ধূসর শ্রাবণ পর্ব ৫

0
863

#ধূসর_শ্রাবণ?
#লেখিকা:#তানজিল_মীম?
#পর্ব-০৫

ব্রেকফাস্ট টেবিলে বর্ষা বাদে গোল হয়ে বসে আছে সবাই। একমাত্র কাঁটা চামচের শব্দ ব্যতিত তেমন কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না তেমন। শুভ্র, শুভ্রের বাবা মা, দাদু,শুভ্রা সবাই চুপচাপ খাওয়ায় ব্যস্ত। যদিও তাঁরা বর্ষার অপেক্ষা করছিল অনেকক্ষন কিন্তু শুভ্র বারন করায় নিজেদের খাওয়ার কাজে মগ্ন হন সকলেই। তাদের পাশেই রাহেলা নামক এক মহিলা খাবার সার্ভ করছেন। উনি এ বাড়ির পুরনো একজন কাজের লোক। যদিও উনি কাজের লোকের চেয়ে পরিবারের একজন সদস্যের মর্যাদাই বেশি পান। এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে একটা লাল টুকটকে শাড়ি পড়ে নিচে নামলো বর্ষা। এই শাড়িটার জন্য যা দেরি হলো তাঁর। এতটা দেরি হওয়ার জন্য বেশ সংকোচতা ফিল হচ্ছিল ভিতরে ভিতরে। বর্ষাকে আসতে দেখে শুভ্রা বলে উঠল,

‘ ওই তো বর্ষা ভাবি চলে এসেছে।’

সাথে সাথে সবাই তাকালো বর্ষার দিকে। শুভ্র একপলক তাকিয়ে তক্ষৎনাত চোখ সরিয়ে খেতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো যেন খাওয়া ব্যতীত আপাতত তাঁর জন্য আর বড়সড় কোনো কাজ নেই। বর্ষা টেবিলের কাছ পর্যন্ত আসতেই শুভ্রের বাবা বলে উঠল,

‘ আমার পাশ দিয়ে বসো, বউমা?’

এই প্রথমবার বর্ষা শুভ্রের বাবার মুখে বউমা ডাকটা শুনলো বেশ লেগেছে তাঁর। বর্ষা মুচকি হেঁসে বললো শুভ্রের বাবার পাশে থাকা চেয়ার পেতে। বর্ষা বসতেই রাহেলা খাবার দিতে শুরু করলো বর্ষাকে। কিছুক্ষনের নীরবতার ভর করলো সকলের মাঝে। হঠাৎই সেই নীরবতা কাটিয়ে শুভ্রকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো শুভ্রের বাবা,

‘ তোমার লন্ডনে যাওয়ার ফ্লাইট কবে শুভ্র?’

খাবারের প্রতি বিশেষ মনোযোগ ছিল শুভ্রের। হুট করেই বাবা মুখের কন্ঠ শুনে খাওয়া বন্ধ করে বাবার মুখের দিকে তাকালো শুভ্র তারপর বললো,

‘ এক সপ্তাহ পর।’

শুভ্রের কথা শুনে শুভ্রের বাবা বেশ ভাবনাহীন ভাবেই বলে উঠল,

‘ তুমি নিশ্চয়ই জানো এবার তুমি একা নও তোমার সাথে বর্ষাও যাবে। ‘

প্রতি উওরে কিছু বললো না শুভ্র কারন সে এটা জানতো। শুভ্রকে চুপ থাকতে আবারো প্রশ্ন ছুড়লো শুভ্রের বাবা,

‘ এখন তুমি কি বলো?’

বাবার ফের প্রশ্ন শুনে শুভ্র তাঁর বাকি খাবারগুলো শেষ করে আধ গ্লাস পানি খেয়ে উঠে দাঁড়ালো তারপর টিসু দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে বললো,

‘ তোমরা তো সবকিছু আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছো তাই নতুন করে আমি আর কি বলবো, তোমাদের যা ভালো মনে হয় তাই করো। যাইহোক আমি একটু বের হবো আমার কিছু কাজ আছে।’

এতটুকু বলে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় শুভ্র। শুভ্রের যাওয়ার পানে কিছুুক্ষন তাকিয়ে থাকে বর্ষা। বাকি সবাই না বুঝলেও সে বুঝতে পেরেছে অনেকটা অভিমান নিয়েই কথাগুলো বললো শুভ্র।’

