নীল জোছনায় ভাসি পর্ব ১৩

0
203

#নীল_জোছনায়_ভাসি (১৩)
#লেখা: ইফরাত মিলি
___________________

টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। আকাশ কালো। বাতাসে তেমন বেগ নেই। প্রায় কিছুক্ষণ হলো ছাদে বসে আছি, কিন্তু এখনও সম্পূর্ণ ভিজে যাইনি। চোখ বন্ধ করে উপরের দিকে মুখ তুলে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ছোটোখাটো একটা কল্পনা করে ফেললাম। আমার সেই কল্পনায় ভবিষ্যৎ মোটেই সুখকর নয়। তবে দুঃখকে আমি ভয় পাই না।

শ্রবণেন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে কেউ যেন পা টিপেটিপে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। উপলব্ধি বোধ থেকে এটাও বুঝলাম রুফটপের উপর কিছু রাখলো সে। ঠিক আমার পাশেই। তারপর যাওয়ার জন্য ঘুরে এক-দু পা বাড়ালো। চোখ বন্ধ অবস্থায়ই বলে উঠলাম,
“তোমার চোরের মতো স্বভাব কবে থেকে হলো সেজান ভাইয়া?”

সেজান ভাইয়া থামলো। আমি চোখ মেলে তার দিকে তাকালাম। আমার অনুমান একটুখানিও ভুল হয়নি। সে ইতস্তত করছে। ভাবছে আমার কথার জবাবে তার কী বলা উচিত। অথচ সে এরকম মানুষ না। এই মানুষটাকে কিছু বলার জন্য এরকম সময় নিয়ে কথা সাজাতে খুব কমই দেখেছি, বা বলা যায় দেখিইনি। কথা সাজানোর চেষ্টা করেও আমার প্রশ্নের জবাবে কোনো উত্তর তৈরি করতে পারলো না সে। উলটো সে-ই একটা প্রশ্ন করে বসলো,
“বৃষ্টির ভিতর বসে আছিস কেন?”

“আমি তো বসে নেই। জিন আম্বিয়া বসে আছে। জানো, আমার ভিতর এখন আম্বিয়ার বাস। আমি এখন সেতু নই, আমি আম্বিয়া।”

সেজান ভাইয়া ভ্রু কুঁচকে ফেললো।
“বলছিস কী এসব?”

আমি শব্দ করে হাসলাম। সেজান ভাইয়ার রাখা শুকনো বেলি ফুলগুলো হাতে উঠিয়ে বললাম,
“তাহলে বেলি ফুল চোর তুমি ছিলে?”

সেজান ভাইয়া দৃষ্টি নত করে ফেললো।
এই মানুষটাও যে দৃষ্টি নত করতে পারে আমি জানতাম না। নত দৃষ্টি জোড়া এবার আমার উপর ন্যস্ত করে গহন গলায় বললো,
“ইচ্ছা হয়েছিল কারো অবহেলায় ফেলে রাখা ফুলের যত্ন নিতে। কিন্তু ভুল করে ফুলের বদলে কিছু ভুল কুড়িয়ে নিয়েছিলাম! ফিরিয়ে দিলাম!”

বুক চিরে অতিশয় এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসার জন্য হাঁসফাঁস করছে, কিন্তু আমি ধরেবেঁধে সেই দীর্ঘশ্বাসকে নিজের মাঝেই চেপে রেখে বললাম,
“ভুল? ভুলটা কী সেজান ভাইয়া?”

সেজান ভাইয়াও দীর্ঘশ্বাস চেপে বললো,
“যেটা ভুল সেটাও একটা ভুল।”

আমার কান্না পেল। কিছু বলার পেলাম না। সেও শব্দহীন। কিছুক্ষণ একইরকম নীরবতায় কাটলো। বাক্যহীন সে চলে যাওয়ার পথ মাড়ালেই বললাম,
“কিছু ভুলে যাচ্ছ না তো?”

সে দাঁড়ালো। ফিরে তাকিয়ে বললো,
“কী ভোলার আছে?”

