#নির্মোচন . ❤
#পর্বসংখ্যা_০৩ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .
রুমটা অন্ধকারে ডুবে আছে। ঘুটঘুটে অদ্ভুত এক রহস্যময় অবস্থা। ফিহা বুঝতে পারছে না সে কি চোখ খুলেছে নাকি স্বপ্ন দেখছে। ঘড়ির টিক-টিক আওয়াজটা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। হঠাৎ কানে যেন ‘ধুপ ধুপ’ করে একটা সুক্ষ্ম আওয়াজ শুনতে পেল। এক মিনিট! এটা কীসের শব্দ? মনে হচ্ছে কেউ নিরিবিলি পায়ে সতর্কভাবে হাঁটছে। আরেকটু সতর্ক হয়ে শব্দটা শোনার চেষ্টা করলো ফিহা। না, ভুল নয় একেবারে ঠিক! একজোড়া পায়ের আওয়াজ খুব সাবধানী কায়দায় এগুচ্ছে এই রুমের দিকে। শব্দটা এত আস্তে, এত ধীরে হচ্ছে যে ঘড়ির টিক-টিক শব্দের আড়ালে মাঝে মাঝে ঢাকা পরে যাচ্ছে। খুট করে কিছু খুলার শব্দ হল এখন। চমকে উঠলো ফিহা! কেন জানি মনে হল রুমের দরজা খুলে ফেলেছে। ফিহা অনুভব করল তার নিশ্বাসের গতি ধক্ করে বেড়ে গেছে। সে স্বাভাবিক নেই। শরীর প্রচণ্ড ঘেমে উঠেছে। টালমাটাল হচ্ছে নিঃশ্বাস। শরীরের শিরদাঁড়া বেয়ে হিমশীতল হাওয়া বয়ে যেতেই ধপ করে উঠে বসলো ফিহা। অস্থিরচিত্ত ঘামার্ক্ত মুখে ডানে-বামে উন্মাদের মতো চাইল। তাড়াতাড়ি বিছানা থেকে এক লাফ দিয়ে নেমে রমের বাতি ধরিয়ে ফেলল। বুক ফুলিয়ে ফুলিয়ে নিঃশ্বাস নিতেই দেখল রুমে কেউ নেই। কিন্তু অবচেতন মনটা তখন শক্তভাবে জানান দিয়েছে এখানে কেউ ছিল। এখানে কেউ হেঁটেছে! হঠাৎ হাঁপাতে হাঁপাতে নিঃশ্বাস নেওয়া ফিহা দরজার দিকে চাইতেই অত্যাশ্চর্যের মতো দু-পা পিছিয়ে গেল। শোয়ার আগে দরজার নব লাগিয়ে ঘুমিয়েছিল, কিন্তু এখন সেই নবটা খুলে দরজা একটু ফাঁক হয়ে আছে। বাইরের কুচকুচে কালো অন্ধকারটা উঁকি দিচ্ছে ওইটুকু সরু ফাঁক দিয়ে। ‘ লা ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনায জোয়ালিমিন ‘ মনে মনে অজান্তেই দুয়াটা পড়ল ফিহা। নির্বাক-হতবাক-মূঢ় হয়ে প্রচণ্ড ভয়ে পা পিছাতে শুরু করলে একপর্যায়ে বিছানার যেতেই ধপ করে বিছানায় বসে পরল। কিছুক্ষণ না যেতেই হঠাৎ জলন্ত কী যেন দরজার ওইটুকু ফাঁক দিয়ে দ্রুতবেগে চলে গেল, হকচকিয়ে ফিহা আঁতকে উঠতেই তাড়াতাড়ি বিছানায় পা তুলে কুঁকড়ে গেল। প্রচণ্ড ভয়ে থরথর করে কাঁপতেই মনে মনে ‘ আল্লাহু আকবর ‘ বলে যিকির করে যাচ্ছে। মাথার উপর ঘূর্ণায়মান ফ্যান থাকা সত্ত্বেও চুটিয়ে ঘাম দিচ্ছে ফিহা। এমন অবস্থায় মূঢ় হয়ে আছে যেখানে ডাকার বা চিৎকার করার মতো স্থিতিতে নেই একদম। দরজার দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলে হঠাৎ ডান হাতের তেলোয় কিছু একটা