#পারমিতা
পর্ব—১১
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ
পারমিতার দাদু লোকটাকে দেখতে বেশ সাদাসিধে মনে হলেও লোকটা মোটেও সেরকম নয়,কিছু একটা তো চলছে তার মনের ভেতরে।যে নিশ্চয়ই চায় না আকাঙখা পারমিতার ব্যাপারে আগ্রহ দেখাক,পারমিতার মৃত্যু রহস্য খুঁজে বের করুক।নয়তো আকাঙখাকে অ্যাটাক করার আর কি কারণ হতে পারে।
নাহ!পারমিতার সাথে এই ব্যাপারে কথা বলতেই হবে,একমাত্র পারমিতাই পারবে তার মনের সন্দেহকে দূর করতে।
আকাঙখা নিজের বেড থেকে উঠে মর্গের দিকে ছুটতে থাকে!
আরফান আর সৌজন্য তার এই ব্যবহারে বেশ অবাক হয়ে যায়।
আকাঙখা এভাবে ছুটে যাচ্ছে কোথায় কিছু বুঝে উঠতে পারছে না তারা।
আকাঙখা কোনোক্রমে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ছুটে চলছে,ওর মাথার ব্যান্ডেজ টা এখনো খোলা হয় নি।
—-আরে এভাবে ছুটে কোথায় যাচ্ছো,
থেমে যাও বলছি,,থেমে যাও।আকাঙখা থামো।
(আরফান তাকে পেছন পেছন অনুসরণ করছে )
—ম্যাডাম,আপনি এভাবে কেন ছুটছেন,আপনি কিন্তু এখনো সুস্থ হন নি,লেগে যাবে আপনার।প্লিজ থামুন।(সৌজন্য)
কারো কথা কানে তুলছে না আকাঙখা সে নিজের মতো করে এগিয়ে যায়।
দুজনেই লক্ষ্য করে আকাঙখা মর্গের দিকে মুভ করছে।
—-ভারী অদ্ভুত তো,এ এই সময়ে মর্গে কেন যাচ্ছে,কতগুলো লাশ ছাড়া কি আছে মর্গের ভেতরে?(আরফান)
—ম্যাডাম প্লিজ, আপনি এইভাবে ছুটবেন না, আপনি তো নিজেও একজন ডাক্তার,এইরকম শারিরীক কন্ডিশনে ছুটোছুটি করাটা কি ঠিক কাজ হচ্ছে বলুন,
ছুটতে ছুটতে আকাঙখা একপর্যায়ে মর্গের ভেতরে প্রবেশ করলো।
তারপর সোজা ২০৪ নম্বর ফ্রিজ বক্সের কাছে।
বক্সটা খুলতেই পারমিতার লাশটা বেরিয়ে আসলো।
আকাঙখা পারমিতাকে উদ্দেশ্য করে বলতে থাকে…..
—-পারমিতা,ওঠো। আমার তোমার সাথে কথা বলা খুব প্রয়োজন।দেখো আমি তোমায় হেল্প করতে এসেছি,প্লিজ কথা বলো আমার সাথে।
আরফান আর সৌজন্য ওর এই অদ্ভুত ব্যবহারে চমকে গেলো,
—এটা কি করছেন উনি,,,উনি একটা ডেডবডির সাথে কথা বলছেন,এর তো মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
(সৌজন্য)
—আকাঙখা,এটা কি করছো তুমি,তুমি কি নিজের ভেতরে আছো,নাকি,কি করছো,হুশ আছে তোমার?একটা লাশের সাথে কথা বলতে চাইছো তুমি?এটা কোন ধরনের পাগলামি।।(আরফান)
— আমি শুধু একটা লাশের সাথে কথা বলছি না,তুমি ভালো করেই জানো আরফান (আকাঙখা)
—দেখুন,স্যার,ম্যাডাম এমন ভাবে কথা বলছেন,, মনে হচ্ছে এটা কোনো ডেডবডি না,জাস্ট ঘুমিয়ে আছে,ঘুম ভাঙ্গলেই ওনার সাথে কথা বলা শুরু করেন। ইটস টু মাচ্!
