নির্মোচন পর্ব ৪

0
843

#নির্মোচন .
#পর্বসংখ্যা_০৪ .
#ফাবিয়াহ্_মমো .

কল দিয়েও পাওয়া যাচ্ছে না সাঈদকে। লাগাতার কলগুলো করেই যাচ্ছে। নিরুপায় হয়ে ওরা বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। একমাত্র সুফিয়া ছাড়া এ বাড়িতে দ্বিতীয় প্রাণীর উপস্থিতি নেই সেটাই তারা জানত। তাই সুফিয়ার উদ্দেশ্যে দরজা থেকে দাঁড়িয়ে উচ্চস্বরে হাঁক ছাড়ল,

– সুফি খালা আছেন?

রান্নাঘর থেকে ডাকটা শুনতে পেয়ে সতর্ক হলো সুফিয়া। আটপৌরে শাড়ির আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দরজার সামনে এসে শুধাল,

– আয় হায়, তুমরা আইছ দেহি। আহো ভিতরে আহো। বাইরে খাড়ায়া আছ ক্যান?

ভেতরে ঢুকল সবাই। আসল কথাটা বলার জন্য দেরি না করে লাবিব প্রশ্নাত্মক সুরে বলল,

– সাঈদের ব্যাপারটা জানেন খালা? ও কোথায় গিয়েছে কিছু বলতে পারেন? আমরা কল দিচ্ছি কল রিসিভ করছে না। এভাবে তো টেনশন কমে না খালা। আপনি কিছু জানেন ওর বিষয়ে?

সুফিয়া পাতলা ভ্রুঁ-দুটো একত্র করে কিছুক্ষণ ভেবেচিন্তে বলল,

– ভোর চাইরটার সময় উঠছে এইডা কইতে পারুম। কিন্তু কই গেছে হেইডা তো কইতে পারি না। তুমগোর মুখ এমন কালা হইয়া আছে ক্যান? কুনো সমস্যা হইছে নাকি?

লাবিব নিচের ঠোঁটটায় জিভ বুলিয়ে জানালার কাছে চলে গেল। এদিকে সুফিয়ার জবাবটা ফাহাদ দিয়ে বলল,

– ফাহিমকে মনে আছে আপনার?

সুফিয়া ফট করে বলল,

– হ, মনে থাকব না ক্যা? ফিহার ভাইয়ের কথা কইতাছ না?

পুরো ঘটনাটা খুলে বলল ফাহাদ। যতটা সংক্ষেপে বললে সুবিধা হয়, ততটুকুই বলল সুফিয়াকে,

– ফাহিম এখন সাঈদের সাথে দেখা করতে চায়। ফাহিমের একটাই কথা, ওর বোন ফিহা ছোটোখাটো ভুল করেছে যেটা বয়সের দোষে সবাই করে। কিন্তু আপনি তো জানেন, সাঈদ এমন বুজরুকি শোনার মানুষ না। ও নিজে যেটা দেখবে, যেটা বুঝবে সেটাই বিশ্বাস করতে বাধ্য। ওর সিদ্ধান্ত টলাতে পারবে এমন মানুষ এখন পযর্ন্ত আসেনি। আমরা চাচ্ছিলাম ওদের দু’জনকে মুখোমুখি বসিয়ে ঠান্ডা মাথায় সর্ট আউট করতে, কিন্তু সাঈদ মেবি অ্যাগ্রেসিভ হয়ে গেছে। খুব টেনশনে আছি খালা। না জানি ফাহিমকে এখন রাস্তায় ফেলে কুত্তার মতো পেটাচ্ছে। ওর রাগ তো আপনি জানেনই।

