পানপাতার ঘর? পর্ব ১১+১২

0
666

পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ১১+১২
লেখা – Mahfuza_Monira

কিছু একটা পায়ে লেগে লিমা হোচট খেয়ে পড়ে যেতে নেয়। কোনোভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বসে পড়ে। ডান পায়ের বুড়ো আঙুলের পাশটায় লেগেছে বেশ। গলগল করে রক্ত বের হচ্ছে খুব। লিমা খুব সন্তর্পণে হাত বুলায় সেখানে।

– এখনো ঠিকভাবে হাটতে শিখলে না?

কারো গলার স্বর পেয়ে লিমা উপরে মুখ তুলে তাকায়। এসময়ে মেঘ কে এখানে দেখে লিমা প্রায় ভূত দেখার মতো করে চমকে উঠে।

মেঘ হেসে ফেলে। তবে সেই হাসিতেই কোনো প্রাণ নেই। শুকনো হাসি একদমই…
.
লিমা কোনোভাবে দাঁড়িয়ে বিষ্ময়ভরা চোখে তাকিয়ে বলে-
– তুমি!?

মেঘ তার একহাত বাড়িয়ে দেয় লিমার সামনে। চোখ দিয়ে ইশারা করে হাত ধরে সোজা হয়ে দাড়ানোর জন্য। মুখে বলে-
– হ্যাঁ আমি।

লিমা সে হাত ধরে না। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলে-
– এই হাত ধরার অধিকার তো আর নেই।

মেঘ কষ্ট পায়। কিন্তু প্রকাশ করেনা। আবার সেই শুকনো হাসি দিয়েই হাত গুটিয়ে নেয়। লিমা একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মেঘকে পাশ কাটিয়ে যেতে নিতেই মেঘ বলে-
– লিমা, একটু দাঁড়াবে।

লিমা দাড়াতে চায়না। তবুও যেন তার পা আপনা আপনি থমকে যায়। সে না চাইতেও দাঁড়িয়ে রয়।
মেঘ কোনোভাবে মুখে হাসি টেনে বলে-
– তোমাকে শেষ বারের মতো দেখতে এলাম। এরপর আবার কবে দেখতে পাবো,কে জানে!

লিমার পিলে চমকে উঠে। কোনোভাবে বলে-
– মানে! কোথাও চলে যাবে?

মেঘ গুটিগুটি পায়ে হেটে এসে লিমার সামনে দাঁড়ায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে তার। কতোদিন পর দেখা…!
মেঘ নিম্নস্বরে বলে-
– মা,আমার বিয়ে ঠিক করেছে। আমার অমতেই।

লিমার বুকের ভেতর যেন ঝড় বয়ে যায়। ভয়ংকর ঝড়। লিমার চোখ ভেঙে কান্না আসছে। কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে-
– ওওও! ভালো তো।

মেঘ চুপ করে থাকে। লিমা নিচু হয়ে চোখের পানি মুছে নেয়। তারপর বলে-
– আর কিছু বলবে?

মেঘ তবুও চুপ। লিমা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে উত্তরের জন্য। মেঘের কোনো উত্তর না পেয়ে বলে-
– আচ্ছা,আসি তবে। ভালো থেকো।
লিমার গলা কাঁপছে। মেঘের চোখ ভিজে যাচ্ছে। লিমা আর এক মুহুর্ত দেড়ি না করে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে আসে।
আচ্ছা,মেয়েটার না পায়ে ব্যথা ছিল!? এখন তবে এত দ্রুত হাটছে কি করে…!? মনের ব্যথার থেকে পায়ের ব্যথা টা যে অনেক কম….
.
.
.
১৭ মিনিটে ৮ টা সিগারেট খেয়েছে মেঘ। তবুও থামছে না। একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে। কিন্তু কই,ব্যথা তো কমছে না। বরং মনের ব্যথা টা আরো জোরে জোরে করাঘাত করছে যেন।

.
সোহেলা বেগম আসেন। হাতে তার চার রকমের শাড়ি। মনটা বেশ ফুরফুরা আজ তার। অবশেষে মেঘের বিয়ের জন্য মেয়ে দেখতে পেরেছেন। খানদানি বংশের মেয়ে। বিয়েতে মেয়ের বাবা ৪০ ভরি স্বর্ণ দেবেন নাকি..!
ভাবতেই গা কাটা মেরে উঠছে সোহেলা বেগম এর।
তিনি মেঘের পাশে বসেন। আনন্দে ডগমগ হয়ে বলেন-
– দেখ তো, তোর হবু বউকে কোন রঙের শাড়িটা দেওয়া যায়!

