প্রস্থান — ১৭তম পর্ব।

0
489

প্রস্থান — ১৭তম পর্ব।

রিফাত হোসেন।

২১.
তখন বিকেল, দিনটি শুক্রবার। পশ্চিমাকাশে সূর্য হেলে পড়েছে। শহর থেকে উত্তাপ কমেছে। সূর্য রঙ বদলাচ্ছে আস্তে আস্তে। বাতাস হালকা। সুব্রত একটা কালো রঙের টি-শার্ট আর ট্রাউজার পরে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। হাতে গাড়ির চাবিটা। দরজা দিয়ে হনহনিয়ে বেরোতে যাবে, তখন হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, সানগ্লাসটা নেওয়া হয়নি। খুব রাগ হলো তাঁর! আবার উপরে গিয়ে সানগ্লাস আনতে হবে। ওটা ছাড়া তো বেরোনো যাবে না।
সুব্রত পিছন ঘুরে আবার ড্রয়িংরুমে আসতেই দেখল, রান্নাঘর থেকে সুলতানা আর চিত্রা বেরিয়ে আসছে। সে থেমে গেল। সুলতানার দিকে তাকিয়ে বলল, “সুলতানা, ঘরে টেবিলের উপর সানগ্লাসটা রেখে এসেছি। তুমি প্লিজ ওটা নিয়ে এসো। আমি ততক্ষণে গাড়িটা বের করি।”
সুলতানা জবাবে বলল, “ঠিক আছে, ভাইজান।”
সুলতানা চলে গেলে সুব্রত আবার ঘুরে বেরোনোর জন্য অগ্রসর হচ্ছিল, চিত্রা থামিয়ে দিলো হঠাৎ। সে খানিকটা এগিয়ে এসে বলল, “কোথাও যাচ্ছেন, সুব্রত ভাই?”
সুব্রত বলল, “হুম। একটু বাইরে যাচ্ছি। কেন?”
“না। এমনিই জিজ্ঞেস করলাম। আপনার শরীর ঠিক আছে এখন? ক’দিন ধরে তো আপনার ঘরে তেমন যাওয়া হয় না।” কথা বলতে বলতে সুব্রত ভাইয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়াল চিত্রা। এরপর ধীর পায়ে হেঁটে, সুব্রত ভাইয়ের সাথে সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে চলে এলো গাড়ির কাছে।
সুব্রত ভাই গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল, “ভালো আছি।” একটু থেকে আবার বলল, ” তোমাকে অসংখ্য ধন্যবাদ, আমার বিপদে পাশে থাকার জন্য।”
চিত্রা অভিভূত হয়ে বলল, “ধন্যবাদ দেওয়ার কী আছে? আমি তো আপনার ছোট বোনের মতো। ভাই অসুস্থ হলে বোন পাশে থাকবে না?”
কথাটা শুনে সুব্রত ভাই তাঁর সেই অভ্যাসগত তাচ্ছিল্যের হাসিটা দিলেন। মুখে একটা-টু শব্দ করলেন না।
চিত্রা খানিক দমে গিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টাল, “আচ্ছা, কালকে যে আপনার ঘরে আমের আঁচার পাঠিয়েছিলাম, সেটা খেয়েছিলেন?”
“হ্যাঁ।” সহসা হাসিমুখে জবাব দিলো সুব্রত।
চিত্রা বলল, “আমি নিজেই আপনার হাতে দিতাম। কিন্তু সময় পাইনি একদম। আসলে দিনকাল খুব ব্যস্ততার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। টুক-টাক নানান কাজকর্ম করতে করতে কোথা দিয়ে যে দিন পেরিয়ে যায়, টের পাই না। ঘড়ি দেখা হয় না, বাইরে বেরোনো হয় না, সেজন্য সময়ের কোনো দিক-বেদিক খুঁজে পাই না।”
সুব্রত ভাই নিচের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমার সময়টা ইদানীং ব্যস্ত যাচ্ছে না, বরং তোমাকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে। এবং সেটা করছে সয়ং তোমার শাশুড়ি মা।”
চিত্রা বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল, “এমনটা করার পিছনে মায়ের কী উদ্দেশ্য থাকতে পারে?”
“সেটা তোমার শাশুড়ি মা স্পষ্ট করে বলতে পারবেন। তবে আমার যেটুকু ধারণা, তুমি যাতে আমার থেকে দূরে থাকো, সেজন্য এই প্ল্যান। তোমার শাশুড়ির ধারণা, তুমি আমার কাছে নিরাপদ নও।”
চিত্রা স্তম্ভিত হয়ে গেল সুব্রত ভাইয়ের কথা শুনে। এমনটা তো ফিরোজের ভাবনা। মা কেন এমন ভাবনা থেকে আমাকে ব্যস্ত রাখবেন? তবে কী ফিরোজের সাথে সাথে মায়ের-ও ধারণা, আমার আর সুব্রত ভাইয়ের এই মেলামেশা অস্বাভাবিক? এই সম্পর্কটা দৃষ্টিকটু! চিত্রার সহসা মনে হলো, দুজন মানুষ একসাথে তো আর ভুল হবেন না। হয়তো সে-ই ভুল! সুব্রত ভাই আর তাঁর সম্পর্কটা নিয়ে তাঁর ধারণা যতটা সহজ, প্রকৃত অর্থে এটা ততটা সহজ না; বরং জটিল।
চিত্রা সিদ্ধান্ত নিলো, সে এখন থেকে ফিরোজের মন জুগিয়ে চলবে। ও যখন বলেছে, সুব্রত ভাইয়ের সাথে এভাবে মেলামেশা করা উচিত না, তখন নিজেকে সামলে রাখাই উত্তম। অন্তত এতে ফিরোজ খুশি হবে। তাঁর সংসারে শান্তি থাকবে। বিয়ের আগের জীবন আর বিয়ের পরের জীবন তো সম্পূর্ণ ভিন্ন। তখন যেভাবে সকলের কথা চিন্তা করা যেতো, এখন সেভাবে সকলের কথা চিন্তা করা যায় না। এখন তো একজন নারীর ধ্যানমগ্ন শুধুমাত্র তাঁর সংসার হওয়া উচিত। প্রথমে নিজের সংসার, পরবর্তীতে কিছুটা বাকি থাকলে অন্যের পাশে থাকা যাবে না-হয়।”