“কিছু কথা।”

“কী কথা?”

কিছু মুহূর্ত নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে তাকে পর্যবেক্ষণ করলাম। বুকের মাঝে মৃদু কম্পন হচ্ছে। যা স্বস্তি দিচ্ছে না।
আজ সেজান ভাইয়াকে বুঝতে আমার অনেকটা সময় লেগে গেল। এত বেশি সময় আর কখনও লাগেনি। নিস্তেজ কণ্ঠে বললাম,
“ও, কোনো কথা নেই তাহলে। ভেবেছিলাম তুমি কিছু বলবে। হয়তো ভুলে যাচ্ছ, তাই মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।”

সে আবারও চলে যেতে উদ্যত হলো। বলে উঠলাম,
“তুমি কোনো কারণে কষ্টে আছো?”

সে না তাকিয়ে জবাব দিলো,
“না।”

আমি উঠে দাঁড়ালাম। বেলি ফুলগুলো ওড়নায় জড়িয়ে তার সামনে এসে দাঁড়ালাম। আবারও প্রশ্ন করলাম,
“কোনো কারণে কষ্টে আছো?”

আরও একবার প্রশ্ন করায় সেজান ভাইয়া বিস্মিত হলো, অপ্রস্তুতও হলো। এবার তার উত্তর দিতে গিয়ে গলা কাঁপলো সামান্য,
“না।”

আমার বাম চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো। অশ্রু আড়াল করার কোনো রকম চেষ্টা করলাম না। ক্রন্দন ভেজা কণ্ঠে বললাম,
“শুক্রবার আমার বিয়ে সেজান ভাইয়া!”

সেজান ভাইয়া আমার কান্না দেখে অবাক হলো না। বললো,
“তো?”

“তোমার কাছে একটা কথা জানতে চাই। অবশ্যই সত্যি জানতে চাই। মিথ্যা বলবে না।”

“কী জানতে চাস?”

কণ্ঠনালি দিয়ে কথাটি বের হতে চাচ্ছে না। হৃদয়ের ভয়ানক কষ্ট আমার গলা চেপে ধরেছে। কিছুটা সময় নিয়ে অবশেষে প্রশ্নটি করলাম,
“তুমি কি কখনও আমায় ভালোবাসোনি?”

এ প্রশ্নটা শুনেও সেজান ভাইয়া চমকালো না। খুব স্বাভাবিক, খুব শান্ত দেখাচ্ছে তাকে। শান্ত স্বরে আমাকে বললো,
“বৃষ্টিতে ভিজিস না সেতু, ঘরে যা।”

বলে সে নেমে যেতে চাইলেই আমি তার পথ রোধ করে দাঁড়ালাম। ঠোঁটে বিবর্ণ হাসি এঁকে বললাম,
“ভয় পাচ্ছ? চিন্তা নেই, তোমার বন্ধুকে আমি বিয়ে করবো। বিয়ে ভেঙে দেবো না।”

এ কথার পর সেজান ভাইয়া কিছু বললো না। আমি টের পাচ্ছি তার হৃৎপিণ্ড এখন তীব্রভাবে ছটফট করছে। আমি এক পা তার কাছে এগোলাম। যথেষ্ট দূরত্ব ছিল আমাদের মাঝে, তবুও সেজান ভাইয়া কিছুটা পিছনে সরে গেল। আমি বললাম,
“প্রশ্নটা করা কি ভুল হয়েছে সেজান ভাইয়া? কখনও আমায় ভালোবেসেছো কি না জিজ্ঞেস না করে কি এটা জানতে চাওয়া উচিত ছিল, আরও কতদিন তুমি আমায় ভালোবাসবে?”

সেজান ভাইয়ার শুষ্ক চোখে হালকা অশ্রু বাষ্প লক্ষণীয়। খুব খেয়াল করে না দেখলে ধরার উপায় নেই। কিন্তু আমি ধরতে পারছি। এটাও বুঝতে পারছি তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। সে বললো,
“তুই পাগল হয়ে গেছিস সেতু। আবোল-তাবোল বকছিস!”

