প্রণয় রেখা পর্ব ১৭

0
485

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৭.

সন্ধ্যার দিকে মেহমানরা চলে গেলেন। সবাই চলে যাওয়ার পর মোহনা ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় গিয়ে একটু হেলান দিয়ে বসে। কিছু একটা নিয়ে তার চিন্তা হচ্ছে। সে ছাদ থেকে নামার পর থেকেই খেয়াল করেছে তার মা বাবা আর অরূপের মা বাবা কী একটা নিয়ে যেন খুব সতর্ক ভাবে কথা বলছেন। কেমন একটা যেন চঞ্চলতা ভাব তাদের মধ্যে। কী নিয়ে এত সোরগোল মোহনা তখন বুঝতে পারেনি। পরে মা’কে জিজ্ঞেস করেছিল তবে মাও তাকে তেমন কিছু বলেনি। ব্যাপারটা পুরোপুরি অস্বাভাবিক না হলেও একটু চিন্তা তার হচ্ছেই।

মাহিয়া ধপ করে তার সামনে এসে বসল। দু হাত ছড়িয়ে উল্লাসিত কন্ঠে বলল,

‘আজকে কি সুন্দর একটা দিন কাটিয়েছি, উফ। আর অরূপ ভাইয়া তো ঝাক্কাস একটা মানুষ। দেখো, কত কিছু আমার জন্য নিয়ে এসেছে।’

মাহিয়ার জন্য অরূপ সত্যি সত্যিই অনেক কিছু এনেছে। মেকআপের জিনিস মাহিয়ার বরাবরই পছন্দ। তাই একগাদা মেকআপ এনেছে অরূপ। সাথে তো চকলেট আছেই। তবে মোহনার জন্য সে একটা অদ্ভুত জিনিস এনেছে। একটা ছোট্ট ডায়েরী আর একটা কলম। তবে কলমটার একটা বিশেষত্ব হলো এটা দিয়ে লিখলে সেই লেখা খালি চোখে দেখা যায় না। সেই লেখা দেখতে হলে ঐ কাগজটাকে আগুনের উপর ধরতে হবে। এত কিছু থাকতে এটাই কেন দিল কে জানে? এসব জিনিস দিয়ে সে কী করবে? মোহনা এসব প্রথম দেখেছিল একবার সি আই ডি তে। কাগজে কিছু লেখা থাকে না অথচ আগুনের কাছে নিলেই ফরফরিয়ে সব স্পষ্ট হয়ে উঠে। সেকি আশ্চর্যই না হয়েছিল প্রথম এটা দেখে। এখন আগের কথা ভেবে সে মনে মনে হাসে। তারপর সেই ডায়েরী আর কলমটা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে দেখে। তারপর কী ভেবে ডায়েরীটা খুলে মাঝের একটা পাতা বের করে কিছু লিখতে আরম্ভ করে। সামনে থেকে মাহিয়া একটু উঁকি ঝুঁকি মারে দেখার জন্য। তা দেখে মোহনা হেসে বলে,

‘দেখ দেখ, যত খুশী দেখ।’

মোহনা জানে মাহিয়া কিছুই দেখছে না। ইনফেক্ট, সে নিজেও কিছু দেখছে না। আন্দাজের উপর লিখে যাচ্ছে কেবল। কী জানি কী লিখল। লেখা শেষ করে ডায়েরীটা বন্ধ করে কলম সমেত আলমারি তে রেখে দিল। আবার কোনো একদিন হয়তো খুলে দেখবে।

রাতে মাহিয়া আর মোহনা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ে। মোহনা সারাদিন একটু বেশিই কাজ করেছে। তাই শুতে শুতেই ঘুমে তলিয়ে যায় সে। তবে মাহিয়ার তখনও ঘুম আসে না। জেগে জেগে কী করবে বুঝতে পারছে না। ঘুমন্ত বোনের গায়ে এক পা তুলে ফ্যানের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবে কী করা যায়। ভাবতে ভাবতেই তার হঠাৎ লরিনের কথা মনে পড়ে গেল। সে উঠে তখন আস্তে করে মোহনার ফোনটা নিয়ে লরিন কে একটা টেক্সট দিল। মেসেজে লেখা ছিল, “সরি”

মোহনার নাম্বার থেকে এমন একটা মেসেজ দেখে লরিন তো আকাশ থেকে পড়ল যেন। সে সঙ্গে সঙ্গেই রিপ্লাই দিল,

‘What happen?’

