পুষ্পের_হাতে_পদ্ম (পর্ব- ০৬)
– সুমাইয়া বিনতে আ. আজিজ
১৩
ভাবি এই বাড়িতে আসার পর আরো কয়েকমাস কেটে যায়। এতদিনে সে পাকা গৃহিণী বনে চলে গিয়েছে। এত রাতারাতি যে ও এত বেশি সংসারী হয়ে উঠবে তা রীতিমতো অবিশ্বাস্য ছিল সবার কাছে। এই কয়েকটা মাসের মধ্যেই নিজের ব্যবহার, ভালোবাসা দিয়ে সে সবার মনটাও জয় করে নিয়েছিল সে। ওর আচার-ব্যবহার এতটাই মনোমুগ্ধকর ছিল যে, সেই মনোমুগ্ধকর আচার-আচরণের তলায় চাপা পড়ে গিয়েছিল ওর সমস্ত কলঙ্ক। যেখানে বড় কাকি একসময় ওর মতো মেয়েকে বিয়ে করার জন্য ছেলেকে ভর্ৎসনা দিতেন, কান্নাকাটি করতেন; সেই কাকিই এখন পুরো পাড়া জুড়ে হাঁটেন আর ছেলের বউয়ের প্রশংসা করেন। ‘আংগো পুষ্প এইডা করল, আংগো পুষ্প অইডা করল’ এই…সেই…আরো কতো কী!
পাড়ার লোকে কাকির কথা শুনে মুচকি হাসত। তারাও কাকির সাথে তাল মিলিয়ে পুষ্পর প্রশংসায় মত্ত হয়ে উঠত। কারো সঙ্গে কোনোরকম কথা-কাটাকাটি, রেষারেষি, মনোমালিন্য কিছুই হয়নি ওর কখনো। বরং কোনোভাবে কাকির সাথে কারো কোনোরকম ঝগড়া লাগলেও পুষ্প ওইসব গায়ে মাখত না। দেখা যেত যে, কোনো প্রতিবেশির সাথে ঝগড়া হওয়ায় কাকি সেই প্রতিবেশির সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে, তাদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে; অথচ এদিকে পুষ্প সেসব ঝগড়াঝাটিকে বুড়ো আংগুল দেখিয়ে ঠিকই সেই প্রতিবেশির সাথে নিজের মতো করেই কথা বলছে, তাদের বাড়ি যাচ্ছে, তাদের জিনিস খাচ্ছে। মানে, ওর মনে কোনোপ্রকার হিংসা-বিদ্বেষের লেশমাত্র ছিল না। সবার সাথে অনায়াসে মিশে যেত, কোনোরকম বাছ-বিচার করত না।
বিভিন্ন শস্যের মৌসুমে, বিশেষ করে ধানের মৌসুমে পুষ্পর ব্যস্ততার শেষ থাকত না। অথচ বড় কাকার কোনো ফসলি জমি নেই, আর না আছে তাদের কোনো শস্য। পুষ্প ব্যস্ত থাকতো পাড়াপড়শির শস্য নিয়ে। কখন আকাশে মেঘ করল, কখন ঝুম করে বৃষ্টি নেমে পড়ল, পাশের বাড়িদের রোদে শুকাতে দেয়া ধান আদৌ তোলা হলো কি-না সেসব নিয়ে ওর চিন্তার শেষ ছিল না। দেখা যেত, নিজেদের বাড়ির কাজের কোনো এক ফাঁকে ভৌ-দৌড় দিয়ে চলে যায় সেই পাশের বাড়ি। হয়তো ধানগুলো জড়ো করে দেয়, নয়তো ঝাড়ু দিয়ে দেয়। ধান শুকানো শেষে যখন বড়ো স্ট্যান্ড ফ্যানের বাতাসে ধানগুলো উড়িয়ে ধানের ধুলো ছাড়ানো হতো তখনও সেই কাজে বাকিদের সাথে হাত লাগিয়ে ওদের সাহায্য করতে দেখা যেত ভাবিকে। হয়তো-বা কুলায় ধানগুলো উঠিয়ে দিত, নয়তো নিজেই গিয়ে ধান উড়াত। এসব কাজে ও অভ্যস্ত ছিল না কখনোই। তবুও উৎসাহ নিয়ে সব কাজেই এগিয়ে এগিয়ে যেত।
এই পাড়ায় কারো বাড়িতে পুলি বা সেমাই পিঠা কিংবা এই ধরনের অন্যান্য পিঠা অর্থাৎ যেসব পিঠা বানাতে বেশি লোকের হাত লাগানোর প্রয়োজন হয়, সেসব পিঠা বানাতে গেলে ওকে আগে আগে সেখানে দেখা যেত। যেখানে অন্যান্যরা একটুতেই ক্লান্ত হয়ে যেত, মুখে বিরক্তিভাব ফুটিয়ে তুলত; সেখানে ও হাসিমুখে ক্লান্তিহীনভাবে সব পিঠা বানিয়ে দিয়ে তবেই নিজের ঘরে আসত।
এইযে এত কষ্ট, অন্যের ভালো-মন্দ নিয়ে এত মাথাব্যথা, সবার বিপদে আগে আগে এগিয়ে যাওয়া; এগুলোর পারিশ্রমিক হিসেবে ওর কাম্য ছিল শুধুই ভালোবাসা। আর সে তার এই কাঙ্ক্ষিত পারিশ্রমিক সবার কাছ থেকে ষোল আনা করেই পেয়ে গিয়েছিল। না দিয়ে উপায় আছে বুঝি?
