নিবেদিতা শেষ পর্ব

0
525

নিবেদিতা (শেষ পর্ব)

১৩

‘এই রইল তোর ধুতি-আচকান, এই হচ্চে বরমাল্য- আর বেশি দেরি করিসনে যেন! লগ্ন কাছিয়ে আসচে!’- ঝট করে হাতের জিনিসগুলি নামিয়ে রেখে ফট করে বেরিয়ে গেলেন ননিপিসি। তাঁর আসল নামটি কেউ জানে না। তিনি এখানের সকলেরই পিসি। বিবাহ সংক্রান্ত বিষয়াদিতে ননির চেয়ে করিৎকর্মা কাউকে গোটা কাশীতে খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কাননবালার কপাল বলতে হবে, ঠিক সময়ে ঠিক প্রতিবেশীটিকেই পেয়েছিলেন!

এই বিয়ের পেছনে কী আটঘাঁট বেঁধেই না ননিপিসি নেমেছিলেন! কম হলেও সাতখানা সম্বন্ধ এনেছেন, নিজে খুঁজে খুঁজেই। কাননের তো সবক’টি মেয়েকেই বেশ পছন্দ হলো। হলে কী হবে, যার বিয়ে তারই তো খবর নেই! তারপর কোথা থেকে কী আজগুবি কাণ্ড দেখ—কোথাকার কোন ললিতা, সেই এলাহাবাদে বাড়ি… তাকে নাকি টুপ করে মনে ধরে গেল শশীর! হতভাগা ছেলে! সে বিয়েই যখন করছিস, এত দিন শুধু শুধু মা-মাসি-পিসিদের মনযন্ত্রণা দিয়ে তোর কী লাভটা হলো?

এই ললিতাটিকে দেখার জন্য ননিপিসির আর তর সইছে না। ঘুরেফিরে শশীর মায়ের কাছে গিয়ে একই আলাপ পেড়ে বসছেন বারেবারে।

‘সে মেয়ে বুঝি খুব সুন্দরী? শিক্ষা দীক্ষায়ও নাকি পটু?’

‘বাপের বুঝি অনেক পসার?’

‘বলি, গেল মাসে যে সম্বন্ধখানা এনেছিলুম… সেই হেমনগরের জমিদারের নাতনির ঘরের মেয়ে… মনে আছে তোর? সুরবালা তার নাম… বলি, তোদের এই ললিতে না ছাই- সেই সুরবালার থেকেও বুঝি সুন্দরী?’

কানন কেবল হাসেন। মাঝে মাঝে উত্তর করেন, ‘সুন্দরী না বান্দরী- সে তোমরাই দেখেশুনে বিচার করে নিয়ো। কুষ্ঠিতে জোড় করা ছিল, কোন্‌ জমিদারের নাতির ঘরের পুতির সাধ্য তাকে ভাঙবার?’

‘সেই লালমোহনের পাঁচনেই তবে কাজ হলো, বল্‌? লোকে কি আর সাধেই বলে বেড়ায়- প্রজাপতির সাক্ষাৎ আশিব্বাদ আছে ওঁর ওপর!’

এইসব আলাপের মধ্যিখানে বিয়ের বরটি কোন এক ফাঁকে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। সজোর দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বলল, ‘আশীর্বাদের পাঁচন বড় তেতো ছিল গো, পিসি! মাতৃদেবীর চোখের জলে লঘু করে তবে সে পাঁচন গিলতে বাধ্য হলাম!’