“যাই, সুব্রত ভাই।” ভাবনা শেষে মুখ ভার করে কথাটা বলে ঘরের দিকে ফিরল চিত্রা।
সুব্রত হঠাৎ বলে উঠল, “ডায়েরিটা কিন্তু ডান দিকের ড্রয়ারে ছিল। তুমি বাঁ-দিকে রেখে এসেছিলে।”
চিত্রা বিস্ফারিত চোখে আবার তাকালো সুব্রত ভাইয়ের দিকে। কী অদ্ভুত! লোকটা জানলো কীভাবে, ডায়েরি সে-ই নিয়েছিল? সে মুখ ‘হা’ করে তাকিয়ে রইল। এমনসময় সুলতানা সানগ্লাস নিয়ে এলে স্বাভাবিক হলো সে। সুলতানা চলে যেতেই এগিয়ে গিয়ে কৌতূহল ভরা গলায় জানতে চাইল, “সুব্রত ভাই, আপনি কি জানতেন আমি বইয়ের সাথে সাথে ডায়েরিটাও নিয়েছিলাম?”
সুব্রত মৃদু হেসে মাথাটা সামান্য কাত করে স্বীকার করল। ঠোঁটের কোণে ঈষৎ হাসি!
চিত্রা বলল, “তবুও আপনি গর্জে উঠেননি? হম্বিতম্বি দেননি?” অবিশ্বাস্য!”
“বাট এটা সত্যি।” মৃদু হাসল সুব্রত। “আসলে, আমি দেখতে চেয়েছিলাম তোমার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হয়। অর্থাৎ, সত্যিটা স্বীকার করে আমার সম্পদ আমার কাছে ফিরিয়ে দাও। না-কি গোপন করে অন্যের ডায়েরি পড়ার মতো ভয়াবহ অপরাধে লিপ্ত হও।”
অনুশোচনা হলো চিত্রা। সে নতকণ্ঠে বলল, “কিন্তু আমি কিছুটা পড়েছি, সুব্রত ভাই।”
সুব্রতর মন খারাপ হলো কথাটা শুনে। তবে এটা ভেবে চিত্রার প্রতি আস্থা প্রশস্ত হলো যে, মেয়েটা সব দোষ স্বীকার করছে আস্তে আস্তে। এত সরল মেয়ে সে জীবনে দুটো রেখেছে মাত্র। প্রথমজন রুশা, দ্বিতীয়জন চিত্রা। এই গত হওয়া ৪০ বছরের জীবনে এই দুজন মানুষকেই সে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছে!
সুব্রত ভাইকে শব্দহীন দেখে চিত্রা আরও বিমর্ষ হলো। তাঁর মুখের ভঙ্গি হলো কাঁদোকাঁদো। চোখ জোড়া অশ্রুসিক্ত! সে কাতর গলায় বলল, “মাফ করে দেন, সুব্রত ভাই। আমার এমনটা করা উচিত হয়নি। আসলে খুব লোভ হচ্ছিল তো, সেজন্য। জানেন তো লোভ মানুষের মনুষ্যত্ব নষ্ট করে দেয়। তাকে অন্যায়ের জন্য ক্ষুধার্ত করে তোলে। না-হলে আমি কখনোই এমন কাজ করতাম না।”
সুব্রত ভারী সুরে বলল, “কীসের এত কৌতূহল তোমার? আমার জীবনে কী ঘটেছে, তা জেনে তোমার কী লাভ? যেটুকু জানলে যথেষ্ট, সেটুকু নিশ্চয়ই জেনেছ ফিরোজের বা বাড়ির অন্য লোকদের থেকে।”
“জেনেছি। কিন্তু আমার আরও জানতে ইচ্ছে করে। কেন আপনি রুশা ভাবিকে দিনের পর দিন অত্যাচার করেছিলেন, তা জানতে ভীষণ উদগ্রীব আমি।”
সুব্রত চোখ রাঙিয়ে বলল, “দ্বিতীয়বার আর এভাবে কিছু জানতে চেষ্টা করো না, চিত্রা। তাহলে ফল ভালো হবে না। নিশ্চয়ই ইতোমধ্যে অবগত হয়েছ, আমি যতটা নম্র হতে পারি, ঠিক ততটাই উগ্র হতে পারি।”
বোবা বনে গেল চিত্রা। হ্যাঁ, সে সুব্রত ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে অবগত হয়েছে; এবং তা বিয়ের আগেই। খুব কাঁদতে হয়েছিল তাকে।
চিত্রাকে নির্বাক দেখে সুব্রত আবার বলল, “আর দয়া করে আমার ঘরে যাওয়া থেকে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে বিরত রাখো। আমি চাই না আমার জন্য তোমার সংসার ভাঙুক। ফিরোজের ব্যাপারটা তো জানা নেই, কিন্তু তোমার শাশুড়ি হয়তো চান না এটা। আমি লক্ষ্য করেছি, যখন তুমি উপরে আসতে চাও, উনি তখন তোমাকে কৌশলে আটকে দেন।” কথাগুলো বলে সানগ্লাস চোখে দিলো সুব্রত।
চিত্রা আবার সুব্রত ভাইকে পিছনে রাখল।
সুব্রত সহসা হেসে বলল, “এভাবে ঘরে যেতে মানা করছি বলে রাগ করলে? কিছু করার নেই। এই বাড়ির কেউ না আমি। আমাকে এত ভরসা করো না।”
চিত্রা কিছু বলতে পারল না তৎক্ষনাৎ। যখন সুব্রত ভাই গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিল, তখন বলল, “যদি কিছু জানতে চাই, বলবেন?”
সুব্রত থেমে গেল। আবার গাড়িতে হেলান দিয়ে বলল, “কী জানতে চাও?”
“বিয়ের পর কী হয়েছিল, সেটা তো বলবেন না বলেছেন। কিন্তু এটা বলুন, কীভাবে আপনাদের বিয়েটা হয়েছিল?”
সুব্রত মুচকি হাসল। এভাবে আগে কখনো কেউ জানতে চায়নি এইসব। অবশ্য এক বন্ধু ছাড়া এই বাড়ির আর কেউই জানতো না, রুশাকে বিয়ের আগে থেকেই জানতো সুব্রত। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী সেদিন বাড়িতে ঘটক এসেছিল। চিত্রার প্রশ্ন শুনে সে রুশার সাথে দ্বিতীয় দেখার দিনটা মনে করল।

