোমার দায়িত্বে রেখে গিয়েছিল বলে? নাকি অন্য কোনো কারণ আছে?”
খালেদ সাহেব চুপ করে রইলেন। এইসব প্রশ্নের জন্য অবশ্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন তিনি। এবং জবাবগুলোও তাঁর কাছে আছে। এখন শুধু বলার অপেক্ষা।
ছেলের কথা শেষ হতেই দীপালি বেগম বলে উঠলেন, “তোমার ভাই যখন অসুস্থ শরীর নিয়ে উইল করেছিলেন, তখন কী একবারও আমার ছেলে-মেয়েদের কথা ভেবেছিলেন? ওদের জন্য কিছু করেছিলেন তোমার ভাই? করেননি তো। তাহলে আজ তুমি কেন উনার ছেলের জন্য করতে চাচ্ছ? তোমার কীসের দায়বদ্ধতা?”
“দায়বদ্ধতা আছে। আছে দায়বদ্ধতা।” মুখ শক্ত করে বলে উঠলেন খালেদ সাহেব। এরপর কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর আবার বলতে লাগলেন, “আমি মনঃস্থির করে রেখেছিলাম, এবার সত্যিটা সামনে আনবো। তোমাদের থেকে কিছু পাওয়ার নেই আমার। তাই হারানোর ভয় নেই। আমি শুধুমাত্র হালকা হতে চাই। যে ক’দিন বেঁচে আছি, যেন ভেতরে ভেতরে দ্বিধাদ্বন্দে জর্জরিত হতে না হয়। সুব্রতও এখানে নেই। তাই তোমাদের সেই সময়ের কিছু কথা বলব, যখন এই বাড়িতে তোমাদের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। সুব্রতর সামনে এগুলো বলতে পারব না আমি। আমি চাই না ও আমাকে আরও ঘৃণা করুক। তাই ওর অনুপস্থিতিতে তোমাদের সবটা জানিয়ে দিতে চাই। আমার মৃত্যুর পরবর্তীতে তোমাদের থেকে সত্যিটা জানলেও ও কিছু করতে পারবে না। মৃত ব্যক্তিকে নিশ্চয়ই অভিশাপ দিবে না।
সময়টা তখনকার, যখন আমি বিদেশে কর্মরত ছিলাম। এক বিদেশি ফরেনারের সাথে আমার সম্পর্ক তৈরি হয়। বিয়েও হয়। সুব্রত আমার প্রথম স্ত্রীর সন্তান। সুব্রতকে জন্ম দিতে গিয়েই ও মারা যায়। তখন আমার কোলে নিষ্পাপ শিশু, সুব্রত। ও ঠিক ওর মায়ের মতো দেখতে হয়েছিল। ফরসা গায়ের রঙ। চোখগুলো একেবারে আলাদা। সেসময় আমি বুঝতে পারছিলাম না কী করব। সুব্রতকে সামলানো আমার পক্ষে ছিল অসম্ভব। মাত্র ৩০ বছর বয়সী যুবক আমি। সামনে গোটা ক্যারিয়ার। আমার এই বিয়ের ব্যাপারটা ভাইজান জানতো না প্রথমে। সুব্রতর জন্মের পর যখন জানালাম, তখন ঝগড়া লেগে যায় আমাদের মধ্যে। কিন্তু শেষমেষ আমার বিপদের কথা ভেবে তাঁরাই এগিয়ে আসে৷ তাঁরা সন্তান নিবে, এমনই পরিকল্পনা ছিল। মাঝখানে সুব্রত চলে এলো। ভাইজান কাম-কাজ ফেলে ভাবীকে নিয়ে আমার কাছে চলে যায়। এরপর দীর্ঘ একবছর ওখানে কাটিয়ে সুব্রতকে নিয়ে দেশে ফিরে আবার। ওকে নিজেদের সন্তান বলেই পরিচয় দেয়। আমি ফিরি আরও ৫-৬ বছর পর। দেশে এসে নিজের ব্যবসা শুরু করি। এরপর দীপালিকে বিয়ে করি। এক বছর পরই ফিরোজের জন্ম হয়।”
একনাগাড়ে কথাগুলো বলে খালেদ সাহেব পরিবারের সবার দিকে তাকালেন। সবার চোখ-মুখ উত্তেজনাপূর্ন। দীপালি বেগম হঠাৎ বসে পড়লেন ধপাস করে। ফিরোজ তাকিয়ে আছে বিস্ফারিত চোখে!
সবার এমন অভিব্যক্তি দেখে খালেদ সাহেব সহসা কাতর হয়ে বললেন, “আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। নিজের উজ্জ্বল ক্যারিয়ারের কথা ভেবে সুব্রতর দায় এড়িয়ে গেছি। কিন্তু সেসময় আর কোনো উপায় ছিল না আমার হাতে। আমি নিরুপায় ছিলাম বিধায় কখনোই কাউকে বলতে পারিনি, সুব্রত আমার প্রথম স্ত্রীর সন্তান। দীপালি আমার দ্বিতীয় স্ত্রী।”
ড্রয়িংরুমে স্তম্ভিত! সবার দৃষ্টিই ছিল খালেদ সাহেবের দিকে। কিন্তু দীপালি বেগম চাহনি ফিরিয়ে নেওয়ায় হঠাৎ দেখলেন আধখোলা সদর দরজার বাইরে সুব্রত দাঁড়িয়ে আছে। তিনি আবার দাঁড়িয়ে পড়লেন সঙ্গে সঙ্গে। শ্বাস থমকে গেল তাঁর। মুখ থেকে ‘সুব্রত’ নামটা ছিটকে পড়ল।
কলিংবেল বেজে উঠল। ড্র‍য়িংরুমের সবাই দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল, দরজাটা ভেড়ানো। দীপালি বেগমও দেখলেন দরজা বন্ধ! অথচ কয়েক সেকেন্ড আগেই ওটা বেশ ফাঁকা ছিল। তিনি স্পষ্ট দেখেছেন, সুব্রত দাঁড়িয়ে আছে ওখানে।
চিত্রা এগিয়ে গেল দরজার দিকে। দরজার খুলে দেখল, বাইরে সুব্রত দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াল সে, সঙ্গে সঙ্গে।
সুব্রত ভিতরে ঢুকল। স্বভাবতই চোখে গানগ্লাস। কাঁধে ব্যাগ। কারোর দিকে না তাকিয়ে সরাসরি উপরে ওঠে গেল সে।