কথাটা মিথ্যে নয়। গুরুজীর ভবিষ্যতবাণীর থেকে কাননবালার অশ্রুসজল হুমকি-ধমকির তেজটাই বেশি ছিল। ‘মঙ্গলসূত্রের বাঁধা জোড়’, ‘কুষ্ঠিতে লেখা নাম’- ইত্যাকার নানাবিধ যোগসূত্র স্থাপন সত্ত্বেও শশী টলছিল না। শেষমেশ, ‘তুমি যদি সন্ন্যাসী হও, আমিও তবে তোমারই মা। এই আমি চললুম তোমার ঘর ছেড়ে, দেখি কে আমাকে ফেরাতে পারে!’- এহেন হুমকিতে ডাক্তারবাবু টলতে বাধ্য হলেন।

তা বেশ! তাহলে, নিবেদিতাকে বুঝি শেষমেশ ভুলেই গেল শশী?

ধর্ম বলে, নিখোঁজকাল এক যুগের বেশি হলে তার শ্রাদ্ধ করার নিয়ম। এক যুগ নয়, গোটা জন্মটাই শশী কাটিয়ে দিতে পারে অপেক্ষায়। কিন্তু, এক মানুষের এক জন্মের সাথে আরও গোটাকতক মানুষ যে লতাপাতার মতো জড়িয়ে থাকে! তাদের মুখে চেয়ে অপেক্ষার রাশ টানতে হলো যে বেচারাকে, তাকে আর অনর্থক এসব প্রশ্ন কেন? সঙ্গ না পেলেই মন ভুলে যায় যদি—ও তবে নিছকই মোহ। সেদিনের ঐ মেয়েটি, দেখবার কালে যার নামটি অবধি শশী জানত না, শশীর তো সে মোহ নয়! তাকে মনে রাখবার জন্য সঙ্গ দরকার নেই তো! সবাই ভাববে ভুলে গেছে হয়ত, কিন্তু বুকের খুব গভীর কোথাও শশী তাকে ঠিক মনে রাখবে… যেমনি করে বুদ্ধি হবার পর থেকে শিশুটি মনে রাখে নিজের নাম- ঠিক তেমনি করে!

মা কখনোই, কোনো বিষয়েই এমন জবরদস্তি করেন না। কে জানে কী এমন দেখলেন ঐ ললিতা মেয়েটির মধ্যে! জোড়া খরগোশের পিছু পিছু ধাওয়া করতে গিয়ে শশী অত ভালো করে দেখেনি তাকে। তবু যতটুকু দেখেছে এবং জেনেছে- মিস্‌ নিরঞ্জনার সাথে ও মেয়ের প্রভেদ নেই কোনো। না, কেবল চোখের দেখাতেই এত বড় কথাটা ভেবে বসেনি শশীভূষণ। সুরেশ বলে একটি ছেলে সেদিন এসেছিল। রীতিমতো হন্তদন্ত ছুটে আসা ছেলেটিকে দেখে শশী ডাক্তার ভাবল, কোনো জরুরি রোগী বুঝি! জিজ্ঞাসাসূত্রে জানা গেল, ঘটনা ভিন্ন। হড়বড় করে ছেলেটি নিজের পরিচয় জানাল, এলাহাবাদে একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ছে সে। আরো জানাল, ললিতা… মানে শশিভূষণের হবু স্ত্রীটি তার প্রাক্তন বাগদত্তা।

বোকা-বোকা চেহারার এই হবু ইঞ্জিনিয়ার ছেলেটির মধ্যে শশী ডাক্তার কি নিজেকেই দেখতে পেলেন? সেই ডাক্তার হবার বাসনায় কলকাতায় পা রাখা নিতান্ত সুবোধ, গেঁয়ো ছেলেটি, যখন তিনি শশী ডাক্তার হননি, কেবলই শশীভূষণ ছিলেন…

গোল চশমাটাকে খুলে নিয়ে শশী ডাক্তার সরাসরি চাইলেন ছেলেটির দিকে। কৌতুক মিশ্রিত সুরে জিজ্ঞেস করলেন,
‘ধরো, বিয়েটা আমি ভেঙেই দিলাম। এতসবের পরেও, তুমি তাকে ফেরত পেতে চাও?’

