#পারমিতা
পর্ব—৹৩
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ।
আরফান সাহেব আর তার স্ত্রী আকাঙ্খার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লো।
এদিকে ডাক্তার ভয়ে আধমরা!
—-নয় বছর আগের লাশ,স্যার,ম্যাম এটা কি বলছেন আপনারা?আমার পক্ষে আর এখানে কাজ করা সম্ভব নয়।
—দেখুন আপনি এতোটা ভয় পাবেন না,আমাদের কাজটা শেষ করতেই হবে।পোস্টমর্টেম করার পরে ডেডবডির পার্টস ল্যাবে পাঠাতে হবে।তারপর সেখানে পরীক্ষা নিরীক্ষা হবে।এখন কাজ বন্ধ করে দিলে কিভাবে হবে?
মুখে যাই বলুক না কেন,এদিকে ডাক্তারদম্পতি যে খুব আনন্দে আছে এমন নয়,মনে মনে ভীষণ ঘাবড়ে আছে দুজনে।কিন্তু ডাক্তারের সামনে সেটা প্রকাশ করতে পারছে না তারা।
এমনিতেই তারা দুজন বেশ পপুলার ডাক্তার,, ভালো নামডাক তাদের।এখন যদি রাতে ডেডবডির ভয়ে মর্গ থেকে পালিয়ে যায় ব্যপারটা মোটেও সম্মান জনক হবে না তাদের জন্য।
জীবনের থেকে সম্মান টা কখনো কখনো বেশি দামী হয়ে ওঠে।এক্ষেত্রে তাই ঘটছে।
তাছাড়া হাসপাতালের একটা রেপুটেশন আছে।। তারা কিছুতেই হাসপাতালের বদনামের কারন হতে চায় না।
ডাক্তারকে অনেক কষ্টে রাজি করানো হলো।সে নিজের কাজ শুরু করে।
একটু পরে ডোম আবারো চিৎকার দিয়ে উঠলো।আকাঙ্খা জামান আর আরফান সাহেব এবার আর অবাক হলেন না।কারণ তারা জানতেন আবার নিশ্চয়ই কোনো ঝামেলা হবে। এক প্রকার এটার জন্য প্রস্তুত ছিলেন দুজন।
—কি হলো?আবার কি হয়েছে?
(বেশ স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন)
—স্যার!
—জাস্ট শাট আপ।লাশটা গিলে খাবে না আপনাকে,বলছি তো আমরা আছি এখানে।
যা হয়ে যাক আপনি নিজের কাজ শেষ করুন।
—ডেড বডি,ডেডবডির নার্ভ চলছে স্যার!
আরফান সাহেব,আকাঙ্খা ছুটে গেলন ডেডবডির কাছে।সত্যি তো।
নার্ভ রেসপন্স করছে।
কিন্তু নার্ভের গতি কোনো সাধারণ মানুষের মতো মনে হচ্ছে না।কোনো সাধারন মানুষের নার্ভ এতো দ্রুত রেসপন্স করে না।
কিন্তু ডেডবডির নার্ভ কিকরে চলতে পারে,ধরে নেয়া যাক এটা যদি কোনো জীবিত মানুষ ও হয়ে তাকে,তাকে পোস্টমর্টেম করার পরে,শরীরে সব কিছু প্রায় কাটাকুটি করে বের করে আনা আনার পরেও এভাবে নার্ভ রেসপন্স করা শুধু অস্বাভাবিক নয়,অকল্পনীয় বটে।ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেলো সবার!
ডাক্তার ইতিমধ্যে তার জ্ঞান হারিয়েছেন।
আকাঙ্খা লক্ষ্য করছে তার স্বামী অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে দিয়েছে।
—-না এটা হতে পারে না,হতে পারে না এটা।। এটা কোনো লাশ না,আমি খুব ভালো করেই জানি।
—আরে কি হলো তোমার?মাথা ঠান্ডা রাখো প্লিজ।
—কি বললে তুমি।মাথা ঠান্ডা রাখবো,এটা দেখেও মাথা ঠাণ্ডা রাখবো আমি।আমি আগেই বলেছিলাম তোমার দরকার নেই ফালতু ঝামেলায় জড়িয়ে পড়ার,শুনলে না আমার কথা।
—আহ,কি হচ্ছে আরফান।চুপ করো।
আকাঙ্খা বুঝতে পারছে ভয়ে তার হাসবেন্ডের মাথা ঠিক নেই,সত্যি বেচারা বড্ড ভীতু আর একগুঁয়ে।ওকে জোর করে নিয়ে আসা একদম ঠিক হয় নি।
এখন কি করে সামলাবে একে।
—আমাদের সাথে লুকোচুরি হচ্ছে,আজকে দেখে নেবো আমি।এই ডেডবডির সাহস হয় কিকরে আমাকে ভয় দেখায়।জ্বালিয়ে দেবো,পুড়িয়ে দেবো,শেষ করে দেবো সব।
—-ওহ,নো কাম অন আরফান।কী ভুলভাল বকবক করছো তখন থেকে,আচ্ছা চলো এখান থেকে।
—নাহ।আমি কোথাও যাবো না।আজ ওর একদিন কি আমার একদিন,আমায় ভয় দেখানো!
