দোলনচাঁপা পর্ব ৮

0
61

#দোলনচাঁপা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -৮

ভাইয়ার চোখমুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। নরম গলায় বললো, ” বাহ্, আজ-কাল পুলিশও অনেক এগিয়ে গেছে। এতো তাড়াতাড়ি খু’নিকে ধরে ফেললো। তাছাড়া আমাদেরকেও তেমন অসুবিধা পোহাতে হয়নি। ”

” হ্যাঁ। কাকে ধরেছে না ধরেছে কাল সকালে জানা যাবে। এখন ঘুমিয়ে পড়ো। সকাল সকাল উঠতে না পারলে ঝামেলা হবে। ”

” হ্যাঁ, আমি শুয়ে পড়ছি। তুইও যা। যাওয়ার সময় দরজা লাগিয়ে দিস। তনিমার মতো দরজা খুলে ঘর থেকে বেরিয়ে যাস না যেন।”

ভাইয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এলাম। ইচ্ছে করে দরজা লাগালাম না। লোকটা হরহামেশাই ভাবীকে ঠেস দিয়ে কথা বলে। অথচ এই ছেলে উনাকে বিয়ে করার জন্য পা’গ’ল হয়েছিল। রাতের খাওয়া শেষ করে বিছানায় চলে এলাম। কাল থা’নায় যেতে হবে, না গেলে কেন আমাকেই দোষী বানিয়ে ফেললো। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে চোখ লেগে গেছিলো।

মোবাইল বাজছে। রাত-বিরেতে কল আসলে বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। এতো রাতে কে কল করতে পারে? রিপা। মেয়েটার কাণ্ডজ্ঞান বলতে কিছু নেই, রাত তিনটের সময় কেউ কল দেয়।
কল কেটে গেল। হাফ ছেড়ে বাঁচালাম। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। স্বস্তির নিঃশ্বাস বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না, মাঝ পথে গিয়ে হতাশায় পরিনত হলো। বিরক্ত হয়ে কল রিসিভ করলাম।

” বিরক্ত করলাম নাকি?”

” কিছুটা, মাঝ রাতে কল আসলে সকলেই বিরক্ত হয়। ”

” নাহ্, সকলে বিরক্ত হয় না। অনেকে মাঝ রাত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করে। কখন প্রিয় মানুষের কল আসবে সেই অপেক্ষা মোবাইল হাতে পায়চারি করে বেড়ায়। ”

” আমার প্রিয় মানুষ নেই, কারো কলের অপেক্ষায় থাকি না। ”

” আসলেই কি তাই? আপনার প্রিয় মানুষ নেই? ”

” নাহ্, নেই। কোনদিন হবেও না। ”

” হয়তো হবে। জানেন রঞ্জু, জীবনে এমন কিছু কথা থাকে, আমরা সেগুলোকে লুকিয়ে রাখি। এমনকি নিজেদের কাছেও অস্বীকার করি। ”

” মাঝ রাতে কাব্যিক আলাপন ভালো লাগছে না। কাজের কথা বলো। ”

” কাল আমার বিয়ে, হুট করে ঠিক হয়ে গেছে। অনেক ভালো ছেলে, শিক্ষিত, সরকারি চাকরি করে। ”

” বিয়ে করে নাও। অনেক অনেক শুভ কামনা রইলো। ”

” খুব সহজে বলে দিলেন যে?”

” সহজ কথা সহজ ভাবে বলতে হয়। ”

” ভালো থাকবেন। ”

” সবসময়। ”

কল কেটে গেল। রিপার বোধহয় অভিমান হয়েছে। রাগ করে কল কেটে দিয়েছে। বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো, এই জীবনে তোমাকে জড়িয়ে কি লাভ বলো? কোন লাভ নেই, নাহ্ সত্যিই নেই।