অনুভব করল। সাথে সাথে তাকিয়ে দেখল হাতের কাছাকাছি ফোন। মরুর বুকে তৃষ্ণার্ত পথিক যখন জলের উৎস দেখতে পেয়ে চান্ঞ্চল্যকর অনুভূতিতে পাগল হয়, তেমনি প্রাণপূর্ণ উচ্ছ্বাসে ফিহা দ্রুত ফোনটা হাতে তুলে ডায়ালের জন্য হাত চালাতে থাকল। ঢোক গিলে নূন্যতম দেরি না করে কাঁপা কাঁপা হাতেই কলটা বসিয়ে কানে চাপল সে। ‘ টুট টুট ‘ বাজনা হচ্ছে। একবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার কল রিসিভ হবার জন্য প্রচণ্ড উদগ্রীব হচ্ছে। তিনটে রিংটোন যেতেই আচমকা কলটা রিসিভ হলে আতঙ্কিত ফিহা ফড়-ফড় করে বলল,
– আপু, আপু রুমে আসো! তাড়াতাড়ি আসো! একদম দেরি কোরো না। এখানে কেউ আছে, এখানে কেউ আছে। তুমি এক্ষুণি এসে —
ওর অস্থিরতার ভেতর অগাধ জলের পানি ঢেলে ভাবশূন্য গম্ভীর গলাটা জবাব দিলো,
– নাম্বারটা চেক কর।
সমস্ত অস্থিরতা চুরচুর হয়ে স্তব্ধ হলো ফিহা। এ কী কাণ্ড! মেয়েলি কণ্ঠটা এরকম শোনাচ্ছে কেন? অকস্মাৎ এমন কণ্ঠ শুনে হতবুদ্ধির মতো বলল,
– তোমার কণ্ঠটা এমন লাগছে কেন আপু? তুমি কী আমার সাথে ছেলে কণ্ঠের অ্যাপস দিয়ে ফাজলামি করছ?
বোকার মতো কথাগুলো শুনে কলের বিপরীতে থাকা মানুষটি বেজায় রাগ হলো। এরকম ফালতু কথাবার্তা তার কালেভদ্রেও সহ্য না। সুগভীর কণ্ঠটা বেজায় ক্ষিপ্ত হলেও যথাসম্ভব কাট-কাট ভঙ্গিতে বলল,
– ফ্যান্টাস্টিক! কাকে কল দিয়েছিস নিজেই জানিস না?
আকাশ থেকে ঠাস করে পরার মতো আশ্চর্য হলো ফিহা। কান থেকে ঝড়ের গতিতে ফোনটা নামিয়ে দেখল সে, ইংরেজি বর্ণমালায় বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা ‘ Sayeed Vai ‘। রক্তশূন্য মুখে বরফের মতো জমে যেতেই সাথে সাথে কলটা কেটে দিলো ফিহা। বালিশের দিকে ছুঁড়ে মেরে স্তব্ধের মতো লজ্জায় কুঁকড়ে গেল সে। কী করল এটা? কাকে কল দিয়ে ফেলল? অতিমাত্রায় তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে ডায়াল প্যাডে ‘ Sa ‘ লিখে সার্চ দিতেই ভুলবশত ‘Sabila’ নামের জায়গায় ‘ Sayeed ‘ নামটা টাচ হয়েছে। এখন ওই ব্যক্তি কী না কী ভাববে! রাত এখন তিনটা বাজতে পনের মিনিট বাকি, আর এসময় তাকে কল দিয়ে উদ্ভট কথা করলে যে-কেউ ঘুমের ব্যাঘাতে খেপে যাবে। ফিহা বিছানা থেকে নেমে পানির জন্য গেল। কিন্তু টেবিলের জগ শূন্য। তলানিতে অল্প একটু পানি ঝমঝম করে উঠল তাতে গলা ভিজবে না ওর। না চাইতেও এক বুক সাহস নিয়ে দুরুদুরু পায়ে দরজার বাইরে পা দিলো। ওর রুমটা মাঝখানে, ফিমার রুমটা বাঁদিকে এবং ডানদিকে একটু দূরত্বে সেই বদখত লোকটার রুম। হঠাৎ ফিহা চকিত ভঙ্গিতে দেখতে পেল বাঁ-দিকের দরজা ও ফ্লোরের