সকাল থেকেই বাড়ির মানুষজন বেশ ব্যস্ত কারন কাল শুভ্র আর বর্ষার বৌ-ভাতের অনুষ্ঠান। বউভাতের অনুষ্ঠানটা বাড়িতে হওয়ায় ব্যস্ততা যেন আরো বেশি সবার। শুভ্রদের আত্মীয়স্বজন আসতে শুরু করেছে অনেকেই। পুরো বাড়ি জুড়েই একটা হট্টগোল ব্যাপার। যদিও এগুলো কাল থেকেই ছিল। শুভ্রদের বাসা থেকে বর্ষাদের বাড়ির দুরত্ব কয়েক মিনিটের জাস্ট।’

নিজের রুমে চুপচাপ বসে আছে বর্ষা। তাঁর পাশেই শুভ্রা বক বক করে যাচ্ছে। শুভ্রার কথার প্রতি উওর হিসেবে জাস্ট হা না এই দুটো শব্দই বেশি ইউজ করছে সে। হঠাৎই বর্ষা বলে উঠল,

‘ আচ্ছা শুভ্রা তোমার ভাইয়ার বিদেশি ফ্রেন্ডরা কেন আসলো না বিয়েতে?’

এতক্ষণ বর্ষার হা না শব্দ ছেড়ে বড় কথা শুনে শুভ্রা বেশ ভাবনাহীন ভাবেই বলে উঠল,

‘ আজ আসবে বোধহয় আসলে তোমাদের বিয়েটা তো কয়েকদিন আগে হয়ে গেছে তাই হয়তো তাঁরা আসতে পারে নি।’

‘ ওহ!’

‘ হুম। ভাইয়া বোধহয় তাদের আনতেই গেছে।’

প্রতি উওরে তেমন কিছু বললো না বর্ষা। এমন সময় তাঁর ফোনটা বেজে উঠল উপরে তাঁর বেস্টফ্রেন্ড আরোহীর নাম দেখে চোখে মুখে হাসি ফুটলো কিন্তু পরক্ষণেই হাসিটাকে দমিয়ে রেখে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,

‘ ফোন কেন করেছিস তুই?’

বর্ষার কথা শুনে অপর পাশে আরোহী বলে উঠল,

‘ লে খুকি যেখানে রাগ আমার করার কথা সেখানে তুই করছিস কেন?’

‘ মানে?’

‘ মানে আবার কি বিয়ের ডেটের দুসপ্তাহের আগেই বিয়ে সেরে ফেলেছিস আবার রাগ দেখাচ্ছিস?’

‘ তোকে তো আগেই বলেছি?’

‘ কচু বলেছিস যাই হোক পিছন ফের।’

‘ কি?’

‘ বলছি পিছন ঘুর।’

সাথে সাথে পিছনে ফিরে তাকালো বর্ষা। সত্যি সত্যি পিছনে তাঁর প্রবাসী বেস্টফ্রেন্ডকে দেখে চোখে মুখে হাসি ফুটে উঠলো তাঁর। তক্ষৎনাত খুশি হয়ে একবার শুভ্রা তো একবার আরোহীর দিকে তাকিয়ে দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো সে আরোহীকে। তারপর কান্না ভেঁজা কন্ঠ নিয়ে বললো সে,

‘ কেমন আছিস দোস্ত কতদিন পর তোকে দেখলাম?’

‘ আমি ভালো আর তুই?’

‘ হুম ভালো!’

________

পরন্ত বিকেল বেলা! ঢাকার উওরার আনাচে কানাচে বিভিন্ন বইয়ের দোকানে ঘুরে ঘুরে দেখছে হিয়া। মাথা মন সবকিছুই নিস্তেজ প্রায় তাঁর। কোনো এক সাহিত্যের খোঁজেই নাজেহাল অবস্থা তাঁর। বিকেল হওয়া সত্বেও প্রচন্ড গরমে মাথা মন প্রায় ক্লান্ত তাঁর। কিছুটা হতাশ হয়েই বইয়ের দোকান থেকে নামলো হিয়া। ব্যস্ত শহর জুড়ে চলছে শাঁই শাঁই সব গাড়ি। হিয়া তাঁর ক্লান্ত মাখা মুখটা নিয়েই হাঁটা ধরলো হাতের ডান দিকের রাস্তা দিয়ে। হয়তো বইয়ের খোঁজের জন্য তাঁকে কুরিয়ার সার্ভিস অর্থাৎ অনলাইনই ব্যবহার করতে হবে। শুধু শুধু সারা বিকেল জুড়ে হাটলো এদিক সেদিক। মুখ জুড়ে থাকা ঘামগুলো নিমিষেই ওড়না দিয়ে মুছে ফিললো সে। এই মুহূর্তে বৃষ্টি নামলে হয়তো মন্দ হতো না খুব। কিন্তু আকাশটা আজ বড্ড পরিষ্কার মনে হয় না আজ আর বৃষ্টি নামবে। আনমনেই আকাশ পথে তাকিয়ে এগিয়ে চললো হিয়া ব্যস্তশীল রাস্তা পেরিয়ে। তৃষ্ণা পেয়েছে খুব কিন্তু আশেপাশে তেমন কোনো চায়ের দোকান দেখছে না সে। যাও আছে তাও তাঁর অপজিট রাস্তায় সেখানে যেতে হলে তাঁকে মাঝরাস্তার এই গাড়িগুলো টপকাতে হবে। কিন্তু এই মুহূর্তে রাস্তাপারাপাত হতে মটেও মন চাইছে না তাঁর। একবার পা হলে দ্বিতীয় ঘুরে আবারো আসতে হবে তাঁকে।’