সকালে থেকে হৈচৈ লেগেছে। ভাবী তড়িঘড়ি করে সব কাজ শেষ করতে চাইছে। ফুফু সোফার কোণায় বসে ভাবীকে হুকুম করে চলেছে। যেন জীবনের শেষ যাত্রায় রওনা দিবে, এরপর কাউকে হুকুম করার সুযোগ পাবে না। চাচা মিয়া টেবিলে বসে চায়ের কাপে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছে। উপভোগ করার মতো খাবার। ভাইয়াকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সকালবেলা কোথায় বেরিয়ে গেছে, ভাবীকে কিছু বলে যায়নি।

বেলা দশটা নাগাদ থানার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। ভাইয়া থাকলে গাড়ি করে যাওয়া যেত, কিন্তু সে লাপাত্তা। অগত্যা সবাইকে অটোরিকশা করে যেতে হচ্ছে। বাড়ি থেকে থানায় আসতে আধঘন্টা সময় লাগলো। বাদশা বাবু চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আছে। আমাদের দেখে উঠে আসলো। মিষ্টি গলায় বলল, ” এখানে আসতে অসুবিধা হয়নি তো?”

” না, কোন অসুবিধা হয়নি। ”

” তা বেশ, হাবু মিয়া এদের বসার ব্যবস্থা করো। আপনার ভাইকে কোথাও দেখতে পাচ্ছি না। সে আসেনি?”

” না, ভাইয়া সকালবেলা উঠেই কাজে বেরিয়ে গেছে। ”

” কি এমন কাজ করেন উনি? সে যাইহোক। আপনারা বসে বিশ্রাম করুন। ”

ভ্রু কুঁচকে উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। লোকটা মাথায় সমস্যা আছে। এমনভাবে কথা বলছে যেন উনার বাড়িতে বেড়াতে এসেছি। বসে বিশ্রাম নিয়ে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষ করবো।

” এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? কোন সমস্যা? ”

” না। ঠিক আছে। ”

” আপনার ভাইকে প্রয়োজন ছিলো। উনার নম্বরটা…”

বাদশা বাবু কথা শেষ করতে পারলেন না। ভাইয়া এসে থানায় ঢুকলো। ব্যস্ত গলায় বললো, ” একটু কাজ ছিলো। দেরি হওয়ার জন্য দুঃখিত। ”

” সমস্যা নেই। খুব বেশি দেরি হয়নি। ”

” আচ্ছা। বাবার খু’নিকে পাওয়া গেছে? কোথায় সে?”

” আপনি!”

” কিহ্? কি বলছেন এসব? মাথা খারাপ হয়ে গেছে আপনার!”

” ফাহাদ সাহেব অযথা উত্তেজিত হচ্ছেন। আমি তো মজা করেছি। ”

ভাইয়াসহ সকলে বাদশার দিকে তাকালো। বাদশা বাবু মুচকি হেসে বললেন, ” এভাবে দেখার কিছু নেই। কখনো কখনো অপরাধীদের মনকে শান্ত করতে এসব কথা বলে ফেলি। কয়েক মুহুর্তের জন্য তাদের অন্তরকে প্রশান্তি দেওয়া। কাজের কথা শুরু করি। হাবু মিয়া মেয়েটিকে নিয়ে এসো। ”

হাবু মিয়া থানার বাইরে চলে গেলেন। কয়েক মিনিট পর একজন মেয়েকে সাথে নিয়ে ফিরলেন। মেয়েটার গলায় ওড়না পেঁচানো। ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক, চোখে গাড় করে কাজল দেওয়া। চোখে-মুখে বিষন্নতার ছাপ।

” এই মেয়েকে কেউ চেনেন? ”

না সূচক মাথা নাড়লাম। ভাবীও আমার সঙ্গে তাল মেলালো। ফুফু আর কাকা দু’জন দু’জনের দিকে চাওয়াচাওয়ি করছে। ভাইয়া হতভম্ব হয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে।

” ফাহাদ সাহেব, আপনি উনাকে চেনেন?”

” হ্যাঁ। তুলি। ”

ভাবী আড়চোখে ভাইয়ার দিকে তাকালো। চোখ দুটো ছলছল করছে। সামান্য ব্যাপারে কান্নার কি আছে!

