প্রস্থান — ১৮তম পর্ব।

0
480

প্রস্থান — ১৮তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

সুব্রত অবিশ্বাসের চোখে দেখছে রশ্মিকে। হিসেবে মেলাতে পারছে না সে। তাঁর এক হাতে সিগারেট, অন্য হাতে চা। দোকানের বেঞ্চিতে একাকী বসে আছে। রশ্মি ঠিক তাঁর সম্মুখে দাঁড়িয়ে আছে। দোকানে আসার সময় তাকে খেয়াল করেনি। ব্যাক সাইড দেখলেও চিনতে পারেনি। পারলে নিশ্চয়ই আসতো না!
রশ্মি ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সুব্রত শান্ত গলায় বলল, “বসো।”
রশ্মি বসল না। আমতা আমতা করতে লাগল, “আসলে সুব্রত ভাই..। মানে..। আমি।”
“বসো বলছি।”
সুব্রত ঈষৎ ধমকাল এবার। সাথে সাথে চমকে ওঠে বসে পড়ল রশ্মি, সুব্রতর ঠিক সামনের বেঞ্চে। সিগারেটে একটা টান দিয়ে সুব্রত বলল, “এটা কীসের জন্য, রশ্মি?”
রশ্মি নতকণ্ঠে বলল, “আসলে, সুব্রত ভাই।” থেমে গেল সে।
সুব্রত সাবধান করল আগেই, “ভুলেও অস্বীকার করো না যে, এটা অন্য কারোর। যে মেয়ে ঘর থেকে তেমন বের হয় না, সেই মেয়ে অন্য কারোর জন্য সিগারেট কিনতে আসবে, এটা আমার বিশ্বাস হবে না কখনোই। এছাড়া তোমার কাছের এমন কেউ নেই, যে তোমাকে এটা কিনতে পাঠাবে।” এরপর চোখ কটমট করে সে বলল, “সত্যি বলো, রশ্মি। এটা তোমার জন্য, তাই না?”
রশ্মি জবাব দিতে পারল না। লজ্জায় একেবারে কোনঠাসা হয়ে পড়েছে সে। মাথা কিছু করে বসে আছে কোনোক্রমে! সুব্রত ওকে এমন নির্বিকার দেখে যা বুঝার বুঝতে পেরে বলল, “ছি রশ্মি! আমি কখনো কল্পনা করিনি তুমি এমন কিছু করবে। তোমাকে কত ভদ্র মেয়ে ভাবতাম আমি। যখন তুমি ছোট, তখন থেকে দেখছি, তোমার মতো শান্ত মেয়ে এই অঞ্চলে দুটো নেই। কখনো কারোর সাথে উচ্চস্বরে কথা বলতে দেখিনি। সেই তুমি কী-না আজ নেশা করছ।”
রশ্মির হাত-পা কাঁপছে। মায়ের সামনেও এতটা কুণ্ঠাবোধ হয়নি তাঁর। সে নিশ্চুপ থাকল আগের মতোই।
সুব্রত আবার বলল, “তুমি জানো, সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য কতটা ক্ষতিকর? এটা মরণব্যাধি একটা নেশা। এটা খেলে বেশিদিন বাঁচতে না তুমি।”
“আপনিও তো খান।” মাথাটা সামান্য উঁচু করল রশ্মি; এই ভেবে, সে সাহস করে কথা বলতে পেরেছে। এবার বলতেই থাকবে। “আপনি বুঝি এটা খেয়েও অনেকদিন বাঁচবেন? এটা আপনার জন্য ক্ষতিকর না? তাছাড়া আপনি আরও বড় নেশা করেন। আপনার জানালা নিচে যে ঝোপটা আছে, সেখানে একদিন আমি মদের বোতল দেখেছিলাম। কাউকে বলিনি অবশ্য। কিন্তু এমন কেন, আপনি খেতে পারবেন, আর আমি খেতে পারব না?”
সুব্রত হতবিহ্বল হয়ে গেল রশ্মির কথা শুনে। বলে কী এই মেয়ে? তাঁর খাওয়া আর ওর খাওয়া এক হলো? সে বিস্মিত চোখে তাকিয়ে থেকে বলল, “এইসব কী বলছ তুমি? আমি খাই বলে তুমিও খাবে? আমি খাই এই কারণেই, যেন খুব তাড়াতাড়ি আমি মরে যাই। তুমি খাও কীজন্য?”