সত্যি এবার বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে।আমিও এই হসপিটালের একজন ডক্টর,নিজের চোখের সামনে অন্য একজন ডাক্তারের এমন কার্যকলাপ টলারেট করতে পারি না।(বেশ রুক্ষ স্বরে সৌজন্য)
—আকাঙখা,কি হচ্ছে এসব।দেখো আমার মনে হয় তোমার লং টাইম ট্রিটমেন্ট দরকার।এখান থেকে চলো তাড়াতাড়ি,আর ফেস লস করো না আমার।
আকাঙখা কারো কথার কোনো গুরুত্ব দিয়ে নিজের কাজে ব্যস্ত,সে পারমিতাকে ডেকেই চলছে।
—কি হলো,তুমি কি আমার কথা শুনতে পাচ্ছো না,দেখো একদম ঠিক হচ্ছে না কিন্তু,আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই।
—তোমার মাথাটা কি পুরোপুরি গেছে,একটা লাশকে নিজের কথা শুনতে বলছো,আচ্ছা ডেডবডি শুনতে পারে,না দেখতে পারে?(আরফান)
—পারমিতা পারে,ও দেখতে শুনতে সব পারে, এমনকি কথা বলতেও পারে।
—এটা কোন ধরনের পাগলামি,তোমার আচরণ একদম ঠিক লাগছে না আমার।দিন দিন পাগল হয়ে যাচ্ছো তুমি,
—স্যার,ম্যাডাম কে বরং আমরা নিয়ে যাই এখান থেকে।ওনার সত্যি ট্রিটমেন্ট প্রয়োজন।আমি আজ অবধি কোনো ডক্টর কে এমন অদ্ভুত ব্যবহার করতে দেখি নি,তাছাড়া এমন ও তো নয় যে উনি মেন্টালি ফিট নন,একটু আগেও সুস্থ স্বাভাবিক অবস্থায় দেখেছি ওনাকে।
হঠাৎ আকাঙখার একটা কথা মনে পড়লো,পারমিতা বলেছিলো তার ব্যাপারে কাউকে না বলতে,এখানে আরফান,সৌজন্য এদের সামনে সে হয়তো কথা বলতে চাইছে না, তাই এমনটা করছে।এই কথা আগে মাথায় আসেনি কেন আকাঙখার।
না,এরা ভেতরে থাকলে কিছুতেই কিছু হবে না, এদের বাইরে বের করতে হবে এখন।
—নাহ!!আমি কোথাও যাবো না,তোমরা যাও।প্লীজ আমায় একটু একলা ছেড়ে দাও।
আর আমি পুরোপুরি সুস্থ আছি,তোমাদের ধারনায় পাগলও হয়ে যায় নি।প্লিজ একটু সময় দাও আমায়।
—কিন্তু ম্যাডাম,আপনি যেটা করতে চাইছেন সেটা সম্পূর্ণ অযৌক্তিক..আপনি…..
আরফান বুঝতে পারলো তার স্ত্রী দমবার পাত্রী নয়,ও যেটা বলছে সেটা করেই ছাড়বে,, তাছাড়া পারমিতা শুধু একটা লাশ নয় সে নিজেও জানে,নেহাত সৌজন্য যাতে কিছু বুঝতে না পারে তাই তার সামনে না জানার ভান করেছে জাস্ট।
—ছেড়ে দাও সৌজন্য,তুমি আমার বাইরে চলো,ও যা করতে চায় করুক।আর তুমি এই ডেডবডির ব্যাপারে এখনো অনেক কিছু জানো না,তাই তোমার ওর আচরন এতো অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে,আমি তোমাকে যেতে যেতে সবটা বলছি।চলো,
আরফান সৌজন্যকে নিয়ে মর্গের বাইরে বেরিয়ে আসলো।
মর্গের ভেতরে শুধু আকাঙখা একা আছে।
আরফান সৌজন্যের কাঁধের ওপর হাত রেখে ওর সাথে কথা বলতে বলতে সামনের দিকে চলে গেলো!
—পারমিতা এখন ওঠো,দেখো সবাই চলে গেছে, প্লিজ এবার তো সাড়া দাও।।
পারমিতা মৃতদেহ ধীরে ধীরে সচল হতে শুরু করে।উঠে দাঁড়ায় সে!
— আমি তোমায় বলেছিলাম না,আমার ব্যাপারে কাউকে কিছু না বলতে।।ভুলে গেলে সেই কথা।(পারমিতা)
—-হ্যাঁ,বলেছিলে,আর আমি কিছুই ভুলি নি,একটা বিশেষ কারনে মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো,সরি, আই’ম এক্সট্রিমলি সরি।।
—-বিশেষ কারন,কি বিশেষ কারন??
—আচ্ছা,শোনো।আমার তোমার থেকে অনেক কিছু জানার আছে,,বিশেষ করে তোমার পরাবারের বিষয়ে।
—আমার পরিবারের সম্বন্ধে!আমার পরিবারের সম্বন্ধে কি জানতে চাও তুমি?
