নীল জোছনায় ভাসি পর্ব ৯

0
203

#নীল_জোছনায়_ভাসি (০৯)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________

রূপকথা নামের ভীষণ রাগী মেয়েটি গতকাল বিয়ে করে শ্বশুরবাড়ি চলে গেছে। আর সেই কারণে আমাদের ঘরটা আজ খুব নিস্তব্ধ। আজকের মতো আর কখনও এত নিস্তব্ধ মনে হয়নি ঘরটাকে। আপন কেউ ঘর থেকে চলে গেলে তার বিনিময়ে অনেকখানি শূন্যতা তৈরি হয়। আমাদের ঘরেও তাই। বিশালাকারের এক শূন্যতা এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিছু ভালো লাগছে না, কষ্ট হচ্ছে। শুধু যে আমার কষ্ট হচ্ছে তা না, বাবাও কষ্ট পাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে বাবার রুমের দরজায় দাঁড়ানো ছিলাম। বাবা জানালার দিকে ঘুরে বসা ছিল। আমি তার মুখ দেখতে পাইনি। কিন্তু আমার বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি যে বাবা কাঁদছে। বাবা কাঁদছে দেখে আমারও বুকের ভিতরটা মুচড়ে উঠলো, যে মুচড়ানো ভাবটা এখনও প্রশমিত হচ্ছে না। সকালে আপু শ্বশুরবাড়ি থেকে কল দিয়েছিল, আমি স্পষ্ট উপলব্ধি করতে পেরেছি আপুর মন খারাপ। একটা সময় আমাদের এই মন খারাপি, কষ্ট ফিকে হয়ে যাবে। আমরা একে অন্যকে ছাড়া থাকতে শিখে যাব। মানুষ নামক প্রাণীরা এমনই। তারা সব পরিস্থিতিতে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে বা নেওয়ার চেষ্টা করে।

আজকে প্রাইভেট পড়তে না গিয়ে পেয়ারা তলায় বসে আছি। কিন্তু পেয়ারা খাচ্ছি না। কেবল উদাস চোখে বিকেলের মিঠে আলোয় বেলি ফুলের স্নান দেখছি। আমারও বেলি ফুলের মতো আলোয় স্নান করতে ইচ্ছা করছে, কিন্তু পেয়ারা গাছের নিচের ছায়া ক্ষেত্রটি ছেড়েও উঠতে ইচ্ছা করছে না। মনে হচ্ছে আমি এই মুহূর্তে খুব দুর্বল। কষ্ট মানুষকে দুর্বলও করে দেয়।
জাবির ভাই পেয়ারা তলার দিকে আসছে। হয়তো আমাকে দেখতে পেয়েই সে এসেছে। কিন্তু সে না আসলেই বোধহয় ভালো হতো। সে এসেই কিছু বললো না। কিছু সময় নীরব থাকলো। তারপর বললো,
“মন খারাপ?”

“হুম।”

“আজ পেয়ারা খাবে না?”

“মন খারাপ থাকলে মানুষ খেতে পারে না, খেলেও বিস্বাদ লাগে।”

জাবির ভাই গাছ থেকে দুটো পেয়ারা পাড়লো। একটি আমার কোলের উপর রেখে অন্যটি সে নিলো। এক কামড় খেয়ে বললো,
“তোমার আপুকে মিস করবো।”

“কেন?”

“সে তো আর এ বাড়িতে থাকবে না। তুমি আমার সাথে কথা বলছো দেখে কে নিষেধাজ্ঞা জারি করবে?”

আমি হঠাৎ জানতে চাইলাম,
“আপনার বড়ো বোন আছে জাবির ভাই?”

“না। আমিই বড়ো। ছোটো একটা ভাই আছে। বোন নেই।”

“জীবনে একটা বোন থাকা জরুরি।”

“আর ভাই?” জাবির ভাই প্রশ্ন করলো।

“জানি না, আমার তো ভাই নেই, বোন আছে। সেই বোন থাকা থেকে আমি এই বিষয়টা উপলব্ধি করলাম, জীবনে একটা বোন থাকা জরুরি।”

জাবির ভাই কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে বললো,
“একটা কথা বলবো মিস তুতু?”

“শুনতে ইচ্ছা করছে না। তবুও যদি আপনার বলতে ইচ্ছা হয় বলুন।”

“থাক, যেদিন তোমার ইচ্ছা হবে সেদিন বলবো।”

জাবির ভাই পেয়ারা ফেলে দিয়ে চলে যাওয়া দিলো। আমি বললাম,
“আজ অর্ধেক পেয়ারা খেলেন না?”