আকাঙ্খা বুঝতে পারলো আরফান পুরো উন্মাদ হয়ে গেছে।এমন ঘটনা প্রথম নয়,আগেও বহুবার ঘটেছে।একটু কঠিন সিচুয়েশনে পড়ে গেলে নিজেকে কন্ট্রোল রাখতে পারে না সে। এটাকে এক প্রকার অসুস্থতা বলা যায়।
তাকে এখন কিছুতেই সামলানো যাবে না।পুরো সাইকোদের মতো আচরণ করছে সে।
—লাইটার টা কোথায়?কোথায় লাইটার?
—লাইটার দিয়ে কি করতে চাইছো তুমি?
—আছ আমি জ্বালিয়ে দেবো ওকে,পুড়িয়ে দেবো।দেখি তারপরেও কিভাবে বেঁচে থাকে ও।
–নাহ! তুমি এরকম কিছু করবে না।আমি জানি তুমি এখন অসুস্থ। মেডিসিন নিতে হবে তোমার। তোমার ট্রিটমেন্ট, চলো আমার সাথে।
আরফান তার পকেট থেকে একটা লাইটার খুঁজে বের করে।
আকাঙ্খা বাধা দিতেই ওকে ধাক্কা মেরে বাইরে ফেলে দেয়।
তারপর মর্গের দরজাটা বন্ধ করে দিলো।
বাইর থেকে আকাঙ্খা দেখছে তার স্বামী পারমিতার ডেডবডিতে আগুন ধরিয়ে দিলো।
দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো। পারমিতার পুরো শরীর আগুনে ঘিরে ফেলেছে।।
দরজার বাইর থেকে এই দৃশ্য দেখে পারমিতা আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারলো না, সে দেখতে পাচ্ছে তার স্বামী একটা বড়ো ধরনের অঘটন ঘটাতে চলেছে।
—আরফান কি করছো না,ওপেন দ্যা ডোর, প্লিজ ওপেন দ্যা ডোর।প্লিজ।
আরফান তার কথায় কর্ণপাত করে না,এদিকে আকাঙ্খা আপ্রাণ চেষ্টা করছে ভেতরে যাবার।
সে জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে লাগলো।
এক পর্যায়ে দরজাটা খুলে গেলো।
হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়লো।
ধীরে ধীরে স্বামীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালো সে।
আরফান এখন অনেকটাই স্বাভাবিক।অবাক দৃষ্টিতে দুজনে তাকিয়ে আছে পারমিতার লাশের দিকে।
এতো দীর্ঘ সময় ধরে আগুনে পোড়ার পরেও পারমিতার লাশ এখনো অক্ষতো অবস্থায় পড়ে আছে!