সবার মন জয় করার ওর এই অদ্ভুত ক্ষমতাটা আমাকে বরাবরই বিস্মিত করত। অবাক হতাম এটা ভেবে যে, একটা মেয়ের মধ্যে রাতারাতি এত পরিবর্তন কিভাবে সম্ভব? মানে কিভাবে?
যখন ভাবি নতুন আসলো তখন ও রান্না করার সময় মাঝেমধ্যেই আমি ওর পাশে গিয়ে বসে থাকতাম। কিভাবে কোন মসলা কতটুকু পরিমাণ দিতে হবে সেসব দেখিয়ে দেখিয়ে দিতাম। কিন্তু এই কয়েকটা মাসের ব্যবধানে এখন ঠিক ওইটার বিপরীত দৃশ্য দেখা যায়। আজকাল ভাবিই আমার রান্নায় ভুল ধরে, আমাকে রান্না নতুন করে শেখায়। গোল করে রুটি আমি কখনোই বানাতে পারতাম না। হাজার চেষ্টা করলেও কেন যেন পারি না। অথচ কয়েকবার চেষ্টাতেই ওর রুটিগুলো কম্পাস দিয়ে আঁকানো বৃত্তের মতোই গোল হয়। আর সেটা দেখে গোল হয় আমার ‘হা’ হয়ে যাওয়া মুখের ঠোঁটের শেপটাও। বরাবরের মতোই অবাক হয়ে ভাবি, “কেমনে সম্ভব! মানে কেমনে?”
পুষ্পর সাথে বেশি মেলামেশা করার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আসার পর থেকে আমি মনের বিরুদ্ধে গিয়েই ওকে একটু অন্যভাবে এড়িয়ে যেতে চাইতাম। এমনিতেই ফোন আর বইয়ের প্রতি আমার নেশা বেশি, তারমধ্য এই সময়গুলোতে ওকে কৌশলে এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল হিসেবে ফোন আর বইয়ে সময় আরো বেশি দিতাম। ওর কাছে গিয়ে ওর সাথে বসে আড্ডা দেয়ার পরিমাণ কমিয়ে দিলাম। উপরন্তু ও আমার কাছে এসে বসলেও আমি ফোনের দিকে চোখে রেখে ওকে বলতাম, “ওয়েট ভাবি, একটু বয়। একটা লেখা পড়তেছি। পড়া শেষ কইরা নেই।”
কিংবা কখনো-বা বইয়ের পাতায় চোখ রেখে বলতাম, “ওয়েট ওয়েট ভাবি, একটু বয় প্লিজ। আমি এইটুকু একটু শেষ করে নেই।”
কিন্তু আমার সেই ফোনের লেখা পড়া কিংবা বইয়ের পাতার ওই ওইটুকু লেখা পড়া আর সহজে শেষ হত না। ও বিরক্ত হয়ে যেত আমার এহেন ব্যবহারে। কখনো-বা হাত থেকে ফোন কিংবা বইটা কেড়ে নিয়ে বলতো, “আমি আইছি, এহন আমার সাথে কথা কবি। এগ্লা রাখ।”
আমি ক্রুদ্ধ ও বিরক্তিমাখা দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ওর কাছ থেকে ফের সেই ফোন কিংবা বই কেড়ে নেয়ার চেষ্টা করতে করতে বিরক্তমাখা স্বরে বলতাম, “উফ ভাবি! দে তো। ইন্টারেস্টিং একটা লেখা পড়তেছি। ডিস্টার্ব করবি না।”
আমার এমন ব্যবহারে হয়তো-বা ও কষ্ট পেত কিংবা পেত না। তবে বিরক্ত যে হত এটা নিশ্চিত। অগ্নিমূর্তিধারণ করে উঠে দাঁড়াত সে। আমার রুম থেকে ক্রোধান্মত্ত হয়ে বের হতে হতে অত্যুগ্র, রুঢ়, ক্রুদ্ধ অথচ স্পষ্ট অভিমানী স্বরে বলতো, “আর যদি কুনোদিন তোর কাছে আইছি তারপরে কইস!”