“কিছু কিছু খাবার একা খাওয়া যায় না।”

“একটা প্রশ্ন করবো?”

“না করাই ভালো। কারণ, আমি উত্তর দেবো না।”

আমি জাবির ভাইয়ের কথা শুনলাম না, প্রশ্ন করেই ফেললাম,
“আপনি একটা পেয়ারা সম্পূর্ণ খান না কেন? এর কি বিশেষ কোনো কারণ আছে?”

জাবির ভাই সত্যিই কোনো উত্তর না দিয়েই চলে গেল। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেলি ফুলগুলোর দিকে তাকালাম। জানি না কী কারণ, হয়তো বা অকারণেই আমি যাওয়ার সময় সব বেলি ফুল গাছ থেকে ছিঁড়ে তলায় ফেলে রাখলাম। জানি না কার গাছের ফুল ছিঁড়েছি এমন নির্দয়ভাবে। সে নিশ্চয়ই আমাকে অভিশাপ দেবে।

বিকেলে ভাবছিলাম কার গাছের ফুল ছিঁড়েছি। সন্ধ্যায় মনে পড়লো ওই গাছ আমারই লাগানো। ফুলগুলোর জন্য কষ্ট হচ্ছে এখন। কেন ওরকম ভাবে ছিঁড়ে ফেলেছি? অযত্নে অবহেলায় নিশ্চয়ই এখনও গাছের তলায় পড়ে আছে ওগুলো।
আমি নিচে এলাম ফুলগুলো নেবো বলে, কিন্তু আশ্চর্য! একটা ফুলও নেই তলাতে। কে নিলো? চাচি কি জায়গাটা ঝাড় দিয়েছে? না জায়গাটা তো পরিষ্কার দেখাচ্ছে না। তাহলে নিলো কে? যে সেজান ভাইয়ার গাছ থেকে গোলাপ চুরি করেছিল সে? বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে। কেউ বেলি ফুল চুরি করতে বাড়ির পিছন অবধি এসেছিল? গোলাপ গাছ না হয় বাড়ির সামনে ছিল, কিন্তু জানলো কী করে বাড়ির পিছনে বেলি ফুল গাছ আছে?

“ওখানে কে?”

দৈবাৎ কারো কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলাম, ভয়ও পেলাম। তাকিয়ে দেখলাম সেজান ভাইয়া এগিয়ে আসছে লাইট নিয়ে। আমার মুখেই লাইটের আলো ধরে রেখেছে। কাছাকাছি এসে প্রশ্ন করলো,
“কে আপনি?”

আবারও চমকালাম। কে আপনি? সেজান ভাইয়া কি আমাকে চিনতে পারছে না? আবার আপনি সম্বোধন করছে?

“এটা আমি, সেতু। তুমি আমাকে চেনো না?”

“সেতুকে তো চিনি, কিন্তু আপনি কে?”

সেজান ভাইয়ার কথা বুঝতে পারছি না। সে বলছে সেতুকে চেনে, আবার জিজ্ঞেস করছে আমি কে। সেতুকে চিনলে তো আমাকেও চেনার কথা, কারণ আমিই তো সেতু। জানতে চাইলাম,
“তুমি কি কিছু খেয়েছো?”

“কী খাবো? হ্যাঁ বিকেলে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলাম। খেয়েছি অনেক কিছু। কিন্তু সেটা তো এখানে ইম্পরট্যান্ট না। আপনার পরিচয় দিন। আপনি কি মামুন সাহেবদের বাসায় থাকা সেই জন?”

অবাক হয়ে বললাম,
“মামুন সাহেবদের বাসায় থাকা সেই জন মানে?”

সেজান ভাইয়াও অবাক হলো আমার কথায়। অবাধ বিস্ময়ে বললো,
“তাহলে কি আপনি জিন আম্বিয়া নন?”

“জিন আম্বিয়া মানে? বলছো কী এসব? আমি জিন?”

“জিন ছাড়া আর কী? এত রাতে জিন ছাড়া আর কে বাড়ির পিছনে ঘুরবে?”

“এত রাত? এখন সাতটা বাজে সেজান ভাইয়া।”

“তাহলে তুই জিন না?”

“আমি সেতু।”

“এইমাত্র দেখে এলাম সেতু ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে।”

“তাহলে নিশ্চয়ই ওটা জিন ছিল। তুমি আসল জিনকে চিনতে পারোনি। তুমি কোনো কাজেই ভালো না। আসল সেতুকে জিন সেতু ভাবছো।”

সেজান ভাইয়া দুর্বোধ্য দৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে রইল কীয়ৎক্ষণ। তারপর হঠাৎ তৃতীয় তলার জানালায় তাকালো। কিন্তু সে যা দেখবে ভেবেছিল তা দেখতে পেল না। জানালায় কেউ নেই।
সেজান ভাইয়া হঠাৎ ধমকে উঠলো,
“ঘরে যা, রাতের বেলা এত বাইরে ঘোরাঘুরি কীসের?”