সুরেশ হাসল। সিঁথি কাটা চুলগুলিকে হাতে আঁচড়ে নিতে নিতে বলল, ‘আমাকে দেখতে বোকা-বোকা লাগে হয়ত। অতখানি বোকা আমি নই!’

‘তবে আর শুধু শুধু খাটনি করে এত দূর কেন এলে?’

‘আপনাকে সাবধান করতে—’

শশী উত্তরে হাসল। মেঝের দিকে চেয়ে মাথা দোলাল খানিকক্ষণ। তারপর হাসিটুকু ধরে রেখেই বলল ‘বেশ! সাবধান হলাম!’

সুরেশ উঠে দাঁড়াল। বুঝল, এখানে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তবু কী ভেবে কে জানে, যাবার আগে বলে গেল, ‘ভেবেছিলুম কাচকে হীরে ভেবে গলার মালা করছেন, তাই খাটনি করে জানাতে এসেছিলুম। সবটা জেনেশুনেই করছেন যখন, খাটনিটাই বৃথা গেল!’

হীরে!

কেবল ভাগ্যবানেরাই যে তার সন্ধান পায়!

তারপর আসে সাধারণেরা, যারা কাচকে হীরে ভেবে বিগলিত হৃদয়-গদগদ জীবনটুকু কাটিয়ে দেয়। আর, সবশেষে— নিতান্ত হতভাগা যারা— তারাই কেবল খুঁজে পেয়েও তাকে হারিয়ে ফেলে। বহু দিন আগে, যেন একটা আস্ত জন্ম… শশীও তো দেখা পেয়েছিল তার! তারপরেই না বেচারা শশীভূষণ চাটুয্যের নামটি সাধারণের দল থেকে মুছে হতভাগাদের মিছিলে নতুন কালিতে লেখা হলো!

***

বিয়ের আয়োজন যৎসামান্য। আত্নীয় স্বজন বলতে খুব বেশি কেউ তো নেই, হাতেগুনে দুটো কেবল ভাই কাননের। তারা এসেছে সপরিবারেই। এর বাইরে শশীর কিছু বন্ধুবান্ধব, জ্যাঠা-পিসির দিকের আত্মীয়রা—এই তো। এদের অধিকাংশই শশীর বিয়ের আশা একপ্রকারে ছেড়েই দিয়েছিলেন। এবারে এই বিস্ময়কর বিয়েটি হবার প্রাক্কালে প্রবীণাদের মুখে মুখে লালমোহন গুরুজীর সুনাম ভেসে বেড়াচ্ছে। তাঁর সম্যক হস্তক্ষেপ ছাড়া এ ছেলের বিয়ে হওয়া আর ডুমুরের ফুল হওয়া, হুহ! কয়েকজন ইতোমধ্যেই গুরুজীর আশীর্বাদের আশায় আশ্রমে ঢুঁ দিয়ে এসেছেন। সকলের ঘরেই এক-দু’টো করে ‘আপদ’ আছে কিনা!

শশীর সহস্রবার বারণ সত্ত্বেও ননিপিসি কোথা থেকে ঢুলীর দল ডেকে এনেছেন। ঢপাঢপ, ঢপাঢপ ঢোল বাজছে। ঢুলীর দলে এক সানাইওয়ালাও জুটে গেছে কী করে যেন। সুর নেই, তাল নেই- মনের আনন্দে যখন খুশি সানাইয়ের প্যাঁ-পোঁ বাজিয়ে চলেছে সে। চারিদিকে সাজ সাজ রব- কেউ নিজের সাজটুকু শেষবারের মতো দেখে নিচ্ছে, কেউ বরণডালা সাজাচ্ছে, কেউ আবার কাজের থেকে কথাতেই মাতিয়ে তুলছে জমজমাটি আসর! একদল ছেলেমেয়ে কোত্থেকে রঙ যোগাড় করে আলপনা আঁকতে বসে গেছে সিঁড়ির গোড়ায়। কেবল যাকে ঘিরে এতকিছু, তারই কোনো হেলদোল নেই। হাল ছেড়ে দেয়া দৃষ্টি নিয়ে একে-ওকে দেখছে। সত্যিই, বাঙালের নিজের বিয়ে বলে কিছু নেই! ‘করব না, করব না’ করেও শেষমেশ সেই কোথাকার কোন এলাহাবাদের ঢাক, গুরুজীর আশীর্বাদ মোড়ানো কুষ্ঠি প্যাঁচানো কাঠি আর আত্মীয়-প্রতিবেশী নামের ঢাকীদের দলটি নিয়ে বিয়ের বাদ্য তো বাজলই!