মেঘ সেদিকে একবারো তাকায় না। মুখেও কিছু বলে না। সে তার মতো করেই সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছে।

সোহেলা বেগম আবার বলেন-
– কি হলো! বল কিছু।

মেঘের ভেতর টা গভীর ভাবে জ্বলছে। কেরাসিন দিয়ে কেউ যেন আগুন লাগিয়ে দিয়েছে জায়গাটায়। আর সেই মানুষ টা তারই আপন মা…!
মেঘ তবুও গর্জে উঠে না। শান্ত গলায় বলে-
– এখন যাও। ভালো লাগছে না মা।

মেঘ আরেকবার ফুঁকার জন্য সিগারেট টা মুখের কাছে আনতেই সোহেলা বেগম সেটাকে ফেলে দেন। রাগী গলায় বলেন-
– কিসব ছাইপাশ গিলছিস! আবার কথার উত্তর দেস না। দিন দিন বেয়াদব হয়ে গেছিস? হবিই না কেন..! সব যে ঐ ডাইনি.. কি যেন নাম। ওহ হ্যাঁ লিমা,লিমা ডাইনির কারনে…

সোহেলা বেগম কথা শেষ করতে পারেন না। মেঘ গর্জে উঠে। রাগে তার মাথার রগ দপদপ করছে। বাজখাঁই গলায় বলে-
– বিয়ে করতে রাজি হয়েছি না?? এখনো কেন লিমাকে ঢোকাচ্ছে এসবের ভেতরে?? কেন?? জাস্ট যাও এখান থেকে,তোমাকে আমার সহ্য হচ্ছে না মা। সহ্য হচ্ছে না।

মেঘ দুহাতে মুখ ঢেকে বসে পড়ে। সোহেলা বেগম ছলছল চোখে বলেন-
– এভাবে কথা বলতে পারলি তুই আমার সাথে?? পারলি??

মেঘ বসা থেকে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে বলে-
– হ্যাঁ পেরেছি। নিজের ভালোবাসাকে তোমার জন্য বিসর্জন দিয়েছি। অন্য একজন কে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি। আর তুমি,তুমি আমার মা হয়েও আমার বুকের ভেতর হওয়া ক্ষতগুলো আবারো জাগাচ্ছো? কেমন মা তুমি? যে কিনা সামান্য নিচু পরিবারের বলে,তার ছেলের ভালোবাসাকে মেনে নেয় না। তার ছেলেকে কষ্ট পেতে দেখেও হাসে। এরকম মার তো কোনো দরকার নেই। কেন বেঁচে আছো তুমি? না না,তুমিই বেঁচে থাকো। আমাকে মেরে ফেলো। মেরে ফেলো।

মেঘ হুহু করে কেঁদে ফেলে। হাটু গেড়ে দপ করে বসে পড়ে। দুহাতে মুখ ঢেকে কেঁদেই চলে।
সোহেলা বেগম যেন নির্বাক হয়ে পড়েন। তিনি কোনোভাবে উঠে বেরিয়ে পড়ে সেখান থেকে। তার যেন মেঘকে আর সহ্যই হচ্ছে না।

রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে সবটাই দেখেছে গোলাপী। ভাইয়ের এরকম কষ্ট যে তারও সহ্য হচ্ছে না। সে শক্ত হয়ে দাঁড়ায়। নিজে যে সাহসের কারনে আজও পস্তাতে তা তার ভাইয়ের সাথে কিছুতেই হতে দিবেনা।
কিছু একটা তার করতেই হবে..

চলবে….

পানপাতার ঘর ??
পর্বঃ১২
লেখা – Mahfuza_Monira

সাপের লেজে কেউ পাড়া দিলে সাপ যেভাবে ফণা তুলে,সোহেলা বেগম নিজের ঘরে বসে সেইভাবেই ফণা তুলছেন। একবার সুযোগ পেলেই বোধহয় কামড়ে দেন মেঘকে…!

গোলাপী নিঃশব্দে তার রুমে ঢুকে। ধীর পায়ে গিয়ে তার পাশে বসে। নিচু গলায় একবার ডাকে-
– মা!

সোহেলা বেগম রাগী গলায় জবাব দেন।
– কি হয়েছে?