সজোরে পদধ্বনি ফেলে বের হয়ে যেত রুম থেকে। আর এদিকে আমি মুচকি হাসতাম। কারণ খুব ভালো করেই আমি জানতাম যে, ওইটা শুধু ওর মুখের কথা। বাস্তবে আমার কাছে না এসে কখনো পারবেই না সে! আমি ওকে যত অপমানই করি না কেন, যতই এড়িয়ে যাই না কেন; কোনোকিছুতেই ওর কিছু হয় না। হওয়ার মধ্যে শুধু এতটুকু হয় যে, এমনভাবে গাল ফুলিয়ে বসে থাকবে যে গাল দেখে মনে হবে কয়েক কেজি আতপচাল গালে ভিজিয়ে রেখেছে পিঠা বানানোর জন্য। অভিমান করে কতক্ষণ আমার ধারের কাছেও আসবে না। মনে মনে একশ একবার শপথ গ্রহণ করবে আমার থেকে দূরে দূরে থাকার। আর তারপরই দেখা যাবে সমস্ত শপথকে চূর্ণবিচূর্ণ করে ভেঙে আবার সুড়সুড় করে একাই এসে পাশ ঘেঁষে বসে আছে।
ওর এমন কাণ্ড দেখে আমি হেসে দিতাম। তারপর রসিকতাস্বরূপ বিস্মিত হওয়ার ভান ধরে গম্ভীর ভঙ্গিমায় বলতাম, “কী ব্যাপার ব্রো? গালের মধ্যে আতপচালের কোনো অস্তিত্ব দেখতেছি না যে এখন! পিঠা বানানো হইয়া গেছে না-কি? কই, কই পিঠা? আনোস নাই আমার জন্য?”
ভাবি আমার গম্ভীর ভঙ্গিতে করা এরকম রসিকতা কপাল কুঁচকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে নির্নিমেষ চেয়ে দেখত কতক্ষণ। তারপর পুনরায় গাল ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে সুর তোলার মতো করে বলতো, “হ, হ! মজা নে, মজা নে। যতদিন বাঁইচা আছি মজা নিয়া ল। মইরা গেলে তো গেলামই। তখন এমনে কইরা কার লগে ভাব দেখাস আর কারে উঠতে বসতে পচাস, হেইডাও তো দেখমু।”
আমি ওর কথা শুনে হো হো করে হেসে উঠতাম। আমার হাসি দেখে ও ফের আমার দিকে ক্রুদ্ধ দৃষ্টি নিক্ষেপ করত। অথচ আমার হাসি থামত না। হাসি না আসলেও আমি ঢং করেই জোরপূর্বক প্রচণ্ড হাসিতে ফেটে পড়ার ভান ধরে ওর কথার প্রত্যুত্তরে বলতাম, “হ, তুই অবশ্য সেইটা দেখতে পারবি। খারাপ মানুষ তো মরার পরে আকাশের তারা হয় না। ভূত হইয়া দুনিয়াতেই ঘুরঘুর করে। আর তুই যে মরার পর ভূত হইয়া সর্বপ্রথম আমার ঘাট মটকানোর মিশনেই নামবি; সেই ব্যাপারে আমি শতভাগ নিশ্চিত!”