কিন্তু, বিয়ের বাদ্য তো জোড়ে বাজে। জোড়ের একদিকের ছবি তো এই, অন্যদিকে তাকানো যাক এবারে।

কনের বাড়ি এলাহাবাদে।
নাহ, কথাটায় ভুল রয়ে গেল। কনে এখন যে বাড়িতে আছে, সেই বাড়িটি এলাহাবাদে। যে হতভাগীটি এ বিয়ের কনে, তার নিজের কোনো বাড়ি নেই। ‘মেয়েদের নিজের বাড়ি বলতে আদতে কিছু নেই’- এ তর্ক করবেন না যেন! এই গল্পের সাথে ওই তর্কটির যোগসূত্র নেই।

চারুলতার বাপের বাড়িটি বড় ছিমছাম, শান্তিদায়িনী। খোলা উঠানের পেটের ভেতর সাদা রঙের একতলা বাড়ি, বড়সড় ঝিনুকের খোলসের ভেতর একদানা মুক্তোর মতো। পেছনের উন্মুক্ত জমিটুকুতে হাতে-বোনা নানা পদের গাছগাছড়া। এত বড় বাড়িতে হাতে গুনে দু’জন কেবল মানুষ। চারুর মা আর বাবা। দু’জনেই সজ্জন। নিবেদিতাকে বলতে গেলে একরকম মাথায় তুলেই রেখেছেন তারা। পারলে মুখে তুলে খাওয়াচ্ছেন!
নিবেদিতা এখানে এসেছে প্রায় দশ দিন হতে চলল। কে জানে সুলেখামাসীকে কী বলে রাজি করিয়েছে চারুদি, এখনো নিবেদিতার ডাক পড়েনি ও-বাড়িতে।

আজকের সকালটা শুরু হলো আলাদাভাবে। ছায়াদেবী, মানে চারুর মা ঘুম ভেঙে উঠেই নিবেদিতার ঘরে উঁকি দিয়ে জানিয়ে গেলেন, আজ এ বাড়িতে সকলের নির্জলা উপবাস।

উপবাসে নিবেদিতার সমস্যা নেই কোনো। সে অভ্যস্ত এতে। মুখহাত ধুয়ে উঠানে দাঁড়াতেই ভারী অবাক হলো সে। পশ্চিম কোণে, মাধবীলতার ঝাড়ের পাশে ইয়া বড় মাটির চুল্লি বসানো হয়েছে। জনা চারেক ষণ্ডামতো লোক ভারী সতর্কতার সাথে সেখানে রাঁধাবাড়া করতে লেগে গেছে। নির্জলা উপবাস শেষে ভোজ হবে বুঝি? নিবেদিতার হাসি পেল। দুনিয়াটা বড় আজব! কেউ না খেতে পেয়ে বাধ্য হয়ে উপোস দেয়। কেউ আবার গোটা দিন উপোস থাকার বিনিময়ে বেলাশেষে রাজকীয় ভোজ পেতে বসে।

‘এই হতচ্ছাড়ি মেয়ে! এটা পরে নে, শিগগির!’, ঘাড়ের পেছনে কেউ একজন আস্তে টোকা দিল, ছেলেবেলার সেই ফুলটোক্কা খেলার মতন।

নিবেদিতা ঘাড় ঘুরিয়ে হতভম্ব হলো।
‘চারুদি!’