আগুনে ওর শরীর এতটুকু ক্ষতিগ্রস্ত হয় নি।
একটু পরে আগুন থেমে গেলো।
ধীরে ধীরে চারপাশের পরিবেশ স্বাভাবিক হতে থাকে।
পারমিতার লাশ আবারো স্বাভাবিক হয়ে গেছে।একটু আগে তাকে পোস্টমর্টেম করা হয়েছে বোঝার কোনো উপায় নেই।
নেই শরীরের কোথাও কাটা ছিড়ার দাগ,
নেই কোনো রক্ত।
পারমিতার পরিপূর্ণ অক্ষত দেহ পড়ে আছে টেবিলের ওপরে।।
আরফান আর আকাঙ্খা শুধু একে অপরের দিকে তাকাতে থাকে।তাদের মুখে কোনো কথা নেই।
দুজনেই নির্বাক।
তারা বুঝতে পারলো,এই লাশ নিজেই নিজের নিয়ন্ত্রণ করছে।এর ইচ্ছার বিরুদ্ধে এর সাথে কিছুই করা সম্ভব না।
কিন্তু এই লাশের রহস্য কি,কেন তার কোনো ক্ষতিসাধন করা সম্ভব হচ্ছে না,প্রশ্নটা এখনো সবার কাছে অজানাই রয়ে গেলো।
ডাক্তার এদিকে ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠলেন।
অতঃপর প্রোটোকল অনুযায়ী মর্গের ভেতর থেকে পারমিতার লাশ বের করে ফ্রিজিং করে রাখা হলো।
আরফান সাহেব,আকাঙ্খা জামান মর্গ থেকে বেরিয়ে আসলেন।
আগামীকাল সকালে তাদের আবার হটপিটালে ফিরতে হবে সকাল সকাল।
–
–
–
পরের দিন সকালে নিজের চেম্বারে বসে রোগী দেখছেন ডাক্তার আকাঙ্খা জামান।
একের পর এক রোগী আসছে যাচ্ছে।
হঠাৎ গার্ডের আগমন।
গার্ড : ম্যাম,দেখুন বাইরে ঝামেলা হচ্ছে।
—-কি হয়েছে?
—একজন মহিলা ভেতরে ঢোকার জন্য রীতিমত পাগলামি শুরু করে দিয়েছেন?
—আচ্ছা ওনার সিরিয়াল নম্বর কত?
—সিরিয়াল নম্বর 106!
—সে তো এখনো অনেকটা দূরে,সবে 65 চলছে।
—এখন কি করবো ম্যাম।দেখে মনে হচ্ছে এমারজেন্সি কোনো কেইস।
—হ্যাঁ।সেরকম কিছু হতে পারে। আপনি বরং ভেতরে পাঠিয়ে দিন তাকে।
—ওকে ম্যাম।
একটু পরেই একজন মহিলা রোগী চেম্বারের ডুকে পড়ে।
তার মুখটা একটা বড়ো ওড়না দিয়ে ঢাকা।
ডাক্তার আকাঙ্খার বড্ড অদ্ভুত লাগলো ব্যপারটা।তিনি তার রোগীকে বসতে বললেন। মহিলাটা তার কথা শুনে বসলো।
—কি ব্যাপার,আপনি মুখ ঢেকে আছেন কেন? আর প্রবেলেম কি আপনার?
কোনো উত্তর আসছে না।
—আজব তো,আচ্ছা আপনি কথা না বললে আমি ট্রিটমেন্ট করবো কিভাবে।কিছু বলুন প্লিজ ।
মহিলাটা কোনো কথা বলছে না।
–মুখটা সড়ান, একটু দেখি আপনাকে। আপনাকে না দেখে চিকিৎসা করতে পারবো না আমি।এমনিতেই তো রুলস ব্রেক করে এসেছেন। এখন আবার টাইম ওয়েস্ট করছেন।
কি হলো আমি কিছু বলছি আপনাকে।
—সরি,সরি ম্যাডাম।।রুলস ভাঙার জন্য আমি সত্যি দুঃখিত। (বেশ ক্ষীণ স্বরে)।
—ঠিক আছে,এবার বলুন, প্রবেলেম কি আপনার?
—পিরিয়ড,,বিগত কয়েকমাস ধরে বেশ অনিয়মিত পিরিয়ড হচ্ছে আমার।এমনকি মাসে(………………………………..)আরো অনেক কিছু ইত্যাদি ইত্যাদি।
পিরিয়ডের কথা শুনেই চমকে উঠলেন ডাক্তার আকাঙ্খা।গতকালের সেই অদ্ভুত আর অসম্ভব পিরিয়ডের কথা মনে পড়তেই বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো।
—আচ্ছা,আপনার সাথে ফেইস টু ফেইস কথা বলতে হবে,দেখুন এভাবে ট্রিটমেন্ট করা যায় না।ঘোমটাটা সরান দয়া করে।
মহিলাটা তার মাথার ওপর থেকে ওড়নাটা ধীরে ধীরে সরিয়ে ফেললো।
ওড়নাটা নিজের কাধের ওপরে ফেলে দিলো সে।
আকাঙ্খা জামান চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে দেখছেন তাকে।
ভয় ,আতঙ্ক আর বিষ্ময়ে গলা শুকিয়ে আসছে তার।
—এতো পারমিতা।পারমিতার লাশ যখন ফ্রিজিং করে রাখা হয়েছিলো সেই চেহারা এখনো স্পষ্ট মনে আছে আকাঙ্খা জামানের।হুবহু সেই মেয়েটার মতো দেখতে।সেই চোখ,সেই নাক,সেই গাল, সেই ঠোঁট!সেই অবয়ব।সাথে দুজনের সেম পিরিয়ড কেস।কিন্তু এমনটা কি করে পসিবল?
