প্রস্থান — ৪০তম পর্ব।

0
473

প্রস্থান — ৪০তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

মাঝরাতে ঘরে এলো সুব্রত। রুশা আগের মতোই আধশোয়া হয়ে বসে আছে। হাত নাড়িয়ে চোখ মুছতেই সুব্রত বুঝতে পারল, ও এখনো ঘুমোয়নি। তাঁর বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো সাথে সাথে। আবার চেয়ারে বসে পড়ল সে।

ভোরবেলা সূর্যের আলো চোখে পড়তেই সুব্রত জেগে উঠল। চোখ ডলতে ডলতে নিজের অবস্থান দেখল; ব্যালকনির চেয়ারেই তাঁর রাত কেটেছে। দাঁড়িয়ে জানালা দিয়ে ভিতরে তাকিয়ে দেখল, বিছানায় রুশা নেই। খানিক বিস্মিত হয়ে ঘরে গেল সে। ওয়াশরুম থেকে পানি পড়ার আওয়াজ আসছে। রুশা ওখানে। চিন্তামুক্ত হয়ে বিছানায় বসল এবার। মিনিট দুয়েক কেটে গেল বসাতেই। হঠাৎ মেঝেতে চোখ পড়তেই কিছু একটা নজরে এলো। ভুরু কুঞ্চিৎ হয়ে ঝুঁকতেই দেখল, একটা সিম; যা দু’টুকরো হয়ে পড়ে আছে। ওটা তুলতেই ওয়াশরুম থেকে রুশা বেরিয়ে এলো, তোয়ালে দিয়ে হাত-মুখ মুছতে মুছতে।
রুশা ফ্রেশ হয়েছে বটে, কিন্তু ওর চোখ-মুখের অস্বাভাবিক রঙ উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। চোখ দুটো বেশ ফোলা ফোলাও মনে হচ্ছে। চুলগুলো এলোমেলো। সুব্রকে দেখে ও আর বিছানায় গিয়ে বসল না। ব্যালকনির জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়াল, সংকুচিত হয়ে।
সুব্রত নিজেকে সামলে জানতে চাইল, “এটা কার সিম, রুশা?”
রুশা ঘুরে দাঁড়াল। সুব্রতর দিকে অস্বস্তি ভরা দৃষ্টিতে তাকাল একবার। সিমটা একপলক দেখে জবাব দিলো, “আমার।”
“ভাঙল কীভাবে?”
“আমিই ভেঙেছি।”
সুব্রতর চোয়াল ঝুলে পড়ল রুশার কথা শুনে। কয়েক সেকেন্ড অবাক চোখে তাকিয়ে থাকার পর আবার বলল, ” বাড়ির লোকদের সাথে যোগাযোগ করবে কীভাবে?”
সুব্রতর প্রশ্নের কোনো জবাবা দিলো না রুশা। সে তোয়ালে হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে রইল একভাবে, মাথা নুইয়ে। কিছুক্ষণ কেটে গেল নীরবতায়!
সুব্রত অধৈর্য হয়ে দাঁড়িয়ে গেল এবার। গম্ভীর গলায় বলল, “বাড়ি থেকে বের হওয়ার পরপরই আমার সিমটা ভেঙে দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম সবার থেকে যেহেতু দূরের চলে যাচ্ছি, তাহলে এই যোগাযোগের মাধ্যমটাকে বাঁচিয়ে রেখে কী হবে? কারোর প্রশ্নের জবাব দেওয়া কখনোই সম্ভব হবে না আমার দ্বারা। কিন্তু আমার আর অদৃশ্য হওয়া হলো না।” একনাগাড়ে কথাগুলো বলে রুশার অভিব্যক্তি লক্ষ্য করল সুব্রত। ও সোৎসুক ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে। সে আবার বলল, “এখন তুমিও নিজের সিমটা ভেঙে দিলে। কেউ যদি আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে চায়?”
