নিবেদিতা পর্ব ৬

0
211

নিবেদিতা (ষষ্ঠ পর্ব)

চেয়ে থাকা ছাড়া আর কী করার আছে? যে দুর্ভাগ্যকে এড়াবে বলে লোকের বাড়ি ঝি হয়ে পড়ে আছে, পায়ে হেঁটে এসে দরজার কড়া নাড়ছে সেটিই- এমন আচমকা, অদ্ভুতুড়ে, দুর্ভাগা কাকতালের কথা কেউ শুনেছে কোনো দিন?

নির্বাক ছবিটি আচমকা সবাক হয়। ‘চারুদি, আমায় দু’দিনের জন্যে কোথাও পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে পার? তোমার বাপের বাড়িও তো শুনেছি এখানেই। দু’টো দিন… না, না… এক দিন হলেও চলবে। পারবে, চারুদি?’- বাষ্পাকুল চোখজোড়া চারুর দিকে চেয়ে রয় আকুতি নিয়ে।

‘তোর আবার কী হলো ছাই! দেখি… এ মা! কাঁদছিস যে বড়! হয়েছে কী তা কইবি তো?’

ক্রন্দনরতার মুখে কথা সরে না। কেবল একটি অনুরোধই বারংবার ধ্বনিত হয়- ‘আমার মাথার দিব্যি, চারুদি। কিছু জানতে চেয়ো না গো। আমি কুশনের ফুল তুলে, সমস্তটা রেঁধে-বেড়ে দিয়ে যাব। পরশু সকালে… অতিথিরা আসবার আগে— কেবল কাউকে দিয়ে আমায় কোথাও একটা পাঠিয়ে দিও-‘

‘বলতে চাইছিস না যখন, তখন জোর করব না। মা’কে বলে তোর যাবার আমি বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। এবারে ফ্যাঁচফ্যাঁচানি কান্নাটা থামা তো মেয়ে!’- নিবেদিতার গালে দু’টো আলতো চাপড় বসিয়ে চারু শাশুড়ির ঘরের দিকে যায়। এই মেয়েটিকের নিজের বোনের চেয়ে কিছু কম ভালবাসেনি সে। হতভাগীর কী মতি হয়েছে কে জানে!

পাত্রপক্ষের ধারেকাছে কনে ভিন্ন বিবাহ উপযুক্ত, সুশ্রী অপরকেউ ঘুরঘুর করলে উদ্ভুত বিপত্তিসমূহ এবং তদসম্পর্কিত একটি কতকটা সত্য, কতকটা বানোয়াট মুখরোচক ঘটনা, চারুর খুড়তুতো পিসির মাসতুতো বোনের মেয়ের বিয়েতে ঘটেছিল দাবি করে শাশুড়িকে বাগে আনতে বেগ পেতে হলো না। ফলশ্রুতিতে, “ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মরিয়া গেল”, অর্থাৎ পাত্রপক্ষ এলাহাবাদের মাটিতে পা রাখবার আগেই নিবেদিতাকে বাড়িছাড়া করা হলো।

নিবেদিতাকে নিয়ে ঘোড়ায় টানা টাঙ্গাটি ঘোষালবাড়ির সীমানা ত্যাগ করার আধবেলা বাদেই অপর একটি জুড়িগাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামল। পরের ঘটনাটুকু সেই চিরচেনা দৃশ্য—সত্যের সাথে মিথ্যের মিশেলে ‘ঘরের আপদ’টির ওপর নানাবিধ গুণপনার দায় চাপিয়ে তাকে অপরপক্ষের ঘাড়ে গছিয়ে দেয়ার নির্লজ্জ প্রচারণা।

মেয়েছেলেকে ঘরের আপদ বললাম বলে সচেতন পাঠককূল যেন আমার ওপর খেপবেন না! গল্পের টেঁপির মতো একটু ‘চোখ-কান খোলা রেখে’ যারা চলেন, তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন— বাঙালির ঘরের বিবাহযোগ্যা মেয়েটি নিজ জন্মদাত্রীর কাছেই গলার কাঁটা। সেখানে আমি আর কোথাকার কোন হতভাগা গল্পকার!

যা হোক, আমরা গল্পে ফিরে আসি।

এবারে ঘটনাস্থল- দীনবন্ধু ঘোষালের পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত একতলা বাড়িটির বসবার ঘর। দৃশ্যপট এরকম-

‘বলছি, এই ছানামালাইটা একটু যদি চেখে দেখতেন…ললিতে নিজ হাতে করেছে কিনা!’- সুলেখার গদগদ হাসি আরও একটু তৈলাক্ত হয়।

‘ওরে ললি, বাটিটা এগিয়ে দে না রে মা! বাবাজীবনের হাতে তুলে একটু দে, অত লজ্জা করতে আছে নাকি রে?’- মুখভর্তি হাসি নিয়ে ভব ঘোষাল এগিয়ে এলেন।

‘হাঁ রে মা? সত্যি সত্যিই ললিতে করেছে নাকি রে এসব?’- দীনবন্ধুবাবু মাথা চুলকে পুত্রবধূকে জিজ্ঞেস করলেন। ফিসফিসিয়ে।

‘ছাই করেছে বাবা! সারারাত জেগে নিবিটা করল না সব? শেষে সেই কাকডাকা ভোরে বের হলো মেয়েটা, জলখাবারটুকুও খেতে পারেনি!’