রাত তখন ১০টা। এক তলা থেকে দুতোলায় ওঠে এলো ফিরোজ। সিঁড়ির ধাপ শেষ করতেই দেখল, অদূরে সুব্রত দাঁড়িয়ে আছে। থমকে দাঁড়াল সে। ওর পা থেকে মাথা অব্দি দেখল একবার। এই প্রথম একটু ভিন্ন ভঙ্গিতে তাকাল। এখনো তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না, সুব্রত তাঁর বাবার রক্তের।
সুব্রত এগিয়ে এলো ফিরোজের দিকে। ওর জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল সে; অবসান হলো এইমাত্র। পেছনের দিক থেকে হাত সামনে নিয়ে এলো; উঁচু করে ধরল।
ফিরোজ দেখল, সুব্রতর হাতে দুটো ডায়েরি। সে বিস্মিত কণ্ঠে জানতে চাইল, “এগুলো কী? আর এগুলো নিয়ে দিয়ে আমি কী করব?”
সুব্রত ডায়েরি দুটো ফিরোজের হাতে দিয়ে বলল, “খুব জরুরি। তোর কাজে লাগবে। এগুলো পড়লেই বুঝতে পারবি, কেন বারবার চিত্রা আমার ঘরে যেতো। ওর এত কৌতূহল কীসের। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করানোর জন্য এগুলো দিচ্ছি না তোকে। আমি শুধু চাই, তোর আর চিত্রার মধ্যে যে ভুল বুঝাবুঝি চলছে, সেটার সমাপ্তি হোক। চিত্রার মতো মেয়ে আমি এই দুনিয়াতে দুটো দেখিনি। ও হারালে তোর জীবন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ওর চোখের একেক ফোঁটা পানি হবে তোর জীবনের ব্যর্থতা। ওকে আর কষ্ট দিস না, প্লিজ।”
ডায়েরি দুটোর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল ফিরোজ। সুব্রত আর অপেক্ষা করেনি, কথাগুলো বলেই সে নিজের ঘরে চলে গেছে।