মাঝে অল্প যেটুকু ফাঁক থাকে সেখান দিয়ে এক চিলতে আলো আসছে। অর্থাৎ ফিমা এখনো ঘুমায়নি। এতো রাত অবধি কখনো ফিমাকে জাগতে দেখেনি, এমনকি পরীক্ষার রাতে নাকে তেল দিয়ে পড়ার মতো শক্ত অভ্যাসও নেই ফিমার। ব্যাপারটা স্বাভাবিক লাগল না ওর। প্রচণ্ড উৎকণ্ঠিত হয়ে দরজায় আলতো চাপ দিয়ে চেক করতে নিল, কিন্তু দরজাটা ভেতর থেকে বন্ধ। ফিহা সেখান থেকে পা চালিয়ে চলে যেতে নিলে হঠাৎ ওর চোখ দুটো আচমকাই থমকে গেল। বোধহয় অবচেতন মনটাই ওকে থামিয়ে দিলো ক্ষণিকের জন্য। ডানদিকের রুমটা থেকে ফর্সা আলো আসছে। হাঁট করে খোলা রয়েছে কাঠের দরজাটা, দু’পাশে ঝুলছে খয়েরি রঙের লম্বা লম্বা পর্দা, ফ্যানের বাতাসে দুলতে থাকা পর্দাগুলো ফুলেফেঁপে উঠতেই তার মধ্য দিয়ে ভেতরের দৃশ্যটুকু ওর আঁখিদুটোয় ধরা দেয়। বহু বছর, ঠিক চারটে বছরের অনুপাত, ঠিক অনেকগুলো সময় শেষে স্বাভাবিক নয়নে দেখতে পাচ্ছে ফিহা। বিশাল বড়ো জানালার ধার ঘেঁষে দাম্ভিকতার মেজাজে দাঁড়িয়ে আছে জুনায়েদ সাঈদ। সাদা শার্টটা এখনো খোলেনি, বদলায়নি কালো প্যান্টটাও। তার ভারি বলশালী দেহের হাতদুটো দেখলে মানুষ একটু ঢোক গিলে তাকায়। ওই দুটো হাতই যেন গলা চেপে শূন্যে তোলার মতো অদ্ভুত ক্ষমতা রাখে। তার সুদীর্ঘ উচ্চতা যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি দেখতে অতিশয় সুন্দর মানুষ। তার দানবের মতো শক্ত সুঠাম শরীরটা একদিক দিয়ে আকর্ষণীয়, অন্যদিকে ভীতি সন্ঞ্চার করে মনে। হঠাৎ কেমন একটা খটকা লাগতেই মাথাটা পিছু ঘুরায় সাঈদ, সাথে সাথে ফিহা চমকে গিয়ে দরজার পাশে লুকিয়ে পড়ল। বাইরে শূন্যতা ও অন্ধকার দেখে মুখটা ফিরিয়ে নেয় সাঈদ। এদিকে ফিহা আকস্মিক কাণ্ডটুকুর জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাসে ঠোঁট গোল করে ছাড়ল। আর দাঁড়াল না সে, নির্দিষ্ট কাজের জন্য চলে যায় নীচে। সুকঠিন আদলের মানুষটা তখন কথা বলায় ব্যস্ত। বাঁ-কানে থাকা ছোট্ট ডিভাইসে তর্জনী টিপে কানেক্ট করল। কথাগুলো শান্ত শ্রোতার মতো শুনে মার্জিত গলায় বলল,
– কাজ শেষ। এ বিষয়ে আমি কিছুই বলতে চাই না। আই অ্যাম এক্সট্রেমলি স্যরি আমি এই মূহুর্তেই ব্যাপারটা ডিসক্লোজ করতে চাচ্ছি।
ওপাশ থেকে গরম কফিতে চুমুক দিতেই জবাব দিলো ফাহাদ। ব্যাপারটা যথাসম্ভব আয়ত্তে রেখে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
– মাথাটা ঠান্ডা কর দোস্ত। আমি চাই না সামান্যতম বিষয় নিয়ে তুই হাইপার হ। ম্যাটারটা গোঁড়া থেকে তুলে না ফেললে ইন ফিউচার তোর জন্য পথের কাঁটা হবে। তুই নিশ্চয়ই চাচ্ছিস না এরকম কিছু হোক?