দীনবন্ধুর মুখখানা পাথরবৎ শক্ত হয়ে ওঠে।

‘আপনি আবার কিছু বলতে যাবেন না যেন, বাবা! খামোখা অশান্তি হবে।’- চারু সাবধান করে দেয় তাঁকে। শ্বশুরকে তো দিব্যি চেনে। পাথর ঘষা আগুনের মতন রাগ তাঁর, সহজে জ্বলে না কিন্তু একবার জ্বললে নেভানোও যায় না।

ওদিকে কু-ঝিকঝিক রেলগাড়ি চলছেই-

‘মা হয়ে তো আর মেয়ের পশংসে করতে পারিনে, তবু না বলেও পারছিনে! বড় বড় পাশ দিয়েছে, তাই বলে ভাববেন যেন ঘরের কাজকম্ম জানেনে! এই যে দেখছেন, কুশন বালিশের ওয়্যার থেকে আরম্ভ করে ঐ আয়নার ওপরের আর্শিলতাটা, তারপর এইযে টেঁপির…ও টেঁপি, দিদি- এদিকে আয় দিখি!’- বিস্মিত টেঁপি দৌড়ে আসতেই ছাই দিয়ে পেছল মাছ ধরবার মতো তাকে চেপে ধরেন সুলেখা।

‘এইযে টেঁপির পরনের ফুলতোলা জামাটা, এটিও তো ললির হাতের কাজ! কেমন মিহি করে ফুল ভরেচে, পাতা করেচে…’-

কাননবালা সরু চোখ করে তাকিয়ে আছেন টেঁপির পরনের জামাটার দিকে। হালকা বেগুনী জমিন জুড়ে ছোট ছোট পদ্ম নকশা, গলা আর হাতের কাছটায় বরফি পাড়। গোল গলার কিনারা জুড়ে সাদা রঙের কুচি দেওয়া ঝুল, চোক পাড়ের নকশা বসানো। এই ফোঁড়গুলি… সহজে চোখে পড়ে না আর আজকাল। কিন্তু, কাননবালা দেখেছেন আগে। কেবল মা মাসীদের কাছেই নয়, আরও একজনকে দেখেছিলেন পটু হাতে সুতো দিয়ে এরকম ছবি আঁকতে।

‘এত সব তোমার করা? তা বেশ, এই যে গলার ঝুলে পাড় বসানো, এই নকশাটা তো আগে দেকিনি। এর নাম কী গো বাছা?’

হবু শাশুড়ির অতর্কিত প্রশ্নে ললিতা ঢোঁক গেলে। টেঁপিটার গলার কাছে ঝুল একটা আছে দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু ওতে কীসের নকশা করা তা ছাই কেমন করে জানবে! জীবনে তো সূঁচে সুতোটিও পরায়নি। আপ্রাণ চেষ্টায় নকশাটা বুঝবার চেষ্টা করে ললিতা, যাহোক কিছু একটা নামটাম তো বলতে হবে!

‘ঝুলের কাছে এটা চোক, আর হাতায় বরফি। ললিপিসি জানবে কী করে, ঐ নিবিদিই তো—’, ললিতার আগেই টেঁপির গলাটা মাজা কাঁসার মতন ঝনঝনিয়ে ওঠে। মেয়েটি বয়সের আন্দাজে অত্যধিক পাকা। ডাকের সম্পর্কে নিবেদিতা তার মাসী-পিসি গোত্রীয় হলেও টেঁপি তাকে মাসী ডাকতে অস্বীকার করে কটকটিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, ‘সুরমাসীর মতো হাতে শাঁখা নেই, লালপিসির মতো ইয়া বড় পেট নেই—নিবিদি আমার সইদিদি, মাসি-পিসি কিচ্ছু নয়!’

টেঁপির লাগামছাড়া মুখখানার ওপর ঢাকনা সাঁটতে সুলেখা তড়িঘড়ি কলকলিয়ে ওঠেন।

‘ওর কি আর নাম আছে গো দিদি? ঐ বসে বসে যখন যা মনে আসে তাই বানায় আরকি। নিজেই বানিয়েছে, নামটাম দেয়নিকো…’

শাশুড়ির চোখ গরমিতে মেয়েকে টেনে ভেতরে নিয়ে যায় চারু।

‘হাঁ রে মুখপুড়ি, কতবার বলেছি তোকে? গুরুজনেদের কথার ভেতর কথা কইতে নেই?’