রুশা সঙ্গে সঙ্গে ক্ষিপ্ত গলায় বলল, “আমি চাই না। কারোর সাথে সম্পর্ক রাখতে চাই না আমি।”
“উনারা তোমার পরিবার।”
“আমি মানি না ওদের। যারা আমাকে এতটা আঘাত দিতে পারে, তাঁদের আমি আপনজন বলে গণ্য করি না। আপনি ভাবতে পারবেন না ওরা কতটা নির্যাতন করেছে আমাকে। সাতটা দিন আমাকে ঘরে বন্দী করে রেখেছিল। জোর করে আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছে নিজেদের সিদ্ধান্ত। যারা একবারও ভাবেনি, এতে আমি কতটা কষ্ট পাবো, তাঁরা আবার কীসের পরিবার?” কথাগুলো বলে রুশা ফোঁপাতে শুরু করল। সুব্রতর দিকে এগিয়ে এসে চোখ বড় বড় করে বলল, “খবরদার, যদি আপনি আমার কোনো খোঁজ ওদের দিয়েছেন। যদি আমি বুঝতে পারি আপনি ওদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছেন, তবে আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি, আপনি আর কখনোই আমাকে দেখতে পারবেন না।”
সুব্রত বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল রুশার দিকে। এভাবে আগে কখনো কথা বলে মেয়েটা। আজ যেন একটু ভিন্ন রূপই দেখাল।
কিছুক্ষণ পর রুশা সামান্য শান্ত হলে সুব্রত বলল, “যদি দীপ্ত তোমার অনুসন্ধানে তোমার সিমে ফোন করে, তবে তোমাকে পাবে না; এটা ভেবে দেখেছ একবার?”
রুশা উদাস ভঙ্গিতে বলল, “যদি সত্যিই ও ফোন দিতো, তাহলে কতই না ভালো হতো। আমার মোবাইলের দ্বিতীয় নম্বরটা শুধুমাত্র ওর কাছেই আছে।”
“ওহ্।” সুব্রত অস্ফুটস্বরে বলে উঠল। এরপর মলিন হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ।
রুশা তখন বিছানায় এসে বসেছিল, সুব্রত বসে ছিল টুলে। হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই সুব্রত দাঁড়িয়ে গেল। রুশার দিকে নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইল।
রুশা সুব্রতকে দেখে কিঞ্চিৎ অস্বস্তিতে পড়ে জানতে চাইল, “কিছু বলবেন?”
সুব্রত মুখ গোমড়া করেই বলল, “রক্তিম বলছিল ও আজ ছুটিতে যাবে। নিজের গ্রামের বাড়িতে। আমাদের সাথে নিতে চাচ্ছে।”
সুব্রতর কথা শুনে তাজ্জব বনে গেল রুশা। সে চট করে বিছানা থেকে নেমে বলতে লাগল, “পাগল হয়েছেন আপনি? আমি নিরুপায় হয়ে শুধুমাত্র আপনার সাথে আছি। আর আপনি হানিমুনের পরিকল্পনা করছেন। আমাদের চুক্তিতে তো এমন কিছু ছিল না।”
সুব্রতর মধ্যে অসহায়ত্ব এসে ভর করল। সে নতকণ্ঠে বলল, “আমাকে ভুল বুঝো না, প্লিজ। রক্তিমই হঠাৎ করে বলল।”
“তো?”
“আসলে, আমি তোমার ভালোর জন্যই বলছি। তোমার মানসিক অবস্থা দিনদিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। এখানে থাকলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। যা আমাদের কারোর জন্যেই খুব একটা ভালো হবে না। এই মুহূর্তে তোমার এমন কোথাও অবস্থান করা উচিত, যেখানে থাকলে তুমি সহজেই অতীতের সবকিছু ভুলে যেতে পারবে।”
“দীপ্তকেও?”
সুব্রত অকস্মাৎ হাসল মৃদুস্বরে। সশব্দে বলল, “তুমি যদি সত্যি সত্যিই দীপ্তকে ভুলতে চাও, তবে আমি পৃথিবীর সমস্ত চিকিৎসক-কবিরাজকে তোমার সামনে হাজির করাব। শুধু একবার বলো তুমি ওকে ভুলতে চাও।”
রুশা রেগে গেল এবার। কাছে এসে বলল, “আপনার মাথা ঠিক আছে? কীসব আবোলতাবোল বলছেন? যাকে ভালোবাসি, তাকে ভুলতে চাইবো কেন?”