১৪
এই বাড়িতে আসার আট মাসের মাথায় ওর বাপের বাড়ি থেকে দুলাভাই বাদে বাকি সবাই ওদের মেনে নেয়। বিয়ের আট-নয় মাস পর আকিব ভাইয়ের প্রথম শ্বশুরবাড়ির আদর-আপ্যায়ন লাভের সৌভাগ্য হয়। তবে দুলাভাই কখনো ওদের মুখোমুখি হয়নি। এমনিতেই এই ঘটনা ঘটার পর থেকে দুলাভাই শ্বশুরবাড়ি অর্থাৎ আমাদের বাড়ি আসাও বন্ধ করে দিয়েছিল। নাহার আপুকে কখনো এখানে এসে রেখে যেতে হলে বাজার পর্যন্ত এনে রেখে যেত। বাজার থেকে পাঁচ মিনিট হেঁটে শ্বশুরবাড়ির সীমানায় পা রাখত না। কারণ ওই একটাই, পুষ্পর মুখোমুখি হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া।
এতদিন পর বাবা-মা যখন একমাত্র মেয়ের এতবড় ভুল ক্ষমা করে মেয়েকে নিজের বুকে টেনে নিতে চাইলেন তখন তিনি জোরগলায় না-ও করতে পারেননি। আবার বাবা-মায়ের মতো অত উদারতা, স্নেহপরায়ণ মন-মানসিকতা দেখিয়ে বোনকে বুকে টেনে নিতেও পারেননি।
সত্যি বলতে, বোনকে খুব বেশিই ভালোবাসতেন কিনা! তাই এতবড় আঘাতটা মেনে নেয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি। যে বোনটা সবচেয়ে বেশি ভালোবাসার ছিল, আদরের ছিল; সময়ের ব্যবধানে আজ সেই বোনই তাঁর কাছে সবচেয়ে ঘৃণিত, সবচেয়ে অপছন্দের ব্যক্তি। তাঁর সমস্ত স্বপ্ন এই বোনরূপী শত্রুটি চূর্ণবিচূর্ণ করে দিয়েছে। এলাকায় তাঁর যে সম্মানটা ছিল সেটা এক নিমিষেই ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। একদল ফেরেস্তারূপী মানুষদের কাছে তাঁর উঁচু মাথা নিচু করে দিয়েছে৷ সেই ফেরেস্তারূপী মানুষগুলোকে মুখ দেখানোর সমস্ত রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে। নিখুঁত অভিনয় করে প্রতিটা মানুষকে ঠকিয়েছে সে। এরপরও কিভাবে ওকে ঘৃণা না করে পারবেন উনি? ঘৃণা তো ওকে তিনি করতে চাননি। ঘৃণা তো সে নিজ ব্যবহার দ্বারা অর্জন করে নিয়েছে।
ভালোবাসার জিনিসকে এত সহজে ঘৃণা করা যায় না। কিন্তু যদি সেই ভালোবাসার জিনিসটির উপর কখনো কোনোভাবে ঘৃণা চলে আসে তবে সেই ঘৃণাটা হয় ভয়ংকর আগ্নেয়গিরির মতোই ভয়াবহ। সেই ঘৃণা পুনরায় কখনো ভালোবাসায় পরিণত হতে পারে না। কিংবা কখনো পুনরায় ভালোবাসায় পরিণত হলেও সেটা বেশ দেরিতে, অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর হয়। তবে ঘৃণার পরিমাণ চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেলে সেটা কস্মিনকালেও সাধারণত ভালোবাসায় পরিণত হতে পারে না। সম্ভবই না সেটা!
আর পুষ্পর প্রতি দুলাভাইয়ের ঘৃণাটা সেই চরম পর্যায়েই পৌঁছে গিয়েছিল। এই ঘৃণার পরিমাণটা এত বেশি ছিল যে, তিনি আজীবনেও এই বোন নামক কালনাগিনীর মুখ না দেখার ব্যাপারে খুব দৃঢ়ভাবে সংকল্পবদ্ধ ছিলেন! তাই দেখা যেত যে, বোন যখন বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসত তখন দুলাভাই বাড়ির বাইরে থাকতেন। হয়তো ব্যবসার কাজে শহরে শহরে ছোটাছুটি করতেন, নয়তো ঢাকায় তাঁর চাচার বাসায় চলে যেতেন কয়েকদিনের জন্য। মোটকথা, কোনোভাবেই পুষ্পর মুখোমুখি হওয়া যাবে না মানে যাবে না। পুষ্প নামের কোনো বোন তাঁর বর্তমানে নেই। একটা পুতুল পুতুল আদুরে বোন ছিল একসময়। কিন্তু সে এখন তাঁর কাছে মৃত, অস্তিত্বহীন!