শেষমেশ নিরুপায় হয়েই ক্লান্ত শরীর আর মন নিয়েই হাঁটা শুরু করলো সে। কয়েককদম যেতেই হঠাৎই পিছন থেকে একটা পিচ্চি ছেলে এসে ওড়না ধরে টান দিলো হিয়ার। গলায় টান অনুভব হতেই তক্ষৎনাত দাঁড়িয়ে পড়লো সে ওখানেই পিছন ফিরে পিচ্চি একটা ছেলেকে দেখে নিচে বসে বললো হিয়া,

‘ কিছু বলবে আমায়?’

উওরে ছেলেটিও মাথা নাড়িয়ে হা সমর্থন দিলো যার অর্থ হা সে কিছু বলবে। ছেলেটির মাথা নাড়ালো দেখে হিয়া তাঁর চোখের চশমাটা হাত দিয়ে ঠিক করে বললো,

‘ হুম বলো।’

সাথে সাথে পিছন থেকে একসাথে একবোতল ঠান্ডা পানি, আর অন্য হাতে একটা গোলাপ আর চিরকুট এগিয়ে দিল হিয়ার পানে। ছেলেটির কাজে হিয়া অবাক হয়েই ওগুলো হাতে নিলো। পরক্ষণেই পাল্টা কিছু বলতে তাঁর আগেই পিচ্চি ছেলেটি দৌড়ে হাওয়া হয়ে গেল মুহূর্তেই। হিয়া বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো তারপর চিরকুটটা খুললো সে যেখানে লেখা,

‘ এত আলসে কে তুমি? জানো না তৃষ্ণা পেলে পানি খেতে হয়, সবসময় সাহিত্যের পিছনে ছুটলেই হবে নাকি মিস ঔপন্যাসিকা। মাঝে মধ্যে কাল্পনিকতা থেকে বেরিয়ে বাস্তবেও মুখ লুকাতে হয় প্রিয়দর্শিনী।’

হিয়া বেশ অবাক হলো চিরকুটটা পড়ে। সে যে সাহিত্যের পিছনে ছুটছিল এটা কি করে বুঝলো এই চিরকুটের মালিক। অবাক হয়েই বললো সে,

স্ট্রেঞ্জ!’

বলেই পেছন ফিরে তাকালো কয়েকবার বাট আশেপাশে তেমন কাউকেই চোখে পড়লো না তাঁর।’

পরক্ষণেই বেশি কিছু ভাবলো না আর এগিয়ে গেল নিজের গন্তব্যের দিকে। চেয়েছিল ফুলটা ফেলে দিতে কিন্তু ফুলটা এতটাই সুন্দর যে না চাইলেও সেটাকে নিয়েইন এগিয়ে গেল সে। আপনা আপনি ঠোঁটে হাসি ফুটলো তাঁর।’

অন্যদিকে থেকে বেশখানিকটা দূরে হিয়া হাসিমাখা মুখ দেখে নিশ্চুপেই হাসলো কেউ। হয়তো এতক্ষণ হিয়ার এই হাসিমাখা মুখটা দেখার জন্যই ব্যাকুলভাবে অপেক্ষা করছিল সে।’

_____

পরেরদিন খুব ধুমাধাম করেই বৌভাতের অনুষ্ঠান পালন করা হলো শুভ্র আর বর্ষার। শুভ্রের কয়েকজন বিদেশি ফ্রেন্ডরাও সামিল ছিল তাতে। যদিও তাতে বর্ষার কোনো খোপ ছিল না। বর্ষার সাথে হাই হ্যালো ব্যতীত তেমন কোনো কথা হয় নি আর তাদের সাথে।’