‘হাঁ, চারুদি! নে তো, ঝটপট এই শাড়িটা পরে নে—’
চারুর হাতে একটা চকচকে নতুন হলুদরঙা শাড়ি।

নিবেদিতা অবাক গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘এটা কার? আমায় পরতে বলছ কেন?’

চারুর হাসি হাসি মুখটা মুহূর্তেই কঠিন হয়ে গেল। নিবেদিতার প্রশ্নাকুল মুখের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে সে ধীরে ধীরে বলল, ‘মা বলেনি তোকে কিছু?’

‘হ্যাঁ, বলেছে তো! আজ তোমাদের বাড়ির সকলের উপোস—’

‘সকলের নয়, কেবল তোর। নিবি, আজ মাঝরাত্তিরের লগ্নে তোর বিয়ে—’

নিবেদিতা খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। ‘যাও, চারুদি! তুমি এমন আজেবাজে বলে ভয় দেখাতে পার!’

চারু ওরকম চোখ সরিয়ে রেখেই আবার বলল, ‘নিবি শোন্‌, এ বাড়িটা করবার সময় বাবার খুব টাকার টান পড়ল। আত্মীয়-স্বজনেরা ঐ আহা-উহু পর্যন্তই, দু’টি পয়সা ধারের বেলায় সব বেপাত্তা! কেবল আমার এক দুঃসম্পকের পিসেমশাই সবটা শুনে বেশ অনেকগুলি টাকা ধার দিলেন। বাবা বললেন, ‘কুমারদা’র দয়ার শরীর, না চাইতেই এতখানি দিলেন!’ কেউ কাউকে স্বার্থ ছাড়া কিছু দেয়, বল্‌? কুমারপিসের চুক্তি ছিল—দু’বছরের মধ্যে টাকার পুরোটা ফেরত দিতে না পারলে জমিসহ বাড়িটা পিসের নামে লিখে দিতে হবে। চুক্তিমতো দু’বছর শেষ… গত হপ্তায় কুমারপিসে এসেছিলেন, দেখেছিস না তুই?’

হ্যাঁ, এই কথাটি ঠিক—সত্যিই টাকমাথা এক ভদ্রলোক এসেছিলেন সেদিন। নিবেদিতা উপর-নিচে মাথা নাড়ল।

‘কুমারপিসে বিপত্নীক। পিসি মরে গেছেন আরও আগেই। সেদিন তোকে দেখবার পর নতুন করে বাবার কাছে প্রস্তাব রেখেছেন, অন্য উপায়েও চুক্তিটা মিটমাট করে নেয়া যেতে পারে। নিবি—’, নিবেদিতার কম্পমান হাতটাকে অনুরোধী দু’হাতে জাপটে ধরে চারুলতা। ‘মা-বাবার বুড়ো বয়সের এই একটিমাত্র সম্বল। তুই পারবি না শেষরক্ষা করতে?’

নিবেদিতার দ্বিধাগ্রস্ত চোখজোড়ায় অবিশ্বাস ভর করল। বানভাসি, সর্বস্বান্তের দৃষ্টি শরীরে মেখে চোখজোড়া ফ্যালফ্যালিয়ে চেয়ে রইল, অনেকটাক্ষণ।

ব্যস, ঐটুকুই। ঐ জলেভাসা চোখ দিয়ে যতখানি বলা যায়। নির্বিবাদ নিরুত্তরে শাড়িখানা হাতে তুলে নিয়ে নিবেদিতা সরে গেল তারপর।

বরের গায়ে ছোঁয়ানো হলুদ এল সন্ধ্যারাত্রে, বরযাত্রীর সাথে। তাই দিয়ে তড়িঘড়ি নিবেদিতার গায়েহলুদ হলো পেছনের উঠানে।