“সেদিন রুশা চলে যাওয়ায় পর চারদিন কেটে গেল। এর মধ্যে আর উনার কোনো খোঁজ পাইনি। হয়তো একদিন হুট করে কোথাও দেখা হয়ে যাবে। কোনো এক বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখব তাকে। অপেক্ষা করতে করতে অধৈর্য সে; ক্লান্ত-বিধ্বস্ত! ফরসা গাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। ঠিক তখন দেখা হবে আমার সাথে। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তাকে বলব, “আপনার যদি অসুবিধা না থাকে, তাহলে এই ড্রাইভারের পাশে বসতে পারেন সামান্য সময়। কথা দিচ্ছি, সামান্য ঝাঁকুনি ছাড়াই আপনাকে গন্তব্যে পৌঁছে দেবো।” আমার এমন কথা শুনে সে এমনভাবে হেসে উঠবে, যে হাসিতে আমার প্রশান্তি মিলবে! আমি আমার কথা রাখব না তখন। তাঁর সাথে একটু প্রতারণা করে তাকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাব। খুব সুন্দর একটা জায়গা। এরপর তাকে নিজের মনের কথা জানাব।
এইসব কল্পনা করে অনেকবার অকারণে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে গেছি। কখনো ঘণ্টাখানিক অপেক্ষা করেছি তাঁর জন্য। একেক সময় একেক বাসস্ট্যান্ড! যখন সিদ্ধান্ত নিলাম, আগে ওই ছেলেটাকে খুঁজে বের করব, তখনই হঠাৎ দেখা মিল সেই রমণীর, যার প্রেমে বিভোর হয়ে অন্যসব ভাবনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছি আমি!