কলটা গ্রুপ কলে কানেক্ট ছিল। ফাহাদের কথাটা অন্যপ্রান্ত থেকে শুনতে পেয়ে লাবিব বলে উঠল,
– তোর জল্লাদের মতো কর্মকাণ্ড দেখলেই কলিজাটা শুকায় যায় সাঈদ। মাথা কুল অ্যান্ড কাম রেখে কাজটা যে করবি এইটা তুই মানতেই চাস না শাlলা।
গাlলিটা শুনেও বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখাল না সাঈদ। লাবিবের জায়গায় অন্য কেউ এরকম কিছু বললে খবর হয়ে যেতো। সাঈদ কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে শেষ সিদ্ধান্তের ঘোষণা দিলো,
– ঠিক আছে। আসতে বলিস। বাট, উলটাপালটা কোনোকিছুই আমি সহ্য করব না। আমার বিহেবিয়ার ততক্ষণ পযর্ন্ত স্বাভাবিক, যতক্ষণ পযর্ন্ত কেউ উষ্কাতে না আসবে। কথাটা ওয়ার্নিং হিসেবেই বলে রাখলাম।
সবাই কথাটায় সায় দিলে এবার কলটা কেটে দেয় সাঈদ। জানালা দিয়ে আসা উচ্ছল, মনোরম, স্নিগ্ধ বাতাসে চোখ বন্ধ করে গভীর করে নিঃশ্বাস টেনে নেয়। বুকটা ভীষণ ফুলে উঠতেই বুকের খাঁজকাটা অংশগুলো স্পষ্ট করে ফুটে উঠে, উজ্জ্বল ফর্সা চামড়ার নিচে নীল-নীল রগগুলো উদ্ধতভাবে ফুটে উঠে যেন। তৃষ্ণায় গলাটা খুব শুকিয়ে গেছে। ঠান্ডা জুস বা কোল্ড ড্রিংক্সের জন্য তখনই রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে সে। এ বাড়ির নাড়ি-নক্ষত্র তার মস্তিষ্কের ভেতর মানচিত্রের মতো গেঁথে আছে। তাই ঘুটঘুটে অন্ধকার সত্ত্বেও দেদারসে নিকষ কালো আঁধার ফুঁড়ে এগিয়ে চলছে রান্নাঘরের দিকে। হঠাৎ দৃষ্টিযুগল আবদ্ধ হলো তার, পা-দুটো সচকিত ভঙ্গিতে থেমে গেল প্রবেশদ্বারের মুখে। রান্নাঘরের দিকে যে মৃদু আলো ও খুটখাট শব্দ হচ্ছিল সেদিকে সতর্ক ভঙ্গিতে লক্ষ রেখে প্রবেশ করল সাঈদ। তখনই সে চোখের সামনে সমুদয় ব্যাপারটা নির্বাক হয়ে অবলোকন করতে লাগল। কাঁচের বয়াম হাতে দু’গাল ফুলিয়ে চোখ বন্ধ করে আচার খাচ্ছে। বাসন্তী-কমলার অদ্ভুত মিশেলের পোশাকে ঢেকে সুকমারী সৌন্দর্য, যার কোমল-স্নিগ্ধ-প্রাণপূর্ণ উচ্ছাস ওইটুকু আচার খাওয়ার ক্ষণটুকুতে মিশে আছে। কী তৃপ্তিদায়ক অভিব্যক্তি ফুটিয়ে চক্ষু মুদিয়ে রেখেছে। নরম, কোমল, সুন্দর ঠোঁটদুটোতে তেলের আবরু লেগে লালগোলাপের মতো লোভাতুর লাগছে এখন। যেন প্রকৃতির এক টুকরো লালচে রঙ স্পর্শ করেছে ওই ঠোঁটে। আরেক টুকরো খাওয়ার বাসনা হতেই চোখ খুলে হাসিমুখে তাকায় সে, ওমনেই অমাবস্যা রাতের মতো কালো হয়ে যায় সপ্তাদশীর মুখ। পিপাসার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে যে নৈসর্গিক দৃশ্যপটে আঁটকা পরেছিল সে, তা যেন ধূলোর বাতাসে শূন্যে মিলিয়ে গেল। সপ্তাদশী ভয়কাতুরে মুখটা মৃদু একটা ঢোক গিলে তোতলানো সুরে বলল,
– আ-আ-আর ক-করব না।
বয়ামে হাত ঢুকানো অবস্থায় সুডৌল মুখটা আরো পাংশু হয়ে যাচ্ছে। মধ্যবর্তী দূরত্ব ঘুচে যাচ্ছে এখন দু’জনের ভেতর। পায়ে পায়ে ধীর ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে জুনায়েদ সাঈদ। ওই পাংশুবর্ণের মুখটাকে আরো একটু বিচলিত করে গম্ভীর স্বর তুলল,
– এটা আচার খাওয়ার টাইম?