রশ্মি বিবর্ণমুখ করে বলল, “আমিও আর বাঁচতে চাই না।”
সুব্রতর মুখ আরও শক্ত হলো। বলল, “এইসব কী বলছ তুমি? তোমার এত কীসের কষ্ট, যে তুমি নিজেকে এভাবে শেষ করতে চাইছো?”
“আপনার এত কীসের কষ্ট? রুশা ভাবির জন্য কষ্ট হয়? এখন কষ্ট পেয়ে লাভ কী? তখন তো উল্টো তাকেই কষ্ট দিয়েছেন।”
সুব্রত রাগান্বিত হয়ে রশ্মির কাঁধে শক্ত করে হাত রাখল। ওকে ঝাঁকিয়ে বলল, “তুমি নিজের চোখে দেখেছ, আমি রুশাকে কষ্ট দিয়েছি? দেখোনি তো। শুনেছ শুধু।”
রশ্মি এবার চোখে চোখ রেখে বলল, “দেখেছি। আমি নিজের চোখে দেখেছি। যে স্বামী স্ত্রীকে রেখে মাঝরাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে নেশা করে, সেই স্ত্রী সুখে থাকবে আপনি ভাবলেন কীভাবে? আমি নিজের চোখে দেখেছি, একবার না, অসংখ্যবার রুশা ভাবি আপনাকে নেশা করতে বারণ করেছে। কিন্তু আপনি তাঁর সাথে খারাপ আচরণ করেছেন। সে আপনাকে বাঁধা দিয়েছিল বলে আপনি তাকে আঘাত করেছেন। আমি ঘরের জানালা দিয়ে স্ব-চোখে দেখেছি এইসব।”
সুব্রত কিছু বলতে পারল না জবাবে। নির্লিপ্ত হয়ে পড়ল সহসা। কিন্তু তাকে দেখে রশ্মির ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। লোকটা এখানেই দুর্বল, বড্ড বেশি! পাপী পাপকে ছেড়ে দিলেও পাপ পাপীকে ছেড়ে দেয় না। ক্ষণেক্ষণে শিক্ষা দেয়। তাকে উপলব্ধি করায়, সে ভুল করেছে। যেমন সুব্রত ভাই।
রশ্মি ওঠে যাচ্ছিল, সুব্রত শান্ত গলায় জানতে চাইল, “কোথায় যাচ্ছ?”
“তা জেনে আপনার কী কাজ?”
“আমার সাথে চলো। গাড়ি আছে আমার সাথে।”
“আমি আপনার সাথে যাচ্ছি না। একা এসেছি, একাই যেতে পারব।”
এ-কথা বলে দোকান থেকে বেরোতে যাচ্ছিল রশ্মি, তখনই হাতে টান পড়ল। সে তাকিয়ে দেখল, সুব্রত ভাই হাতটা ধরে। বেশ শক্ত করে, যেন ছুটতে না পারে। সে ভুরু কুঁচকে বলল, “কী হলো, সুব্রত ভাই।”
সুব্রত সহসা ওঠে, পকেট থেকে কিছু টাকা বের করে দোকানীকে দিয়ে রশ্মির হাত ধরে রাস্তায় নেমে এলো। এরপর হাঁটতে হাঁটতে বলল, “তুমি আমার সাথেই যাচ্ছ। তোমাকে একা ছাড়লে তুমি সিগারেট খাবে। এটা আমি হতে দিচ্ছি না।”
কিছু বলতে পারল না রশ্মি। এভাবে হাত ধরে কেউ তাকে সঠিক পথে টেনে নেয়নি। এমনকি মা-ও না। তাঁর তো সেই সময় নেই।
এইসব ভাবতে ভাবতে সুব্রত সাথে হাঁটতে লাগল সে। হঠাৎ সুব্রত বলল, “তুমি খেয়াল করেছ, সিগারেট খেয়ে তোমার ঠোঁট কেমন শুকিয়ে গেছে৷ রঙ পালটে গেছে। মেয়েদের এভাবে দেখতে পছন্দ করে না কেউ। সভ্য মেয়েরা রূপের যত্ন নেয়। ঠোঁটেরও।”
রশ্মির ঠোঁট কেঁপে উঠল। সুব্রত ভাই তাঁর ঠোঁটের রং খেয়াল করেছে, এটা কল্পনা করে তাঁর শরীর শিহরিত হলো। মানুষটা কখন তাকে দেখল অমন মনোযোগ দিয়ে? সে তো বুঝতেই পারেনি।
রশ্মিকে নিশ্চুপ দেখে সুব্রত আবার বলল, “তোমাকে এই অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। এখন থেকেই।”
“যদি না করি?” রশ্মির মুখ ফসকে এমন ত্যাড়া কথা বেরিয়ে এলো অকস্মাৎ! সে এটা বলতে চায়নি!
