নিবেদিতা
★
১
গ্রামের বাকি ছেলেরা যখন বিয়েথা করে সংসার পেতে বসেছিল, শশীভূষণ তখন ‘ডাক্তারি পড়ব’ বায়না করে ব্যাগপত্র গুছিয়ে কলকাতাভিমুখে রওনা করবার পাঁয়তারা করছিল। পিতৃহীন একটিমাত্র ছেলের কোনো আবদারই কাননবালা কোনো কালে ফেলতে পারেননি। ছেলে ডাক্তার হতে চায় শুনে তাই বুকে পাষাণ বেঁধে হলেও হাসিমুখে তাকে কাছছাড়া করবেন বলে ভেবে রাখলেন। মায়েদের ভাবনার তো লাগাম নেই, উপরি উপরি আরও একটা ভাবনা ভেবে রাখতেও তাই বাঁধল না। শশী পড়তে চায়- তা সে পড়ুক। বছরটা ঘুরলেই কমবয়সী একটা ফুটফুটে বউ নিয়ে আসলে কেমন হয়? ছেলের যতদিন না পড়ালেখার পাট চুকেবুকে যাচ্ছে, তিনি বুড়ো মানুষ বউটাকে নিয়েই নাহয় মেতে থাকবেন। আকারে ইঙ্গিতে সেই কথাটাই ছেলেকে বারবার করে বুঝিয়ে তবে কলকাতায় পাঠানো হলো। ওদিকে শশীভূষণ মায়ের এরূপ ইচ্ছের কথা জেনেও যেন অজ্ঞাত ছিল, সম্মতি কিংবা অসম্মতি কোনোটিই প্রকাশ করেনি কোনোদিন। ‘অরাজি যখন হয়নি, তখন রাজিই বটে!’- এমনটি ভেবে নিয়ে কাননবালা তাই আশায় আশায় বসে রইলেন, ছেলেকে চেপে ধরলে সামনের বছর পূজোর ছুটিতেই শুভ কাজটা সম্পন্ন করে ফেলা যাবে।
সে আশার গুড়ে বালি পড়তেই বোধহয় কলকাতায় যাওয়ার মাস ছয়েকের মধ্যেই শশীভূষণের নিস্তরঙ্গ জীবনে এক নতুন ঢেউয়ের আগমন ঘটল। দাশগুপ্ত লেনের যে বাড়িটাতে শশী আরও কতগুলি সমবয়সী ছেলের সাথে উঠেছিল, সে বাড়ির বাড়িওয়ালা নরেন ঘোষালের শিক্ষিতা, সুদর্শনা, অষ্টাদশবর্ষীয়া মেয়েটিকে তার বড় মনে ধরে গেল।
রোজকার মতন সকাল সকাল স্নানাহার শেষে শশীভূষণ কলেজের উদ্দেশ্যে রওনা করেছিল। দোতলার সিঁড়িটিতে পা রাখতে না রাখতেই একটি অচেনা মেয়ে হাপুস নয়নে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে এল। ‘আপনি নাকি ডাক্তার? দেখুন না বাবা কেমন করছে!’- বলেই যেভাবে এসেছিল আবার সেভাবেই ছুটে নিচে নেমে গেল।
মিস্ নিরঞ্জনার সঙ্গে শশীর সেটিই প্রথম দেখা। মেয়েটি তাকে ‘ডাক্তার’ বলে সম্বোধন করায় শশীর ভীষণ সংকোচ হয়। সে তো সবে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছে! তবু দ্রুতপায়ে তাকে অনুসরণ করে শশী। নিজে দৌড়ে গাড়ি ভাড়া করে এনে নরেনবাবুকে টানাটানি করে হাসপাতাল অব্দি নিয়ে যায়। পরিচিত স্যারেদের বলে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয়। তারপর নরেনবাবুর জ্ঞান না ফেরা পর্যন্ত সেখানে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। স্যারেদের ধরিয়ে দেওয়া ফর্দ মিলিয়ে মিলিয়ে ঔষধপত্রের যোগাড়যন্ত্র করে।
-‘আপনাকে অনেক ধন্যবাদ! অচেনা মানুষের জন্যে যা করলেন…’- নিরঞ্জনা চোখ মুছে বলে।
-‘না! না! আপনারা আমার অচেনা কই? নরেন কাকুর সাথে কথা বলেই তো গেল মাসে বাড়িতে উঠলুম!’- শশীভূষণ বড় ব্যগ্র হয়।
নিরঞ্জনা প্রত্যুত্তরে খানিক হাসে। হাসলে তার গালে টোল পড়ে।
সে হাসি শশীর অন্তরে অদ্ভুত বেদনা জাগায়। ঐ টোল-পড়া গালখানা ছুঁয়ে দিতে না পারার অক্ষম যন্ত্রণাটা হৃদপ্রকোষ্ঠে জন্ম নিয়ে ক্রমশ সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে।
দিন দুয়েক বাদেই নরেনবাবু সেরে ওঠেন। যে দু’দিন তারা হাসপাতালে ছিলেন, শশী যত্ন আত্তির চূড়ান্ত করেছে। অল্পদিনেই সোজা-সরল গ্রাম্য এই ছেলেটিকে বেশ ভালো লেগে যায় মিস নিরঞ্জনার। কলকাতার আধুনিকা নিরঞ্জনা সহজ স্বাভাবিক বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয় সরল ছেলেটির দিকে। শশী প্রকম্পিত হাতে সে হাত ধরে। তার ভয় হয় পাছে ‘বন্ধুত্বের’ আড়ালে লুকিয়ে থাকা ঐ ‘ছুঁয়ে দেবার’ দাবিটুকু নিরঞ্জনা টের পেয়ে যায়! বোকা শশী জানেনা পুরুষের চোখ পড়তে পারবার বিচিত্র ক্ষমতাটি নারীর জন্মসূত্রেই লব্ধ। শশীভূষণের এই প্রেমে পড়বার খবরটি তার নিজের মনে চাওড় হবার বহু আগেই নিরঞ্জনা জেনে বসে আছে!