সেদিন আকাশে খুব মেঘ করেছিল। প্রতিদিনের মতো বাসস্ট্যান্ডে অপেক্ষা করে, হতাশ হৃদয় নিয়ে বাড়ির পথে অগ্রসর হচ্ছিলাম, তখন হঠাৎ বাঁ-দিকের মিররে একটা মুখ দেখতে পাই। তৎক্ষনাৎ আমার বুকটা চিলিক দিয়ে ওঠে। সেই মুহূর্তটার কথা ভাবলে আজও আমার বুকের ভিতর চিনচিন অনুভূতি হয়! আমি সাথে সাথে ব্রেক কষি। ভালো করে লক্ষ্য করি তাকে, এবং নিশ্চিত হই, সে-ই রুশা, আমার প্রথম ভালোবাসা! আমি গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়াই। আবারও অপেক্ষা করি তাঁর জন্য। সে এসে আমার পাশ দিয়ে চলে যায়৷ আমি এতবড় মানুষটা তাঁর নজরে আসিনি তখন।
চলে যাচ্ছিল রুশা, সাথে একটি মেয়ে ছিল। কিন্তু আমার দৃষ্টি শুধুই রুশার দিকে। যখন ওরা আমার থেকে কম হলেও ১০হাত দূরে, তখন আচমকা ডেকে উঠি ‘রুশা’ বলে। সে পিছন ফিরে তাকায়। কিন্তু সাথে সাথে চিনতে পারে না। ঘন ভুরুর নিচে চোখ জোড়া আরও টানাটানা করে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকার পর তাঁর ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফোটে, যা অন্য সময়ের হাসির থেকে ভিন্ন মনে হয় আমার কাছে।
আমি এগিয়ে গেলাম রুশার দিকে। রুশাও এগিয়ে এলো, প্রথমে এক পা, এরপর দুই পা এর বেশি আমি ওকে এগোতে দিইনি। আমি নিজে সম্মুখে দাঁড়িয়ে বলি, “আমায় চিনতে পেরেছেন?”
রুশা বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ। সেদিন তো
অফিসে আপনার সাথে দেখা হয়েছিল।”
“জি। ভেবেছিলাম আপনি আমায় চিনতে পারবেন না।”
রুশা উজ্জীবিত হাসি দিয়ে বলল, “তা কী করে হয়? সেদিন আপনি না থাকলে দীপ্ত ইন্টারভিউটাই দিতে পারতো না। আপনাকে আমি ভুলে যাব, তা কী করে হয়? তা আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন যে? কারোর জন্য অপেক্ষা করছেন?”
আমি বিব্রত হই তখন। আমার সবকিছু কেন জানি এলোমেলো হয়ে যায় হঠাৎ করে। কীভাবে বলি, ‘আমি আপনার জন্য অপেক্ষা করছি, যুগ যুদ ধরে!’
আমাকে নির্বাক দেখে রুশা পাশের মেয়েটাকে বলল, “তুমি এগিয়ে যাও। আমি আসছি।”
পাশের অল্পবয়সী মেয়েটা বাধ্য মেয়ের মতো চলে গেলে রুশা আমার গাড়িটার দিকে তাকিয়ে আবার বলল, “গাড়ি নষ্ট হয়নি তো?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ, এটাই ঘটেছে।”
এই কথাটা আচমকা বলে ফেলি আমি। বলার পর বুঝতে পারি, অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। নিজেকে তখন আহাম্মক মনে হচ্ছিল। এত গাধা!