সুব্রত দাঁত খিঁচিয়ে বলল, “আমি তোমার মা-কে জানাবো পুরো ব্যাপারটা। তাকে জিজ্ঞেস করব, মেয়েকে এতটা বেপরোয়া হওয়ার সুযোগ তিনি কেন দিলেন?”
রশ্মির ভীষণ হাসি পেলো এই মুহূর্তে। অনেক কষ্টে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখল সে।

দোকান থেকে খানিক সামনেই একটা ফাঁকা জায়গা, সেখানেই গাড়িটা পার্ক করে রেখেছিল সুব্রত। রশ্মিকে নিয়ে ড্রাইভিং সিটের পাশে সিটে বসিয়ে দিলো সে। এরপর নিজে গাড়িতে ওঠে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলো।

সেদিন রাতে সিগারেট ছোঁয়া থেকে বিরত থাকল রশ্মি।

২৩.
এর কয়দিন পরের ঘটনা, এক রাতে ডিনারে সামান্য আগে। রান্না তখনো পুরোপুরি শেষ হয়নি। খালেদ সাহেব, ফিরোজ এবং দীপালি বেগম তখন ড্রয়িংরুমে গুরুত্বপূর্ণ এক মিটিং করছে। চিত্রা আর সুলতানা রান্নাঘরে। চিত্রা একটা একটা করে আইটেম টেবিলে রাখছিল, সেসময় তাঁর কানে এলো শ্বশুর মশাইয়ের উচ্চস্বরের কথা।
খালেদ সাহেব বললেন, “না না দীপালি এটা হয় না। জমিটা ভাইজান কিনেছিল। ওটা এখন সুব্রতর। ওই জমিতে আমি হাত দিতে পারব না।”
স্বামীর কথা শুনে দীপালি বেগম রেগেমেগে বললেন, “তোমার বড় ভাই তো আর ওই জমি হাওয়া দিয়ে কিনেনি। কিনেছিল টাকা দিয়ে। আর সেই টাকা কোথা থেকে পেয়েছিলে? তুমি বিদেশে থেকে টাকা পাঠিয়েছিলে, আর সেই টাকা দিয়ে উনি জমি কিনে নিজের নামে করেছিলেন। তোমাকে বোকা পেয়ে ঠকিয়েছিল উনি। আজ যখন নতুন ফ্যাক্টরির জন্য জমিটা তোমার প্রয়োজন, তখন কেন তুমি ওটা ব্যবহার করবে না।”
“দেখো দীপালি, আমার ভাইজানকে নিয়ে উল্টো পাল্টা কথা বলবে না। আমাকে ঠকিয়েছিল মানে? আমাকে বিদেশে পাঠিয়েছিল কে? উনিই নিজের পকেটের টাকা খরচ করে আমাকে পাঠিয়েছিলেন। আর আমি নিজেই বলেছিলাম জমিটা উনার নামে করতে। আমার দেওয়া উপহার ছিল ওটা।”
ফিরোজ বসে ছিল নীরবে, বাবার কথা শুনে বলল, “কিন্তু বাবা, ওই জমিটা ছাড়া আমাদের আর এমন জমি নেই, যেখানে ফ্যাক্টরিটা করা যেতে পারে। আজ কাজটা এখন খুবই জরুরি। না হলে হবে না।”
খালেদ সাহেব জোর গলায় বললেন, “জরুরি হোক। তবুও সুব্রতর জমি নেওয়া যাবে না। ও যদি কখনো নিজের জন্য কিছু করতে চায়, তখন জমি কোথায় পাবে? প্রয়োজনে আমরা এই মুহূর্তে কোনো কারখানা ভাড়া নিবো। জমিও কিনতে পারি।”
“সেটা সময়সাপেক্ষ, বাবা। অত সময় নেই আমাদের হাতে। খুব তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করতে হবে। না-হলে সময়মত অর্ডার ডেলিভারি দিতে পারব না। তাছাড়া জমি কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থ আমাদের কাছে নেই। আর এই মুহূর্তে লোন নেওয়া খুবই রিস্কি পদক্ষেপ, যা একেবারেই করা যাবে না।”
খালেদ সাহেব নিচের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমরা বুঝতে পারছ না। সুব্রত এমনিতেই আমাকে পছন্দ করে না। আমার উপর ওর ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি। এই মুহূর্তে আমি ওকে কিছুতেই বলতে পারব না জমিটার কথা।”
দীপালি বেগম রাগে গজগজ করে বললেন, “বেশি বুঝতে যেও না। ওকে এত গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। জমিটা তোমার টাকায় কেনা। কষ্টের উপার্জনের টাকা। ওর নামে আছে বলেই কী সব ক্ষমতা ওর হাতে? ওর বাপ-মা মারা যাওয়ার পর যে ওকে খাইয়েছ-পড়িয়েছ, এগুলো কিছুই না?”