টেঁপিও ছাড়বার পাত্রী নয়। রাজহাঁসের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে জবাব দিল, ‘বারে! দিদিমণি যে শেখাল- “সদা সত্য বলিবে”, তার বেলায়? তোমাদের কথা শুনব না দিদিমণির, সে কাটকাট করে বলে দাও দিখি বাপু!’

‘কারুর কথা শুনতে হবেনে তোর! এই এখানে বসিয়ে গেলাম, কলের পুতুলের মতন এমনই যাতে বসে রোস!’- চারু আঙুল তুলে শাসায় মেয়েকে। ভেতরে ভেতরে কে না জানে, এই আট বছুরে টেঁপিই ঠিক! তবু চারু মেয়েকে শাসায়, বলা ভালো- শাসাতে বাধ্য হয়। সংসারের শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে কত কীই না করতে হয় বাড়ির বৌয়েদের! বলতে নেই, চারুর ভেতরটা আজ বড় বিদ্রোহ করে উঠছে বারবার। বিশেষত, রাত জেগে সত্তর পদ রাঁধবার পরে সাতসকালে খালি মুখে বিদায় নিল মেয়েটা, তারপর থেকে কোন কিছুই ভালো লাগছে না। শাশুড়ি, ননদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান বরাবরই তলানিতে ছিল। আজ একেবারে নেই হয়ে গেল। সামাজিকতা রক্ষার্থে মেয়েটিকে বসিয়ে রেখে আবার বাইরের ঘরে গেল বটে চারু, কিন্তু মনের ভেতর যে তিক্ততা আসন গেড়ে বসেছে, মেকি হাসির মিষ্টতায়ও তা ঢাকতে পারল না পুরোপুরি। অভিনয় তো আর সকলে জানে না!

মেয়ের গুণপানার গীত গাইতে গাইতে মুখ ধরে এসেছিল। তাই হবু বেয়ান যখন ‘এবারে উঠি তবে’- বলে উঠে দাঁড়ালেন, সুলেখা আক্ষরিকই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।

বেরুবার মুখে সকলকে বিদেয় দিতে হয়। অবাধ্য টেঁপিকেও তাই ডেকে আনা হলো। মায়ের বকুনি খেয়ে মুখ গোঁজ করা টেঁপিকে একটানে কোলে তুলে নিয়ে কাননবালা ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- ‘সে কই? হাতার বরফিখানা করেচে যে।’

কিছু একটা নিগূঢ় রহস্যের গন্ধ পেয়ে টেঁপির বুদ্ধি জ্বলজ্বল চোখজোড়া নিয়নবাতির মত ফট করে জ্বলে উঠল। কাননবালার ফিসফিসানিকে দুই দিয়ে গুণ করে নিয়ে কানে কানে বলল- ‘সোনাঠাম্মার বাড়ি, আজ সকালেই গেছে।’

‘সে বাড়ির ঠিকানা জানো?’

‘মা জানে! এনে দেব?’

হাতব্যাগ থেকে দু’টো লজেঞ্চুস বের করে দিতে দিতে কানন বলেন- ‘উঁহু। কেবল কাউকে বলোনে কিচ্ছু, কেমন?’

টেঁপি ঘাড় হেলিয়ে সায় জানায়। পেটে বোমা পড়লেও এ কথা বের হবে না।

তারপর, টেঁপি এবং ললিতার সাথে সাথে চারুকেও ‘প্রণামী’ দিলেন কাননবালা। সুলেখা আর তার গুণধর ভাইটি মেতে ছিলেন শশীর আপ্যায়ন নিয়ে, ‘লজ্জাবতী(!)’ ললিতা তো ঘোমটার বাইরে চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত। প্রথমে লজেঞ্চুস এবং তারপরে প্রণামীর সাথে সাথে যে উপরিটুকুর আদান-প্রদান হয়ে গেল, তার পুরোটাই তাই এদের চোখ এড়িয়ে গেল। হবু কুটুমেরা বিদেয় নিলে পরে তাই সুলেখার চোখেমুখে খুশির ধারা উপচে উঠল।

আত্মবিশ্বাস গদগদ গলায় সুলেখা ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাঁ রে ভব, সম্বন্ধটা তবে হয়েই যাবে, বল্‌?’

‘গুনে গুনে দু’শো টাকা খাইয়েচি পেটমোটা লালমোহনটাকে। না হলে না, পেট গেলে দেব ওটার!’

ভব ঘোষালের মুষ্ঠিবদ্ধ ডান হাতটা বাঁ হাতের পেটের ভেতর সেঁধিয়ে গিয়ে ‘পেট গেলে দেয়া’র ব্যবস্থাটি হাতেনাতে প্রদর্শন করল।

অদূরে টেঁপিকে কোলে নিয়ে দাঁড়ানো চারুলতার বুকের ভেতর তখন ‘ঢিপঢিপ, ঢিপঢিপ’ করে ডাকছে। পোড়ারমুখী, হতচ্ছাড়িটা চুপিচুপি বাড়ি ছেড়ে যাবার পাঁয়তারা করল… এত বড় কথাটা একবারও মুখে ফুটে জানাল না!