১৫
দেখতে দেখতে বছরখানেক কেটে যায়। ভাবির অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার সুসংবাদও এসে যায়। কিন্তু এটাকে আমি সুসংবাদ বললেও এটা মূলত ওর শ্বশুরবাড়ির পরিবারের কাছে ছিল দুঃসংবাদ।
আকিব ভাই চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাড়িতে এসে বসেছে দুইমাস হলো। ইচ্ছে করেই চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছে। এই চাকরি তার ভালো লাগে না। কষ্ট বেশি, টাকা কম। এত কম টাকায় এত কষ্ট তার করতে ইচ্ছে করে না। এটার চেয়ে বাড়িতে বসে বসে খাওয়া তার কাছে বেটার অপশন। দুইমাস যাবত চাকরি ছেড়ে বাড়ি আসলেও এখন পর্যন্ত নতুন চাকরির সন্ধান করেনি সে। বিদেশ যাবে বলে নতুন সুর তুলেছে। আর সেজন্য বড় কাকি ইনিয়ে বিনিয়ে ভাবিকে বার কয়েক ওর বাবার বাড়ি থেকে টাকাও এনে দিয়ে বলেছে। কিন্তু ভাবি বুঝেও না বোঝার ভান করে গিয়েছে প্রতিবার। এই কারণে কাকি মনে মনে কিছুটা ক্ষেপে আছে ভাবির প্রতি।
সংসার তুলনামূলক একটু বেশিই টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। কাকার দোকানের গুটিকয়েক চা বিক্রির টাকা, আর একমাত্র গাভীটার দুধ বিক্রির টাকা দিয়েই সংসার কোনোমতে চলে যাচ্ছে। আজকাল এই সংসারে ভাত ফুটানো গেলেও সেই ফুটানো ভাতের সাথে খাওয়ার জন্য একটুখানি তরকারির দেখা মিলে না। কাকি ঘুরে ঘুরে একটু-আধটু শাক-পাতা এখান সেখান থেকে সংগ্রহ করে আনেন। নয়তো পাতলা করে পাতিল ভরে ডাল রান্না করা হয়। সেটা দিয়েই কোনোমতে পেট চালানো হয় সবার। চা আর একটুখানি দুধ বিক্রিতে কতো টাকাই-বা আসে? এই কয় টাকায় পরিবারে যতজন সদস্য আছে ততজনের পেট চালানোই দায় হয়ে পড়ছে; এরমধ্যে যদি আরো অতিরিক্ত একজন সদস্য যোগ হয়, তবে তার পেট চলবে কিভাবে?
কাকি প্রথমবার ভাবির প্রেগন্যান্সির সংবাদ শুনে খুশি হওয়ার বদলে মুখে একরাশ কালো মেঘের আবির্ভাব ঘটালো। অনেকটা বিরক্তির সাথে ভাবির মুখের উপরই তাচ্ছিল্য ভরা স্বরে কটাক্ষ করে বলে ফেললেন, “হুইবার সমায় কি একটু দেইখা হুইনা হুইবার পারছিলা না? পুলাহান যে পয়দা করবার চাও, খাওয়াইবা কী? বাপের সম্পুত্তি বেইছা আইনা খাওয়াইবা?”
বড় কাকি কথাটা আমার সামনেই বলেছিল। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম সেই কথা শুনে। বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল ভাবি নিজেও। হবেই-বা না কেন? কোনো শাশুড়ি তার ছেলের বউকে কি আদৌ এরকম কথা বলতে পারে? কিংবা বললেও কি শোভা পায় সেটা?
কাকি তো কথাখানি বলেই পেছন ফিরে চলে গেলেন গাভীর কাছে। গাভীকে ঘাস খাওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এদিকে ভাবি বাকরুদ্ধ হয়ে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো কাকির দিকে। ওর চোখে তখন ভর করেছে জন্মের অসহায়ত্ব। ঠোঁটগুলো মৃদু কাঁপছে। এটা কান্নার পূর্বলক্ষণ।
ভাবি নির্নিমেষ তাকিয়ে আছে কাকির প্রতি, আর আমি তাকিয়ে আছি ভাবির প্রতি। এভাবে কত সেকেন্ড কেটে গেল জানি না। এরপর হুট করে ভাবির চোখ থেকে একফোটা তরল অসহায়ত্ব যখন কপোল স্পর্শ করলো তখন ভাবি সেটা প্রাণপণে লুকাতে ওর ঘরে গিয়ে ঢুকল। ভাগ্যিস কেউ দেখেনি এই অশ্রু!