গাল বেয়ে উষ্ণ অশ্রু নামছে টের পেলাম। মন খুলে কিছুক্ষণ কাঁদতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু কাঁদতেও যেন মানা এখন। বললাম,
“আমি অনেক আগে থেকেই পাগল, এত দেরিতে এসে বুঝলে?”

সেজান ভাইয়া আমাকে উপেক্ষা করে যেতে চাইলো। বললাম,
“প্রশ্নের উত্তর তো দিলে না। ভালোবাসো আমাকে? বলে যাও। আমার বিশ্বাস তুমি সত্য বলা ভুলে যাওনি।”

সেজান ভাইয়া থামলো। অতি ক্ষীণ গলায় আমার অনেক দিনের প্রতীক্ষিত একটি শব্দ আজ তার ওষ্ঠাধর হতে উচ্চারিত হলো,
“বাসি!”

এই শব্দটা শুনে আমার অনেক আনন্দ হওয়ার কথা ছিল, এই কথাটা আমি শুনতে চাইতাম। খুব করে শুনতে চাইতাম। কিন্তু আজ এমন একটি সময় সে কথাটি বললো যে সময় আমার আনন্দিত হওয়ার সুযোগ নেই। যে কথা শুনে আনন্দিত হতাম আজ সে কথা শুনেই তীব্র বেদনায় আমার হৃদয় উপকূল নীলচে হয়ে গেল।

সেজান ভাইয়া আমার দিকে ফিরে তাকালো। এবার স্পষ্ট গলায় বললো,
“হুম, বাসি। তাতে কী আসে যায়? আমি একটা খারাপ মানুষ। খারাপ মানুষরা ভালোবাসলেও কিছু যায় আসে না, না বাসলেও যায় আসে না।”

বলতে বলতে সেজান ভাইয়ার চোখে জল চিকচিক করে উঠলো। তার চোখে জমা জল আমার বুকে যন্ত্রণা জমা করলো আরও। ভারাক্রান্ত গলায় বললাম,
“অন্য কারো হয়তো যায় আসে না, কিন্তু যে তোমায় ভালোবাসে তার তো যায় আসে। আগে কখনও কিছু বলোনি কেন?”

“কী করে বলবো? খারাপ মানুষরা চাইলেই সবকিছু বলতে পারে না। এছাড়াও যার সাথে এককালে প্রেম ছিল তারই ছোটো বোনকে ভালোবাসি এ ব্যাপারটা কেমন? যদিও আমাদের মাঝে গভীর অনুরাগ ছিল না, নাম মাত্রই আমরা আমাদের সম্পর্কটা অনেক দিন ধরে টেনে এনেছিলাম। অনেকবার আমাদের ব্রেকআপ হয়েছে। এক ব্রেকআপের বয়স এক বছরও ছিল। ওর আমাকে ছেড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কিন্তু তবুও রূপকথা যখন জানতে পারতো আমি ওর বোনকে ভালোবাসি তখন ও কী ভাবতো আমার সম্পর্কে? আর তোকে হয়তো মে’রেই ফেলতো!”

“বিয়ের খবর শোনার পর তো কিছু বলতে পারতে। বলতে পারতে, ‘তোর বিয়ে হলে আমার খারাপ লাগবে সেতু!’।”

সেজান ভাইয়া এই কথা শুনে হেসে বললো,
“সবকিছু খুব সহজ মনে হয় সেতু? সবকিছু এত সহজ হলে মানুষ কষ্ট পেতো না। কষ্ট নামক একটা জিনিস আছে কেবল এটাই জানতো।” সেজান ভাইয়া একটুক্ষণ থেমে বললো,
“যেদিন থেকে খারাপ হওয়ার পথ ধরলাম, সেদিন থেকেই আমার সব বন্ধুরা আমাকে ছাড়তে শুরু করেছিল। একটা সময় দেখলাম বন্ধু তালিকায় একজন ছাড়া আর কেউ নেই। ও একজন ছিল, আর এখনও একজনই আছে, ও আনাম। অমন ভালো একটা মানুষ এখনও আমার সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক রাখছে এটা আমার সৌভাগ্য। সেই মানুষটার সঙ্গে তোর বিয়ে! আমি ওকে কী বলতাম? যাকে বিয়ে করার জন্য রাজি হয়েছিস, পাত্রী হিসেবে পছন্দ করেছিস, তাকে তুই আমাকে দিয়ে দে? চাইলে হয়তো ও দিয়ে দেবে, কিন্তু বাকিরা?”