—-হায় আল্লাহ!এটা আমি কি দেখছি নিজের চোখে দেখেছি,স্বপ্ন দেখছি না তো?
(নিজের মনকে অজান্তেই প্রশ্ন করে আকাঙ্খা জামান)
—আআ!আপনি এখানে?
—জ্বী ম্যাডাম,আমি এখানে মানে?বুঝলাম না আপনার কথা।আপনি কি আমায় চেনেন, আগে দেখেছেন কোথাও?
—আপনার নাম কি,নাম কি আপনার?
—আমার নাম আর্শি!আর্শি চৌধুরী।
—ও আচ্ছা।।
—-কিন্তু আপনি,আচ্ছা আগে কি কখনো দেখা হয়েছে আমাদের?
—না না।আমি এমনি জিজ্ঞাসা করলাম, প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।
—আর ইউ ওকে ম্যাডাম?আপনাকে কিন্তু ঠিক লাগছে না আমার।
—না আমি ঠিক আছি,আই’ম অলরাইট।
আকাঙ্খা জামান মেয়েটার মুখের কথা যতোই শুনছে অবাক হয়ে যাচ্ছে।এটা কিকরে হয়?একটা মৃত মানুষ, যাকে গতরাতে পোস্টমর্টেম করতে দেখেছে।সে এখন জলজ্যান্ত সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
দুজন মানুষের চেহারায় এতোটা অদ্ভুত মিল থাকে কিকরে?আর কিছু ভাবতে পারছে না আকাঙ্খা জামান।মনে হচ্ছিল কেউ যেন শত টন মন ওজনের একটা পাথর চাপা দিয়ে রেখেছে তার মাথায়।এই নিয়ে কিছু ভাবতেই গেলেই মাথাটা ক্রমাগত ভারী হয়ে আসছে তার।
মেয়েটাকে কোনমতে চোখ বুঝে কাঁপা হাতে একটা প্রেসক্রিপশন লিখে দিথলো।।
কি লিখলো না লিখলো সে নিজেও জানে না।
মেয়েটাকে বিদায় করতে পারলেই বেঁচে যায় আকাঙ্খা,কারণ তাকে এখন মর্গে যেতে হবে।
সে মর্গে গিয়ে পারমিতার লাশ নিজের চোখে দেখতে চায়,পারমিতার লাশ না দেখা পর্যন্ত শান্তি পাচ্ছে না কিছুতেই।
মেয়েটা যদি পারমিতা হয়ে থাকে তবে মর্গে তার লাশ নিশ্চয়ই থাকার কথা নয়।
আর কিছু না চিন্তা করে মর্গের দিকে ছুটে চললেন ডাক্তার আকাঙ্খা জামান।
তার চেম্বার থেকে মর্গ বেশ দূরে,যেতে একটু বেশী সময় লাগে।
নিজের সর্বশক্তি দিয়ে যতো দ্রুত সম্ভব হেঁটে চলছে সে।
আতংক আর উত্তেজনায় প্রতিটা মুহূর্তকে ঘন্টার মতো দীর্ঘ মনে হচ্ছে তার।
এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একপর্যায়ে মর্গের সামনে পৌঁছে গেলো,,তারপর ডেডবডি স্টোর রুমে।
বুকটা এখনো দুরুদুরু করছে।
ভয়ে ফ্রিজ বক্সটা খুলতে পারছে না সে।।
না জানি ফ্রিজ খুলে আবার কোন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়!
লাশটা ভেতরে থাকলে তো ভালো,আর না থাকলে তখন,তখন কি করবে আকাঙ্খা।
কিকরে সামলাবে নিজেকে?