সুব্রত ভেঙে পড়ল আরও; ক্ষত-বিক্ষত হলো।
রুশা বলতে থাকল, “দেখুন স্যার, আমি জানি আপনার সাথে আমার বিয়ে হয়েছে। আমি আপনার স্ত্রী। যদিও আমি এখনো সম্পূর্ণভাবে আপনাকে ভরসা পারছি না, কিন্তু সেদিন যখন আপনি বললেন আপনার দীপ্তর সাথে আমার দেখা করিয়ে দেবেন, তখন থেকে আমি আশার আলো দেখতে পেয়েছি। আপনার ওই একটা সিদ্ধান্তই ছিল আমার বাঁচার অনুপ্রেরণা। আমি বিশ্বাস করি, আমার উপর আপনার একটা অধিকার আছে। কিন্তু আপনাকেও এটা বিশ্বাস করতে হবে, আমি সারাজীবন দীপ্তকেই ভালোবেসে যাব। আমার মনে শুধুমাত্র ওর অস্তিত্ব থাকবে। ও আমার সকল চিন্তা-ভাবনা, আমার স্বপ্ন। আপনার সাথে আমার কখনোই মনের মিলন হবে না।” রুশা দুই হাত উপরে তুলল সহসা। আকুতি করে বলল, “প্লিজ। আপনি ভুলে যাবেন না, আমি কখনোই আপনাকে মেনে নিতে পারব না। আমার সবটা জুড়ে ওই একজনই আছে, এবং থাকবে। আপনি জানেন না, সেই সম্পর্কের শুরু করে আমরা কতশত স্বপ্ন বুনতে বুনতে এই অব্দি এসেছি। অথচ আজ আমাদের সেই বোনা স্বপ্নগুলোর অনিশ্চয়তার দিকে। আমার মনের অবস্থাটা একটু বুঝার চেষ্টা করুন। প্রয়োজনে আমাকে মারুন বকুন, যা ইচ্ছা করুন। কিন্তু দীপ্তকে ভুলে যেতে বললেন না। যদি কখনো কাউকে মন থেকে ভালোবেসে থাকেন, তাহলে তাকে কী আপনি ভুলে যেতে পারবেন?”
সুব্রত মাথা নামিয়ে মেঝেতে দিকে তাকাল। ধরা গলায় বলল, “না, পারব না।”

চারিদিক নিস্তব্ধ ছিল। দীর্ঘক্ষণ ধরেই এমন মুহূর্ত অব্যাহত ছিল। সুব্রত ব্যালকনিতে, আর রুশা ঘরে। হঠাৎ একটা ফোন রিংটোনের শব্দে দুজনেই চমকে ওঠে। সুব্রত বসা থেকে দাঁড়িয়ে যায়। রুশা নিজের মোবাইল খুঁজতে থাকে। হাতে পেতেই রিসিভ করে কানে ধরল।
ওপাশের কোনো কথাই শুনতে পেলো না সুব্রত। রুশার কথা শুনে বুঝতে পারল, কেউ ওকে দীপ্তর খোঁজ দিয়েছে। কিন্তু কান থেকে ফোন নামিয়ে দেওয়ার সময় রুশাকে বড্ড নিরাশ দেখাল!
সুব্রত ঘরে গিয়ে, রুশার বিমর্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, “কে ফোন করেছিল?”
রুশা নির্বিকারে তাকালো সুব্রতর দিকে। কয়েক সেকেন্ড হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকার পর মলিন সুরে বলল, “গতকাল রাতে দীপ্তর এক বন্ধুকে ফোন করেছিলাম। তখন রিসিভ করেননি। এখন ফোন দিয়ে বললেন, তিনদিন আগে দীপ্তকে একবার দেখেছিল, ওর মায়ের সাথে। তিনদিন আগে, অর্থাৎ বিয়ের দিন।”
সুব্রতর মুখ রক্তশূণ্য ফ্যাকাসে হয়ে উঠল রুশার কথা। শুকনো গলায় জানতে চাইল, “এখন কোথায় আছে দীপ্ত?”