ভাবির পেছন পেছন আমিও ঢুকলাম ওই ঘরে। হাসিখুশি, চঞ্চলমতি, প্রাণবন্ত এই মেয়েটাকে বিগত একবছরে কেউ মন ভার করে থাকতে না দেখলেও এই হাসিমাখা চেহারাটার আড়ালে লুকিয়ে থাকা এক বিভৎস বিষাদগ্রস্ত চেহারাটার সাথে আমি খুব ভালো করেই পরিচিত। ওর মেকি হাসির আড়ালে লুকিয়ে রাখা কান্নাগুলো আমার সামনে ঠিকই প্রকাশ পেয়ে যেত। ওর সমস্ত কান্নাগুলো ও আমার কাছে জমা রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করত। ভেতরের চেপে রাখা ব্যাথা, হাহাকারগুলোকেও আমার সামনেই উন্মুক্ত করে দিত। আমি ছিলাম ওর ব্যক্তিগত ডায়েরি।
এইতো কয়েকদিন আগে তাকবীর দ্বিতীয় বিয়ে করল। বিয়ে করার জন্যই নাকি মাসখানেকের ছুটি নিয়ে দেশে এসেছিল। ওর বিয়ের খবর মায়ের কাছ থেকে শুনতে পেয়ে ভাবি দৌড়ে আমার কাছে এসেছে। আমি তখন শুয়ে শুয়ে ফোনে কাকড়া বিষয়ক একটা ইন্টারেস্টিং আর্টিকেল পড়তে ব্যস্ত। ভাবি এসেই আমার পাশে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়ল। ওর দিকে তাকালেও ওর মুখটা আমি দেখতে পেলাম না। বিছানার সাথে মাথা ঠেকিয়ে মুখটা আড়াল করে রেখেছে।
আমি ফের ফোনের দিকে তাকিয়ে নির্লিপ্ত স্বরে বললাম, “কী রে?”
“তাকবীর কাইলকা বিয়ে করছে নন্দি।”
ভাবির কাঁপা কাঁপা কণ্ঠের কম্পনগুলো আমাকে বিস্মিত করে তুলল। স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম যে, ভাবির মন খারাপ, ওর কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু এখানে কষ্ট পাওয়ার মতো তো কিছু দেখছি না। আমি ফোন রেখে ভাবির দিকে মুখ ফিরে শুয়ে উচ্ছ্বাসের স্বরে বললাম, “ওয়াহ্! কোত্থেকে পাইলি এই গুড নিউজ?”
ভাবি এবার আমার দিকে ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বিস্মিত স্বরে বলল, “গুড নিউজ?”
আমি আগের মতোই উচ্ছ্বাসিত ভঙ্গিতে বললাম, “তা নয়তো কী?”
ভাবি কোনো কথা বলল না। আমার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে মুখ করে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে শুয়ে রইল। ভাবির ভেতরের অবস্থা বুঝতে পেরে আমি সেদিন ওর কাঁধে মমতামাথা একটা হাত রাখতেই ওর ফোঁপানোর আওয়াজ শুনতে পাই। ধড়মড়িয়ে উঠে বসি। উৎকণ্ঠিত গলায় চাপাস্বরে বলি, “ওই, কান্না করস ক্যান? এইখানে কান্নার কী আছে?”
ভাবি প্রত্যুত্তরে কান্নারত অবস্থায় আমাকে বলেছিল, “ও বিয়া করছে শুইনা আমার কেমন খারাপ লাগতাছে! অথচ ওর বিয়া করাটা স্বাভাবিক। তাও এত্ত খারাপ লাগতাছে আমার। আর আমি যেইদিন ওরে ঠকাইয়া আকিবের হাত ধইরা চইলা আইসা আকিবরে বিয়া করছিলাম ওইদিন তাইলে ওর কেমন খারাপ লাগছিল! ও এহন যেইটা করছে ওইটায় তো কারো সাথে অন্যায় করা হয় নাই। কিন্তু আমি যেইটা করছিলাম সেইটা ওর সাথে অন্যায় করা হইছিল। ও কেমনে সহ্য করছিল সেইসব নন্দি? বিশ্বাস কর! এইসব ভাইবা কলিজাডা ছিঁড়া যাইতাছে আমার। মানুষটা আমারে কম ভালোবাসছিল না। কেমনে পারছিলাম ওর মতো মানুষরে ঠকাইতে? আমি না পারতাছি কাউরে কিছু কইতে, আর না পারতাছি সইতে। জীবনে এতবড় একটা ভুল করমু আমি সেইটা কল্পনাতেও ভাবি নাই কুনোদিন।”
এইরকম আরো অনেক কথা। সবগুলো কথাই আফসোস আর অনুতপ্ততা মেশানো। আমি আর কী করি? মনে মনে তাচ্ছিল্যের হাসি দিলাম একটা!
চলবে ইন-শা-আল্লাহ