১২

‘কী বাপ? মেয়ে কেমন দেখলি?’- ঘোড়ায় টানা গাড়িটিতে বসেই কাননবালা প্রশ্ন করেন।

কে উত্তর দেবে? শশীভূষণ? সে তো সেই কখন, কোন অবেলায়, নিরুদ্দেশে হারিয়ে বসে আছে। নিজের ভেতর আর ফিরল কই? ওহহো! অত কথা বলা হলো, শশীর নিরুদ্দেশযাত্রার কথাটি তো বলাই হলো না আর!

‘এই যে দেখছেন, কুশন বালিশের ওয়্যার থেকে আরম্ভ করে ঐ আয়নার ওপরের আর্শিলতাটা—’ বলতে বলতে মেয়ের মা যেদিকে আঙুল নির্দেশ করলেন, সেদিক বরাবর তাকাতেই তো ডাক্তারবাবুর চোখজোড়া আটকে গেল! দেয়ালে সাঁটানো বড় আয়নাটার ওপর দু’ফালি আকাশরঙা কাপড় টাঙানো, পাখার হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। দু’পাশে দু’টি তিড়িংবিড়িং খরগোশ ছানা। অগ্রবর্তীটির মুখে কামড়ে ধরা গাজরের টুকরো…

এই দৃশ্যটুকু কি শশীভূষণের খুব চেনা নয়? ঐ পর্দার ফালি দু’টোর আড়ালে যেন কিছু একটা আছে। বড় আরাধ্য… বড় কামনার কিছু একটা। শশী জানে, শশীর তীরবেগে ধাবিত হৃদয় জানে, শিরা উপশিরায় প্রবাহিত রক্তকণিকারা জানে কিন্তু হতচ্ছাড়া মগজটাই কেবল জানে না! শশীর ভেতরে যে শশীর বাস, সে বারবার তাগাদা দিচ্ছে মস্তিষ্কে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা স্মৃতিকোষগুলিকে জাগিয়ে দিতে। সেই তাড়নায় মগজের সমস্তটা আতিপাতি করে খোঁজে শশীভূষণ।

খোঁজে তো, কিন্তু পায় না যে!

হৃদপিণ্ডের তোড়জোড় জানান দিচ্ছে, বড় লোভনীয় এক টুকরো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই দৃশ্যটার সাথে। এরকম, ঠিক এই রকমটাই দেখেছিল শশী আর তারপরেই ঘটেছিল ঘটনাটা…

কী ঘটনা?

মাথার ভেতরের আগাপাশতলা নড়চড় করেও কিছুতেই সমস্তটা মনে পড়ছে না কেন? কত আগের স্মৃতি এসব? এই জন্মের? নাকি আগের? কত আগের?

একটা তীব্র বেদনামধুর অনুভূতি শশীর সমগ্র সত্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে৷ ধীরে, খুব ধীরে… সকলের মাঝে বসেও শশী হারিয়ে যায়।

‘কীরে বাপ? তখন থেকে দেখছি…কী ভাবিস এত?’- মায়ের পুনর্বার প্রশ্নে শশী বাস্তবে ফিরে আসে।

‘হুঁ? না কিছু নয়। আচ্ছা মা, এদের বাড়িতে আমরা আগে তো আসিনি কখনও, না?’

এ কেমন অদ্ভুতুড়ে প্রশ্ন! কাননবালার স্তম্ভিত দৃষ্টিপাতে শশী বিব্রত হয়, তোতলাতে তোতলাতে বলে- ‘না, ওই ইয়ে… কাপড়চোপড়গুলো… কেমন চেনা লাগছিল… কোথায় দেখেছি, ভেবে পাচ্ছি না।’

ওহ! তবে এই কথা! কাননবালা মনে মনে হাসেন। লোকে বলে শশী ডাক্তার নাকি রোগীর চেহারা দেখেই রোগের নামধাম বলে দিতে পারেন। নামজাদা ডাক্তার, সে তুমি পারতেই পার! কিন্তু মায়েদের মতন এমন চতুর্ব্যাপী দৃষ্টি তুমি কই পাবে?

‘সে তুই কই দেখেছিস তুই-ই জানিস! কত রোগীদের বাড়িতে যাস-টাস…কই কী দেখেছিস! অত বেশি ভেবেচিন্তে মাথাটা বিগড়োসনি বাপ, সময় হলে আপনাতেই খুঁজে পাবিখন!’

এহেন ভাগ্যের নদীতে গা ভাসিয়ে দেয়া আশ্বাসবাণীতে শশীর কোঁচকানো ভ্রূ সোজা হয় না। গাজর খাওয়া খরগোশের ছানা দু’টি বেচারার মাথার ভেতর তিড়িং-তিড়িং করে নাচতেই থাকে…

নাচতেই থাকে!