মাহিয়া লিখল,

‘Nothing.’

তারপর মাহিয়া আবার লিখল,

‘Are you angry with me?’

আরেকদফা অবাক হলো লরিন। কেন যেন তার সন্দেহ হলো এটা মোহনা না। সে উত্তরে লিখল,

‘You are Mahiya, am I right?’

মেসেজটা দেখে মাহিয়ার চোখ মুখ বিরক্তিতে গুঁজে এল। সে রিপ্লাই দিল,

‘না, আমি মোহনা।’

লরিন একটা হাসির ইমুজি পাঠিয়ে লিখল,

‘তোমার বোন কখনোই আমার সাথে এত সুন্দর ভাবে কথা বলবে না। তুমি ধরা পড়ে গিয়েছ মাহিয়া।’

মাহিয়া বিরক্তির একটা ইমুজি পাঠাল। লরিন পাঠাল মুচকি হাসির ইমুজি। তারপর লরিন লিখল,

‘এখনো ঘুমাওনি কেন? তোমার বোন কী করছে?’

‘আপু ঘুমাচ্ছে। কিন্তু আমার ঘুম আসছে না।’

লরিন লিখল,

‘তোমার বোন জানলে খুব রাগ করবে। আর মেসেজ দিও না। এই মেসেজ গুলোও ডিলিট করে দাও।’

‘আচ্ছা করে দিব। তবে ভাইয়া, আপনি কি সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন?’

লরিন হালকা হাসির ইমুজি পাঠিয়ে বলল,

‘না, কষ্ট পাওয়ার কী আছে?’

মাহিয়া লিখল,

‘আমাদের বাসায় আবার কবে আসবেন, ভাইয়া?’

‘আসব, একদিন সময় করে আবার আসব।’

মাহিয়া খুব খুশি হয়ে লিখল,

‘আচ্ছা, তাড়াতাড়ি আসবেন।’

লরিন উত্তরে লিখল,

‘ঠিক আছে। এবার তুমিও ঘুমিয়ে পড়ো। গুড নাইট।’

‘লাস্ট একটা কথা জিজ্ঞেস করব, ভাইয়া?’

‘কী? বলো।’

মাহিয়া কিছুক্ষণ ভেবে লিখল,

‘আপুকে কি আপনি ভালোবাসেন?’

মেসেজ টা দেখে লরিন কিছুক্ষণ নির্বাক চেয়ে রইল মোবাইলের দিকে। উত্তর কী দেবে ভেবে পাচ্ছে না। মেয়েটা ছোট হলেও পাকা ভীষণ। সে ভেবে উত্তরে লিখল,

‘এই যে ম্যাডাম, এত পাকা পাকা কথা না বলে এবার ঘুমান। আপনার আপু জানলে আপনাকে আর আস্ত রাখবে না। সাথে আমারও মাথা ফাটাবে। তাই আপুর হাত থেকে বাঁচতে হলে এখন ঘুমাতে হবে, ওকে? নো মোর মেসেজ, শুভ রাত্রি।’

মেসেজটা দেখে মাহিয়া আর কোন মেসেজ পাঠাল না। সবগুলো মেসেজ ডিলেট করে, ফোনটা বালিশের কাছে রেখে সেও ঘুমিয়ে পড়ল।

___________________

মোহনা তাড়াহুড়ো করে বাসা থেকে বের হয়েছে। লেইট হয়ে গিয়েছে অনেক। প্রথম ক্লাসটা নির্ঘাত মিস। যখন তাড়াহুড়ো করা লাগে তখনই কোনো গাড়ি পাওয়া যায় না, এটাই নিয়ম। মোহনা রেগে গেল খুব। সব রিক্সাওয়ালা কি একসাথে শহর থেকে উধাও হয়ে গিয়েছে? সে উপায়ান্তর না দেখে জোর পায়ে হাঁটতে আরম্ভ করে। কিছুটা পথ সামনে যেতেই পেছন থেকে কে যেন তাকে ডেকে উঠে। সে ফিরে দেখল, এশা। এশার রিক্সাটা মোহনার সামনে এসে থামে। মোহনা ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,

‘কিরে, তুই ঐদিকে কোথায় গিয়েছিলি?’