১৪

গোলমালটা শশী টের পেল বেশ দেরিতে, ছাদনাতলায় গিয়ে দাঁড়াবার পর। তাকে বলা হয়েছিল, কনের বাড়িতে খোলামেলা জায়গার অভাব বলে কনের মামার বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে। বাড়ি বদল হলো বলে কনের মা-বাবাও কি বদলে যাবে নাকি? ধান-দুব্বা ছিটিয়ে বরকে বরণ করলেন যিনি, কই তাঁকে তো সেদিন দেখেনি! আচ্ছা, অনেকে মানেন— সন্তানের বিয়ে মায়েদের নাকি দেখতে নেই, অমঙ্গল হয়। এরাও ওরকম হবেন হয়ত- এই ভেবে ব্যাপারটাকে একরকম মেনে নিল সে। কিন্তু, ছাদনাতলায় গিয়ে তো চক্ষু চড়কগাছ! পুরোহিতের মুখোমুখি বসে পূজোপাঠ করছেন যিনি, ইনি তো মেয়ের বাপ নন! নাহ! এবারে, সত্যিই গোলমেলে লাগছে সব!

শেষমেশ না পারতে বেচারা ডাক্তারবাবুকে মায়ের শরণাপন্নই হতে হলো। পলকা শোলার টোপরটিকে এক হাতে চেপে ধরে, মুখ ঝুঁকিয়ে শশী জিজ্ঞেস করল, ‘মা! কনের বাড়ির লোকেরা কই?’

বরের মা তখন মহাব্যস্ত। ‘এই তো, এখানেই তো সব—’, বলে পাশ কাটিয়ে আরেকদিকে উড়াল দিলেন।

এরই মধ্যে ননিপিসি কোথা থেকে বিয়ের গীত গাইতে গাইতে এসে ঘোষণা দিয়ে বসলেন, ‘এই না হলে ডাক্তারবাবুর চোখ, হাঁ? রিম্পি-ঝিম্পিদের মধ্যি থেকে কেমন লক্ষী ঠাকুরটি বেছে নিয়েছে! অমন একটা বউয়ের জন্য সাত জন্ম অপেক্ষা করা যায়, হুঁহ… এই ননীবালার ত্রিনয়নী দিষ্টি— মুখ দেখলেই মন বলে দিতে পারে!’

মেয়েপক্ষের দেয়া ধুতি-পাঞ্জাবি গায়ে চাপিয়ে বিয়ের মণ্ডপটি দখল করেছে বর, মুনিদের মতো পা ভাঁজ করে বসে আছে চুপচাপ। ননিপিসির দূরদর্শী ত্রিনয়নের ওপর তাকে তেমন ভরসা পেতে দেখা গেল না। গোলমেলে বিয়েটা কোনোমতে মিটে গেলেই সে বেঁচে যায়। মাড় দেয়া নতুন পোশাক গায়ের ওপর দমবন্ধ হয়ে চেপে আছে। শশীর আচমকা মনে হলো, বৃষ্টিতে ভিজতে পারলে বেশ হতো!

কী অদ্ভুত কাণ্ড! ঠিক সাথে সাথেই শোঁ শোঁ শব্দে দমকা একটা হাওয়া উড়ে এল কোথা থেকে! হাওয়ার গা জুড়ে ভেজা ঘ্রাণ… দূরের কোথাও বৃষ্টি নেমেছে বোধহয়। হাওয়ারা জানাতে এল, বৃষ্টির গতি এবারে এমুখো।

বাহ! বেশ তো! আজ বুঝি শশীর ইচ্ছেপূরণের দিন? মনে মনে চাইলেই, সত্যি হয়ে যাবে? বেশ! শশীভূষণ চ্যাটার্জি তবে আরও একটা কিছু চেয়ে নিক আজ মনে মনে।

শশী, শশী, শশী… কী চাইলে তুমি?
আহ! ভুল প্রশ্ন হলো!
শশী, শশী, শশী… কাকে চাইলে তুমি?