হাত দিয়ে জামা চেপে ধরে আছি। কান্না চাপার চেষ্টা করছি। কিন্তু চোখ দিয়ে জল নামছেই। গলার কাছটা ব্যথা করছে। কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করলে আমার গলার কাছে ব্যথা হয়। সেজান ভাইয়াও কান্না চেপে রেখেছে। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তা। এই প্রথম আমি তার অশ্রুসজল চোখ দেখছি। সেজান ভাইয়া বললো,
“আমি যতবার ভেবেছি সেতু মেয়েটা আমার হবে, তার চেয়ে অধিকবার ভেবেছি ও আমার হবে না! কিন্তু তবুও আমি কী বোকা!” সেজান ভাইয়া হঠাৎ হাসলো, “আমি তোর জন্য ভালো হওয়ার চেষ্টা শুরু করেছিলাম। কিন্তু এখন আমার ইচ্ছারা মৃত হয়ে গেছে। আমার আর ভালো হওয়া হলো না রে সেতু!”

আমি এবার জোরে কাঁদতে বাধ্য হলাম। আমি তো চাইতাম সেজান ভাইয়া ভালো হোক, আমার জন্য হলেও হোক। আজ জানতে পারলাম সে সত্যিই আমার জন্য ভালো হওয়ার চেষ্টা করেছিল। এ পাওয়াটুকু আমার পরম পাওয়া। কিন্তু তার ভালো হওয়ার ইচ্ছা মরে যাওয়া সারা জীবনের কলুষিত ব্যাপার হয়ে থাকবে। আমার বলতে ইচ্ছা হলো, না সেজান ভাইয়া, তুমি ভালো হবে। কিন্তু বলতে পারলাম না।

“আরও কিছু জানতে চাস?”

আমার সব জানার ইচ্ছারা মরে গেছে। ইচ্ছারা নির্জীব, অপ্রাণ। আমি না বোধক মাথা নাড়লাম। সেজান ভাইয়া সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো। এমন সময় আমার মনে হলো একটা কথা আমার জানা উচিত। প্রশ্ন করে উঠলাম,
“কবে থেকে ভালোবাসো আমায়?”

সেজান ভাইয়া থামলো না, যেতে যেতে উত্তর দিলো,
“যেদিন থেকে বুঝলাম সেতু আমাকে ভালোবাসে, তার কিছুদিন পর থেকে আমি ওকে ভালোবাসি।”

এই কথাটা শোনার পর আরও বেশি কষ্ট হলো। সেজান ভাইয়া কবে থেকে জানে? কত আগে থেকে জানে? দুই হাতে চোখ ঢেকে কাঁদলাম আমি। এ কান্না প্রকৃতিরও দেখার যোগ্য নয়। মনে হলো জীবনের সবচেয়ে বড়ো কষ্টটা আমি আজ এখন পেলাম। কারণ এত যন্ত্রণাদায়ক অনুভূতি এর আগে আসলেই হয়নি।
স্বাভাবিক হতে অনেকটা সময় লাগলো। আমি নিচে এলাম। ঘরের দরজা খোলা। আমিই খুলে রেখে গিয়েছিলাম, বাবা বন্ধ করেনি। বাবাকে ডেকে বললাম,
“বাবা, দরজা বন্ধ করোনি কেন? চোর-ডাকাত ঢুকে পড়লে কী হবে?”

বাবা রুম থেকে বেরিয়ে এলো। তার হাতে একটি বাটি। এগিয়ে আসতে আসতে বললো,
“কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছি। কোথায় ছিলি?”
বাবা আমার হাতে বাটিটা দিয়ে বললো,
“এটা মুখে লাগা।”

“এটা কী?”