রুশা বলল, “ঠিকানা জানে না। কিন্তু ঢাকায় নেই এটা নিশ্চিত করে বলল। সেদিন নাকি দীপ্ত বলেছে, ও চিরদিনের জন্য ঢাকা ছাড়ছে। তাছাড়া ও দীপ্তর শরীরে বেশ আঘাতের চিহ্নও দেখেছে। নিশ্চয়ই আরিফ ভাই ওকে খুব মেরেছিল বিয়ের আগে।”
সুব্রতর বুক থেকে আবার ভারী শ্বাস নেমে এলো। বুকের ধুকপুকানি কমে এলো। তাঁর মন যেন আজ বড্ড অমানবিক হলো; কিছুতেই চাইছে না রুশা দীপ্তর খোঁজ পাক। এই মুহূর্তে তাঁর বোধগম্য হলো, ভালোবাসা তাকে লোভী করে তুলেছে। অথচ ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ হওয়া উচিত ত্যাগের বিনিময়ে! যেখানে শুধুই পাওয়ার আকাঙ্খা, সেখানে ভালোবাসা কতটা?
খুব কষ্টে নিজেকে সংযত করল সুব্রত। নিজের মনকে জোর করে বোঝাতে চাইল, ভালোবাসার মানুষকে সুখী করাই প্রকৃত প্রেমিকের ধর্ম। আর রুশার সুখ শুধুমাত্র দীপ্তর সংস্পর্শেই নিবদ্ধ! কিন্তু মন তা মানতে নারাজ!
ব্রেকফাস্ট এলো। সুব্রত বা রুশা, কেউই তা স্পর্শ করল না। এর মধ্যে রক্তিম এসে তাগাদা দিয়ে গেল দুবার। সুব্রতর বড্ড ইচ্ছা করছিল রুশাকে নিয়ে রাঙামাটি যেতে। কিন্তু ওকে বিরক্ত করতেও ভয় পাচ্ছিল। তখনকার প্রতিক্রিয়া খুব একটা সুবিধাজনক ছিল না কী-না।
বেশ কিছুক্ষণ দ্বিধাদ্বন্দ্বে জর্জরিত হওয়ার পর সুব্রত সহসা বলে উঠল, “রুশা, রক্তিম অনেক করে বলছে। একবার ভেবে দেখো, এই মুহূর্তে ঢাকায় থেকে কোনো লাভ নেই। দীপ্ত তো ঢাকার বাইরে কোথাও আছে। এতদিন একঘরে বন্দী থেকেছ তুমি। এখানে এসেও তাই। সেজন্যই আমি বলছি, তোমার এখন বিশ্রামের প্রয়োজন। আর তার জন্য একটা সুন্দর জায়গায় যেতে হবে। এখানে থাকলে তুমি অসুস্থ হয়ে পড়বে। তোমার নিজেকেই অদ্ভুত লাগবে তখন। দীপ্তর খোঁজ করতে পারবে না। আমার সাজেশন হলো, অন্তত চার-পাঁচটা দিনের জন্য কোনো খোলামেলা পরিবেশ জীবনযাপন করো, এরপর তুমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে, দীপ্তর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করো।”
সুব্রতর এই কথাগুলোতে খানিক আশ্বস্ত হলো রুশা। সে বলল, “আপনি ঠিক বলছেন? কোনো উদ্দেশ্য নেই তো?”