গোলাপী জব্বর ভয় পায় সোহেলা বেগম কে। তবুও সাহস করে কাচুমাচু হয়ে বলে-
– মা,কিছু বলতে আসছিলাম।

সোহেলা বেগম রাগী গলায় বলেন-
– শুনছি। কান খোলা আছে আমার।

গোলাপী ঢোক গিলে বলে-
– আমি মেঘের বিষয়ে কথা বলতে এসেছি। মেঘ যেহেতু বিয়ে করতে চাচ্ছে না,তবে কেন জোর করা? ওর পছন্দের মেয়েকে….

গোলাপী কথা শেষ করার আগেই সোহেলা বেগম গর্জে উঠেন।

– তুই আমার মেয়ে হয়ে ঐ ডাইনির গান গাইছিস?

গোলাপী আমতাআমতা করে।

– না মা,আমি সেটা বলছি না আসলে..
– চুপ। একদম চুপ। আমি লিমার ব্যাপারে কোনো কথা শুনতে চাইনা আর না মেঘের ব্যাপারে।
– মা একটা বার আমার কথা টা শুনো? একটাবার। প্লিজ,আমার খাতিরেই..

সোহেলা বেগম শান্ত হন কিছুটা। তবুও আক্ষেপ ভরা কণ্ঠে বলেন-
– বল কি বলবি।

গোলাপী একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। যাক অবশেষে একটু শান্ত হয়েছে তার মা।
গোলাপী মৃদু গলায় বলে-
– মা,মেঘ আমার ছোট ভাই। তোমারও তো ছোট ভাই আছে। সে অন্যজন কে ভালোবাসতো আর যখন পুরো পরিবারের তাদের বিপক্ষে ছিল তুমিই তো তাদের পক্ষে ছিলে। একমাত্র তোমার ভাই বলে তার কষ্ট তুমি সইতে পারোনি। তাহলে আমি কিভাবে পারি মেঘের কষ্ট সইতে? ওর চোখমুখ দেখেছো মা? ছেলেটা শুকিয়ে কি হয়ে গিয়েছে। মুখের দিকে তাকানোই যায়না। পাংশুটে হয়ে গেছে ও। তুমিই বলো তুমি কি চাওনা মেঘ সুখে থাকুক? ওর সুখের কথা ভেবে হলেও লিমা কে মেনে নেওয়া উচিত আমাদের!

সোহেলা বেগম চুপচাপ সবটা শুনে গেছেন। তা দেখে গোলাপী ভাবে,হয়তো তিনি মেনে নিবে। সোহেলা বেগম খানিকটা সময় চুপ থাকেন। গোলাপী আশাভরা চোখে তার দিকে তাকিয়ে রয়। যদি একটা বার মেনে নেন…!

যতটা শান্ত হয়ে সোহেলা বেগম সবটা শুনেছে ঠিক ততটাই রাগী হয়ে তিনি বলেন-
– তোর এসব কথায় আমার মন গলবে? এটা ভাবিস?

গোলাপী অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সোহেলা বেগম আবারো বলেন-
– শোন মেয়ে,আমি মরে গেলেও মেঘ আর লিমা কে মানবো না। তাতে যদি আমার ছেলে থাকে তো থাকবে নইলে না। আর তুই ওদের পক্ষ নিলে যা,নে। তবে এই বাড়ি ছেড়ে যাওয়ার পরে নিস।

গোলাপী অবাক হয়ে বলে-
– মা!
– কিসের মা? এই বাড়িতে থাকতে হলে আমি যেভাবে চাইবো সেভাবেই থাকতে হবে। আমার মতের বিরুদ্ধে যাওয়া যাবে না। শুনেছিস? আর হ্যাঁ আমি আমার ভাইকে সাপোর্ট করেছি কেননা তার ভালোবাসার মেয়েটাও খানদানি বংশের ছিল। লিমার মতো ছোট ঘরের না!

গোলাপী আশাহত হয়। আর কিচ্ছু না বলে চুপচাপ বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। মাকে বোঝানো বড় দায়! সে কি আদৌও বুঝবে মেঘের কষ্টটা.! কেমন মা উনি…!
গোলাপী নিজের মনেই প্রশ্ন করে যায়।কিন্তু আফসোস উত্তর মিলে না কোনো।
.
.
মায়ের রুম থেকে বেরিয়েই গোলাপী সাথে সাথে মেঘের রুমে যায়।

বিছানার উপর উল্টো পাল্টা ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে মেঘ। চোখের কোণা টা এখনো ভিজা। হয়তো কাঁদতে কাঁদতেই ঘুমিয়ে পড়েছে!