সাঈদের চোখের দিকে অসংখ্যবার পলক ঝাঁপটানো চোখদুটো একটুখানি থেমে ‘ না ‘ সূচকে মাথাটা ডানে-বামে ঘুরায়। ভয়ে হচ্ছে, যদি চোরের মতো খাওয়ার জন্য এখন ঠাস করে লাগায়? আজ পযর্ন্ত ওর গায়ে কেউ হাত তোলেনি। বড্ড আদরে আদরে সকলের স্নেহে বড়ো হয়েছে ও, সেখানে যদি এই মানুষটা কঠিন চlড় মাlরে সেটা নিদেনপক্ষে সকলের জন্য স্বাভাবিক ব্যাপার হতে পারে কিন্তু ওর কাছে লজ্জায়-শোচনায় মlরে যাওয়ার মতো অনুতাপ। ফিহা বয়ামটা চুলার পাশে রেখে দিয়ে শুকনো গলায় বলল,
– মা আচার বানায় না। এখানে এসে খালামনির —
বলতে বলতেই নিজের বড়ো ভুলটার জন্য চোখটা ঝাপসা হয়ে গেল। অসময়ে বেহায়া চোখদুটো এমন কাজ করে বসে তখন চোখ লুকোবার জায়গা থাকে না একদম। সাঈদ ওকে কিছুই বলল না। ফ্রিজের দরজা খুলে দুটো ক্যান বের করে চুপচাপ চলে গেল সেখান থেকে। বাঁ-হাতের উলটোপিঠে চোখদুটো মুছল ফিহা, হাতদুটো ধুয়ে বয়ামটা জায়গামতো রেখে নিজেও রুমে চলে আসে। আসার সময় ওই রুমের দরজাটা আর খোলা দেখে না ও, দরজা করে রেখেছে এখন। অন্ধকারময় জায়গাটুকু পেরিয়ে এসে রুমের দরজা লাগাল ফিহা। উচ্ছল মনের উপর লজ্জাজনক আবরু এসে সাময়িক আনন্দটুকু ছিন্নভিন্ন করে দিলো। বিছানায় যেয়ে বসতেই হঠাৎ বালিশের পাশে একটা ক্যান দেখতে পায় ফিহা এবং আশ্চর্য হয়ে সেটা তুলে নেয় হাতে। ভ্রুঁ কুঁচকে ওটা পরোখ করতেই মনে পড়ল একটু আগে এরকম দুটো ক্যান যার হাতে দেখেছিল, সে কী তাহলে দ্বিতীয় ক্যানটা ওর জন্য রেখে গেছে? কেন রেখে গেল সে?
.
আফসানা সকাল থেকেই ফিহার মুখের দিকে বার বার লক্ষ করছে। মুখটা শুকনো, ম্লান ও বিষণ্ণ হয়ে এইটুকুনি দেখাচ্ছে। কী এমন হতে পারে যেটার জন্য রাতারাতি মুখের এমন বিধ্বস্ত পরিবর্তন হয়ে গেছে? ফিমা বাস ধরার জন্য একটু ব্যস্তভাবে নাস্তাটা খাচ্ছে। সাঈদ বাড়িতে নেই। ছেলে খুব ভোর সকালে উঠে ট্র্যাকস্যূট গায়ে দিয়ে কয়েক মাইল জকিংয়ের জন্য বেরিয়ে যায়। ক্লান্তিমাখা চোখ, ঘামার্ক্ত দেহ, চোখ-মুখ লাল করে ওয়ার্কআউট শেষে বাড়ি ফেরে। সুফিয়া নাস্তার কাছে ব্যস্ত। আফসানা এবার না পারতে ফিহাকে স্পষ্টমুখে বলল,
– তোর কী হয়েছে বলবি? সেই কখন থেকে মুখটা কালো করে বসে আছিস, কিচ্ছু খাচ্ছিস না, নিচ্ছিস না। কোনো সমস্যা? কী হয়েছে?
টেবিলের দিকে মাথা নিচু করে ফিহা শান্ত ও স্বাভাবিক স্বরে বলল,
– আমি বাসায় যাব। এখানে থাকতে চাচ্ছি না। বাবাকে বলে দাও আমাকে বিকেলে এসে নিয়ে যেতে। আমি ব্যাগদুটো দুপুরের ভেতর গুছিয়ে নেব।
উদ্ভট কথাগুলোর বিন্দুবিসর্গ বুঝতে পারল না আফসানা। এখানে আসার একদিন-না-একদিন না পেরোতেই চলে যাওয়ার কথা বলছে কেন? প্রশ্নটা সে কাষ্ঠ ভঙ্গিতে শুধাল,
– কী সমস্যা হয়েছে খুলে বল। কোনো উটকো ঝামেলা হয়েছে নিশ্চয়ই। না হলে আমার বাসায় এসে কখনো ফালতু কথা বলতিস না তুই। কেউ কী তোকে বিরক্ত করেছে? হঠাৎ এক রাতের ভেতর কী হয়েছে যেটার জন্য তুই আজই চলে যেতে চাচ্ছিস?