নিবেদিতা (ষষ্ঠ পর্ব)

চেয়ে থাকা ছাড়া আর কী করার আছে? যে দুর্ভাগ্যকে এড়াবে বলে লোকের বাড়ি ঝি হয়ে পড়ে আছে, পায়ে হেঁটে এসে দরজার কড়া নাড়ছে সেটিই- এমন আচমকা, অদ্ভুতুড়ে, দুর্ভাগা কাকতালের কথা কেউ শুনেছে কোনো দিন?

নির্বাক ছবিটি আচমকা সবাক হয়। ‘চারুদি, আমায় দু’দিনের জন্যে কোথাও পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করতে পার? তোমার বাপের বাড়িও তো শুনেছি এখানেই। দু’টো দিন… না, না… এক দিন হলেও চলবে। পারবে, চারুদি?’- বাষ্পাকুল চোখজোড়া চারুর দিকে চেয়ে রয় আকুতি নিয়ে।

‘তোর আবার কী হলো ছাই! দেখি… এ মা! কাঁদছিস যে বড়! হয়েছে কী তা কইবি তো?’

ক্রন্দনরতার মুখে কথা সরে না। কেবল একটি অনুরোধই বারংবার ধ্বনিত হয়- ‘আমার মাথার দিব্যি, চারুদি। কিছু জানতে চেয়ো না গো। আমি কুশনের ফুল তুলে, সমস্তটা রেঁধে-বেড়ে দিয়ে যাব। পরশু সকালে… অতিথিরা আসবার আগে— কেবল কাউকে দিয়ে আমায় কোথাও একটা পাঠিয়ে দিও-‘

‘বলতে চাইছিস না যখন, তখন জোর করব না। মা’কে বলে তোর যাবার আমি বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। এবারে ফ্যাঁচফ্যাঁচানি কান্নাটা থামা তো মেয়ে!’- নিবেদিতার গালে দু’টো আলতো চাপড় বসিয়ে চারু শাশুড়ির ঘরের দিকে যায়। এই মেয়েটিকের নিজের বোনের চেয়ে কিছু কম ভালবাসেনি সে। হতভাগীর কী মতি হয়েছে কে জানে!

পাত্রপক্ষের ধারেকাছে কনে ভিন্ন বিবাহ উপযুক্ত, সুশ্রী অপরকেউ ঘুরঘুর করলে উদ্ভুত বিপত্তিসমূহ এবং তদসম্পর্কিত একটি কতকটা সত্য, কতকটা বানোয়াট মুখরোচক ঘটনা, চারুর খুড়তুতো পিসির মাসতুতো বোনের মেয়ের বিয়েতে ঘটেছিল দাবি করে শাশুড়িকে বাগে আনতে বেগ পেতে হলো না। ফলশ্রুতিতে, “ডাক্তার আসিবার পূর্বেই রোগী মরিয়া গেল”, অর্থাৎ পাত্রপক্ষ এলাহাবাদের মাটিতে পা রাখবার আগেই নিবেদিতাকে বাড়িছাড়া করা হলো।

নিবেদিতাকে নিয়ে ঘোড়ায় টানা টাঙ্গাটি ঘোষালবাড়ির সীমানা ত্যাগ করার আধবেলা বাদেই অপর একটি জুড়িগাড়ি এসে বাড়ির সামনে থামল। পরের ঘটনাটুকু সেই চিরচেনা দৃশ্য—সত্যের সাথে মিথ্যের মিশেলে ‘ঘরের আপদ’টির ওপর নানাবিধ গুণপনার দায় চাপিয়ে তাকে অপরপক্ষের ঘাড়ে গছিয়ে দেয়ার নির্লজ্জ প্রচারণা।

মেয়েছেলেকে ঘরের আপদ বললাম বলে সচেতন পাঠককূল যেন আমার ওপর খেপবেন না! গল্পের টেঁপির মতো একটু ‘চোখ-কান খোলা রেখে’ যারা চলেন, তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন— বাঙালির ঘরের বিবাহযোগ্যা মেয়েটি নিজ জন্মদাত্রীর কাছেই গলার কাঁটা। সেখানে আমি আর কোথাকার কোন হতভাগা গল্পকার!

যা হোক, আমরা গল্পে ফিরে আসি।

এবারে ঘটনাস্থল- দীনবন্ধু ঘোষালের পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত একতলা বাড়িটির বসবার ঘর। দৃশ্যপট এরকম-

‘বলছি, এই ছানামালাইটা একটু যদি চেখে দেখতেন…ললিতে নিজ হাতে করেছে কিনা!’- সুলেখার গদগদ হাসি আরও একটু তৈলাক্ত হয়।

‘ওরে ললি, বাটিটা এগিয়ে দে না রে মা! বাবাজীবনের হাতে তুলে একটু দে, অত লজ্জা করতে আছে নাকি রে?’- মুখভর্তি হাসি নিয়ে ভব ঘোষাল এগিয়ে এলেন।

‘হাঁ রে মা? সত্যি সত্যিই ললিতে করেছে নাকি রে এসব?’- দীনবন্ধুবাবু মাথা চুলকে পুত্রবধূকে জিজ্ঞেস করলেন। ফিসফিসিয়ে।

‘ছাই করেছে বাবা! সারারাত জেগে নিবিটা করল না সব? শেষে সেই কাকডাকা ভোরে বের হলো মেয়েটা, জলখাবারটুকুও খেতে পারেনি!’

