পারমিতা পর্ব ১০

0
520

#পারমিতা
পর্ব—-১০
কাহিনী ও লেখা : প্রদীপ চন্দ্র তিয়াশ

হাসপাতালে পৌঁছাতে পৌঁছাতে প্রায় ভোর চারটা বাজে।আকাঙখা জানেনা এতোক্ষণে বোধহয় আমার চিন্তায় আরফান পাগলই হয়ে গেছে।

পারমিতার লাশ নিয়ে যতো দ্রুত সম্ভব মর্গে পৌঁছে গেলো সে।তারপর ওর লাশটা আবার ফ্রিজ বক্সের ভেতরে রেখে দেয়।

এবার বাসায় ফিরতেই হবে,একটু বেশিই বাড়াবাড়ি হয়ে গেলো।ইতিমধ্যে পারমিতার কথামতো ফোন করে অনেককেই ওর মা দাদার কথাটা জানিয়ে দেয়া হয়েছে।এবার দেখা যাবে কি হয় না হয়।

মর্গ থেকে ফেরার পথে হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠলো।আকাঙখা বুঝতে পারলো এটা আরফান ছাড়া কেউ নয়।
ফোন তুলতেই তার ধারণা সঠিক হলো।

—হ্যালো।

—-আরে রাখো তোমার হ্যালো।আচ্ছা একটা কথা বলো তো,তোমার লাইফে কি আমার কোনো গুরুত্ব নেই।যখন যা খুশি তাই করবে।

—আমি কি এমন করেছি আরফান!এতোটা রিয়্যাক্ট করছো কেন?

—বাহহহ,বাহহ,বা,তুমি কি করেছো,কি মনে হয় তোমার,আজ সকাল থেকে যে কান্ডগুলো ঘটিয়ে যাচ্ছো একের পর এক,তারপরো একটি বারো মনে হয় না তোমার,তুমি যা করছো ঠিক করছো না।

—কি ঠিক করি নি আমি?

—আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি আকাঙখা,মানে কি বলবো বুঝতে পারছি না,তুমি সকাল থেকে উধাও,ফোন করছি বার বার কেটে দিচ্ছো,না হয় ফোন অফ করে রাখছো।
হ্যাঁ,হতেই পারে কোনো পার্সোনাল কাজে হয়তো আটকে ছিলে!কিন্তু রাতে,সারারাত ধরে কি এমন পার্সোনাল কাজ তোমার,যে আমি এতোবার ফোন কল করার পরেও ডেলিভারেটলি ইগনোর করে যাচ্ছো!

—আমি বাসায় ফিরে তোমায় খুলে বলছি সব। দেখো এতো কথা মোবাইলে বলা সম্ভব নয়।

—আচ্ছা,কখন ফিরছো বাসায়?(নিজেকে সংযত করে)

—এইতো হাসপাতাল থেকে বের হচ্ছি,আধাঘন্টার ভেতরে ফিরছি,রাস্তায় জ্যাম নেই,লেট হবার তো কথা নয়।

–তাড়াতাড়ি ফিরে এসো,দেখো এমনিতেই তোমার এই অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যবহারের জন্য মাথাটা ঘেঁটে আছে।আজ মেজাজ গরম করিও না। তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।

—ওকে,তুমিও অযথা চাপ নিও না,আমি আসছি।

ফোনটা রেখে আবারো হাঁটতে থাকে আকাঙখা।হাঁটতে হাঁটতে একদম হাসপাতালের সামনে চলে আসে সে।

একটা অদ্ভুত অনুভূতি হতে লাগলো তার,আবারো মনে হচ্ছে কেউ বোধহয় আছে তার পেছনে।কিন্তু এই সময়ে কে ফলো করবে তাকে আর কেনই বা করবে।

একটু ভয় ভয়ও লাগতে আরম্ভ করলো,এমনিতে আশেপাশে তেমন কেউ নেই।

আকাঙখার সন্দেহ ক্রমশ বাড়তেই থাকে।
এবার সে নিশ্চিত কেউ এসে দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে।

নাহ!এবার ঘুরে তাকাতেই হয়।যদিও পেছনে তাকাতে ভীষণ ভয় করছে তার।

আচ্ছা,আরফানকে একটা ফোন দিলে কেমন হয়।এখনো অনেকটা পথ তাকে একা একাই যেতে হবে।কিন্তু সাহস পাচ্ছে না সে কিছুতেই। আরফানকে বরং ফোন করে চলে আসতে বলা যাক,তার সাথে নির্ভয়ে বাসায় ফেরা যাবে।কোনো রিক্সও থাকবে না তখন।

এগুলো ভেবে কাঁপা কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে নিলো আকাঙখা।

ফোনে আরফানের নম্বর ডায়াল করতে যাবে ঠিক তখন কিছু বুঝে ওঠার সুযোগ না দিয়েই পেছন থেকে কেউ আঘাত করে তার মাথায়!

হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায় আকাঙখার।সে একটা অস্ফুট আর্তচিৎকার দিয়ে ধীরে ধীরে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো।

আকাঙখা নিজেও বুঝতে পারে নি,তার ওপর কেউ এভাবে অতর্কিতে আক্রমন করবে।সেই সুযোগ টা নিয়েছে অপরাধী।

সে আকাঙখার মাথায় সজোরে আরো একটা ব আঘাত করতে যাবে ঠিক তখন কারো পায়ের শব্দে ছুটে পালিয়ে গেলো।

সকালবেলা চোখ খুলতেই আকাঙখা দেখতে পায় সে তার হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে।।
তার পাশে একজন অপরিচিত ব্যক্তি বসে আছে।লোকটার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকায় আকাঙখা।ধীরে ধীরে তার ভোররাতের সকল কথা মনে পড়তে থাকে।

আরফানকে ফোন করা,কারোর অস্তিত্ব অনুভব করা,পেছন থেকে আঘাত করা তারপর মাথা ঘুরে মাটিতে লুটিয়ে পড়া,সবকিছু ক্লিয়ার হতে থাকে আকাঙখার কাছে।

—-এখন কেমন আছেন ম্যাডাম?

—একটু বেটার লাগছে।(ইতস্তত স্বরে উত্তর দেয় আকাঙখা)

—আমায় চিনতে পারলেন না,তাই তো??(মুচকি হেসে)

—নাহ!সরি।চিনতে পারলাম না আপনায়।।

—আমার নাম সৌজন্য,ডক্টর সৌজন্য।গতকালকেই এই হাসপাতালে জয়েন করেছি।

—ওহ!ইয়েস।তার মানে আপনি সেই,যার নিউ জয়েন করার কথা ছিলো।বাই দ্যা ওয়ে,ইউ আর মোস্ট ওয়েলকাম।

—আমাকে এক্ষুনি ওয়েলকাম জানাতে হবে না ম্যাডাম,আগে আপনি সুস্থ হোন।

—আমি এখন সুস্থই আছি।আমাকে নিয়ে অযথা টেনশন করার কোনো কারন নেই।

—ভেরি গুড।আর যাই হোক না কেন,আপনাকে কিন্তু রেস্ট নিতেই হবে।আরফানকে স্যারকে ফোন করা হয়েছে,উনি হয়তো এক্ষুনি চলে আসবেন।

—আপনি আরফানকে চিনেন?

—হ্যাঁ,গতকালকেই পরিচয় হয়েছে আমাদের। আপনি ছিলেন না তখন।

—আমি একটা জরুরী কাজে শহরের বাইরে গিয়েছিলাম,ফিরতে এতোটা লেট হয়ে যাবে বুঝতেই পারি নি।তারপর ভোররাতে..

কথাটা শেষ না হতেই কেবিনের ভেতরে আরফান ছুটে এসে ঢুকলো।

—আকাঙখা,আকাঙখা।তুমি ঠিক আছো তো?

—উনি এখন পুরোপুরি সুস্থ আছেন স্যার,আমিই ওনার ট্রিটমেন্ট করেছি।

—থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ,থ্যাঙ্ক ইউ।তুমি বাঁচিয়ে দিলে আমায়।জানিনা আজ তুমি না থাকলে কি হতো?

—প্লিজ আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে লজ্জা কেন দিচ্ছেন।চোখের সামনে কাউকে বিপন্ন অবস্থায় দেখে কি আমি পালিয়ে যেতাম।আর শুধু আমি না আমার জায়গায় যে কেউ থাকলে একি কাজ করতো।

—আচ্ছা,এক্সাইটলি কি হয়েছিলো রাতে,খুলে বলো আমায়।আমার মাথায় ঢুকছে না কিছু।এই হাসপাতালে এতোগুলো বছর ধরে আছি।আজ অবধি এমন কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলো না,আর কেই বা করতে আসলো এমন কাজ,কি চায় তারা আমাদের থেকে?