পুরুত মশাই তাড়া দিলেন। প্রারম্ভলগ্নেই বিয়েটা সেরে ফেলতে চান তিনি, বাতাসের মতিগতি ভালো নয়। খোলা আকাশের নিচে হোমের আগুন ধিকিধিকি জ্বলছে, বৃষ্টি এলে সাড়ে সর্বনাশ!

তারপর, ওই হুড়মুড়, পাগল-পাগল বাতাসের ভেতর দিয়ে, বৃষ্টি বৃষ্টি ঘ্রাণ মাথায় করে সে এল। চারজনে কাঁধে করে রেখেছে ছোট পিঁড়িটির চারপ্রান্ত, মাঝখানে সন্ত্রস্ত অবয়বটি… ওই তো বিয়ের কনে! পানপাতার আড়ালে তার মুখখানি ঢেকে রাখা, গায়ে জড়ানো লাল বালুচরী, মাথায় শঙ্খধবল মুকুট। আলতা রাঙানো আঙুল তিরতিরিয়ে কাঁপছে, কাঁপছে আঙুলে জড়ানো পানপাতা দু’টি, হাতে ধরা গাছকৌটো, কাঁপছে কানের ঝুমকোজবার দুল। শশী একবার মুখ তুলে চাইল সেদিকে। বুকের ভেতর কী একটা ‘নেই-নেই’ হাহাকার ধ্বক দিয়ে উঠল আচমকা।

পিঁড়ির কাঁধে চড়ে কনে সাত পাক ঘুরল। শশী মনে মনে সাতবার বলল, ‘নিবেদিতা! নিবেদিতা! নিবেদিতা!’
যেন এই নামজপের ছেলেমানুষীটুকু সত্যি হয়ে সত্যি সত্যি সে এসে দাঁড়াবে সামনে!

সেরকম হবার নয়, শশী জানে। সে যে অমাবস্যার চাঁদ! একরত্তি মানুষ শশী, তার দেখা কেমন করে পাবে? চিরতরে তাকে ভুলে যাবার আগে তবু শেষবারের মতো মনে করে নেয়া হোক নাহয়। নিভে যাবার আগে যেমন জ্বলে ওঠে প্রদীপ…

শশীভূষণ চ্যাটার্জি দ্বিচারী নয়। আজই শেষ, আজকের পর মনের সচেতন অংশ থেকে ঐ মুখটিকে সে মুছে দেবে ঠিকঠিক। কিন্তু তার আগে… এই শেষবেলায়, আর একটিবার তাকে দেখে নিক!

বিয়ের মণ্ডপে দাঁড়িয়ে শশী চোখ বোজে। এক লহমায় উড়ে চলে যায় রেণুমাসীর বাড়িতে। ওই তো শশী— কাঠের চেয়ারটার ওপর বসে বসে ঘামছে। নিদারুণ অস্বস্তিতে কাঁটা হয়ে থাকা শশী ভাবছে, সংসার নামের বন্দিশালা থেকে যদি পালানো যেত! সংসার ছেড়ে পালানোর কথা ভাবতে ভাবতেই সংসারের খুঁটিনাটির ওপর চোখজোড়া ঘুরছে ওর। এ বাড়ির চেয়ারগুলো সব পোশাক-আশাকে ফিটফাট বাবু—প্রতিটির গায়ে ফুলতোলা ওয়্যার পরানো। ঘুরতে ঘুরতে জানালা গলে চাইল শশীর চোখজোড়া… জানালায় দু’ফালি আকাশ রঙা পর্দা পতপতিয়ে উড়ছে, তালে তালে নাচছে জোড়া খরগোশ—

জোড়া খরগোশ!