দীনবন্ধুর মুখখানা পাথরবৎ শক্ত হয়ে ওঠে।

‘আপনি আবার কিছু বলতে যাবেন না যেন, বাবা! খামোখা অশান্তি হবে।’- চারু সাবধান করে দেয় তাঁকে। শ্বশুরকে তো দিব্যি চেনে। পাথর ঘষা আগুনের মতন রাগ তাঁর, সহজে জ্বলে না কিন্তু একবার জ্বললে নেভানোও যায় না।

ওদিকে কু-ঝিকঝিক রেলগাড়ি চলছেই-

‘মা হয়ে তো আর মেয়ের পশংসে করতে পারিনে, তবু না বলেও পারছিনে! বড় বড় পাশ দিয়েছে, তাই বলে ভাববেন যেন ঘরের কাজকম্ম জানেনে! এই যে দেখছেন, কুশন বালিশের ওয়্যার থেকে আরম্ভ করে ঐ আয়নার ওপরের আর্শিলতাটা, তারপর এইযে টেঁপির…ও টেঁপি, দিদি- এদিকে আয় দিখি!’- বিস্মিত টেঁপি দৌড়ে আসতেই ছাই দিয়ে পেছল মাছ ধরবার মতো তাকে চেপে ধরেন সুলেখা।

‘এইযে টেঁপির পরনের ফুলতোলা জামাটা, এটিও তো ললির হাতের কাজ! কেমন মিহি করে ফুল ভরেচে, পাতা করেচে…’-

কাননবালা সরু চোখ করে তাকিয়ে আছেন টেঁপির পরনের জামাটার দিকে। হালকা বেগুনী জমিন জুড়ে ছোট ছোট পদ্ম নকশা, গলা আর হাতের কাছটায় বরফি পাড়। গোল গলার কিনারা জুড়ে সাদা রঙের কুচি দেওয়া ঝুল, চোক পাড়ের নকশা বসানো। এই ফোঁড়গুলি… সহজে চোখে পড়ে না আর আজকাল। কিন্তু, কাননবালা দেখেছেন আগে। কেবল মা মাসীদের কাছেই নয়, আরও একজনকে দেখেছিলেন পটু হাতে সুতো দিয়ে এরকম ছবি আঁকতে।

‘এত সব তোমার করা? তা বেশ, এই যে গলার ঝুলে পাড় বসানো, এই নকশাটা তো আগে দেকিনি। এর নাম কী গো বাছা?’

হবু শাশুড়ির অতর্কিত প্রশ্নে ললিতা ঢোঁক গেলে। টেঁপিটার গলার কাছে ঝুল একটা আছে দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু ওতে কীসের নকশা করা তা ছাই কেমন করে জানবে! জীবনে তো সূঁচে সুতোটিও পরায়নি। আপ্রাণ চেষ্টায় নকশাটা বুঝবার চেষ্টা করে ললিতা, যাহোক কিছু একটা নামটাম তো বলতে হবে!

‘ঝুলের কাছে এটা চোক, আর হাতায় বরফি। ললিপিসি জানবে কী করে, ঐ নিবিদিই তো—’, ললিতার আগেই টেঁপির গলাটা মাজা কাঁসার মতন ঝনঝনিয়ে ওঠে। মেয়েটি বয়সের আন্দাজে অত্যধিক পাকা। ডাকের সম্পর্কে নিবেদিতা তার মাসী-পিসি গোত্রীয় হলেও টেঁপি তাকে মাসী ডাকতে অস্বীকার করে কটকটিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, ‘সুরমাসীর মতো হাতে শাঁখা নেই, লালপিসির মতো ইয়া বড় পেট নেই—নিবিদি আমার সইদিদি, মাসি-পিসি কিচ্ছু নয়!’

টেঁপির লাগামছাড়া মুখখানার ওপর ঢাকনা সাঁটতে সুলেখা তড়িঘড়ি কলকলিয়ে ওঠেন।

‘ওর কি আর নাম আছে গো দিদি? ঐ বসে বসে যখন যা মনে আসে তাই বানায় আরকি। নিজেই বানিয়েছে, নামটাম দেয়নিকো…’

শাশুড়ির চোখ গরমিতে মেয়েকে টেনে ভেতরে নিয়ে যায় চারু।

‘হাঁ রে মুখপুড়ি, কতবার বলেছি তোকে? গুরুজনেদের কথার ভেতর কথা কইতে নেই?’