সুফিয়া স্তব্ধ চোখে নীরব হয়ে গেলেন। মাথার ভেতর চিন্তার চরকি ‘ বাই বাই ‘ শব্দ করে ঘুরছে। ফিহার ঘটনা নিয়ে এখনো কিছু জানে না আফসানা। সম্পূর্ণ ব্যাপার সে নিজের কাছে, নিজের মধ্যে ধূর্ততার সাথে চেপে রেখেছে। ফিহার আপন চাচাতো ভাই ফাহিম রহমান সাঈদের সাথে একই কলেজে পড়ত। সেই সূত্রপাতে দু’জনের মধ্যে চেনাশোনা হয়, সাক্ষাৎ হয়, কিন্তু বন্ধুত্ব বা সখ্যতা গোছের কিছুই তখন গড়ে ওঠেনি তাদের। ফাহিমের সহযোগিতার মাধ্যমেই নাকি অন্য কোনো পন্থায়, হঠাৎ সাঈদের সাথে বেশ অদ্ভুতভাবে যোগাযোগ হয় ফিহার। শুধুমাত্র ‘ ফিহা ‘ নামটার জন্যই বদলে যায় আরেক ফিহার ডাকনাম। সেই ঘটনার পর থেকে আজ পযর্ন্ত এক টুকরো ছোট্ট নামটা শুনতে পারে না সাঈদ। ভুলক্রমেও সেটা উচ্চারণ করে না তার বন্ধু বা সুফিয়া খালা। সুফিয়াকে অতল চিন্তায় নিবিষ্ট দেখে সাব্বির ভদ্রমহিলার হাতে মৃদু ঝাঁকুনি দিয়ে বলল,

– খালা?

চকিত ভঙ্গিতে সংবিৎ ফিরে পেতেই সাব্বিরের দিকে উজবুক চোখে তাকাল সুফিয়া। চট করে করে দোতলার দিকে কী যেন দেখে স্বস্তির দম ছেড়ে ফের সাব্বিরের দিকে তাকাল,

– এহন কী করা লাগব? সাঈদ বাবারে থামান যাইত না?

– না, খালা অসম্ভব। শালারপুত এখন সাঈদকেই ব্ল্যাকমেইল শুরু করেছে। বার বার বলছে আন্টির কানে সব কথা ফাঁস করে দিবে। কিন্তু আপনি তো জানেন সাঈদ আন্টির জন্য একদমই ভয় পাচ্ছে না। ওর ভয়টা অন্যদিকে। অন্যকিছু। এখন কী করা যায় বুঝতে পারছি না।

সুফিয়া শঙ্কিত মুখে সঙ্গে সঙ্গে বলল,

– খবরদার! ওই ছ্যামরা যেন এই বাড়িতে না আহে। এহনো এদিককার মামলা শুরু হয় নাই। সাঈদরে আমি বুঝাইতেই পারতাছি না ওরও একটু ভাবন দরকার। ওয় আমার কথা কানে লইতাছে না।

সাব্বির এ কথা শুনে অনুযোগ করে বলল,

– সেটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু ওর ভিতরে আবেগের ছিঁটেফোঁটাও নেই খালা। আপনি বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, একবার ট্রেনের নিচে কাটা পরে এক লোক চার টুকরা হয়ে গেছে। আমরা সবাই ওখান থেকে চোখ ফিরিয়ে সরে গেছি, কিন্তু সাঈদের কোনো রিয়েকশন নেই। ও চুপচাপ সব দেখছে। যেন চোখের সামনে নরমাল কোনো দৃশ্য। তাহলে বুঝুন ওর অবস্থা কী পরিমাণে ডেন্ঞ্জারাস হয়ে গেছে। একটা মানুষ যদি অতিমাত্রায় শক্ত আচরণ করে সেটা কখনো স্বাভাবিকতার কাতারে পড়ে না। এখন যদি ফাহিমকে ও পেটায় তাহলে লসটা ওর দিকেই যাবে। ফাহিম কিন্তু বাঁচবে না খালা। ফাহিম মরে যাবে।

পাশ থেকে সবচেয়ে অস্থির ছেলেটা আজ নীরব হয়ে শুনছে। আসার পর থেকে একটা টু শব্দ করেনি সে। লাবিবের কথায় দ্বিমত পোষণ করে চটান করে বলল আদিব,

– উহুঁ। ঘটনা যত সোজা দেখাচ্ছে, কাহিনি তত সোজা না। ফাহিমের সাথে যোগাযোগ করার মাধ্যম শুধু আমি আর ফাহাদ জানি। কারণ, দুই বছরের মধ্যে ফাহিমের সাথে ওর কোনো ধরনের কানেকশন ছিল না। তাহলে ও ঠিকানা কোথায় পেল? ফাহিমের সব দলবল পড়াশোনা বা চাকরির জন্য অ্যাব্রড চলে গেছে। বাদ রইল শুধু ফিহা। আর ফিহাকে কল দিয়ে ঠিকানা জিজ্ঞেস করবে এরকম মানুষ সাঈদ না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে একদিনের ভেতর কোথায়, কীভাবে, কার মাধ্যমে ঠিকানা পেল সাঈদ? এভাবে কোনো ব্যক্তির ঠিকানা জোগাড় করাটা চাট্টিখানি ব্যাপার না।