আমরা এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম, যেখানে দাঁড়ালে উপর থেকে লাল রঙের এক ধরনের ফুল পড়ে। আসলে রাস্তার পাশেই একটা হিজল গাছ ছিল। যেগুলো বাতাসে ঝরে পড়ছিল, সেগুলো হিজল ফুল। কৃষ্ণচূড়ার মতো লাল, তবে ছোটছোট, অথচ দেখতে চমৎকার হয় ওগুলো। আমি লক্ষ্য করি, ফুলগুলো বেশ ঝরঝরিয়ে পড়ছিল আমাদের উপর। বাতাস যত বাড়ছিল, ওরা তত আনন্দে মেতে উঠছিল। আর আমি মুগ্ধ হয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখছিলাম। আসলে ফুল দিয়ে উনার মাথা প্রায় ঢেকে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল। চুলের সাথে আটকে যাচ্ছিল তা। সে একটা একটা করে ফুলগুলোকে বিচ্ছিন্ন করছিল। আমার কী হয়েছিল জানি না, সহসা বলে উঠলাম, “থাকুক না। আপনাকে অনেকটা হিজল ফুলের মতো লাগছে। কী অপূর্ব!”
কথা শেষ হতেই অস্বস্তিতে পড়ে যাই আমি। কী থেকে কী বলে ফেললাম! আমি লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে ফেলি, ক্ষণেক্ষণে আড়চোখে দেখি সে-ও অবাক দৃষ্টিতে দেখছে আমায়। বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতি তখন। কিন্তু সে-ই আমাকে মুক্তি দেয়।
রুশা মাথা থেকে হাত সরিয়ে বলল, “আসলে হিজল ফুল আমিও খুব পছন্দ করি। থাক, এগুলো না-হয় বাড়িতে গিয়ে আলাদা করব।”
আমি তালগোল হারিয়ে অনধিকার চর্চা করে ফেলি! হঠাৎ জিজ্ঞেস করে বসি, “আপনার বাড়ি কোথায়?”
রুশা বেশ ভড়কালেও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “এই তো, দুই নম্বর গলির ১৫২ নম্বর বাড়িটা আমাদের।”
আমি মৃদু হেসে বললাম, “আমিও ওদিকেই যাচ্ছি। ইচ্ছে লিফট নিতে পারেন।”
আমার কথা শুনে রুশা হি হি করে হেসে দিয়ে বলল, “আগে নিজের গাড়িটা ঠিক করুন জনাব। এর পর না আমাকে লিফট দিবেন।”
আমি তখন কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। নিজের উপর রাগ হচ্ছিল খুব। এখানে দাঁড়িয়ে থাকার পিছনে আরও অনেক কারণ থাকতে পারতো!
রুশা তখন ‘আসি’ বলে স্থান ত্যাগ করে। তবে আমি তৎক্ষনাৎ সে স্থান ত্যাগ করিনি। সেই ভাগ্যবান হিজল ফুলগুলোকে হাত দিয়ে ছুঁয়ে দিই, যেগুলো রুশাকে স্পর্শ করার সুযোগ পেয়েছিল!”