টেঁপিও ছাড়বার পাত্রী নয়। রাজহাঁসের মতো ঘাড় বেঁকিয়ে জবাব দিল, ‘বারে! দিদিমণি যে শেখাল- “সদা সত্য বলিবে”, তার বেলায়? তোমাদের কথা শুনব না দিদিমণির, সে কাটকাট করে বলে দাও দিখি বাপু!’

‘কারুর কথা শুনতে হবেনে তোর! এই এখানে বসিয়ে গেলাম, কলের পুতুলের মতন এমনই যাতে বসে রোস!’- চারু আঙুল তুলে শাসায় মেয়েকে। ভেতরে ভেতরে কে না জানে, এই আট বছুরে টেঁপিই ঠিক! তবু চারু মেয়েকে শাসায়, বলা ভালো- শাসাতে বাধ্য হয়। সংসারের শান্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে কত কীই না করতে হয় বাড়ির বৌয়েদের! বলতে নেই, চারুর ভেতরটা আজ বড় বিদ্রোহ করে উঠছে বারবার। বিশেষত, রাত জেগে সত্তর পদ রাঁধবার পরে সাতসকালে খালি মুখে বিদায় নিল মেয়েটা, তারপর থেকে কোন কিছুই ভালো লাগছে না। শাশুড়ি, ননদের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান বরাবরই তলানিতে ছিল। আজ একেবারে নেই হয়ে গেল। সামাজিকতা রক্ষার্থে মেয়েটিকে বসিয়ে রেখে আবার বাইরের ঘরে গেল বটে চারু, কিন্তু মনের ভেতর যে তিক্ততা আসন গেড়ে বসেছে, মেকি হাসির মিষ্টতায়ও তা ঢাকতে পারল না পুরোপুরি। অভিনয় তো আর সকলে জানে না!

মেয়ের গুণপানার গীত গাইতে গাইতে মুখ ধরে এসেছিল। তাই হবু বেয়ান যখন ‘এবারে উঠি তবে’- বলে উঠে দাঁড়ালেন, সুলেখা আক্ষরিকই হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন।

বেরুবার মুখে সকলকে বিদেয় দিতে হয়। অবাধ্য টেঁপিকেও তাই ডেকে আনা হলো। মায়ের বকুনি খেয়ে মুখ গোঁজ করা টেঁপিকে একটানে কোলে তুলে নিয়ে কাননবালা ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন- ‘সে কই? হাতার বরফিখানা করেচে যে।’

কিছু একটা নিগূঢ় রহস্যের গন্ধ পেয়ে টেঁপির বুদ্ধি জ্বলজ্বল চোখজোড়া নিয়নবাতির মত ফট করে জ্বলে উঠল। কাননবালার ফিসফিসানিকে দুই দিয়ে গুণ করে নিয়ে কানে কানে বলল- ‘সোনাঠাম্মার বাড়ি, আজ সকালেই গেছে।’

‘সে বাড়ির ঠিকানা জানো?’

‘মা জানে! এনে দেব?’

হাতব্যাগ থেকে দু’টো লজেঞ্চুস বের করে দিতে দিতে কানন বলেন- ‘উঁহু। কেবল কাউকে বলোনে কিচ্ছু, কেমন?’

টেঁপি ঘাড় হেলিয়ে সায় জানায়। পেটে বোমা পড়লেও এ কথা বের হবে না।

তারপর, টেঁপি এবং ললিতার সাথে সাথে চারুকেও ‘প্রণামী’ দিলেন কাননবালা। সুলেখা আর তার গুণধর ভাইটি মেতে ছিলেন শশীর আপ্যায়ন নিয়ে, ‘লজ্জাবতী(!)’ ললিতা তো ঘোমটার বাইরে চোখ তুলে তাকায়নি পর্যন্ত। প্রথমে লজেঞ্চুস এবং তারপরে প্রণামীর সাথে সাথে যে উপরিটুকুর আদান-প্রদান হয়ে গেল, তার পুরোটাই তাই এদের চোখ এড়িয়ে গেল। হবু কুটুমেরা বিদেয় নিলে পরে তাই সুলেখার চোখেমুখে খুশির ধারা উপচে উঠল।

আত্মবিশ্বাস গদগদ গলায় সুলেখা ভাইকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাঁ রে ভব, সম্বন্ধটা তবে হয়েই যাবে, বল্‌?’

‘গুনে গুনে দু’শো টাকা খাইয়েচি পেটমোটা লালমোহনটাকে। না হলে না, পেট গেলে দেব ওটার!’

ভব ঘোষালের মুষ্ঠিবদ্ধ ডান হাতটা বাঁ হাতের পেটের ভেতর সেঁধিয়ে গিয়ে ‘পেট গেলে দেয়া’র ব্যবস্থাটি হাতেনাতে প্রদর্শন করল।

অদূরে টেঁপিকে কোলে নিয়ে দাঁড়ানো চারুলতার বুকের ভেতর তখন ‘ঢিপঢিপ, ঢিপঢিপ’ করে ডাকছে। পোড়ারমুখী, হতচ্ছাড়িটা চুপিচুপি বাড়ি ছেড়ে যাবার পাঁয়তারা করল… এত বড় কথাটা একবারও মুখে ফুটে জানাল না!