এরকম উদ্ভট প্রশ্ন শুধু আদিবের মাথায় নয়, এটার বিশদ কাহিনি নিয়ে সকলের মনেই তীব্র উৎকণ্ঠার জন্ম দিয়েছে। চিন্তার খাতা মেলে আজ পযর্ন্ত কোনো অঙ্ক, কোনো সূত্র, কোনো সমীকরণ তো দূর, এ নিয়ে ভাবতে গিয়ে সবকিছু তিনশো ষাট ডিগ্রি কোণে ঘুরে গেছে। এমন সময় একজোড়া ব্যস্ত পদযুগলের শব্দ শুনে সবাই বিক্ষিপ্ত চোখে দরজার দিকে তাকাল। ওমনেই তাদের স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গির অবয়ব পালটে একরাশ বিস্ময়াকুল অবস্থা ভর করল চোখে। কালো ট্যাকসূট পরে সমস্ত শরীর ঘামিয়ে হনহন করে প্রবেশ করছে সাঈদ। শরীর-সহ পুরো মুখটা তার প্রচণ্ড ঘেমে লাল হয়ে আছে, কপালের সামনে এলোপাথাড়ি চুলগুলো ঘামে ভিজে ঝুলছে, বাঁ-হাতে থাকা কালো ঘড়িটার স্ক্রিন থেকে বিপ্ বিপ্ করে জানান দিচ্ছে সময়। লাবিব কল করাটা বাদ দিয়ে সহসা তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,

– কই ছিলি তুই? কতক্ষণ ধরে কল দিচ্ছি! কী পরিমাণে টেনশনে ফেলে দিছিলি খেয়াল আছে?

বুকের কাছ থেকে লম্বা জিপারটা টান মেরে জ্যাকেটটা খুলতে খুলতে লাবিবের দিকে তাকাল সাঈদ। তীক্ষ্ম চোখদুটো খাটো করে প্রশ্নসূচকে বলল,

– কীসের জন্য?

নিরুত্তাপ ভঙ্গির প্রশ্ন শুনে সবাই একে-অন্যের দিকে দৃষ্টি বিনিময় করল। এতক্ষণ যে সবাই চিন্তায় চিন্তায় পাগল হয়ে যাচ্ছিল সে কী ওটা বুঝে না? ফাহাদ চাপা ক্ষোভের রাগটা আগ্নেয়গিরির মতো বিস্ফোরণ করতে যাবে, ঠিক তখনই পেছন থেকে টিশার্ট খামচাল আদিব। ফাহাদকে চট করেষপুরোপুরি থামিয়ে দিয়ে ফিসফিস সুরে খুবই হালকাভাবে বলল,

– উপরে দ্যাখ।

ফাহাদ নিমিষের ভেতর চোরাদৃষ্টি দিয়ে দোতলার পানে পরোখ করে নিল। রেলিংয়ে হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে নাবিলা হক, উঁচু রেলিংটার উপর ওড়নার একপাশ দুলে দুলে উড়ছে ওর। ছোটোখাটো লাবণ্যভরা মুখ, আদুরে মায়ার ঠোঁটদুটো হৃদয়ে-হৃদয়ে প্রাণঘাতী ইচ্ছাটা জাগিয়ে তোলে। ভরা চাহনির পূর্ণমায়ার চোখদুটো বড্ড কৌতুহল মাখিয়ে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। ফাহাদ ঢোক গিলে বিড়বিড় করে বলল,

– সাক্ষাৎ আগুন! এই আগুন কী সাঈদের শক্ত খোলসকে ভস্ম করতে পারবে না?