(আকাঙখা শুয়ে শুয়ে দুজনের কথা শুনে চলছে,কিছু বলছে না)

—দেখুন স্যার,কাজটা কে করেছে কেন করেছো সেটা তো আমি বলতে পারবো না।
রাতে,রাত বলা ঠিক হবে না ভোররাতের দিকে হবে একটা ইমারজেন্সি পেসেন্ট কেস সলভ করে নিজের রুমে ফিরছিলাম,হঠাৎ চোখের সামনে দেখতে পাই,একটা মুখোশ পড়া লোক ম্যাডামকে অ্যাটাক করতে যাচ্ছেন,যদিও আমি আসার আগে উনি অলরেডি একবার মাথায় আঘাত করে ফেলেছেন,আর ম্যাডাম তখন মাটির ওপরে পড়ে ছিলেন।

লোকটা আমার উপস্থিতি টের পেয়ে ছুটে পালিয়ে যায়।

—মাই গুডনেস।এমন একটা ভয়ানক কাজ কে করলো।আর তার আমাদের প্রতি অভিযোগ টা কি,জাস্ট কিছু মাথায় আসছে না আমার।

–সবাই এখন সেটাই ভাবছে স্যার,

—আমি বলেছিলাম তোমায়,রাত বিরেতে এখানে সেখানে,না যেতে।কই আমার কথা তো কানে নেবার প্রয়োজন বোধ করো না তুমি।

—তুমি কিন্তু শুধু শুধু রাগ করছো আমার ওপর,, দেখো আমি কিকরে জানবো,কেউ আমার সাথে এমন কিছু করতে চাইবে,মানুষ কি আগে থেকে আসন্ন বিপদের জন্য প্রস্তুত থাকে সবসময়,না সে জানতে পারে?বলো?

—এখন তো জানলে।দেখো আমি কিন্তু তোমার আর কোনো কথা শুনছি না,এরপর থেকে আমার অনুমতি ছাড়া বাইরে কোথাও যেতে পারবে না,বলে দিচ্ছি।

ডক্টর সৌজন্য এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দুজনের ভেতরকার কথা শুনছিলো,এরপর সে আবারো তার মুখ খুললো।

—স্যার,ম্যাডাম।আপনারা দুজন কিছু মনে না করলে আমি একটা কথা বলি!(সৌজন্য )

—হ্যাঁ,বলো!

—আমরা তো একটা কাজ করতে পারি,

—কি কাজ?

—হাসপাতালের বাইরে সিসিটিভি ফুটেজ চেক করলে কেমন হয়?জানি পুলিশ এসে তাদের কাজ অবশ্যই করবে,কিন্তু তার আগে আমাদের চেক করে নিতে প্রবেলেম কি?

সিসিটিভি ফুটেজের কথা শুনে আরফানের মুখটা একটু অন্যরকম হয়ে গেলো,

—কি দরকার আমাদের সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে ঘাটাঘাটি করার,এই কাজের জন্য পুলিশ তো আছে।তাদেরকেই বরং তাদের কাজটা সুষ্ঠু ভাবে করতে দেই।এখন এগুলো নিয়ে আদৌ সময় নষ্ট করার মানে হবে না,এখন তার থেকে আকাঙখার সুস্থ হওয়াটা বেশি প্রয়োজন।

—ঠিক আছে স্যার,আপনি যেমনটা চাইবেন। আমি জাস্ট আমার মনের ভাবনাটা জানালাম।

—না ,ঠিক আছে।

আকাঙখা আরফানের ব্যবহারে অবাক হয়ে গেলো,ও সিসিটিভি ফুটেজ চেক করতে বাঁধা দিচ্ছে কেন,আচ্ছা,কোথাও এমন নয় তো গতরাতের ঘটনার সাথে পারমিতার মৃত্যুর কোনো কানেকশন আছে।কেউ বা কারা চায় না, আকাঙখা পারমিতার ব্যাপারে ইনভলব থাকুক।তাকে সাহায্য করুক।ঠিক সেই কারনে আকাঙখার ক্ষতি করতে চাইছে সে।

হতে পারে,এই সিসিটিভি ফুটেজের মাধ্যমে কোনো ক্লু বেরিয়ে আসলো,একটা বেশ ভালো প্রস্তাব দিয়েছে ডক্টর সৌজন্য।
আকাঙখা তার প্রস্তাবে রাজি হয়।শুধু আরফান কেন বাঁধা দিচ্ছে এটাই বুঝতে পারছে না সে।

অবশেষে সিসিটিভি ফুটেজ নিয়ে আসা হলো।
ল্যাপটপ কম্পিউটারের সামনে আরফান,আকাঙখা,ডক্টর সৌজন্য।
তিনজন উৎসুক দৃষ্টিতে রাতের ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে চলছে।

আরফান প্রথমে একটু নিরুৎসাহিতা দেখালেও এখন সেও ভীষণ উৎসুক।
ভীষণ নার্ভাস ফিল হচ্ছে আকাঙ্খার,না জানি কি না কি সিসিটিভি ফুটেজে দেখতে হয়।

মুহুর্তেই স্ক্রিনে ক্রমশ সবটা পরিস্কার হতে থাকে!