“কেন? তোমার চিন্তা হয়? না রাগ হয়?”

“কিছু হয় না আমার।”

হাসলাম। কিছুটা রহস্য করে। তারপর তৃতীয় তলার জানালায় তাকালাম। সেজান ভাইয়াকে শোনানোর জন্য কৃত্রিম আফসোস কণ্ঠে বললাম,
“কী হতো, যদি সে একবার জানালায় এসে দাঁড়াতো?”

কথাটা বলেও মনে মনে হাসলাম।
আড়চোখে সেজান ভাইয়ার মুখটা দেখে আরও বেশি হাসি পেল। সে এবার সত্যিই রেগে গেছে। সেজান ভাইয়াকে আরও রাগানোর জন্য কি আমার ‘সে যে কেন এলো না, কিছু ভালো লাগে না…’ গানটি গাওয়া উচিত? থাক একদিনে একটা মানুষকে এত রাগানো উচিত না। আমি যেতে যেতে গুনগুন করে অন্য একটি গান গাইলাম।

___________________

আজকেও বাবা করিম চাচাকে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে এসেছিল। দুজনে রুমের ভিতর ঢুকে কী নিয়ে যেন আলোচনা করেছে অনেকক্ষণ ধরে। বাবা কি আবারও পাত্রী দেখার কাজ শুরু করবে?
করিম চাচা যখন চলে যাচ্ছিল আমি জানতে চাইলাম,
“বাবার জন্য কি খুব শীঘ্রই পাত্রী পাওয়া যাবে চাচা?”

করিম চাচা হাসলেন। আমি তার হাসির মানে বুঝতে পারলাম না। তিনি প্রশ্নের উত্তর কিংবা অন্য কিছু না বলে চলে গেলেন। হঠাৎ তার এরূপ আচরণে অবাক না হয়ে পারলাম না।।

রান্নাঘরে এলাম সকালের নাস্তা তৈরি করতে। বাবা এসে বলে গেল সুজির হালুয়া বানাতে। আমি হালুয়া বানালাম, পরোটা বানালাম, চা বানালাম। যখন খেতে বসলাম আপু কল দিলো। বাবার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলে আমার সঙ্গেও কথা বললো। একেবারে শেষ দিকে এসে আপু যে কথাটা বললো সেটা হলো,
“আমি নেই সেই সুযোগে কি সারাদিন জাবিরের সাথে কথা বলিস?”

“না।” বাবা সামনে তাই আমি উত্তরটা ছোটো করে দিলাম।

“ভালো। ভালো থাকিস।”

আপু এই কথা দিয়েই ফোনালাপ সমাপ্ত করলো।
বাবার খাওয়া শেষ। সে হাত মুছতে মুছতে বললো,
“রূপকথা ওখানে ভালোই আছে, কি বলিস?”

আমি মাথা নাড়লাম,
“হুম, ভালো আছে।”

বাবা হাসলো। এটা নিশ্চিন্ত মনের হাসি। মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে ভালো আছে জেনে বাবার মন তো নিশ্চিন্তই হবে। বাবার ঠোঁট থেকে হাসি হাসি ভাবটা সরলো না। আমাকে একটা ক্ষুদ্র কাগজের অংশ দিয়ে বললো,
“এখানে পাত্র উপস্থিত থাকবে, তুই দশটার দিকে চলে যাস।”

বলেই আর দাঁড়ালো না। দরজার দিকে এগোলো। আমি প্রশ্ন করে উঠলাম,
“কে পাত্র? কার পাত্র?”

বাবা দরজা খুলতে খুলতে বললো,
“ভালো পাত্র। তুই ওকে চিনিস। গেলেই বুঝতে পারবি।”

বাবা বেরিয়ে গেল। আমি যে আরও কিছু প্রশ্ন করবো তা শোনারও অপেক্ষা করলো না। মানুষটা মাঝে মাঝে এত ব্যস্ততা দেখায়, অথচ সে কখনোই ব্যস্ত থাকে না। তবে আমার ভয় হচ্ছে। বাবা কীসের পাত্রর কথা বলে গেল? আমি কাগজটা দেখলাম। একটা রেস্টুরেন্টের ঠিকানা লেখা এখানে।

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here