গোলাপীর কষ্ট হয়। তীব্র যন্ত্রণা হয় বুকের কোথাও। বুক চিড়ে বেড়িয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। সে কাথা টা টেনে দেয় মেঘের গায়ে। এরপর বিছানার পাশে থেকে খাওয়া সিগারেট গুলোর টুকরো নিয়ে চলে যায়।
.
.
সেই দুপুর থেকেই উদয় মিশিদের বাড়িতে। অংক করাতে করাতে দুপুর। উদয় তখন চলে যেতে চাইলেও মিশি বায়না ধরে আজকে তার সাথে থাকতে। আরো খানিকটা সময়। রাতে যাবেনি দরকার হলে..!
উদয়েরও বিশেষ ইচ্ছে করছিল না মিশিকে ছেড়ে যেতে। তাই সে রাজি হয়।

কিন্তু বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায় যখন,উদয় তাড়া লাগায় বাড়ি ফেরার জন্য। মিশি রাজি হয়। কিন্তু বকর মোল্লা তো না খেয়ে যেতে দেবে না উদয় কে।
তাই উদয় কে থাকতে হবে রাত অব্দি। খেয়ে দেয়ে একদম বাড়ি ফিরবে সে। এতে অবশ্য মিশি উদয় দুজনেই খুব খুশি। যাক আরো কিছুটা সময় একসাথে পার করা যাবে…!
.
.
মিশি হাত মুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বের হতেই উদয় গামছা এগিয়ে দেয় তার দিকে। মিশি মৃদু হেসে গামছা টা নেয়। বলে-
– যখন আমাদের বিয়ে হবে,তখনো এভাবে আমাকে গামছা এগিয়ে দিবা?
উদয় নরম গলায় বলে-
– না তো, তখন অন্য কাউকে থাকবে, তাকে দিবো।

মিশি তেড়ে আসে।
– কি বললা?
উদয় একটু সরে যেয়ে বলে-
– তোমাকে দিবো না তো কাকে দিবো বলো!
মিশি গাক ফুলায়।
– সবসময় আমাদের মাঝে তৃতীয় কাউকে না টানলে হয়না?
উদয় দুহাতে মিশির গাল চেঁপে ধরে বলে-
– সরি। আর টানবো না।

মিশি হাত ছাড়িয়ে নেয়। গামছা নিয়ে বারান্দায় চলে যায়। আলতো করে মুখ মুছে তার। তারপর গামছা টা দড়িতে টানিয়ে দিয়ে উদয়ের দিকে ফিরে তাকায়।
উদয়ের চোখেমুখে ঝিলিক।

মিশি অবাক হয়ে বলে-
– এভাবে হা করে কি দেকছো!

উদয়ের মুখ থেকে আপনা আপনি বের হয়ে যায়-
– তোমাকে। সদ্য ভেজা মুখের অধিকারী এক বালিকা কে। কি যে সুন্দর দৃশ্য রে মিশি! বলে বোঝানো সম্ভব না।

মিশি লজ্জা পায়। লজ্জাবতী ফুলের মতো কুঁকড়ে যায়। উদয় তার এক আঙুল দিয়ে মিশির নাকের ডগায় স্পর্শ করে বলে-
– এখানে একটা চুমু খেতে ইচ্ছে করেছে। খাই?

মিশি চুপ করে রয়। চোখ তার নিচের দিকে। একমুহূর্তের জন্য উদয় কে বেশ অচেনা মনে হয়। একটা দীর্ঘ বলিষ্ঠ পুরুষ মনে হয়। মিশি আরো লজ্জা পায়।

উদয় মিশির উত্তরের অপেক্ষা করেনা। একটু ঝুকে গিয়ে মিশির ঠিক নাক বরাবর নিজের ঠোঁট রাখে। মিশি কাঁপছে। ঠকঠক করে কাঁপছে। যেন পৌষের শীত।

উদয় চোখ বন্ধ করে নেয় তার। তারপর কয়েকটা দম বন্ধ করা মুহুর্ত…
উদয় টুক করে তার ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দেয় মিশির নাকে। মিশির শিরা প্রতিশিরায় কাপন ধরে। চোখ আপনা আপনি বুজে আসে।
এরপর একটা মুহুর্ত..
মিশি চেতনা হারিয়ে উদয়ের বুকে নেতিয়ে পড়ে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here