ডক্টর সৌজন্য ভিডিও ফুটেজ চেক করছে,তার দুপাশে দুজন বসে আছে।

—-এটা তো অনেক আগের,ভোররাতের দিকেরটায় যাও।তোমার এক্সাট টাইম মনে আছে,যখন অ্যাটাক করা হয় তোমার ওপর?(আরফান)

—এক্সাট টাইম মনে নেই,তবে তিনটে কি চারটার দিকে হবে।

—এইতো পেয়ে গেছি,দেখুন স্যার,ম্যাডামকে দেখা যাচ্ছে,উনি বাইরে বেরিয়ে যাচ্ছেন।(বেশ চমকে উঠে সৌজন্য বললো)

—হ্যাঁ,হ্যাঁ,দেখো দেখো কেউ একটা আসছে ওর পেছনে পেছনে,এই দেখো আকাঙখা দাঁড়িয়ে গেলো,লোকটা তখনো পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, আকাঙখা ফোন বার করছে,(আরফান)

—-কিন্তু এ তো মুখোশ পড়া?

—আমি আগেই তো বললাম,মুখোশ পড়া ছিলো তাই চেহারা দেখতে পারি নি।এই দেখুন ম্যাডাম কে আঘাত করলো,তারপর আমি ছুটে আসছি পেছন থেকে।

—একে দেখে তো কোনো বৃদ্ধলোক মনে হচ্ছে,লোকটার মুভমেন্টগুলো খেয়াল করো ভালো করে(আরফান)

—এক্সাইটলি,আমিও সেটাই বলতে চাচ্ছিলাম।

আকাঙখা এতোক্ষণ বেশ গভীর ভাবে লোকটাকে পর্যবেক্ষণ করছিলো,হঠাৎ একটা অসঙ্গতি লক্ষ্য করে সে,

—সৌজন্য,একটু জুম করো তো,ওনার হাতটা ভালো করে দেখাও আমায়।ওহ,সরি আপনাকে তুমি করে বললাম।

—ইটস ওকে ম্যাডাম,আমি আপনার অনেকটা জুনিয়র,তুমি করে বলাটাই বরং বেশি স্বাভাবিক।তাছাড়া স্যার তো আমায় তুমি করেই ডাকেন,সো নো প্রবলেম(হেসে)
আচ্ছা,আমি জুম করছি,আপনি ভালো করে দেখুন।

—হ্যাঁ, হাতটা জুম করো,এতো একটা ঘড়ি।লোকটার হাতের একটা আঙ্গুলে পাথরের আংটিও দেখা যাচ্ছে!

আকাঙখার বার বার মনে হচ্ছে এমন একটা হাত আগেও কোথাও দেখেছে সে!
কিন্তু কোথায় দেখেছে,কিছুতেই মনে করতে পারছে না এই মুহুর্তে।।

—কি হলো,এই ঘড়ি আংটি দেখে কিছূ আন্দাজ করতে পারছো কি,একটু ভালো করে মনে করার চেষ্টা করো!(আরফান)

–হ্যাঁ,সেটাই তো মনে করার চেষ্টা করছি।

আরে,অদ্ভুত ব্যাপার তো,এমন একটা ঘড়ি,হাতের তর্জনী আঙ্গুলে আংটি,এটা তো পারমিতার দাদুর আঙ্গুলে দেখেছে সে,হ্যাঁ, গতকালকেই দেখেছে 😱😱

তার মানে এই লোকটা পারমিতার দাদু ছিলো!ও গড।কিন্তু উনি আকাঙ্খাকে অ্যাটাক করতে কেন আসলেন,আকাঙ্খা কি তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো কাজ করছে।

আকাঙ্খার মাথাটা ভন ভন করে ঘুরতে লাগলো।

এতোদিন ধরে কি আরফানকে শুধু শুধু সন্দেহ করেছে সে?আচ্ছা।পারমিতা দাদু ওর মৃত্যুতে কোনোভাবে,কিন্তু সেটা কি করে হয়?

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here