“দুধের সর, চালের গুঁড়া আর কলা দিয়ে তৈরি ফেসপ্যাক।”

আমি এক আঙুল দিয়ে ফেসপ্যাকের কিছুটা অংশ মুখে দিয়ে বললাম,
“ভালো খেতে। একটু চিনি দিলেই পারফেক্ট হতো। তেলে ভাজলেই পিঠা হয়ে যাবে।”

বাবা আমার কথা ও কাজে হতভম্ব হয়ে গেছে। তার হতভম্ব ভাব কাটতে বেশ কিছুটা সময় লাগলো। বললো,
“এটা কি খাবার জিনিস?”

“নয়, তবে হতে কতক্ষণ? আমি এটা তেলে ভাজতে যাচ্ছি।”

কিচেনের দিকে এগোনো দিলেই বাবা আমার হাত থেকে ফেসপ্যাকের বাটিটা ছোঁ মেরে নিয়ে গেল। যেন আমি তার মোহর ভর্তি হাঁড়ি নিয়ে চম্পট দিচ্ছিলাম। সে সযত্নে তার ধন অর্থাৎ ফেসপ্যাকের বাটিটা বুকে আগলে বললো,
“তোকে এটা লাগাতে হবে না।”

বলে সে বাটি নিয়ে নিজের রুমে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণ পর দেখলাম বাবা মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে ঘুরছে। খুব হাসি পেল। আপু থাকলে এটা দেখে চ্যাঁচামেচি করতো। কিন্তু ও শ্বশুর বাড়িতে গেছে। আসবে আগামীকাল। পরশু শুক্রবার। আমার বিয়ে!

____________________

একটি রাত। রাত পেরোনোর পরে আসবে একটি দিন। আর সেই দিনে আমার বিয়ে। এমন বিদঘুটে যন্ত্রণার রাত এর আগে আর জীবনে আসেনি আমার। হৃৎপিণ্ড কাঁপছে, কম্পনের শব্দ যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি। এত কঠিন যাচ্ছে কেন সময়টা? নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে কষ্ট হচ্ছে। খেতে কষ্ট হচ্ছে, ঘুমাতে কষ্ট হচ্ছে, কোথাও এক মুহূর্ত বসে থাকতেও কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছা করছে হারিয়ে যাই, খুব দূরে। যদি এমন একটা জায়গা পাওয়া যেত যেখানে গেলে স্মৃতিশক্তি হারিয়ে যাবে, নিজেকেই নিজে চিনতে পারবো না, আমি সেখানে চলে যেতাম। আমি ওই মানুষটাকে খুব করে ভুলে যেতে চাই এখন। তাকে ভোলা প্রয়োজন। তাকে ভুলে যাওয়া উচিত। কিন্তু আমি পারছি না। তাকে ভুলে যাওয়ার চিন্তা করতেও কষ্ট হচ্ছে। ইচ্ছা করছে এই বিয়েটা ভেঙে তছনছ করে দিই। কিন্তু আমি তা পারবো না। বাবা আনন্দিত! আমি বাবাকে বিন্দুমাত্র কষ্ট দিতে পারবো না। মায়ের মৃত্যুর পর সে একা আমাদের মানুষ করেছে, কারো কোনো সাহায্য ছাড়াই। যে মানুষটা জীবনে আছে বলে জীবন এত সুন্দর মনে হয়, সেই মানুষটাকে আঘাত দিয়ে তার মনে অসুন্দর অনুভূতি সৃষ্টি করার মতো কঠিন মন আমার নেই। বাবার ভালোবাসা আমার কাছে সবচেয়ে দামি।

গোলাপ গাছে তিনটা ফুল ছিল। আমি ফুলগুলো ছিড়ে রেখে দিলাম ফ্রিজে। তারপর গাছ দুটো তার মালিকের কাছে ফিরিয়ে দিলাম। ফিরিয়ে দিলাম মানে তার সম্মুখে ফিরিয়ে দিলাম না, যেখান থেকে চুরি করেছিলাম সেখানে রেখে এলাম। জাবির ভাই কলে পানি নিতে এসেছিল। আমাকে টব রাখতে দেখে বললো,
“চোরেরা কি আজকাল ভালো হয়ে যাচ্ছে মিস তুতু?”