ফাহাদ ও আদিবের চোখাচোখি অবস্থা দেখে সাঈদ ওদের ভেতরকার আলাপটা আঁচ করতে পারল। নিজে আর দোতলায় তাকিয়ে সেই মানুষটাকে বিব্রত করতে চাইল না। সবাইকে সোফায় বসতে বলে সুফিয়াকে নাস্তার জন্য যেতে বলল সে। চার বন্ধু সোফা ভাগাভাগি করে বসতেই সাঈদ ওদের উলটো দিকের সিঙ্গেল সোফাটায় বসে বলে,

– কী জন্য আসা হয়েছে? বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়া আমার বাড়িতে কেউ আসে না। তাই কারণটা আমি ক্লিয়ার কাট জানতে চাচ্ছি। কোনোপ্রকার মিথ্যা বা লেইম এক্সকিউজ আমি সহ্য করব না।

কাট কাট ভঙ্গির কথা শুনে স্থির হলো ওরা। এবার সিরিয়াস কায়দায় ফিরে এসে প্রথম প্রশ্ন করল আদিব,

– ফাহিমের খোঁজ কে দিছে? মিথ্যা বলবি না তুই! তুই বার বার এমন কাণ্ড করতেছিস যেটা আমাদের কাছে স্পষ্ট না।

পায়ের উপর পা তুলে মনোযোগ দিয়ে শুনল সাঈদ। একটা হাত সোফার নরম হাতলে রেখেছে সে, অন্য হাতটা ভাবুক ভঙ্গিতে ঠোঁটের কাছে রেখে বেশ দাম্ভিকতার সাথে কনুইটা হাতলের উপর ঠেকিয়ে রেখেছে। আস্তে করে সম্রন্ত্র সুরে বলল,

– ফাহিমকে কিছুই করিনি। ওর মতো নোংরা কীটের গায়ে হাত তুলে নিজের লেভেল নামাতে ইচ্ছুক নই।

আদিব কিছু বলার পূর্বেই মাঝখান থেকে বোমের মতো ফুঁসে উঠল লাবিব। গলায় ঝাঁঝ মিশিয়ে বিরক্তির সাথে চ্যাঁচাল,

– তোর কথা, তোর কাজ, তোর মতলব, তোর আচরণ, তোর সবকিছুই আমাদের অদ্ভুত লাগতেছে সাঈদ। নিজেই কালরাতে ম্যাসেজ দিয়ে বললি তুই ফাহিমের সাথে দেখা করবি না। এখন আবার রাতারাতি কী এমন হয়ে গেল যে, সকালই শালারপুতকে ধোলাই দিতে চলে গেলি! ব্যাপারটা কী আমাদের সাথে সাফ সাফ ঝেড়ে কাশবি?

লাবিবের প্রশ্নটাকে গুরুত্ব সহকারে কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করল সাঈদ। সামনে থাকা সেন্টার টেবিলের কাঁচে দোতলা থেকে শান্ত মুখটার আবছা অবয়ব দেখে ধীর গলায় বলল,

– অতীতের চ্যাপ্টার বন্ধ করতে গিয়েছি। আমি চাই না বর্তমানে সেটার প্রভাব পড়ুক। ওকে শুধু এটুকুই বুঝালাম রাস্তা ক্লিয়ার করে সোজাসুজি চলে যেতে। বাঁকা পথে ঢুকলে পরিণামটা ভালো হবে না।

ঘুরপ্যাঁচ দিয়ে কথাগুলো বললেও আসল মর্মগুলো বুঝতে পেরেছে ওরা। ফাহিমকে গলায় পারা দিয়ে শাষিয়ে এসেছে ও। অথচ মুখে মুখে কী সুন্দর সহজ বুলি আওড়ে গেল। সুফিয়া ততক্ষণে নাস্তার ট্রে নিয়ে হাজির হলে হঠাৎ দোতলার অবস্থা দেখে হাসিমুখে ডাকল,

– নাবিলা? ওইহানে দাঁড়ায়া আছ ক্যান? নামবা না? আইয়া দেহো কেডা আইছে। ওগোরে চিনোনি দেহো দেখি।

টনক নড়ার মতো সম্বিত পেল ফিহা। তাকে তিন অক্ষরের নামটা দিয়ে সম্বোধন করে অল্পকিছু মানুষ। তন্মধ্যে সুফিয়া খালা একজন। ফিহা জড়সড় মুখে নীচ নেমে এক এক করে চারটি যুবকের দিকেই চাইল এবং মনে মনে বুঝতে পারল তারা সবাই ভীষণ স্মার্ট এবং সুদর্শন পুরুষ, কিন্তু এদের মাঝে যে ব্যক্তিটি সিঙ্গেল সোফায় বসে ওদের কথায় টুকটাক হুঁ হা করে ক্ষুদ্র জবাব দিচ্ছে, সে একটু বেশিই হ্যান্ডসাম। ফিহা ইচ্ছে করে তার দৃষ্টি এড়ানোর জন্য সিঙ্গেল সোফার ঠিক পিছনে দাঁড়াল, ঠোঁটে জড়তামাখা হাসি টেনে নম্রভাবে বলল,