একনাগাড়ে কথাগুলো বলে সুব্রত থামে। এরপর তাকায় চিত্রার দিকে। আবার বলল, “বুঝলে চিত্রা, সেদিন রুশাকে মনের কথা জানাতে না পারলেও সিদ্ধান্ত পাক্কা ছিল, যদি কখনো বিয়ে করি, তাহলে রুশাকেই করব। উনি-ই হবে আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা। এই এক জীবনে আমি আর কাউকে ভালোবাসবো না।”
সুব্রত ভাইয়ের কথা শেষ হতেই চিত্রার মুখ থেকে বেরিয়ে আসে একটা কথা, “যাকে এত ভালোবেসে ছিলেন, তাকে কেন নির্যাতন করতেন, সুব্রত ভাই? কেন দিনের পর দিন তাকে কষ্ট দিয়েছিলেন?”
চিত্রার কথা শুনে হঠাৎ ক্ষিপ্ত হলো সুব্রত। তাঁর উজ্জ্বল মুখ নিভে গিয়ে গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যায়। সে এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে, চিত্রার দুই কাঁধে শক্ত করে রাখ রেখে চেঁচিয়ে বলল, “চুপ। একদম চুপ। কতবার বললে বিশ্বাস করবে আমি নির্দোষ।”
কথাটা বলেই ফোঁসফোঁস করে গাড়িতে ওঠে বসল সুব্রত। এরপর ছুটল নিজের গন্তব্যে।
সুব্রত ভাই চলে যাওয়ার পরেও চিত্রা মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল সেখানে। এক পা পর্যন্ত নড়লে পারল না সে। কী হয়ে গেল এটা? হঠাৎ তাঁর মাথায় একটা ব্যাপার খেলে গেল; যে মানুষটা এত গভীর ভাবে কাউকে ভালোবাসতে পারে, সে কীভাবে ওই মানুষটাকে কষ্ট দিতে পারে? মন থেকে যে ভালোবাসার জন্ম, সে ভালোবাসা কীভাবে কেউ কলঙ্কিত করে?

২২.
রুমানা বেগম মেয়ের ঘরে এলেন। কিন্তু ঘরে মেয়েকে কোথাও দেখতে না পেয়ে তিনি যখন বেরিয়ে আসতে যাচ্ছিলেন, তখন হঠাৎ ফোনের রিংটোন এর শব্দ তাঁর কানে ভেসে উঠল। তিনি চারিদিকে তাকিয়ে ফোন খুঁজলেন। বিছানা, ড্রেসিং টেবিল খুঁজেও পেলেন না ফোনটা। আওয়াজ-কে অনুসরণ করে যখন টেবিলের ড্রয়ারটা খুললেন, তখন ফোন তো দেখতে পেলেন, তবে সাথে দেখতে পেলেন একটা সিগারেটের প্যাকেট। তাঁর দুই চোখ চকচকে হয়ে গেল। প্যাকেটটা ড্রয়ার থেকে বের করলেন তিনি। চোখ বরাবর এনে তাকিয়ে রইলেন।