“না জাবির ভাই। চোরেরা ভালো হচ্ছে না।”

“তাহলে চুরি করে নেওয়া জিনিস ফেরত দিচ্ছে কেন?”

“সবার সবকিছু চুরি করে বেশিদিন রাখা যায় না। ফেরত দিয়ে দিতে হয়।”

আমি বাসায় এসে দ্বিতীয় টবটিও নিচে রাখতে এলাম। জাবির ভাই এতক্ষণে চলে গেছে। আমি সিঁড়ির অনেকখানি উঠে আসার পর সুমনা চাচি ডাকলো।

“কী হয়েছে চাচি?”

চাচি আমাকে ঘরের ভিতরে নিয়ে এলো। একেবারে তার শোবার ঘরে। ড্রয়ার থেকে দুটো ছবি বের করে বললো,
“কোন মেয়েটা বেশি সুন্দর বল তো?”

ছবির দুটো মেয়েই খুব সুন্দর। কাকে রেখে কাকে সুন্দর বলবো বুঝতে পারলাম না।
“দুজনই বেশি পরিমাণ সুন্দর। এক কাজ করো, দুটো বিয়ে করিয়ে দাও তোমার ছেলেকে।”

“বলছিস কী? এটা তো জঘন্য ব্যাপার। দুইটা বিয়ে? সেজান তো বিয়েই করতে চায় না।”

“তাহলে কারো সাথেই বিয়ে দিয়ো না।”
বলে বেরিয়ে আসা দিয়ে আবার বললাম,
“আর হ্যাঁ, মেয়ে দুটো মোটেই সুন্দর না।”

লিভিংরুমে যে সেজান ভাইয়া বসে ছিল তা আগে খেয়াল করিনি। সে খেলা দেখছে টেলিভিশনে। আজকাল সে খুব একটা বাইরে যায় না। অথচ আগে বাইরেই বেশি সময় কাটাতো। সেজান ভাইয়া সিগারেট খাচ্ছে। আমাকে দেখেও খাওয়া বন্ধ করছে না। কিন্তু সে তো আমার সামনে সিগারেট খাওয়া বন্ধ করেছিল। ভালো হতে চেয়েছিল সে।

“কী খাচ্ছ? গাঁজা?” প্রশ্ন করলাম আমি, খুব স্বাভাবিক কণ্ঠে।
সেও স্বাভাবিক ভাবে প্রত্যুত্তর দিলো,
“হু।”

সেজান ভাইয়া মিথ্যা বললো, সে সিগারেট খাচ্ছে। চাচা বাড়িতে নেই বলে সে বসার ঘরে বসে সিগারেট খাওয়ার সাহস করছে। প্যাকেটও নিয়ে বসেছে সাথে।
আমি টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা তুলে নিলাম। একটা সিগারেট সেখান থেকে বের করে বললাম,
“একটা সিগারেটের দাম কত সেজান ভাইয়া?”

“ষোলো টাকা।”

“সিগারেটটা নিচ্ছি। ষোলো টাকা পরে দিয়ে দেবো।”

“সিগারেট দিয়ে কী করবি?”

“খাবো।”

“কী?”

“অবাক হওয়ার কী আছে? মেয়েরা কি সিগারেট খায় না?”

