#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৬.
সকাল থেকেই মোহনা কাজ করে যাচ্ছে। পুরো বাসা পরিষ্কার করে একেবারে চকচকে করে ফেলেছে। এখন গিয়েছে রান্নাঘরে। লায়লা বেগমের রান্নাও প্রায় শেষের দিকেই। মোহনা একটা ছু রি সাথে শসা, টমেটো, পেঁয়াজ আর মরিচ নিয়ে কাটতে বসেছে। সে খুব ভালো সালাত বানাতে পারে। লায়লা বেগম মোহনাকে তাড়া দিয়ে বললেন,
‘তাড়াতাড়ি এসব কাজ সেরে গোসলে যা। ওরা কিন্তু কাছাকাছি চলে এসেছে। আর বেশিক্ষণ লাগবে না।’
মা’র কথা মতো মোহনা তাড়াতাড়ি হাত চালাল। কাজ সব শেষ করে গোসলে ঢুকে পড়ল সে। মাহিয়া আগে আগে গোসল করে একেবারে তৈরি। গোলাপী রঙের একটা টপস পরেছে। তার কাঁধ পর্যন্ত ছোট ছোট চুলগুলো এখনো আধভেজা। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সে অপেক্ষা করছে। গোলাপ গাছের গোলাপী গোলাপটার মতোই তাকে মিষ্টি লাগছে। যেন কিশোরী বয়সের এক ফুটন্ত গোলাপ।
মোহনা গোসল শেষ করে এসে দেখল তার মা আলামারি খুলে কী যেন খুঁজছে। মোহনা মা’র কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘কী খুঁজছো, আম্মু?’
লায়লা বেগম ঘুরে তাকালেন মোহনার দিকে। তার আপাদমস্তক একবার পরখ করে বললেন,
‘এটা কী পরেছিস? এই লাল জামাটা পর। এটাতে তোকে খুব মানায়।’
‘কিন্তু মা, এটা তো আমি বাইরে গেলে পরি। এটা এখন ঘরে পরার কী দরকার। আর তাছাড়া জামাটা খুব ভারী।’
‘আমি যেটা বলেছি সেটাই কর। বাড়িতে মেহমান আসছেন, এসব পরে যাবি নাকি? যা তাড়াতাড়ি গিয়ে চেঞ্জ করে আয়।’
মোহনা আর দ্বিমত পোষণ না করেই জামা নিয়ে আবার ওয়াশরুমে গেল।
সবকিছু গোছগাছ শেষ। মাহবুব সাহেব বললেন, উনারা চলে এসেছেন। আর হয়তো পাঁচ মিনিট লাগবে। উনি মোহনা আর মাহিয়া কে গেইটের বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করতে বললেন। মোহনা বাবার কথা মতো মাথায় ওড়না দিয়ে বের হতে নিলেই লায়লা বেগম তার কাছে ছুটে গেলেন। বললেন,
‘আরে মেয়ে, একটু লিপস্টিক দিতে পারছিস না? কেমন যেন মরা মরা লাগছে।’
মোহনা মায়ের কথা শুনে একটু বিরক্ত হলো। মুখ কুঁচকে বলল,
‘উফফ আম্মু, আবার লিপস্টিক কেন? জামাটা পরেই অস্বস্তি লাগছে তুমি আবার বলছো লিপস্টিকের কথা। আমি এমনিতেই ঠিক আছি।’
লায়লা বেগম শক্ত গলায় বললেন,
‘তোমাকে কিছু বলাও দায়। যাও এভাবেই যাও।’
মোহনা এভাবেই গেল। মাহিয়াও তার পেছন পেছন নাচতে নাচতে বাইরে গিয়ে দাঁড়াল। বেশ অনেকক্ষণ দুই বোন অপেক্ষা করল। কিন্তু মেহমানের কোনো নাম গন্ধ নেই। এক পর্যায়ে মোহনা খুব বিরক্ত হয়ে উঠে। পাঁচ মিনিটের কথা বলে পাঁচ ঘন্টা লাগাচ্ছে। মাহিয়া কে থাকতে বলে সে চলে আসতে নিচ্ছিল ঠিক সেই সময়ই পেছন থেকে গাড়ির শব্দ পায় সে। সঙ্গে সঙ্গেই মাহিয়া লাফিয়ে উঠে বলে,
‘আপু, চলে এসেছে।’
মোহনা তাকিয়ে দেখে একটা কালো প্রাইভেট কার, ঠিক তাদের সামনে এসে থেমেছে। তারপর গাড়ির ড্রাইভিং সিটের দরজাটা খুলে একজন সুদর্শন পুরুষ নেমে আসে। যাকে দেখেই মাহিয়া “অরূপ ভাইয়া” বলে চিৎকার দেয়। পেছনের দরজা খুলে অরূপের মা বাবা বেরিয়ে আসেন। এবার মোহনা তাদের কাছে এগিয়ে যায়। অরূপের মা বাবাকে সালাম দিয়ে সৌজন্য সাক্ষাতের পর্ব মিটায়। অরূপের মা-বাবা, মোহনা আর মাহিয়াকে দেখে ভীষণ খুশি হোন। অনেকদিন পর মেয়েগুলোকে তারা দেখেছেন। মোহনা তাদের নিয়ে বাসার ভেতরে আসে। আর মাহিয়া ইতিমধ্যেই অরূপের সাথে গল্প জুড়ে দিয়েছে। বাসার ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই লায়লা বেগম সাদরে তাদের গ্রহণ করে নেন। মাহবুব সাহেবও আস্তে আস্তে রুম থেকে বেরিয়ে আসেন। উনার বাল্যকালের বন্ধু আব্দুল্লাহ গিয়ে উনাকে জড়িয়ে ধরলেন। আহ, কতদিন পর তাদের দেখা। ব্যস্ততার চাপে যেন এই সম্পর্কের অস্তিত্ব বিলিন হতে চলছিল। দুই বন্ধুর আলিঙ্গনে যেন পুরোনো সেই প্রশান্তি আবার ফিরে আসে। সবাইকে নিয়ে তিনি ড্রয়িং রুমে বসালেন। লায়লা বেগম রান্নাঘরে গেলেন শরবত আর হালকা নাস্তার আয়োজন করতে। মোহনা মায়ের পেছন পেছন রান্নাঘরে আসে। লায়লা বেগম সব নাস্তা একটা স্ট্রে তে সাজিয়ে দিয়ে মোহনা কে বললেন ভেতরে গিয়ে দিয়ে আসতে। মোহনা মায়ের কথা মতো স্ট্রে নিয়ে আবার ড্রয়িং রুমে গেল। টি টেবিলের উপর নাস্তাগুলো রেখে চলে আসতে নিলেই অরূপের মা তার হাত ধরে বললেন,
‘তুমি কোথায় যাচ্ছ, মা? বসো, আমাদের সাথে বসে নাস্তা করো।’
মোহনা স্মিত হেসে মহিলাটার পাশে বসল। যদিও তার খুব অস্বস্তি লাগছিল তাও খুব স্বাভাবিক ভাবে বসে থাকার চেষ্টা করল। অন্যদিকে তার বোন মাহিয়া অরূপের সাথে বকবক করেই চলছে। যেন তাদের কতদিনের চেনা পরিচয়। তার মধ্যে কোনো জড়তা নেই, কত ফ্রিলি সে কথা বলতে পারছে। এই এক সুবিধা Extrovert হওয়ার, কিছু করতে গেলে এত অস্বস্তি লাগে না।
বড়ো’রা সবাই কথা বলছে। মোহনা তাদের মাঝে বসে বসে খুব বোর হচ্ছিল। মোহনার মা তখন মোহনাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
‘মোহনা, যাও অরূপ কে নিয়ে তোমার রুমে যাও।’
মাহিয়া অরূপের পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, ভাইয়া চলো। আমাদের রুমে চলো।’
তারা সবাই মোহনার রুমে গেল। অরূপ রুমের আশ পাশ একবার দেখে বিছানায় গিয়ে বসল। এতক্ষণে সে মোহনার দিকে তাকিয়েছে। প্রসন্ন হেসে মোহনাকে জিজ্ঞেস করল,
‘কেমন আছো, মোহনা?’
মোহনা তার দিকে চেয়ে মুচকি হেসে বলল,
‘জি ভালো। আপনি কেমন আছেন?’
‘আমিও ভালো আছি।’
‘তা তোমার পড়াশোনা কেমন যাচ্ছে? কোন ইয়ারে আছো এখন?’
‘থার্ড ইয়ার।’
‘ওহ, প্রায় তো শেষের দিকে। তারপর কী প্ল্যান? মাস্টার্স করবে নাকি চাকরির জন্য এপ্লাই করবে?’
‘আমার ইচ্ছে মাস্টার্স এর জন্য দেশের বাইরে যাব। বাবার ও তাই ইচ্ছে। এখন দেখা যাক কী হয়।’
‘হুম, ভালোভাবে প্রিপারেশন নাও।’
মোহনা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
‘আপনি কি একেবারের জন্য চলে এসেছেন?’
‘আপাতত এখানেই আছি। বাবার ব্যবসা দেখতে হবে। পরে যদি মনে হয় তখন আবার যাব।’
‘ওহহ আচ্ছা।’
মোহনা তারপর আর কোনো কথা খুঁজে পেল না। আর মাহিয়া, তার মুখ তো থামছেই না। সে যে কত কিছু বলছে, কত কিছু দেখাচ্ছে। অন্যদিকে মোহনা কেবল বসে বসে তার বোনের চঞ্চলতা দেখছে।
__________________
দুপুরের খাওয়া শেষ করে মাহিয়া, অরূপ আর মোহনা ছাদে গেল। মাহবুব সাহেব তার বন্ধু আব্দুল্লাহ কে নিয়ে বসার ঘরে বসলেন। আব্দুল্লাহ সাহেব সোফায় দুই হাত ছড়িয়ে আরাম করে বসলেন। পান খাওয়া লালচে মুখে প্রশস্ত হাসলেন। অতঃপর গলা ঝেড়ে বললেন,
‘তা বন্ধু, সম্পর্কের নতুন নাম কবে দিবি? এবার তো উপযুক্ত সময় চলে এসেছে। আর কত অপেক্ষা করতে হবে?’
মাহবুব সাহেব হাসলেন। বন্ধুর কাঁধে হাত রেখে উচ্ছাসে বললেন,
‘না না দোস্ত, আর অপেক্ষা করাবো না। এবার দিন ক্ষণ দেখে ডিরেক্ট চার হাত এক করে দিয়ে তবেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলব।’
চলবে…