– আসসালামুয়ালাইকুম,

সুকণ্ঠ গলার নম্র সালামটা শুনে শরীরটা শিরশির করে উঠল তার। একটা পলকের জন্য মাথা ঘুরানোর চিন্তা করলেও পরক্ষণে সেটা উগ্র মেজাজের জন্যই হোক অথবা তার বেপরোয়া ব্যক্তিত্বের জন্য পিছু তাকাল না সাঈদ। দম্ভরূপে নিজের ভঙ্গিতে বসে থাকলে কানে পর্যায়ক্রমিক কথাগুলো শুনতে পেল,

– আমাকে মনে আছে? দেখো তো চিনতে পারো কি না।

প্রশ্নটা করল লাবিব। চায়ের কাপটা তুলে নিল সে। ফিহা তাকে চেনার জন্যই দৃষ্টিদুটো সরু করে ঠোঁটের কোণাটা দাঁতে কামড়াল। কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দের মাঝে নাস্তানাবুদ হয়ে বলল,

– আপনি কী লাবিব ভাইয়া না?

দু’ঠোঁট প্রসার করে হেসে দিলো লাবিব। চায়ের কাপে ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলল,

– এই তো চিনে গেছে। তোমাকে কত দিন পর দেখলাম জানো? শেষবার তোমাকে এইটুকুনি দেখেছি। তখন মেবি ক্লাস এইটে ছিলে। তুমি তো দেখি ক’বছরের ভেতর অনেক বড়ো হয়ে গেছ। এবার কীসে পড়ছ? ম্যাট্রিক শেষ?

ফিহা হাসিমুখেই জানাল,

– জ্বী ভাইয়া, এসএসসি শেষ। এখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে উঠেছি।

দু’জনের ভেতর এটা-ওটা নিয়ে তুমুল আড্ডা হতেই ওদিকে তিন বন্ধুর ভেতর নীচুস্বরের কথা শুরু হলো। সাঈদ কেন জানি বেশ অদ্ভুতভাবেই সেখান থেকে সরে পড়তে চাইল। লাবিব ওকে বসতে বলল, কিন্তু বলার পরপরই কী যেন দেখতে পেয়ে আর কথা বাড়ানোর সাহস হলো না ওর। নাবিলা তখন সহজাত ভঙ্গিতে টুকটাক হেসে হেসে কথা বলছে। ফাহাদ সাব্বিরের সাথে খুবই নীচু গলায় ফিসফিস করল,

– ডিস্কো বাবা ফাহিমরে মনে পড়তেছে। শাlলার নাট-বল্টু ঠিক আছে কি না কে জানে।

ফাহাদের কথায় আশকারা পেয়ে দুষ্টু হাসে আদিব। শlয়তাlনি মার্কা হাসি দিয়ে গলা নামিয়ে বলে,

– তুই হাlলা একটা লুlইlচ্চা। ওর চেহারার চিন্তা না কইরা নাট-বল্টুর কথা চিন্তা করোস কেন? মনে মনে কী চলে রে ব্যাটা?

বলেই ভ্রুঁদুটো নাচাতে থাকে আদিব। চোখে দুষ্টু দুষ্টু চাহনি দিয়ে গরম কাপে ঠোঁট চাপতেই পাশ থেকে সাব্বির সিরিয়াস সুরে বলল,

– আমি ডেফিনেটলি শিওর, সাঈদ বিরাট কোনো প্ল্যান করেছে। যেটা আমাদের কাছে সবসময়ের মতো আজও শেয়ার করবে না। ওর পেট থেকে কোনোদিন কথা বের করতে পারিনি। আনফরচুনেটলি আজও পারব না। না হলে দ্যাখ কোত্থেকে কোন চিপা থেকে ফাহিমের অস্তিত্ব খুঁজে বের করল। উহুঁ। এখন চিন্তা হচ্ছে ও কী আসলেই অতীত ভুলতে চায়?