১২

‘কী বাপ? মেয়ে কেমন দেখলি?’- ঘোড়ায় টানা গাড়িটিতে বসেই কাননবালা প্রশ্ন করেন।

কে উত্তর দেবে? শশীভূষণ? সে তো সেই কখন, কোন অবেলায়, নিরুদ্দেশে হারিয়ে বসে আছে। নিজের ভেতর আর ফিরল কই? ওহহো! অত কথা বলা হলো, শশীর নিরুদ্দেশযাত্রার কথাটি তো বলাই হলো না আর!

‘এই যে দেখছেন, কুশন বালিশের ওয়্যার থেকে আরম্ভ করে ঐ আয়নার ওপরের আর্শিলতাটা—’ বলতে বলতে মেয়ের মা যেদিকে আঙুল নির্দেশ করলেন, সেদিক বরাবর তাকাতেই তো ডাক্তারবাবুর চোখজোড়া আটকে গেল! দেয়ালে সাঁটানো বড় আয়নাটার ওপর দু’ফালি আকাশরঙা কাপড় টাঙানো, পাখার হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। দু’পাশে দু’টি তিড়িংবিড়িং খরগোশ ছানা। অগ্রবর্তীটির মুখে কামড়ে ধরা গাজরের টুকরো…

এই দৃশ্যটুকু কি শশীভূষণের খুব চেনা নয়? ঐ পর্দার ফালি দু’টোর আড়ালে যেন কিছু একটা আছে। বড় আরাধ্য… বড় কামনার কিছু একটা। শশী জানে, শশীর তীরবেগে ধাবিত হৃদয় জানে, শিরা উপশিরায় প্রবাহিত রক্তকণিকারা জানে কিন্তু হতচ্ছাড়া মগজটাই কেবল জানে না! শশীর ভেতরে যে শশীর বাস, সে বারবার তাগাদা দিচ্ছে মস্তিষ্কে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকা স্মৃতিকোষগুলিকে জাগিয়ে দিতে। সেই তাড়নায় মগজের সমস্তটা আতিপাতি করে খোঁজে শশীভূষণ।

খোঁজে তো, কিন্তু পায় না যে!

হৃদপিণ্ডের তোড়জোড় জানান দিচ্ছে, বড় লোভনীয় এক টুকরো স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই দৃশ্যটার সাথে। এরকম, ঠিক এই রকমটাই দেখেছিল শশী আর তারপরেই ঘটেছিল ঘটনাটা…

কী ঘটনা?

মাথার ভেতরের আগাপাশতলা নড়চড় করেও কিছুতেই সমস্তটা মনে পড়ছে না কেন? কত আগের স্মৃতি এসব? এই জন্মের? নাকি আগের? কত আগের?

একটা তীব্র বেদনামধুর অনুভূতি শশীর সমগ্র সত্তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলে৷ ধীরে, খুব ধীরে… সকলের মাঝে বসেও শশী হারিয়ে যায়।

‘কীরে বাপ? তখন থেকে দেখছি…কী ভাবিস এত?’- মায়ের পুনর্বার প্রশ্নে শশী বাস্তবে ফিরে আসে।

‘হুঁ? না কিছু নয়। আচ্ছা মা, এদের বাড়িতে আমরা আগে তো আসিনি কখনও, না?’

এ কেমন অদ্ভুতুড়ে প্রশ্ন! কাননবালার স্তম্ভিত দৃষ্টিপাতে শশী বিব্রত হয়, তোতলাতে তোতলাতে বলে- ‘না, ওই ইয়ে… কাপড়চোপড়গুলো… কেমন চেনা লাগছিল… কোথায় দেখেছি, ভেবে পাচ্ছি না।’

ওহ! তবে এই কথা! কাননবালা মনে মনে হাসেন। লোকে বলে শশী ডাক্তার নাকি রোগীর চেহারা দেখেই রোগের নামধাম বলে দিতে পারেন। নামজাদা ডাক্তার, সে তুমি পারতেই পার! কিন্তু মায়েদের মতন এমন চতুর্ব্যাপী দৃষ্টি তুমি কই পাবে?

‘সে তুই কই দেখেছিস তুই-ই জানিস! কত রোগীদের বাড়িতে যাস-টাস…কই কী দেখেছিস! অত বেশি ভেবেচিন্তে মাথাটা বিগড়োসনি বাপ, সময় হলে আপনাতেই খুঁজে পাবিখন!’

এহেন ভাগ্যের নদীতে গা ভাসিয়ে দেয়া আশ্বাসবাণীতে শশীর কোঁচকানো ভ্রূ সোজা হয় না। গাজর খাওয়া খরগোশের ছানা দু’টি বেচারার মাথার ভেতর তিড়িং-তিড়িং করে নাচতেই থাকে…

নাচতেই থাকে!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here