খালেদ সাহেব বিমর্ষ গলায় বললেন, “যখন তোমরা কেউ ছিলে না, যখন আমার কিছুই ছিল না, তখন ওর ওই বাপ-মা-ই আমাকে দেখে রেখেছিল। উনাদের অনুপস্থিতিতে আমি উনাদের ছেলের দেখাশোনা করব না? সেজন্য বিনিময়ে জমি নিবো? তাছাড়া আমি তো নিজের দায়িত্ব পালন করতে পারিনি পুরোপুরি। তোমরা আমার জীবনে আসার পর থেকেই ওর সাথে আমার সম্পর্কের দূরত্ব বেড়েছে। আজ যদি আমাদের সম্পর্কটা ঠিক থাকতো, তাহলে এত ভাবতে হতো না।”
রান্না করা সকল আইটেম টেবিলে সাজানো শেষ। চিত্রা টেবিলের কাছ থেকে সোফার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “এখনো এত ভাবতে হতো না, বাবা, যদি আমরা সুব্রত ভাইকে সামান্য গুরুত্ব দিতাম। কোনো মানুষই এটা সহ্য করতে পারে না, যে তাঁর পরিবার তাকে গুরুত্বহীন ভাবুক। আর সেখানে আমরা তো সুব্রত ভাইকে নিজের পরিবারের কেউই মনে করি না।”
ফিরোজ চোখ বড় বড় করে তাকালো চিত্রার দিকে। চিত্রাও তাকাল একবার, স্বাভাবিক দৃষ্টিতে।
পাশ থেকে দীপালি বেগম বললেন, “কী বলতে চাচ্ছ, বউমা?”
চিত্রা চোখ পিটপিট করে ধীর গলায় বলল, “মাঝখানে কথা বলার জন্য মাফ করবেন, বাবা। কিন্তু আমার মনে হয়, এই আলোচনাটা যদি সুব্রত ভাইয়ের সামনে হতো, তাহলে ‘প্রয়োজন’ বুঝতে পেরে উনি নিজেই হয়তো বলতেন জমিটার কথা।”
খালেদ সাহেব বললেন, “আমি তোমার কথাকে পূর্ণ সমর্থন করছি, মা। কিন্তু সুব্রত কী আমাদের সাথে বসতে চাইবে?”
চিত্রা সোৎসাহে বলল, “আমরা চেষ্টা করে দেখতে পারি, বাবা৷ মনে নেই, সেদিন যখন অর্ডারটার খবর হলো, আমরা রেস্টুরেন্টে খেতে গেলাম। সুব্রত ভাইকে অনুরোধ করতেই আমাদের সাথে যেতে রাজি হলো।”
দীপালি বেগম ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, “তুমি কী বলতে চাইছো, আমাদের এখন হাতে-পায়ে ধরে বলা উচিত, আমাদের পাশে একটু বসো?”
চিত্রা অসহায় চেহারা করে শ্বশুরের দিকে তাকাল। খালেদ সাহেব তা বুঝতে পেরে বললেন, “ও সেটা বলতে চায়নি, দীপালি। ও বলতে চাইছে..।”
এর মধ্যেই কলিংবেল বেজে উঠল। খালেদ সাহেব থেমে গেলেন। সুলতানা রান্নাঘরে থেকে বেরিয়ে সদর দরজা খুলে দেখল, সুব্রত ভাই দাঁড়িয়ে আছে। ও সরে দাঁড়াতেই উনি ভিতরে ঢুকলেন।
সুব্রত আড়চোখে ড্রয়িংরুমের গাম্ভীর্যতা লক্ষ্য করে নির্বিঘ্নে উপরের দিকে যাচ্ছিল, তখন দীপালি বেগম হঠাৎ বলে উঠলেন, “সুব্রত, শুনে যাও।”
সুব্রত দাঁড়াল। পিছনে তাকালো না।
দীপালি বেগম বিরক্ত হলেন। দাঁত খিঁচিয়ে বলতে লাগলেন, “সেদিন যে অর্ডারটা এসেছিল, সেটার পর আরও কয়েক জায়গা থেকে অর্ডার এসেছে। বেশ বড়ই। এতগুলো কাপড় তৈরি করার জন্য পর্যাপ্ত জায়গা আমাদের অফিসে নেই৷ সেজন্য একটা কারখানার প্রয়োজন। আমরা চাচ্ছি হাইওয়ের পাশে যে জমিটা আছে, সেটাতে কারখানা তৈরি করতে। কারখানার জন্য জায়গাটা সুবিধাজনক। আশেপাশে জনবসতি নেই তেমন।”
সুব্রত হঠাৎ ঘুরল হঠাৎ, চমকে গেছে, এমন চেহারা করে বলল, “মানে? আপনারা চাইলেই হবে? জমিটা আমার, আর সেখানে কী হবে, তার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন আপনারা?”