বাগড়া দিয়ে বলল আদিব,

– অবশ্যই চায়। কেন চাইবে না? ফাহিমকে যদি হাlসপাতাlলের বাসিন্দা বাlনিlয়ে আসে, তাহলে তোরা ধরে নে জুনায়েদ সাঈদ খেলতে নেমেছে। ও কাউকে ছাlড়বে না। সময়মতো সবকিছু দেখতে পারবি। ধৈর্য ধর একটু। আপাতত নাবিলার সামনে কিচ্ছু উচ্চারণ করার দরকার নেই। জিপ লক।

.

সুফিয়ার বাটন ফোন থেকে নাম্বারগুলো পাঠিয়ে দিলো ফিহা। আফসানার কাছে ম্যাসেজ যেতেই মিনিট দশেকের ভেতর রিচার্জটা করে দিলেন তিনি। এদিকে দুপুরের সময়টা শেষ হতেই আসরের আযান দিয়ে কমলাভ সূর্যটা পশ্চিম দিকে হেলে পরেছে। কেউ বলবেই না এ বাড়িতে তিনটে মানুষের উপস্থিত আছে। ফিহার রুমের জানালাটা পশ্চিমের দিকে। থাইগ্লাসের বাইরে গোলাকার সূর্যটা সমস্ত তেজ নিস্ক্রিয় করে পশ্চিমের বুকে প্রতিদিনই ঘুম দেয়। আবার জাগ্রত হয়ে পূব আকাশে ডান মেলে দাপুটে আলো ছড়াতে থাকে। সদ্য গোসল শেষে জানালার কাছে আসলো ফিহা। বাইরে প্রসন্ন দৃষ্টি ফেলে ভেজা চুলগুলো আস্তে আস্তে তোয়ালে দিয়ে মুছে চলেছে সে। দেখতে দেখতে খালামনির বাসায় একদিন পেরিয়ে গেছে। এভাবে থাকতে হবে আরো ত্রিশ দিন। বাবার সাথে একটু আগে হয়েছে ওর। জানালার বাইরে রহস্যজনক ব্যাপারটায় কোনো সুরাহা করতে পারেনি। আপাতদৃষ্টিতে এলাকার কিছু মুরুব্বি এ ঘটনাকে ‘ জ্বিনের আসর ‘ বলে আখ্যা দিয়েছে এবং উপদেশ হিসেবে বলেছে অতিসত্তর যেন ভালো একটা হুজুর ডেকে বাড়িটা বন্ধক করানো হোক। কিন্তু ফিহার বাবা এ কথা শুনে বন্ধক করাতে নারাজ। তিনি নারায়ণগঞ্জে আছেন সেই জন্মের পর থেকে। কোনোদিন শুনেনি এরকম কোনো সমস্যা তাদের বংশ-পরিবারে হয়েছে। তাহলে মেয়ের প্রতি এরকম হবার কারণ কী? তিনি মোটেই গ্রামাঞ্চল বা মফস্বলের দিকে থাকেন না, বরং শহরের মূল কেন্দ্রে জনবহুল এলাকায় বসবাস করছেন। ফিহার বাবা এ কথা অবশ্যই স্বীকার করেন তার মেয়ে দুটো অতিমাত্রায় সুন্দর। এই সৌন্দর্যের মোহটা পুরোপুরি পেয়েছে ওদের মায়ের কাছ থেকে। খাড়া নাক, হরিণী চোখ, গোলাপী ঠোঁট এবং গায়ের উজ্জ্বলবর্ণ রঙটাও। তবে ছোটো মেয়ের চুলটা হয়েছে দাদী হালিমা খাতুনের মতো। পার্লারের বিভিন্ন ট্রিটমেন্টের মতোই আল্লাহ্ প্রদত্ত চুলগুলো লম্বা, ঘন এবং তথাকথিত আধুনিক ভাষায় ‘ সিল্কি চুল ‘ বিশিষ্ট। চুল মুছতে মুছতে গতরাতের বিশ্রী