“নেই। কোনো উদ্দেশ্য নেই।” সুব্রত কণ্ঠ দৃঢ়তর! সে বলতে লাগল, “আমি শুধুমাত্র তোমার কথা ভেবেই এগুলো বললাম। তোমার এই মুহূর্তে যেটা প্রয়োজন, আমি সেটার ব্যবস্থাই করছি। এই একবার বিশ্বাস করে দেখো। কথা দিচ্ছি, আর কখনো কিছু চাইবো না। তোমার এখন শুধুই বিশ্রাম দরকার। কিন্তু সেই পরিবেশ এখানে নেই।”
সুব্রতর কথায় অনেকটাই আশ্বস্ত হলেও বেশ কিছুক্ষণ ইতস্তত করছিল রুশা, কিন্তু শেষ মুহূর্তে রাজি হয়ে গেল।

সকালে হোটেল থেকে বেরোলো সুব্রত, রুশা আর রক্তিম; সন্ধ্যার দিকে পৌঁছাল সেখানে। যে ক’দিন থাকল, মুহূর্তগুলো আর দুর্বিষহ হয়ে উঠল। ওখানে গিয়েও ঘর থেকে বেরোলো না রুশা। ঘরে বসে ইউনিভার্সিটির পরিচিতজনদের অনলাইনে খুঁজতে লাগল, তাঁদের ফোন করে দীপ্তর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করল। কিন্তু ফলাফল প্রতিবারই হতাশার হলো। আর এইসবের মধ্যে দিয়ে রুশার শারীরিক এবং মানসিক, দুই অবস্থারই অবনতি হতে থাকল। যে ক্রমেই যান্ত্রিক হতে শুরু করল। সুব্রত খুব একটা সুবিধা করতে পারে না এই ব্যাপারে। রুশা তাঁর সাথে কথা খুব কম বলে। কিছুর প্রয়োজন হলে সে রক্তিমকে বলে, সুব্রতর থেকেও সে রক্তিমের প্রতি বেশি আস্থাশীল। এই ব্যাপারগুলো সুব্রতকে খুব ব্যথিত করে। কিন্তু নীরবে-নিভৃতে সহ্য করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারে না সে। বরাবরই তাঁর নিজেকে অপরাধী মনে হয়। রুশার চোখের জল তাকে আরও দগ্ধ করে। ভেতরে ভেতরে সে খুব পুড়ে। এভাবেই ৫ দিন কেটে যাওয়ার পর তাঁরা বাড়িতে ফিরে আসে। এরপর শুরু হয় আরেক অশান্তি৷ নানান জনের নানান প্রশ্ন। সারাক্ষণ এসব উপেক্ষা করার উপায় খুঁজতে থাকে সে। কিন্তু লাভ হয় না খুব একটা। রুশাও নির্লিপ্ত! সবদিক একা সামলাতে গিয়ে ক্রমশ সে-ও যান্ত্রিক হয়ে উঠে। তাঁর রাত কাটে ‘স্টাডি’ রুমে নিদ্রাহীন সময় কাটিয়ে, আর নেশা করেই। এরপর রাতের অন্ধকার ভেদ করে শহরে আলো আসে। কিন্তু তাঁর জীবন সেই অন্ধকারাচ্ছন্নই থেকে যায়। এভাবে কেটে বেশ কয়েক দিন; বিয়ের দেড় মাস পূর্ণ হয়।

একদিন বিকেলের আগেই অফিস থেকে ফিরল সুব্রত। দরজা খুলে দিলো সুলতানা। সুব্রতকে দেখে বলল, “ভাইজান, আপনি আজ এত তাড়াতাড়ি চলে এলেন যে?”
সুব্রত জবাবে বলল, “এমনিই।” এরপর ভিতরে ঢুকে জানতে চাইল, “রুশা দুপুরে খেয়েছে?”
সুলতানা কিছু বলল না জবাবে। মাথা নিচু করে ফেলল।
জবাব না পেয়ে সুলতানার দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকালো সুব্রত। আবার বলল, “কী হলো সুলতানা? চুপ করে আছিস কেন?”
“আসলে ভাইজান।” সুলতানাকে খুব ভীত দেখাল। ও কথা সম্পূর্ণ করতে পারল না।
সুব্রত মনে এবার শঙ্কা তৈরি হলো। সে উপরের দিকে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বলল, “রুশার কিছু হয়নি তো?”