হায় শশী! বোকা শশী! এই ক’টা দিন মগজের অলিগলি তন্নতন্ন করে তুমি খুঁজে বেড়ালে, নিজেকে নিজে প্রশ্নে প্রশ্নে ক্ষতবিক্ষত করে জিজ্ঞেস করলে সহস্রবার—‘কোথায় দেখেছি? কোথায়?’… অথচ একটিবার মনের গাড়ি চড়ে সেই আরাধ্য জায়গাটিতে যেতে পারলে না? যাকে হৃদয় দিয়ে খুঁজবার কথা, তুমি তাকে খুঁজতে গেলে মগজাস্ত্র খাটিয়ে। কী বোকা তুমি, শশী! কী বোকা!

বাতাসের বেগ এখন তীব্র, ঝড়ো। ভূপাতিত শুকনো পাতারা হাওয়ায় ভেসে ঝড়ো-নাচের মুদ্রা তুলতে শুরু করে দিয়েছে। যেকোনো সময় ঝড় নামবে। একরকম দৌড়ে দৌড়েই সবে সাতপাক সমাধা হয়েছে। কনেকে নামিয়ে দেয়া হয়েছে বরের মুখোমুখি। এবারে শুভদৃষ্টির পালা। এইটুকু সাবধানী মুহূর্তের মধ্যে বড় অসাবধান কাণ্ড ঘটে গেল হঠাৎ। সহস্রাব্দের ধ্যান শেষে যেন সত্যকে সঙ্গে নিয়ে আচমকা উঠে এলেন মুনি, ঘোষণা দিলেন সর্বসম্মুখে- তেমনই সহসা বিয়ের বর বলে উঠল একটিমাত্র শব্দ-

‘নিবেদিতা!’

কনে মেয়েটি বড় ভীতু, সেই কখন থেকেই তো নামহীন, সংজ্ঞাহীন কী এক দুর্ভাবনায় কাঁপছিল সে তিরতির করে। এই আকস্মিক নাম-সম্বোধনে বেচারি ভড়কে গেল। হাত থেকে খসে পড়ল নাগ বল্লরীর* পল্লব। পত্রচ্ছায়ায় আড়াল করা তার ভীত মুখখানি এই ঘোর অন্ধকার রাত্রির বুকে একফালি চাঁদ হয়ে উঁকি দিল আকস্মিক… যেন অমাবস্যার চাঁদ!

পেছনে কে একজন ফুঁ দিল শাঁখে। ‘উলু লুলু লু’ শব্দের ঝংকার ধাক্কা খেল ঝড়ো বাতাসের গায়ে।

কনের কপোলজুড়ে শুকিয়ে যাওয়া অশ্রুর দাগ। সরল চোখজোড়া মেলে সে ড্যাবড্যাবিয়ে চেয়ে রইল সামনের মানুষটির দিকে। এ তো চারুদির বলা সেই টেকো লোকটি নয়! গলায় রজনীগন্ধার মালা, কপালে চন্দনের তিলক, হাতে ধরা পেতলের আয়না, গায়ে চাপানো সিল্কের খাটো পাঞ্জাবিটি পতপতিয়ে উড়ছে… আর মুখখানা… নিবেদিতা চেনে একে! এই মুখখানার সাথেই যে ওর জন্ম-জন্মান্তরের আড়ি পেতে রাখা!

ঠিক তখনি, দ্যুলোকের আশীর্বাদ ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি হয়ে টপটপিয়ে ঝরতে লাগল এই বিলম্বিত বিবাহমণ্ডপটির ওপর।

শশীভূষণ অবাক হয়ে দেখল, আজ সত্যি সত্যিই অমাবস্যায় চাঁদের দিন!

আজ সত্যি সত্যিই তার ইচ্ছেপূরণের দিন!

*সংস্কৃততে পানগাছের আরেক নাম নাগ বল্লরী।

(
এই ধারার আরও একটা গল্প গল্পসন্ধি ❤ গ্রুপে পোস্ট করেছিলাম, ‘বিবাহ বিভ্রাট’ নামে। অনলাইনের গল্পগুলি বাইরেও দুইটা বই লিখে ফেলেছি একেবারে অযথাই। সেগুলি রকমারিতে পাওয়া যাবে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here