ফিহা আনত চোখদুটো আফসানার দিকে রাখল। এতক্ষণ যাবৎ তর্জমা করা কথাগুলো প্রস্তুতমুখে গুছিয়ে বলল,
– বড়ো হওয়ার পর থেকে আজ পযর্ন্ত বাবাকে ছাড়া থাকিনি। ছোটোবেলায় থাকতাম সে অন্য বিষয়। এখন আমরা সবাই বড়ো হয়ে গেছি, সবাই এখন নিজ-নিজ জ্ঞানের হিসেব বুঝি। তাই চাচ্ছি বাবার কাছে ফিরে যাব। বাবা আমার শাষণ ছাড়া ডায়াবেটিসের ঔষুধ খায় না। তার মনেও থাকে না। আমি যে এখন নিজের দিকটা বিবেচনা করে তোমার কাছে নিরাপদে আছি, সেদিকে বাবাকে দেখে রাখার কেউ নেই খালামনি। মা তো সারাদিন সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকে। নিজেও অসুস্থ মানুষ।
আফসানা পুরোপুরি ব্যাপারটা স্বচ্ছ পানির মতো বুঝতে পারল। একটু আগেই নাজনীন আর নিয়াজের সাথে দু’বোন কথা বলেছে। বলা বাহুল্য, নিয়াজ ছোটো মেয়েটার প্রতি একটু বেশি-ই দুর্বল। নাজনীন যখন দ্বিতীয়বারের মতো অন্তঃসত্ত্বা হয়, তখন নাজনীনের পাশাপাশি ওর শ্বাশুরী হালিমারও ঘোরতর ইচ্ছে ছিল ছেলে হোক কিন্তু আল্লাহ্ পাকের ইচ্ছেতে ঘরে কন্যারূপে রহমত এসেছে। নাজনীনের মন পুরোপুরি ভেঙে গেলেও তা কোনোদিন ছোটো মেয়ের কাছে প্রকাশ করেনি, এমনকি বিদ্রুপ আচরণ করলেও সেটা স্রেফ মাতৃশাষণের অন্তর্ভুক্ত। অন্যদিকে হালিমা খাতুন সর্বত্র ‘ ছেলে হোক, ছেলে হোক ‘ করতেন বলে জ্ঞানত এ ঘটনার পর আর কখনো ছোট্ট ফিহাকে সহ্য করতে পারেননি। এখনো পারেন না। নিয়াজ সেই থেকেই ছোটো মেয়েটার কাছে আলাদা স্নেহ-মমতা পেয়ে কিছুটা নতজানু হয়ে গেছে। আফসানা কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে ওর বাবার দিকটা শান্তভাবে বুঝিয়ে বলল,
– তুই কী চাচ্ছিস সেটা আমি বুঝেছি। কিন্তু বোনজামাইয়ের অনুরোধ আমি ফেলতে পারব না। তোর বাপ নিজেই বলেছে তুই আমার এখানে থাকলে সে নিশ্চিন্ত থাকবে এবং ওখানকার ব্যাপারটা নিয়ে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে পারবে। এখন তুই যদি যাওয়ার কথা বলিস তোর বাপ কিন্তু স্বস্তি পাবে না ফিহা অফিসে গিয়েও তোদের টেনশনে বিপি হাই করবে। তুই কী এরকম কিছু করতে চাচ্ছিস?