সুব্রতর কথা শেষ হতেই সুলতানা বলে উঠল, “ভাবি তো বাড়িতেই নাই।”
“বাড়িতে নেই মানে?” সুব্রত হতভম্ব! জানতে চাইল, “কোথায় গেছে?”
“তা জানি না, ভাইজান। ভাবি তো মাঝেমধ্যেই কোথায় যেন যায়। সকালে যায়, বিকেলে, আপনি আসার ঠিক আগে ফেরে৷ আজ আপনি তাড়াতাড়ি চলে এলেন।”
“অদ্ভুত তো! ও যে বেরোয়, এ কথা তুমি আগে আমাকে বলোনি কেন?” সুব্রত সহসাই চড়াও হলো সুলতানার প্রতি।
সুলতানা কেঁপে উঠল সুব্রতর ধমকে। ভয়ে চুপসে গেল সে। তখনই সোফায় নীরবে বসে থাকা দীপালি বেগম উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, “বললে কী হতো? বউকে শায়েস্তা করতি? আরও আগেই মারতি?”
সুব্রত কাকির দিকে তাকাল। চিন্তান্বিত ভঙ্গিতে বলল, “অদ্ভুত তো! এখানে মারার কথা আসছে কেন? আমি ওকে কেন মারতে যাবো?”
দীপালি বেগম আরও উচ্চস্বরে বললেন, “সেটা তোরাই ভালো জানিস। বিয়ের পর তো কম লীলা দেখালি না। বিয়ের পর থেকে শুনে এসেছি এই বংশের পুরুষেরা কখনো স্ত্রীদের গায়ে হাত তোলেনি৷ তুই তো বংশের মান-সম্মান ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছিস। তোর বউয়েরও দোষ আছে। কখনো দেখি ঘরে বসে কান্নাকাটি করছে। কখনো হুটহাট করে, কাউকে না বলে বেরিয়ে যাচ্ছে। এমন বউ বাপু জীবনে দেখিনি। শরীরের যা অবস্থা করেছে, লোকে দেখলে বলে, ‘কী গো, বউমানে খেতে দেও না? সারাদিন কাজই করাও?’ অথচ তোর বউ সংসারের কোনো কিছুতে হাত দেয় না।”
কাকির অভিযোগপূর্ন কথাগুলো শুনে থিতিয়ে গেল সুব্রত। সে নীরব হয়ে গেল। কিন্তু রুশা মাঝেমধ্যে যায় কোথায়? বাপের বাড়িতে? অসম্ভব! ভাবনাগুলো মাথাতে আসতেই তাঁর ভেতর পুড়তে শুরু হয়।
সেদিন রুশা একটু দেরি করেই ফিরল বাড়িতে, সন্ধ্যায়। তখন বসে বসে ভাবছিল সুব্রত। রুশা আসতেই সে গম্ভীর গলায় জানতে চাইল, “কোথায় গিয়েছিলে, রুশা?”
রুশা ক্লান্ত চোখে সুব্রতকে দেখল একবার। কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে রেখে বলল, “কখন এসেছেন আপনি? বড্ড দেরি হয়ে গেল আজ।”
সুব্রত আবারও একই প্রশ্ন করল, “কোথায় গিয়েছিলে?”
রুশা নতকণ্ঠে বলল, “দীপ্ত যে লোকগুলোর সাথে রাজনীতির করতো, তাঁদের সাথে দেখা করতে। দীপ্তর ব্যাপারে জানতে চাইলাম। যদি বাঁচতে হয়, তবে কামাতে হবে। দীপ্ত রাজনীতি ছাড়া আর কিছু পারে না। ভেবেছিলাম উনারাই হয়তো কোথাও ব্যবস্থা করে দিয়েছে ওকে। কিন্তু প্রতিবারের মতোই হতাশ হলাম। উনারা বললেন, দীপ্ত ঢাকা ছাড়ার সময় উনাদের থেকে বিদায় পর্যন্ত নেয়নি।”
সুব্রতর দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলছিল রুশা; শেষ করে দেখল, সুব্রতও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে তীব্র বিরক্তি। সে আবার বলল, “কী হলো?”