৫৮.
গভীর রাত। আকাশে ঘনকাল মেঘ। তাঁর তীব্র গর্জন কাঁপিয়ে দিচ্ছে শহরকে। চারিদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন।
ছাদে বসে একের পর এক সিগারেট টেনে যাচ্ছে সুব্রত। একটা নেশার বোতলও শেষ হয়েছে ইতোমধ্যে। শহরে বৃষ্টি থেমেছে অনেকক্ষণ আগে। কিন্তু তাঁর দুই চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরছে এখনও; অঝোর ধারায়। ছাদের দেয়ালের উপর বসে কাঁদছে সে। সিগারেট টানছে। মদ্যপান করছে। বিষণ্ণতায় ভারাক্রান্ত। হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু হলো, আবারও। শো শো শব্দে-বাতাসের সাথে প্রবল বেগে বৃষ্টির সেচ তাকে আঘাত করল। হাতের সিগারেট নিভে গেল সাথে সাথে। বোতলটাও পড়ে গেল হাত থেকে। এরপর কেটে গেল কয়েক সেকেন্ড। তাঁর নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে ক্রমশ। হঠাৎ রেলিঙের উপর ওঠে দাঁড়াল সে। আকাশের দিকে তাকাল। মুখের উপর বৃষ্টির ফোঁটা পড়তেই চোখ বুজে ফেলল সে। এরপর মিনিট খানেক সময় পেরিয়ে গেল। মৃত্যুর আর তাঁর মধ্যেকার দূরত্ব এখন শুধুই কিছু সময়। অথচ নিরুত্তাপ সে। সহসা মাথাটা নিচে নামাতেই চক্কর খেলো। টাল সামলাতে পারল না। ডান পা সরাতেই পিচ্ছিল খেয়ে অন্য পা-টাও রেলিঙের উপর থেকে সরে গেল। আর সঙ্গে সঙ্গে নিচে পড়ে গেল সে।

৫৯.
চিত্রা বিছানায় শুয়ে আছে। ভোর হয়েছে সবেমাত্র। হঠাৎ দরজাটা বিকট শব্দ করে খুলে গেল। ভয়ে লাফিয়ে উঠল সে। বুক ধড়ফড় করছে। দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল, ফিরোজ ঘরের ভিতরে আসছে, হাঁপাতে হাঁপাতে। বিছানার কাছে এসে থরথর করে কাঁপতে থাকা গলায় বলল, “চিত্রা, সুব্রত ভাই।”
এই প্রথম ফিরোজের মুখে সুব্রতকে ভাইকে ডাকতে শুনলো চিত্রা। তাঁর বড় ভালো লাগল ডাকটা শুনতে। “কিন্তু ও এত ঘাবড়ে আছে কেন?” প্রশ্নটা চিত্রার মাথায় খেলতেই তাঁর ঘুম সম্পূর্ণ কেটে গেল।
“কী হইছে সুব্রত ভাইয়ের?” চিত্রা জানতে চাইল।
ফিরোজ হঠাৎ হু হু কেঁদে দিয়ে বলল, “সুব্রত ভাই আর নেই, চিত্রা। কাল রাতে ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছে সুব্রত ভাই।”

৪২তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=856345591976809&id=100028041274793

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here