—সব জানতে চাই,তুমি আজ আমায় কিছু লুকোবে না।সব খুলে বলবে আমায়।দেখো আমি একটা ভীষণ অদ্ভুত ঘটনা ফেস করেছি আজ সকালবেলা।আমার তোমার থেকে কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর জানা খুব প্রয়োজন।
—বুঝলাম,কিন্তু অদ্ভুত ঘটনা টা কিসের,একটু বুঝিয়ে বলো আমায়।
—সেটা এক্ষুনি কিছু না শুনে বা জেনে বলা সম্ভব নয়,আগে তোমায় যা জিজ্ঞেস করছি তাই বলো।
—ঠিক আছে।আমি জানি তুমি যা করবে নিশ্চয়ই আমার ভালোর জন্যই করবে।তোমার কি প্রশ্ন বলো আমায়।
—ওকে,আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দাও,আগেই কিন্তু বলে দিয়েছি,কোনোভাবেই কোনোকিছু লুকানোর চেষ্টা করবে না,তাছাড়া দেখো এখন তুমি আর জীবিত নেই, আমাদের মতো সাধারণ মানুষ নও তুমি,তোমার কোনো কিছু লুকোনোর প্রয়োজন পড়বে বলে মনে হয় না আমার।
–হ্যাঁ,বলো।আমার জানা থাকলে নিশ্চয়ই সাহায্য করবো তোমায়!
—তোমার দাদা,গতকালকে আমি যাকে নিয়ে এসেছিলাম তোমার কাছে,সে তোমার নিজের দাদা তো?আমি বলতে চাইছি তোমার সাথে তার রক্তের সম্পর্ক আছে,ওহ!সরি ছিলো কি তোমার?
—হঠাৎ এই প্রশ্ন কেন,এটা জানার কি দরকার পড়লো তোমার?
—দেখো তুমি যদি চাও আমি তোমায় সাহায্য করি তবে কোনো পাল্টা প্রশ্ন না করে আমায় উত্তর দাও।
—নাহ।উনি আমার আপন দাদা ছিলেন না,প্রকৃতপক্ষে ওনার সাথে আমার কোনো রক্তের সম্পর্ক ছিলো না!
—ঠিক বুঝলাম না আমি,হিসেব অনুসারে তুমি তো তার নাতিন হতে,তো তোমার সাথে তার কোনো সম্পর্ক ছিলো না,সেটা কিভাবে,বুঝতে পারছি না আমি।
—আমি আজ তোমার থেকে কিছুই লুকোবো না,আমার জীবতকালের কিছু ধ্রুব সত্য যা খুব কম মানুষ জানতো সেগুলো আজ বলবো তোমায়,আমি জানি তুমি নিশ্চয়ই আমার জন্য মঙ্গলকর দিকটাই বিবেচনা করবে।
সাল ১৯৯৪।আমার মা যখন তার স্বামীর হাত ধরে যখন ঐ বাড়িতে প্রথম প্রবেশ করে,,,অর্থাৎ তাদের দুজনের বিয়ে হয়।আমি আমার মায়ের গর্ভে ছিলাম,আমার মা তখন পাঁচ মাসের গর্ভবতী।
—ঠিক বুঝলাম না,তোমার আর তোমার মায়ের ব্যপারটা একটু ক্লিয়ার করে বলো আমায়।
—হ্যাঁ,বলছি।আমার মায় তার বিয়ের ঠিক পাঁচ মাস আগে সে তার জীবনের এক চরম বিভীষিকাময় অধ্যায় পার করে,সেই ঘটনাই তোমায় আমি বলছি।
মা তার মধ্যবিত্ত পরিবারের সকলের কথা মাথায় রেখে একটা ছোট চাকরিতে জয়েন করে।যদিও এতে তার পরিবারের অর্থাৎ আমার নানা, নানু, মামাদের কোনো মত ছিলো না।মা প্রতিদিন সকালে বের হয়ে হয়,ফিরতে ফিরতে তার সন্ধ্যা হয়ে যেতো।
একদিন অফিসের কাজ সারতে সারতে মায়ের একটু বেশিই দেরী হয়ে যায়,এদিকে বাসা থেকে ফোন আসে আমার নানাভাই ভীষণ অসুস্থ।
মা তার হাতের কাজ ফেলে নিজের বাসার উদ্দেশ্য ছুটলো,
অফিস থেকে তার বাসায় ফেরার জন্য মেইন রোড ছাড়াও একটা শর্টকাট ছিলো,যদিও রাস্তাটা বেশ সরু এবং একটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে যায়।মা একটা ট্যাক্সি নিয়ে সেই পথ ধরে তার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়।ওটাই ছিলো তার জীবনের সবথেকে চরমতম ভুল।
চলবে……