নাহহ।এতো ভাবাভাবি করার টাইম নেই।কাঁপা কাঁপা হাতে পারমিতার লাশের ফ্রিজ বক্সটা ডোরটা খুলতে লাগলো।
তারপর নিজের চোখ মেলে আস্তে আস্তে ভেতরে তাকাতে লাগলো।
যে ভয়টা পেয়েছিলো তাই হলো। বক্সের ভেতরে পারমিতার লাশ নেই।
মাথা ঘুরে পড়ে যাবার উপক্রম হলো আকাঙ্খা জামানের ।একটা লাশ বক্সের ভেতর থেকে গায়ের কিকরে হয়ে যেতে পারে।
আচ্ছা লাশটা কেউ সরিয়ে ফেলে নি তো?হয়তো হসপিটালের কেউ লাশটা নিয়ে গেছে এখান থেকে।
কিন্তু গতকাল রাত থেকে আজ সকাল এতোটুকু সময়ের ভেতরে কে করলো কাজটা,আর করলেও তার নিশ্চয়ই জানার কথা।
কি করা উচিত এখন। আচ্ছা আরফানকে একটা কল করলে কেমন হয়,কিন্তু সেই বেচারা তো এখনো পুরোপুরি সুস্থ হয় নি,অসুস্থতার কারনে হাসপাতালে পর্যন্ত আসতে পারলো না, এখন তাকে এরকম একটা নিউজ কিকরে দেয় সে।
আচ্ছা তার থেকে বরং হাসপাতালের কাউকে বিষয়টা জানানো যাক।আর দেরী করলে চলবে না,এক্ষুনি বেরিয়ে পড়তে হবে।
এটা ভেবে সামনের দিকে পা বাড়ায় আকাঙ্খা জামান।
হঠাৎ মনে হলো বাইরে কিছু একটা যেন নড়েচড়ে উঠলো।
দরজার বাইরে কেউ দাঁড়িয়ে আছে মনে হয়।
—-কে,কে বাইরে?কেউ কি আছো? কি ব্যাপার কথা বলছো না কেনো?
আকাঙ্খার চোখজোড়া ভুলক্রমে দরজার নিচের দিকে যায়।
দরজার নিচের অংশ ফ্লর থেকে দুই ইঞ্চির মতো ফাঁকা।কেউ একটা দাঁড়িয়ে আছে দরজার বাইরে এটা নিশ্চিত।
ভয়ে ভয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো সে।দিনের বেলা হলেও লাশঘরের চারপাশটা সম্পূর্ণ অন্ধকার,আসলে জায়গাটাই এরকম,এখানে দিন রাত সব সমান।সবসময় জায়গাটা অন্ধকার হয়ে থাকে।
ভেতর থেকে কিছুই বুঝতে পারছে না আকাঙ্খা জামান,হাঁটু গেড়ে নুয়ে সেই দুই ইঞ্চি ফাঁক দিয়ে বাইরের দৃশ্য প্রতক্ষ্য করার চেষ্টা করেছে সে।
মূহুর্তে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই বস্তুটা দেখেই একটা প্রচন্ড চিৎকার দিয়ে দূরে সরে গেলো।
—আল্লাহ।এটা কি দেখছি আমি,না আমি নিশ্চয়ই ভুল দেখেছি।এটা কিছুতেই সম্ভব নয়।
ভেতর থেকে দরজার বাইরে একটা পা দেখতে পায় আকাঙ্খা,যে কিনা দাঁড়িয়ে আছে। আর তার পায়ের আঙ্গুলে একটা সিরায়াল নম্বর প্লেট লাগানো।মৃত মানুষের সিরিয়াল নম্বর,ডেডবডির পায়ের আঙ্গুলের সাথে এমন একটা নম্বর প্লেট লাগিয়ে দেয়া হয়,যাতে তাকে সহজে শনাক্ত করা সম্ভব হয়।
তার মানে বাইরে কোনো মানুষ নয়,একটা লাশ দাঁড়িয়ে আছে?
লাশের সিরিয়াল নম্বর 204।
এক দৌড়ে ফ্রিজ বক্সের দিকে ছুটে যায় আকাঙ্খা জামান।
204 নম্বর ডেডবডি! 204 নম্বর।
হন্নে হয়ে খুঁজতে থাকে সে!
এতো পারোমিতার সিরায়াল নম্বর।ওর সিরিয়াল নম্বর 204।
তাহলে বাইরে আর কেউ নয়,পারমিতা দাঁড়িয়ে আছে!
কিন্ত পারমিতা তো একটা লাশ,সে আর বেঁচে নেই,মারা গেছে,আজ নয়,দীর্ঘ নয় বছর আগে মারা গেছে পারমিতা।
কিন্তু ওর লাশ হাটাচলা করছে কিভাবে?