রাত প্রায় ১০টার কাছাকাছি! সারাদিনের অনুষ্ঠান ছেড়ে সবেমাত্র বিছানায় গা এলিয়েছে বর্ষা। আজ তাঁর মা বাবাও এসেছিল। সাথে এসেছিল হাতেগোনা কয়েকজন বন্ধু। বর্ষা খুব নিশ্চুপ স্বভাবের হওয়ার খুব একটা বন্ধু জোটে নি তাঁর। হাতে গোনা দু’চার হবে হয়তো। তপ্ত নিশ্বাস ছাড়লো বর্ষা, আজ আবারও বেলকনিতে দাঁড়িয়ে শুভ্র কারো সাথে কথা বলছে। কার সাথে রাত করে কথা বলে বুঝতে পারে না বর্ষা। কোনো বিশেষ কেউ। উওর মেলে না বর্ষার। অতঃপর বেশি কিছু না ভেবেই চোখ বুঝে ফেললো সে। তাদের সম্পর্কটা ঠিক কোনদিকে যাচ্ছে ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না সে। শুভ্রও তেমনভাবে কোনো কথাই বলে না বর্ষার সাথে। যেটা খুবই খারাপ লাগছে বর্ষার কাছে, শুভ্র চায় কি? কি চলছে শুভ্রের মনে! বুঝে উঠতে পারে না বর্ষা। চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো তাঁর। এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে বর্ষার এই বিয়ে না হলেই বোধহয় ভালো হতো?’

____

রাত প্রায় দেড়টার কাছাকাছি! টেবিল জুড়ে থাকা কিছু ডাইরির পৃষ্ঠা উল্টে চলছে বারংবার। যদিও সেখানে কিছু অস্পষ্ট শব্দ ব্যতীত তেমন কিছুই লেখা নেই। জানালার কার্নিশ বেয়ে আসা রাতের জোৎসা ভরা আলো এসে পড়ছে সেই ডাইরির পাতাতে। এদের পাশেই খাট জুড়ে ঘুমিয়ে আছে হিয়া। কয়েক মুহূর্ত আগেই চোখ বুঝেছে সে। যদিও ঘুমটা খুব বেশি গভীর হয় নি তাঁর। এমন সময় হঠাৎই বেলকনির পাশ দিয়ে কিছু ভয়ানক শব্দ কানে আসতেই হিয়ার কাঁচা ঘুমটা ভেঙে গেল সাথে আঁতকে উঠলো মন। চটজলদি শোয়া থেকে উঠে বসলো হিয়া রুমের লাইট জ্বালালো থাকায় খুব বেশি ভয় পেলো না সে। হিয়া কিছুটা ঘাবড়ানো মুখ নিয়েই এগিয়ে গেল বেলকনির দিকে। তক্ষৎনাত একটা প্যাকেট আর প্যাকেটার ওপর দড়ির সাথে আটকানো একটা চিরকুট দেখে আরো যেন অবাক হয় খুব। হিয়া তক্ষৎনাত এগিয়ে যায় সেদিকে হয়তো সে যেটার খোঁজে সারা বিকাল জুড়ে হাঁটলো সেটাই এটা। হিয়া আশপাশ তাকিয়ে চটজলদি চিরকুটটা হাতে নিলো। তবে এবার চিরকুটটা খোলা আগে সাথে থাকা প্যাকেটটা খুললো সে। প্যাকেটটা খুলতেই মুখে হাসি ফুটলো তাঁর। কারন সে যে বইটা খুঁজছিল সেটাই এটা। হিয়া খুশি মনে চিরকুটটা খুললো যেখানে লেখা,

‘ তোমার একটুখানি নিশ্চিতে ঘুমানোর উপহার হিসেবে এই ছোট্ট উপন্যাস প্রিয়দর্শনী।’

হিয়া খুশি মনে তাকালো আবারো তাঁর হাতে থাকা বইটার দিকে। যেখানে তাঁর প্রিয় একজন লেখক রবীন্দ্রনাথের লেখা উপন্যাস ‘ঘরে-বাইরে’ নামটি জ্বল জ্বল করছে। ঠোঁটে হাসি রেখেই বইটি বুকে জড়িয়ে ধরলো হিয়া। অনাকাঙ্ক্ষিত খুশিরা যখন হুট করে হানা দিলে যেমন খুশি খুশি লাগে এই মুহূর্তে হিয়ার অবস্থাটাও তাই যেটা হয়তো লিখে প্রকাশ করা যাবে না।’

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। আর গল্প কেমন লাগলো অবশ্যই কমেন্ট করে জানাবে।]

#TanjiL_Mim♥️

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here