সুব্রত আগের মতোই গম্ভীরমুখে বলল, “এভাবে আর কতদিন, রুশা?”
“মানে?” রুশা বড় আশ্চর্য হলো সুব্রতর কথা শুনে।
সুব্রত শক্ত গলায় বলল, “এভাবে তুমি শুধু নিজেকেই কষ্ট দিচ্ছ না, বরং আমাদের সবাইকে মসিবতে ফেলছ। প্লিজ, এবার থামো। দীপ্তর যদি তোমার কাছে ফেরার হতো, তবে তোমাকে এত খুঁজতে হতো না। ও তোমাকে খুঁজে বের করতো।”
সুব্রতর কথা শুনে রুশার মাথায় বাজ ভেঙে পড়ে। সে ভেবেছিল যতদিনই হোক, সুব্রতর সাপোর্ট সে পাবে। অথচ এত তাড়াতাড়ি অধৈর্য হয়ে উঠল সে-ও। বিরক্তি প্রকাশ করল।
রুশা অবিশ্বাসের চোখে দেখছিল সুব্রতকে। সুব্রত এর মনের কথা বুঝতে পেরে বলল, “আমাকে ভুল বুঝো না। আমি সবার ভালোর জন্যই বলছি। দীপ্তকে তুমি ভুলে যাও। এতে মোঙ্গল হবে সবার।”
সুব্রতর কথা শুনে মুখ ফিরিয়ে নিলো রুশা। তাঁর দুই চোখে পানি চলে এলো। এমনসময় দরজার বাইরে থেকে সুলতানার গলার আওয়াজ এলো।
“ভাইজান, খালু আপনারে ডাকে।” দরজার বাইরে থেকে বলল সুলতানা।
সুব্রত রুশার দিকে একপলক দেখে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। বাইরে এসে বলল, “ছোট কাকা কেন ডাকছে এখন?”
সুলতানা বলল, “জানি না, ভাইজান। ছোট ভাইজানও আছে। বোধহয় অফিসের কোনো দরকারে।”
সুব্রত পায়ে ঠকঠক আওয়াজ করে চলে যেতেই সুলতানা দ্রুত ঘরে ঢুকে পড়ল। নিজ চোখেই দেখল, রুশা কাঁদছে। সে পাশে গিয়ে বলল, “ভাইজান আজও আপনাকে মেরেছে, না ভাবি?”
রুশা চোখ মুছে তাকালো সুলতানার দিকে। কান্না জড়ানো গলায় বলল, “তুমি এখন যাও, সুলতানা।”
সুলতানা ঠায় বসে থেকে বলল, “জানেন ভাবি, ভাইজান আগে এইরকম ছিল না। আমাকে কত স্নেহ করতো। এখন শুধু ধমকায়। বিয়ের পর কী যে হলো ভাইজানের। আমি আগে জানতাম অশিক্ষিতরা মাতাল হয়ে বউ পেটায়, কিন্তু এখন দেখছি শিক্ষিতরাও বউদের মারে। না জানি আরও কতকিছু দেখা বাকি আছে।”
রুশা বিরক্ত হয়ে বলল, “প্লিজ। আমাকে একা থাকতে দাও। প্লিজ।”
আর বসে থাকল না সুলতানা। যেভাবে এসেছিল, সেভাবেই বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।
এই পর্যন্ত সব থমথমে থাকলেও কিছুদিন পর সবচেয়ে বড় ঝড়টা হানা দিলো সুব্রত আর রুশার জীবনে। তাঁদের জীবনটাই পাল্টে গেল সেদিন। দুজনেই নিক্ষিপ্ত হলো অন্ধকার জগতে; একজন কবরে, অন্যজন কারাগারে!

৪০তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=855110858766949&id=100028041274793

বি:দ্র: আমাগীকাল মৃত্যু রহস্য প্রকাশিত হবে, ইনশাআল্লাহ।

দীর্ঘসময় নিয়ে লেখার পর আর চেক দেওয়ার মুড নাই। অল্পই লেখা। অথচ কীভাবে যে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কেটে যায়, বুঝতেই পারি না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here