দুর্গাপূজোর বন্ধে বাড়ি এলে কাননবালা জোরেসোরেই ছেলেকে বিয়ের জন্যে চেপে ধরেন। ‘ভীষণ পড়া, পরীক্ষার বড় চাপ, পাশ না করা অব্দি বিয়েথা নয়’- ইত্যাদি ইত্যাদি ওজর-আপত্তির ধুঁয়া তুলে মা’কে সেযাত্রায় নিরস্ত করে শশীভূষণ।
পূজো শেষে ছেলে আবার কলকাতায় ফিরে যায়। কাননবালা দীর্ঘশ্বাস চেপে অপেক্ষা করেন তার ডাক্তারি পাশ দিয়ে বাড়ি ফিরবার। দু’চারটে মেয়েকে মনে মনে যা-ও পছন্দ করেছিলেন, তারাও একে একে সুপাত্রস্থ হয়ে যায়। কাননবালা তবু ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করেন- ছেলে পাশ হবে, বড় ডাক্তার হবে, বাড়ি ফিরবে তবে ছেলের বউয়ের দেখা মিলবে। ঐযে সেই গল্পের চাষার ছেলেটির মত- ‘বাবায় ধান বুনবো, সেই ধান বড় হইব, তাতে চাল হইব, সেই চাল বেইচা বাছুর কিনব, সেই বাছুরে বড় হইয়া দুধ দিব- তো আমি দুধ খাইতে পারলাম!’
এর ঠিক এক বছর পর, আরেক দুর্গাপূজোতেই ঘটনাটা ঘটল। শিবরাম বাড়ুয্যে নামের এক সুপ্রতিষ্ঠিত কলকাতাবাসী চিকিৎসকের প্রস্তাবে সাড়া দিয়ে পূজোর বন্ধেই মিস নিরঞ্জনা টুপ করে বিয়েটা সেরে ফেললেন। মায়ের আদর খেয়েদেয়ে, পূজোর ছুটি কাটিয়ে, চাঁদপানা মুখ করে শশীভূষণ কলকাতায় গিয়ে আবিষ্কার করল- অঘটন যা ঘটবার, ঘটে গেছে!
জগতে দুই দলের মানুষ হয়। একদল কর্মে বিশ্বাসী। খোঁপায় গোলাপ গুঁজতে চাইলে এরা আগে মাটি কুপিয়ে গোলাপের চারা পুঁতে। তাতে সার-পানি দিয়ে, ফুল ফুটিয়ে তবে খোঁপা সাজায়। পরের বাগানের সেরা গোলাপটি চুলে গুঁজে লোকের বাহবা কুড়নোতে এদের আত্নসম্মানে লাগে। স্বহস্তে চাষকৃত রুগ্নস্বাস্থ্য ফুলটিকে নিয়েই এরা দিব্যি সগর্বে সর্বত্র বিচরণ করতে পারে। আরেক দল ফলে বিশ্বাসী- এরা এদিক সেদিক খুঁজেপেতে সেরা গাছের সেরা গোলাপখানা ছিঁড়ে এনে খোঁপায় গুঁজে অহংকার করে। ধৈর্যের সুমিষ্ট ফলপ্রাপ্তিতে এদের আগ্রহ কিংবা চেষ্টা কোনোটিই নেই।
আমাদের মিস নিরঞ্জনাটি সেই দ্বিতীয় গোত্রভুক্ত ছিলেন। শশীভূষণ ছাত্র হিসেবে নেহাত মন্দ ছিল না, কলেজে বরং ভাল ছাত্র হিসেবেই তার সুনাম ছিল। হয়ত সেই শিবরামবাবুর মত শহরজোড়া খ্যাতি তার হতো না- সেরকম তো আর সকলের হয়ও না! তবুও ডাক্তারি পাশটা করে বেরুলে পসার কিংবা ‘ক্যারিয়ার’ দুটোর কোনোটাই নিতান্ত ফেলে দেবার মত হতো না শশীভূষণের। কিন্তু ঐযে, নিরঞ্জনা যে তাদেরই গোত্রভুক্ত যারা নিজ প্রচেষ্টায় ইটের পর ইট গেঁথে মাথা গুঁজবার ঠাঁই তৈরি করে নেয়ার সাধনাটুকুকে নেহাতই ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ এবং সময়ের অপচয় বলে ভাবেন। আর অপরের সাধনায় প্রস্তুতকৃত ‘রেডিমেড’ দালানে চটপট খুঁটি গেড়ে বসে যাওয়াকে বুদ্ধিমানের কাজ বলে গণ্য করেন। আধুনিকা নিরঞ্জনা বেশ জানে- কবে শশী পাশ করবে আর কবে তার পসার হবে সেই অপেক্ষায় বসে থাকা নিতান্ত বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই শশীকে ‘আউট’ করে শিবরামবাবুকে ‘ইন’ করতে তার দুটো দিনও সময় লাগেনি।
শশীভূষণের সরল মাথাটায় অবশ্য অতশত হিসেব-নিকেষ ‘ইন’ হলো না! সে কেবল জানল পৃথিবী নামক চ্যাপ্টা গোলকখানা বড় নিষ্ঠুর, আর তাতে যারা বসবাস করে তারা আরও বড় পাষাণ। আত্মবিস্মৃত শশী ঠিক করলো মানব সংস্রবচ্যুত হয়ে এবারে সন্ন্যাসব্রত নেবে।
★