নাহ!এবার আর নিজেকে স্থির রাখা সম্ভব হলো না,মাথাটা ভন ভন করে ঘুরতে লাগলো তার।
পা জোড়া দরজার বাহির থেকে সরে গেলো, তারপর হেঁটে হেঁটে মর্গের পেছনের দিকটায় এগিয়ে যেতে লাগলো।
পারমিতা তার পেছন পেছন।
—কে,কে আপনি?দাঁড়িয়ে যান,দাঁড়িয়ে যান বলছি।
মেয়েটা কোনোদিকে না তাকিয়ে আপন মনে হেঁটেই চলছে,আকাঙ্ক্ষার ডাকের কোনো ভ্রুক্ষেপ করছে না।
—কি হলো,দাঁড়াতে বলছি না আমি,এই যে, প্লিজ থেমে যান।দেখুন আপনি কিন্তু এভাবে ভয় দেখাতে পারবেন না।
মেয়েটা এবার সত্যি নিজের হাঁটা বন্ধ করে থেমে যায়।
ধীরে ধীরে ঘুরে তাকাতে লাগলো সে আকাঙ্খার দিকে!
তাকে এক পলক দেখেই মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে যায় আকাঙ্খা জামান!
তারপর আর কিছুই মনে নেই তার।
জ্ঞান ফিরলে নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করে।একজন গার্ড তাকে অজ্ঞান অবস্থায় পেয়ে নিয়ে আসে, তারপর নার্সরা সুস্থ করে তোলেন তাকে।
তখন বিকেল হয়ে গেছে।
জ্ঞান ফিরে আকাঙ্খার সবার আগে তার হাসবেন্ড আরফানের কথা মনে পড়ে।
বেচারা বাসায় একা অসুস্থ হয়েপড়ে আছে,গতরাতের ধাক্কা এখনো সামলাতে পারে নি সে।
পারমিতার লাশের কথা এখন মাথায় আনলে চলবে না।আগে বাসায় যেতে হবে। না জানি আরফানের কি কনডিশন এখন।
হসপিটালের সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে সে বাসার উদ্দেশ্য রওনা হয়।
বাকিদের ফেইস করলেই সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতেই হয়তো রাত হয়ে যাবে!
সে কেন মর্গে গিয়েছিলো,কিভাবে অজ্ঞান হলো, কেন হলো? ইত্যাদি ইত্যাদি আরো না না প্রশ্ন। এখন আর এসবের ভেতরে জরালে চলবে না।
বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে আসে আকাঙ্খা।অদ্ভুত ব্যাপার আরফান নেই বাসায়। সন্ধ্যা বেলা এমনিতেও বাসায় থাকে না সে, আজো তার ব্যতিক্রম হলো না।
বেডরুমে ঢুকে নিজের জন্য নিয়ে আসা ওষুধগুলো ড্রয়ারে রাখতে গেলো।
একটা পুরনো ওয়ালেট পড়ে আছে ভেতরে। দেখে অনেক পুরনো মনে হচ্ছে। এতো পুরনো জিনিস এখন এখানে কিকরে আসলো।
নিশ্চয়ই আরফান খুঁজে খুঁজে বের করেছে,পরে আবার জায়গামতো রাখতে ভুলে গেছে হয়তো।
কিন্তু এতো পুরনো ওয়ালেটের কি দরকার পড়লো তার।
-কি করবো খুলে দেখবো কি?খুলে দেখা ঠিক আছে (নিজেকে প্রশ্ন আকাঙ্খার)
—আচ্ছা,দেখেই নেই বরং।হয়তো ওর পার্সোনাল কিছু আছে ভেতরে!
ওয়ালেট হাতে নিয়ে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখতে থাকে।ভেতরে তেমন কিছু নেই,তবে একটা পার্টের ভেতরে কিছু একটা দেখা যাচ্ছে।
—এতো কোনো একটা ছবি।বহু পুরনো একটা ছবি।
আকাঙ্খা ওয়ালেট থেকে ছবিটা বের করে আনলো।
ছবিটা নিজের চোখ জোড়ার সামনে ধরতেই একটা প্রচন্ড শক খেলো সে!আঁতকে উঠে দুপা পেছনে সরে যায়।
—-এতো পারমিতার ছবি।ছবিটা কম হলেও আট দশ বছর আগের।
পারমিতাকে চিনতে বিন্দুমাত্র ভুল হয় নি আকাঙ্খার!
তার মানে আরফান আগে থেকেই পারমিতাকে চিনতো?তবে ও পারমিতাকে দেখেও না চেনার ভান করলো কেন?পারমিতার সাথে কি সম্পর্ক আরফানের?
চলবে…….