ব্যাপারটা নিয়ে আপন মনে ভাবছিল ফিহা। ওই বদখত বেয়াদব মানুষটাকে ভয় পাওয়ার তো কিছু নেই। ও তো আপন খালামনির নিজ হাতে বানানো আচারটাই খাচ্ছিল, পরের বাড়ি এসে তো চুপিচুপি খায়নি। তাহলে ধরা পরার পর ওরকম ভয় পেতে হবে কেন? যতবার ওই মানুষটার সামনে পড়েছে, ওর কলিজাটা ভয়ের চোটে যেন দু’হাতের মধ্যে চলে এসেছে। ওই দাপুটের চোখের চাহনি অন্তর্ভেদী, যেন দূর থেকে শ’খানেক ফলার মতো ঝাঁজরা করে দেয়, শক্ত চোয়ালের মুখটা বড়োই কঠোর ও শান্ত, আজও তার মুখটা আম্ভরিক ধাঁচের মতো ক্ষমতাবান ও চৌকশ দেখায়। ভেজা তোয়ালে নিয়ে ছাদের দিকে হাঁটা দিয়েছে ফিহা, আনমনে ছাদের দোরগোড়ায় পৌঁছে যেতেই হঠাৎ ভয়ে বুকটা ধক্ করে উঠল! অজান্তেই হাত থেকে তোয়ালেটা ফস করে ছেড়ে দিয়েছে। ছাদের রেলিং ঘেঁষে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে মানুষটা। ডানহাত পকেটে গোঁজা, অন্য হাতটা কানের কাছে ফোন চেপে হিংস্র স্বরে কথা বলছে। কাউকে প্রচণ্ড গালাগাল করে যাচ্ছে সে। ফিহা ঢোক গিলে দরজার পাশে একটু আড়াল হয়ে নিল, দূর থেকে কথাগুলো শুনতে না পেলেও আবছা আবছা আভাসে ঠিকই বুঝতে পারছে, অপরপ্রান্তের ব্যক্তিকে দু’হাতে কাপড় নিংড়ানোর মতো চিপড়ে দিচ্ছে। কিছুক্ষণ পর ক্ষুদ্ধভাবে কলটা কেটে দিলো সাঈদ। তার মেজাজটা যারপরনাই খারাপ। কেন জানি মনে হচ্ছে লাবিবের কথা শোনাটা একদমই ঠিক হয়নি। ওই মেয়েটা আসার পর থেকে একেবারেই রাগটা কন্ট্রোল করতে পারছে না। এতটা অ্যাপ্রেসিভ আগে কখনো হয়নি সাঈদ। নিজের উপর থেকে ভারসাম্য হারানোর জন্য নার্ভ তার ছিলই না। সে পুরোপুরি জানত তার মন ও মস্তিষ্ক সম্পূর্ণ তার ক্ষমতায় চলে, কিন্তু এখন দেখছে সেই ধারণা ভুল। মাথা ঘুরিয়ে পিছু তাকাল সাঈদ, তখনই তার প্রখর দৃষ্টি সরাসরি দরজার কাছে চড়াভাবে আঁটকে গেল। সাঈদ ভ্রুঁ জোড়া কুঁচকানোর পূর্বেই ত্রস্তব্যস্ত হয়ে তাড়াতাড়ি চলে যাচ্ছিল ফিহা, কিন্তু পেছন থেকে দু’দফা তুড়ির আওয়াজ পেয়ে পাদুটো ওখানেই থামিয়ে দিলো। ভয়কাতুরে মুখায়ব পালটে যাথসম্ভব শান্ত দেখানোর অভিপ্রায় নিয়ে এগিয়ে গেল ও। দু’পাশের ওড়নায় হাতদুটো মুষ্টিবদ্ধ করে এগুতেই বুকের কাছে তখন হাত ভাঁজ করল সাঈদ। দেড় হাত দূরত্ব রেখে ফিহা দাঁড়িয়ে পড়লে নতভাবে নম্রস্বরে বলল,