“জমিটা তোমার বাবা কিনেছিল কীভাবে, সেটা তো দেখতে হবে।” দীপালি বেগম বেশ ইঙ্গিতপূর্ণ ভাবে বললেন।
সুব্রত এবার তাকাল্য খালেদ সাহেবের দিকে। ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে বলল, “বাহ্! দেখিয়ে দিলেন তো নিজের আসল রূপ! সেদিন ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি, আমাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যাওয়ার পিছনে এইরকম জঘন্য উদ্দেশ্য আছে আপনাদের। আপনাদের পুরো পরিবারের মতলবটা আমি আজ বুঝতে পারছি। এইসব তাহলে আমার জমির দখল নেওয়ার ধান্দা!”
ফিরোজ দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করল, “মুখ সামলে কথা বল। আমার সামনে আমার বাবা-মা কে অপমান করিস কোন সাহসে?”
“ওই চুপ!” আচমকা গর্জে উঠল সুব্রত। তাঁর ধূসর রঙের চোখ দুটো যেন ক্রোধের আগুনে হলুদ হয়ে এলো, আস্তে আস্তে লাল! সে ফিরোজের দিকে তাকিয়ে রাগে গজগজ করে বলতে লাগল, “তোর জন্মের পর, তোর বাবার পর আমিই প্রথম তোকে কোলে নিয়েছিলাম। এটা ভেবে খুশি হয়েছিলাম, এবার অন্তত আমাকে একা থাকতে হবে না। একটা ভাই হয়েছে আমার। ছোটবেলায় আমার সাথে থাকার জন্য কান্নাকাটি করতি। আর আজ আমাকে চোখ রাঙাচ্ছিস। এত দুঃসাহস! চুপচাপ বসে থাক ওখানে।” এরপর সুব্রত খালেদ সাহেবের দিকে তাকাল পূনরায়। একই সুরে বলল, “আপনি সবসময় বলেন না, আমি পরিবারের একজন। পূর্বেই তো দিয়েছেন এর পরিচয়। সম্পত্তির জন্যই তো আমাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। আপনারা সবাই আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়ে আমাকে ৫ বছর জেল খাটিয়েছেন। আমার বাবা-মা বেঁচে থাকলে অমন কাজ করতো? নাকি সর্বপ্রথম আমাকে বুঝতে চেষ্টা করতো। সত্যি-মিথ্যে যাচাই করতো। আপনারা না পারবেন আমার বাবা-মা হতে, না পারবেন আমার পরিবার হতে। সবসময় নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবেছেন। আজও ভাবছেন। সম্পত্তি আমার, অথচ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন আপনারা।”
কথাগুলো বলে আর দাঁড়াল না সুব্রত, দ্রুত বেরিয়ে গেল বাড়ি থেকে।
ফিরোজ নির্লিপ্ত! দীপালি বেগম ফুসছেন রাগে। খালেদ সাহেব মাথা নিচু করে শুনছিলেন এতক্ষণ। সুব্রত চলে যেতেই তিনি নির্বিকার ভাবে সোফা থেকে ওঠে নিজ ঘরের দিকে গেলেন। গোটা ড্রয়িংরুম থমথমে ভাব! চিত্রা দেখল, খালেদ সাহেব সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে চোখ মুছছেন। দেখে তাঁর ভীষণ কষ্টবোধ হলো। তাঁর চোখও ঝাপসা হয়ে এলো।