বাথরুম থেকে বের হয়ে মায়ের হাতে সিগারেটের প্যাকেটটা দেখতে পেলো রশ্মি। আকাশ থেকে পড়ল সে! দৌড়ে এসে তৎক্ষনাৎ ছো মেরে নিয়ে নিলো ওটা!
রুমানা বেগম অগ্নিমূর্তি চেহারা করে মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, “এইসব কী, রশ্মি?”
রশ্মি জবাব না দিয়ে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। তাঁর চোখে না ভয়, না অপরাধবোধ, নে বেয়াদবি! নির্লিপ্ত সে। একদম প্রতিক্রিয়া-হীন!
জবাব না পেরে রুমানা বেগম আরও ক্রোধান্বিত হয়ে বললেন, “এর আগেও একবার দেখেছিলাম আমি। সেদিন কিছু বলিনি কারণ, যদি পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়; এই ভেবে। ভেবেছিলাম তুই নিজেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারবি। কিন্তু এখন দেখছি তুই এটা অভ্যাসে পরিণত করেছিস।”
আগের মতো নিশ্চুপ, রশ্মি। এমন পরিস্থিতিতে কথা বলার মতো শব্দ তাঁর জানা নেই।
“দে, ওটা দে আমার হাতে।” হাত বাড়িয়ে মেয়ের কাছ থেকে প্যাকেটটা নিতে চাইলেন রুমানা বেগম।
“কেন?” রশ্মি পিছিয়ে গিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল উচ্চস্বরে।
রুমানা বেগম কোনো কথা না শুনে জোর করে মেয়ের হাত থেকে প্যাকেটটা নিজের হেফাজতে নিয়ে নিলেন। এরপর জানালা দিয়ে ছুড়ে মারলেন বাইরে, যেখানে ঘন জঙ্গল হয়েছে।
রশ্মি গর্জে উঠল সাথে সাথে, “এটা কী করলে তুমি? তুমি জানো এটার দাম..!”
কথাটা শেষ করতে পারেনি রশ্মি, আচমকা মায়ের হাতের তালু গালে পড়তেই থতমত খেয়ে গেল সে। শিউরে উঠল।
রুমানা বেগম ফুসতে লাগলেন মেয়ের দিকে তাকিয়ে। সকল সীমাবদ্ধতা নিজ হাতে ভাঙলেন আজ। স্বামী মারা যাওয়ার পর এই প্রথম মেয়েকে আঘাত করলেন তিনি। তা-ও আবার নিজের সবটুকু ক্রোধ ঢেলে! মারার সময় আজ তাঁর হাত কাঁপেনি একটুও। বরং সেই দৃঢ়তা ছিল, যা সন্তানকে শাসন করার সময় একজন অভিভাবকের মধ্যে বিরাজিত থাকে।
রশ্মি অবাক চোখে কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকার পর দ্রুতবেগে বেরিয়ে গেল ঘর থেকে।

সন্ধ্যে হয়নি তখনো, বাড়ি থেকে কিছুটা দূরের একটা দোকানে গেল রশ্মি। নিচু গলায় দোকানিকে বলল, “মামা, এক প্যাকেট সিগারেট দিন।”
দোকানী একপলক তাকিয়ে তাকে দেখল। এরপর একটা ব্যানসন সিগারেটের প্যাকেট বের করলো। রশ্মি দাঁড়িয়ে ছিল নীরবে, হঠাৎ পরিচিত একটা কণ্ঠে তাঁর নাম শুনতে পেলো। সে পিছনে তাকাতেই চমকে উঠল! চোখ কপালে ওঠে গেল তাঁর! শিরদাঁড়া টানটান করে তাকিয়ে রইল মানুষটার দিকে। সর্বনাশ! একটা বিপজ্জনক মুখ তাঁরই সামনে!

১৭তম পর্ব এখানেই সমাপ্ত। পরবর্তী পর্ব শীঘ্রই আসছে।

গত পর্বের লিংক – https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=834266660851369&id=100028041274793

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here