– কিছু বলবেন?

সাঈদ দেখল এই মেয়েটা তাকে ‘ আপনি ‘ সম্বোধন বলে করছে। অথচ ‘ তুমি ‘ বলে সম্বোধন করা স্বভাব ছিল। সেটা কী বয়সের সাথে সাথেই গায়েব? হতে পারে। সাঈদ গম্ভীরতার ঠাঁট বজায় রেখে স্থুল কণ্ঠে বলল,

– ছোটো আঙ্কেল ক’দিনের জন্য পাঠিয়েছে?

বাবার ব্যাপারে বলেছে বলে চোখদুটো প্রখর দৃষ্টির মাঝে তাক করল ফিহা। মুখটা এখনো আম্ভরিক, বেশ ধারালো দেখতে। মুখটার দিকে শান্ত দৃষ্টি ফেলে সংযতভাবেই বলল,

– একমাস। তবে সময়টা বাবার নির্ধারণ করা না। খালামনি বলেছে একমাস থাকার জন্য।

চটান করে বলল সাঈদ,

– কেউ বায়না ধরলেই সেটা শুনতে হবে? কীসের জন্য একমাস? আমি তো তোর থাকার ইস্যু দেখছি না।

কপালটা ধীরে ধীরে কুঁচকে ফেলল ফিহা। উজবুক চাহনি ফেলে প্রশ্ন ঝুলিয়ে বলল,

– আপনি কী চাচ্ছেন আমি এখান থেকে চলে যাই?

ধার বসানো গলায় বলল সাঈদ,

– হ্যাঁ। সেটা কালই।

বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো চোখদুটোয় বিস্ফোরণ হলো ফিহার। এক লহমায় শান্ত অবয়ব বদলে গিয়ে পাংশু হয়ে গেল। নিরস্ত গলায় বলল,

– আপনি চাচ্ছেন আমি কালই এখান থেকে চলে যাই?

আবারও কঠিন কিছু বলতে চাচ্ছিল সাঈদ। বার বার কানের কাছে ‘ আপনি ‘ সম্বোধনটা প্রচণ্ড রাগ তুলে দিচ্ছে। গম্ভীরতার সাথেই ক্ষিপ্ত স্বরে বলে,

– ইয়েস। কাল মানে কালই। আগামীকাল এখান থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে বিদায় হবি। আমি চাই না তুই আমার সামনে থাক। তোর মুখটাই আমি দেখতে চাচ্ছি না। অর্থাৎ, আমি চাই না আমার বাড়িতে এমন কোনো ব্যক্তি থাকুক যার মুখটা আমার জন্য চরম অসহ্যকর!

মিনিটের ভেতর স্বচ্ছ মুখটা লজ্জায়-ক্ষোভে-অপমাlনে বিবর্ণ হয়ে গেল। মুখে রা নেই। জ্ঞান থাকতে আজ পযর্ন্ত কেউ এতটা বাlজেভাবে অপমাlন করেনি ওকে। ফিহা করুণ লজ্জায় থমথম হয়ে ভেতরের উগ্র শোচনীয় অবস্থা সাথে সাথে ঠান্ডা করে ফেলল। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে মৃদু গলায় বলল,

– আমার অসহ্যকর মুখ আমি দেখাব না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন। আপনার মাকে পার্সোনালি বলে দিবেন আপনিই আমাকে চলে যেতে বলেছেন। আমি চাই না আপনার মা শুনে চটে যাক।

এইটুকুনি মেয়ের ধারালো তেজ দেখে কিছুক্ষণ চুপ রইল সাঈদ। চটান চটান কথার বিপরীতে নাক ফুলিয়ে নিঃশ্বাসটা ছাড়ল। গলায় ঠাঁট বজায় রেখে বলল,

– আমি অবশ্যই এমন মেয়ে পছন্দ করি না যে নূন্যতম ম্যানার্সটুকুও জানে না। রাতের বেলা দরজার বাইরে দাঁড়ালে নক করতে হয়, রান্নাঘরে গেলে অনুমতি নেওয়া লাগে এবং ছেলেদের সামনে দাঁড়ানোর পূর্বে সামান্য লজ্জাটুকুও রাখতে হয়, এগুলো জানা অবশ্যই একজন ব্যক্তির কর্তব্য। যার মধ্যে এসব নেই তাকে আমি একটা সেকেন্ডের জন্যও এই বাড়িতে সহ্য করব না। বেরিয়ে যা! কালই এখান থেকে লাগেজ গুছিয়ে চলে যাবি। তোর বাপকে বলবি জানালার বাইরে যেই দিওয়ানা-আশিক লটকে থাকে, তার জন্য পুlলিশি ব্যবস্থা রেডি করতে, অথবা তাতেও যদি সো-কল্ড ‘ প্র‍্যাস্টিজ ‘ নামক ইস্যুর সমস্যা হয়, তাহলে কোনো গুlণ্ডা মাlস্তাlনকে বাড়িতে ডেকে তিন কবুল সেরে নিবি। আমার বাড়িতে এসে এমন আন-কালচার্ড বিহেবিয়ার আমি এক ইন্ঞ্চিও সহ্য করব না। গেট আউট অফ মাই সাইট! গেট লস্ট!

#FABIYAH_MOMO .

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here