রাত ১০টার দিকে যখম সুব্রত ফিরে এলো, তখন অপেক্ষরত চিত্রা দরজা খুলেই এতক্ষণ ধরে পুষে রাখা ক্ষোভটা প্রকাশ করল। সে বলতে লাগল, “আপনি কেমন মানুষ, সুব্রত ভাই? আপনার হৃদয় কঠিন, তা জানা ছিল। কিন্তু এত খারাপ আপনি! সবাইকে বললেন আপনাকে বুঝতে, অথচ নিজে যে ওই বয়স্ক মানুষটাকে বুঝতে বিন্দুমাত্র চেষ্টা করেননি, সেটা কিছু না। কথাগুলো বলার সময় একবারও কী আপনার ভালো করে মানুষটার দিকে তাকাননি? এই বাড়ির সবচেয়ে বয়স্ক একজন মানুষ উনি। কেন মাথা নিচু করে আপনার কথাগুলো শুনলো? চাইলেই কি পারতো না প্রতিবাদ করতে? আপনার অপমান ফিরিয়ে দিতে? তা করেনি, কারণ আপনি কষ্ট পাবেন বলে। আপনি জানেন, একমাত্র উনিই বলেছিলেন, ওই জমিতে হাত দিবেন না। ওটা আপনার জমি। আপনার ভবিষ্যৎ! ওটা আপনার বাবাকেই উনি উপহার দিয়েছিলেন। আপনি আমার স্বামী আর শাশুড়িকেও অপমান করলেন। উনারা আপনাকে পছন্দ করেন না ঠিক, কিন্তু তাই বলে আপনি এটা বলবেন, উনারা আপনার সম্পত্তি দখল করতে চায়? যদি এমনই উদ্দেশ্য থাকতো, তবে কী কাজটা আগেই করতে পারতো না, যখন আপনি ৫টা বছর জেলখানায় ছিলেন? গোটা পরিবারকে আপনি লোভী বলে অপমান করলেন? এটা ঠিক না, সুব্রত ভাই। আপনি যদি একবার দেখতেন বাবা কেমন নির্বাক হয়ে গেছিল আপনার কথা শুনে, তাহলে হয়তো উনার কষ্টটা বুঝতেন। আজ খুব খারাপ কাজ করেছেন আপনি, সুব্রত ভাই।”
দরজার বাইরে দাঁড়িয়েই চিত্রার কথা শুনছে সুব্রত। একটা শব্দই মুখে উচ্চারণ করেনি।
সুব্রত ভাইকে নীরব থেকে চিত্রা ধরা গলায় বলল, “যতদিন ধরে বাড়িতে এসেছি, আজকের আগে আমি কখনো বাবাকে কাঁদতে দেখিনি, সুব্রত ভাই। আমার খুব ঘৃণা হচ্ছে আপনার প্রতি। আপনি ওই মানুষটাকে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে কাঁদিয়েছেন। ছি সুব্রত ভাই, ছি! নিজেকে খুব মহান ভাবেন আপনি, অথচ একজন মহান মানুষকে চিনতে পারলেন না।” একনাগাড়ে কথাগুলো কথাগুলো বলে চিত্রা ঠিক সেভাবেই নিজের ঘরের দিকে যেতে লাগল, যেভাবে সুব্রত ভাই রাগ দেখিয়ে বেরিয়ে গেছিল বাড়ি থেকে।
চিত্রা চলে যাওয়ার পরও সুব্রতর মাথাটা ঝিমঝিম করতে লাগল। আজ অব্দি কেউ তাঁর চোখে চোখ রেখে এভাবে ঠিক-ভুল দেখানোর চেষ্টা করেনি। চিত্রাই প্রথম দুঃসাহসটা দেখাল! সে ভিতরে ঢুকে দেখল, সুলতানা তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। চোখ চোখ পড়তেই মেয়েটা বলে উঠল, “ভাবি ঠিক কথা বলছে ভাইজান। সত্যিই খালুজান বারবার বলছে, ওই জমিতে হাত দিবে না।”
সুলতানা সদর দরজা আটকিয়ে নিজের ঘরে চলে যাওয়ার পর ধীর পায়ে উপরে ওঠে গেল।

১৮তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=835494350728600&id=100028041274793

বি:দ্র: মাত্রই লিখে পোস্ট দিলাম। চেক দেওয়া হয়নি। টাইপিং মিস্টেক হতে পারে। আর বাক্যে অসংগতি দেখা দিলে অবশ্যই বলবেন আমাকে। আমি এডিট করে নিবো। পুরোটা চেক দিতে একটুও মন চাচ্ছে না।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here