এ কথার প্রেক্ষিতে চুপ করে ভাবতে লাগল ফিহা। বাবার মতো একগুঁয়ে মানুষ শুধুমাত্র ফিহার জোরাজুরিতে কথা পালন করে। সেখানে দ্বিতীয় কোনো ব্যক্তি এমনকি মা-ও যদি চেষ্টা করতে যায় তাহলে বাবার রাগ তখন দেখে কে। সারাটা দিন খাটাখাটুনি শেষে ক্লান্ত-জীর্ণ শরীরটা নিয়ে বাসায় যখন ফেরে, তখন বাবার ওই ক্লান্ত ভারাক্রান্ত মুখ দেখলে পড়াশোনা বাদ দিয়ে বাবার কাধ থেকে খরচের বোঝাটা নামাতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সেটা শুনলে বাবা কীরূপ কষ্ট পাবে সেটাও জানে ও। পাশ থেকে ফিমা পুরোদস্তুর কাহিনি দেখে ওর আলগা আর ন্যাকান্যাকা ঢঙের জন্য দারুণ বিরক্ত হলো। বাবাকে বাবার মতো থাকতে উচিত, তার ব্যাপার নিয়ে এতো মাথা ঘামানোর কী আছে? পুরুষ মানুষ বাইরে রোজগার করতে গেলে শরীরে একটু-আধটু রোগ বাঁধবেই, তাই বলে রোগ-টোগ নিয়ে এমন চিন্তিত হওয়ার কারণ আছে? যত্তসব ফাlলতু তামাশা। কথাটা মনে মনে উচ্চারণ করল ফিমা। আফসানা ওর ব্যাপারটায় ছোট্ট একটা সমাধান করে বলল,
– তোর ফোন আছে না?
ফিহা বিষণ্ণভরা চোখদুটো তুলে আস্তে আস্তে মাথা নাড়িয়ে বলল,
– হ্যাঁ আছে। কিন্তু কোনো সিমে ব্যালেন্স নেই।
মুখ ফুটে রিচার্জের জন্য বাবাকেও বলতে পারে না ফিহা। হাতের স্যামসাং সেটটা কেনার পরপরই বাবার চাকরিটা চলে যায়। এরপর আটমাস বাবার কোনো চাকরি ছিল না। ফিহা জানে, ওই আটটা মাস কতটা বিপন্ন অবস্থার ভেতর দিয়ে ওরা চারটা মানুষ গুজরান করেছে। বাইরের মানুষ ওদের দুরবস্থার চেহারা এক চুলও আঁচ করতে পারেনি। সম্ভবত মাথার উপর দোতলা বাড়ির স্থায়ী ছাদটুকু ছিল বলে কেউ বুঝতেই পারেনি ওরাও কতটা সংকটকালীন দিন কাটিয়েছে। জিনিসপত্রের লাগাম ছাড়া দাম, দু’বোনের পড়ার খরচ, সংসারের যাবতীয় হিসাবের পেছনে সবটুকু সন্ঞ্চয়কৃত অর্থ চোখের নিমিষে হাওয়া হয়ে যায় বাবার। এরপর যদিও চাকরি জুটেছে বাবার, কিন্তু বয়সের একটা সীমা চলে যাওয়ার জন্য আর ভালো বেতনের চাকরি মেলেনি। নিয়াজের নীতিপরায়ণ স্বভাব এবং ভদ্র শিষ্টাচার এতো প্রখর ছিল যে দুরবস্থার দিনেও সে আফসানার কাছে হাত পাতেনি, কালেভদ্রে আদৌ কারোর সাহায্য নিয়েছে কি না সন্দেহ। আফসানা চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের অর্ধেকটা ঘুরে ফিহার পাশে গিয়ে বসল। ওর মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বলল,
– বাপের মতোই স্বভাব পেলি? কোনো কিছু লাগলে যে মুখ ফুটে বলতে হয় এটা জানিস না? আমি তো অন্তর্যামী হয়ে তোর মনের খবর ধরতে পারব না। তোর বাপটাও চাকরি যাওয়ার কথা গোপন রেখে ভালোই শুভ কাজ করল, এখন তুইও দেখছি সেই পথে হাঁটা দিয়েছিস। তোর নতুন নাম্বার দুটো আমাকে আধ ঘন্টার ভেতর ম্যাসেজ করে পাঠাবি। যদি দেখি কোনো ম্যাসেজ আসেনি তোর খবর আছে বলে দিলাম।
বলেই আফসানা অফিসে যাওয়ার জন্য ড্রাইভার নিয়ে চলে গেল। ফিমা খালামনির ধমক খেয়ে বাস ধরা বাদ দিয়ে তার গাড়িতেই রওনা দিলো। সুফিয়া এসে এক কাপ চা ছোট্ট ট্রে থেকে টেবিলে নামিয়ে ফিহার উদ্দেশ্যে বলল,
– আমাগো নবী পাক (সাঃ) এইলিগাই কইছে মাইয়ারা হইল জান্নাত। আর জান্নাত কুনোদিন দুঃখ দিবার পারে না।
.