‘ঐ তো একটু সামনে, একটা কাজ ছিল। তুই রিক্সায় উঠ।’

মোহনা তার রিক্সায় উঠে পড়ে। যেতে যেতে মোহনা তার কাছে অরূপের কথা বলে। অরূপের কথা শুনে এশার মুখ যেন কেমন কালো হয়ে গেল। তার যেন ঠিক পছন্দ হলো না অরূপ নামক ছেলেটাকে। তবে সে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না, কেবল মোহনার কথাই শুনে গেল।

একটা ক্লাস শেষ হওয়ার পর সবাই যার যার মতো ক্যান্টিনের দিকে যায়। মোহনা, মাহি আর রাফাতও ক্যান্টিনের দিকেই যাচ্ছিল। তবে পথিমধ্যে তারা দিশার গলা পেয়ে থেমে গেল। দিশা যেন ফোনে কার সাথে কথা বলছে। তার স্বর খানিকটা চওড়া। কাকে যেন খুব রাগ দেখিয়ে বলছে,

‘কেন, একটু দেখা করলে কী হয়? তুমি এমন কেন করছো? কেন ঐ মেয়ের পেছনেই পড়ে আছো, আমাকে কি চোখে পড়ে না?’

ওর এহেন টাইপ কথা শুনে সবাই বুঝে যায় সে কার সাথে কথা বলছে। এশা তখন এক ছুটে দিশার পেছনে দাঁড়িয়ে বলে,

‘কিরে, লরিন বুঝি পাত্তা দিচ্ছে না?’

দিশা দাঁতে দাঁত চেপে এশার দিকে চাইলে এশা তাকে চোখ টিপ মেরে হাসতে হাসতে সেখান থেকে চলে যায়।
ক্যান্টিনে বসে বলে,

‘দেখেছিস, আমাদের দিশা এখন সব ছেড়ে বিদেশির পেছনে পড়েছে।’

মোহনা ভারি নিশ্বাস ছেড়ে বলে,

‘ভালোই হয়েছে, অনন্ত ঐ মহান পুরুষ আমার ঘাড় থেকে তো নামবে।’

এশা বিরক্ত হয়ে বলল,

‘হ্যাঁ, তুই এইদিকে পাত্তাই দিচ্ছিস না আর ঐদিকে একজন তার জন্য শহীদ হয়ে যাচ্ছে।’

রাফাত মাঝখান থেকে বলল,

‘এইজন্যই বলে, একেক মানুষের মন একেক রকম। তোমার যাকে ভালো লাগবে না অন্য কেউ আবার তাকেই পাগলের মতো ভালোবাসবে। এটাই প্রকৃতি।’

‘আচ্ছা, হয়েছে হয়েছে। এইসব প্রাকৃতিক জিনিস পত্র সাইডে রেখে আপাতত দুইটা কফি অর্ডার কর, মাথা ধরেছে কফি খেতে হবে।’

.

বিকেলের দিকে মোহনা বেলকনিতে বসে গুনগুন করে গান গাইছিল আর তার ফুলগুলো দেখছিল। হঠাৎ তখন তার ফোনে টুং করে একটা শব্দ হয়। মোহনা ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে একটা নাম্বার থেকে মেসেজ এসেছে। যেখানে লেখা, “Who is Arup?”. নাম্বারটা মোহনা চিনে ফেলল। লরিনের নাম্বার। কিন্তু সে অরূপের কথা জানতে চাইছে কেন? আর সে অরূপের কথা জানলই বা কী করে?

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here