“পঞ্চাশ টাকা দিতে হবে।”

“কীসের পঞ্চাশ টাকা?” চাচি এসে মধ্যখান দিয়ে প্রশ্ন জুড়লো।

আমি বললাম,
“পঞ্চাশ টাকা কেন? এখনই তো বললে ষোলো টাকা দাম।”

“সেটা দোকান থেকে কিনলে। আমার থেকে কিনলে পঞ্চাশ টাকা। আমি মানুষটা স্পেশাল।”

আমরা দুজন এমনভাবে কথা বলছি যেন গতকাল ছাদে আমাদের মাঝে যেসব কথাবার্তা হয়েছিল, আসলে সেসব কিছুই হয়নি। আমরা একে অন্যের সাথে খুব স্বাভাবিক বাহ্যিক আচরণে, কিন্তু আমরা একে অন্যের অন্তঃপুরের অবস্থাও জানি। আমি টেবিল থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা ছোঁ মেরে নিয়ে বললাম,
“পুরো প্যাকেট নিয়ে যাচ্ছি। একটা টাকাও দেবো না। ধরে নাও এটা আমার বিয়েতে দেওয়া তোমার উপহার।”

চাচির দিকে তাকালাম। চাচি আমার আর সেজান ভাইয়ার কথোপকথনে হতভম্ব। আমি সিগারেট নিয়ে বেরিয়ে এলাম।

ঘরে ফিরেই বাবার কাছে গেলাম।
“বাবা, আসবো?”

“আয়।”

আমি ভিতরে ঢুকলাম। বাবা হয়তো গুরুত্বপূর্ণ কোনো দলিল দেখছিল, আমার আগমনে তার দলিল দেখার কাজে বাধা পড়লো। বললাম,
“একটা ভালো জিনিস এনেছি বাবা।”

‘ভালো জিনিস’ কথাটা শুনে বাবা উৎফুল্ল হয়ে উঠলো। বললো,
“ভালো জিনিস? ফেসপ্যাক না কি?”

“তোমাকে কি ফেসপ্যাকের ভূতে ধরেছে বাবা? ফেসপ্যাক না, তার চেয়েও ভালো জিনিস।”

বাবা আরও বেশি উৎফুল্ল হয়ে বললো,
“তাই না কি? দেখা তো।”

আমি সিগারেটের প্যাকেটটা বাবাকে দেখালাম। বাবার চোখে-মুখের উৎফুল্ল নিমেষে হাওয়া হয়ে গেল। অবাধ বিস্ময়ে তাকিয়ে বললো,
“সিগারেট কোথায় পেয়েছিস?”

“যেখানে পাওয়া যায়। জানো এটা স্পেশাল সিগারেট। একেকটার দাম পঞ্চাশ টাকা। তবে আমি এটা টাকা দিয়ে কিনিনি। এটা আমার বিয়ের উপহার।”

“তোর কথা তো কিছু বুঝতে পারছি না সেতু।”

“আমি তো বাংলাতেই কথা বলছি বাবা।”

আমি প্যাকেট খুলে দুটো সিগারেট বের করে একটা বাবাকে দিলাম, আরেকটা নিজে রাখলাম। বাবার হাতের সিগারেটে আমার সিগারেটটা ঠুকে বললাম,
“চিয়ার্স!”

ঠিক এই মুহুর্তেই আপু এসে পড়লো। সিগারেট দেখে ও আঁতকে উঠলো প্রায়,
“এসব কী হচ্ছে বাবা? তুমি সিগারেট খাচ্ছ?”

আমার হাতে সিগারেট দেখে বললো,
“তুইও? এসব কী দেখছি আমি!”

বাবার দিকে তাকালো আবারও। বললো,
“খুব তো সিগারেট খাওয়া নিয়ে বয়ান দাও। এখন নিজে কী করছো?”

আমি বললাম,
“তুমি বাবাকে বকছো কেন? বাবা তো কখনও সিগারেট খায়নি, খাচ্ছেও না। আমি তাকে খেতে দিয়েছি।”

“কী? তুই সিগারেট পেয়েছিস কোথায়?”

“এটা আমার বিয়ের উপহার। তুমি খাবে?”