রৌদ্রস্নাত প্রকৃতি। দুপুর বারোটার দাপুটে সূর্য দিগ্বিদিক তাপ ছড়িয়ে দিচ্ছে এখন। সোনালি আলোকচ্ছটা গাছের পাতায় পাতায় ছাপিয়ে গ্রীষ্মের তেজটা আক্রোশে ছাড়িয়ে যাচ্ছে দূর দূরান্তে। ‘ S. A. Jakir ‘ লেখা বিশাল বড়ো গেটটার সামনে টয়োটা অ্যালিয়েন ব্রান্ডের কালো গাড়িটা দু’বার হর্ণ বাজাল। গেটের পকেট গেট থেকে চকচক কালো নতুনের মতো গাড়িটা দেখে চটজলদি গেটটা খুলে দিয়ে গাড়িটাকে আসতে দিলো। গেট থেকে ড্রাইভ-ওয়ের লম্বা প্রশ্বস্ত পথটুকু অতিক্রম করে বাড়ির সামনে এসে থামতেই একসাথে চার-চারটি দরজা খুলে চারটে যুবক বের হলো। যে ড্রাইভিং সীটে ছিল সে নিজের তর্জনীতে চাবির রিংটা চারপাক ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
– সাঈদ কী বাসায় আছে? যদি না থাকে? শুধু শুধু এসে তো লাভ নেই। খালি বাড়ি।
সুন্দর করে চুল আঁচড়ানো, ঠোঁটে প্রসন্নতার ছাপ, চোখদুটো চন্ঞ্চল দেখালেও ভারিক্কি একটা ভাব আছে, পড়নে নেভি ব্লু জিন্স প্যান্ট এবং বুকের কাছে ‘ PUMA ‘ লেখা লাল টিশার্ট। তাকে উদ্দেশ্য করে এবার বলল আরেকজন,
– লাবিব আমি কিন্তু এজন্যই বলেছিলাম এখন এসে লাভ নেই। সাঈদ এসময় বাড়ি থাকে না।
লাবিব মুখ ঘুরিয়ে শেষে দাঁড়ানো ব্যক্তিটির দিকে তাকাল। দুটো হাত কোমরে রেখে লাবিব আফসোসের সুরে বলল,
– ওকে থামানো দরকার ফাহাদ। তুই এখনো বুঝতে পারছিস না কত বড়ো কেলেঙ্কারি হতে পারে। আমি ওর অ্যাগ্রেসিভ ফর্মটার জন্য মারাত্মক ভয় পাচ্ছি। ওর মাথা এখন ঠিক নেই।
লাবিবের কথায় সায় জানিয়ে চিন্তিত হলো ফাহাদ। হাতঘড়িতে সময়টা দেখে তার ডানে থাকা সাব্বিরের দিকে বলল,
– ফিহার ম্যাটারটা সবকিছু শেষ করে দিবে। আমি নিশ্চিত সাঈদ এটার জন্যই ডেসপ্যারেট আচরণ করছে। ওকে থামানো এখন সম্ভব না। অন্য কিছু ভাব। আমাদের হাতে সময় খুব কম।
সাব্বিরের কথা শুনে উদ্বেগের পারদ বহু গুণ বেড়ে গেল সবার। সবার মুখেই যেন অদৃশ্য কালি লেপ্টে আছে এখন। এভাবে হাতে হাত রেখে বসে থাকা যাবে না একদমই। কিন্তু উপায় কী? লাবিব একের পর এক চিন্তায় মশগুল হয়ে বাড়ির খোলা দরজার দিকে বিড়বিড় করে বলল,
– একটাবার ভাব! যদি ফিহার ঘটনা ও জেনে যায় তাহলে সম্পূর্ণ কাহিনি শেষ। সাঈদ ওর কlলিlজা টেনেটুনে ছিঁlড়ে ফেলবে। সাঈদ যে বাড়ি নেই এটা আমাদের জন্য ভালো খবর না। আজই ফাহিমের আসার কথা ছিল। সেখানে ফাহিমও নেই, সাঈদও নেই ব্যাপারটা বুঝতে পারছিস?
তিন জোড়া কৌতুহলী চক্ষু লাবিবের দিকে দৃষ্টিবদ্ধ হলো। তন্মধ্যে ফাহাদ এদিক-সেদিক হিসাব মিলিয়ে অস্থিরভাবে চিৎকার দিয়ে বলল,
– সাঈদকে কল দে। ফাস্ট, এক্ষুণি! দেরি করিস না সাব্বির!
#FABIYAH_MOMO .