এ কথা বলায় আপু প্রচণ্ড রাগ করলো। চ’ড় মা’রার ভঙ্গি করলেই আমি পিছু হটে গেলাম। দৌড়ে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করলাম। সিগারেটটা বাবার রুমেই ফেলে এসেছি। বাবা নিশ্চয়ই রেগে গেছে আমার উপর। বাবা আর আপুর উচ্চ বাচ্যে বাক বিতণ্ডার শব্দ শুনতে পাচ্ছি।

____________________

আজ শুক্রবার। জিন আম্বিয়ার বিয়ে হয়ে গেছে! না, রসিকতা করছি না। সত্যিই বিয়ে হয়েছে, আনাম খন্দকার নামের একজন ছেলের সঙ্গে। বিয়েতে শিক্ষক সমিতি ও সেজান ভাইয়াদের পরিবারের সবাই উপস্থিত ছিল।
বিয়েতে কোনো অনুষ্ঠান হয়নি, সাজ হয়নি, খাওয়াদাওয়া হয়নি। আমি বিয়ের সময় একদম লজ্জা পাইনি, আনাম ভাইয়া…না এখন ভাইয়া ডাকা ঠিক না। কিন্তু আমি পুরোনো অভ্যাস এত তাড়াতাড়ি ছাড়তে পারবো না। যদিও তার সামনে তাকে আমি ভাইয়া বলে সম্বোধন করবো না, কিন্তু তার অবর্তমানে তো তাকে ভাইয়া সম্বোধন করাই যায়। তো যেটা বলছিলাম, আমি লজ্জা পাইনি, কিন্তু আনাম ভাইয়ার বোধহয় লজ্জা লাগছিল। সেজান ভাইয়ার কেমন লাগছিল? না, আমি তার মনের অবস্থা সম্পৰ্কে এখন একদম জানতে চাই না। কিন্তু আমি না জানতে চাইলেও আমি তার মনের অবস্থা জানি।

“কাঁদছো কেন মিস তুতু?”

এত মানুষের ভিতর জাবির ভাই-ই বোধহয় কেবল আমার চোখের জল লক্ষ করলো। কিন্তু তার কথাটা ভুল, আমি কাঁদছি না। কাঁদলে চোখ বেয়ে পানি পড়বে, কিন্তু আমার চোখ থেকে এখনও পানি ঝরেনি। চোখে অশ্রু জমে আছে। বললাম,
“আমি যদিও কাঁদছি না, কিন্তু বিয়ের কনেরা কাঁদে এটা তো নতুন নয় জাবির ভাই। যখন আপনি বিয়ে করবেন, তখন আপনার বউও কাঁদবে।”

“কিন্তু তুমি তো শ্বশুর বাড়ি চলে যাচ্ছ না।”

“আমি তো কাঁদছিও না।”

জাবির ভাই একটুক্ষণ কী যেন ভাবলো, অতঃপর বললো,
“আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি আজ খুব কাঁদবে।”

তার কথায় হেসে বললাম,
“মাঝে মাঝে কান্না করা ভালো, তাতে শরীর ভালো থাকে, মনও ভালো থাকে। আপনিও মাঝে মাঝে কাঁদবেন, মন খারাপ করবেন। তবে আজ যেন আপনার মন খারাপের দিন না হয়। কারণ আজকের দিনটাই ভালো না। মন খারাপের জন্য একটা ভালো দিন দরকার।”

জাবির ভাই আমার দিকে নীরব চোখে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বললো,
“তুমি একজন অদ্ভুত মেয়ে মিস তুতু।”

“আমার আপু একজন রাগী মেয়ে। ওই দেখুন, কেমন তপ্ত চোখে আমাদের দেখছে। মনে হচ্ছে ও আবারও আপনার সঙ্গে আমার কথা বলায় নিষেধাজ্ঞা জারি করবে।”

জাবির ভাই বললো,
“হোক নিষেধাজ্ঞা জারি। আমাদের মাঝে এর চেয়েও বড়ো এক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়ে গেছে!”

বলে সে দূরে সরে গেল। তার শেষের কথাটা খুব মনোযোগ সহকারে ভেবে দেখলাম। সেজান ভাইয়ার দিকে তাকালাম। সুমনা চাচি কী যেন বলছে তাকে। মনে মনে বললাম,
“আমাদের মাঝেও মস্ত বড়ো এক নিষেধাজ্ঞা জারি হয়েছে!”

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here