” উনার সঙ্গে কি সম্পর্ক আপনার?”

” জানি না। তবে ওকে বিয়ে করার স্বপ্ন দেখতাম। বেশ কিছুদিন হলো ওর সঙ্গে যোগাযোগ নেই। হারিয়ে গেছিল। ”

” তা-ও ভালো। আপনি সত্যিটা স্বীকার করে নিলেন। অন্যকেউ কি চেনেন? মনিরা সাহেবা আপনি কি উনাকে চেনেন?”

” না, শহরের মেয়েকে আমি কি ভাবে চিনবো?”

” আচ্ছা। তুলি তুমি কি এদেরকে চেনো?”

তুলি জিহবা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে তরল গলায় বললো, ” হ্যাঁ। যে রাতে মনির চৌধুরীকে খু’ন করতে গেছিলাম সেদিন উনাদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। বয়স্ক দু’জনের সাথে।”

চোখ বড় বড় করে মেয়েটির দিকে তাকালাম। বাবার সঙ্গে এই মেয়ের কি সম্পর্ক? একে তো আগে-পরে কখনো দেখিনি। ভাইয়াই বা তুলিকে কেমন করে চেনেন?

” এখন কি বলবেন? ”

ফুফু দাঁত বের করে হাসতে লাগলো। তাচ্ছিল্যের সুরে বললো, ” বয়স হচ্ছে, কাকে কোথায় দেখেছি ওতো কথা কি মনে থাকে?”

” না তা বলছি না। কিন্তু আপনারা দু’জনে খু’নের রাতে এই শহরে ছিলেন। মিথ্যা বলেছিলেন কেন?”

” ভয়ে বলেছি বাবা। গ্রামের মানুষ এসব ঝামেলায় জড়াতে চাইনি। ”

” সত্যি কথা বলুন। ”

” হ্যাঁ, ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এসেছিলাম। ওর লা’শ দেখে ভয় পেয়ে পালিয়ে এসেছি। ”

” মিথ্যা বলছেন। দয়া করে সত্যিটা বলুন। ”

” সত্যি কথা বলছি, একদম সত্যি কথা। ”

” নাহ্, আপনারা মিথ্যা বলছেন। আমি না হয় সত্যিটা বলে দিই। কি বলেন আপনারা? ”

” কি সত্যি? ”

” রঞ্জু সাহেব অস্থির হবেন না। তুলি তুমিই না হয় প্রথমে শুরু করো। ”

তুলি একটা চেয়ার টেনে বসে পড়লো। টেবিলের উপর দিয়ে পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পানি খেয়ে বলতে আরম্ভ করলো,
” সেদিন রাতে মনির সাহেবকে খু’ন করার জন্য উনার বাড়িতে গেছিলাম। অনেক কষ্ট উনার সন্ধান পেয়েছিলাম। বাড়িতে ঢোকার সময় দেখি উনার দু’জন পা টিপেটিপে পালিয়ে যাচ্ছে। আমায় দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। ভীতু গলায় বললো, ‘ ভুলে অন্য বাড়িতে চলে গেছিলাম। পথ হারিয়ে ফেলেছি, আসলে গ্রামের মানুষ তো। শহরের রাস্তাঘাট চিনি না। ”

” ঠিক আছে সমস্যা নেই। ”

আমার কথা শুনে উনারা ছুটে পালালো। দৌড়ে গিয়ে রিকশায় উঠলো। মনে হয় চুরি করতে এসেছিল। উনাদের দিকে মন না দিয়ে নিজের কাজে মন দিলাম। পা টিপেটিপে সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দরজা খোলা ছিল। সময় নষ্ট না করে মনির সাহেবের ঘরে চলে গেলাম। ফাহাদের কাছে থেকে উনার ঘরের লোকেশন আগেই জেনে রেখেছি। ঘরে গিয়ে দেখলাম উনি বিছানায় পড়ে আছেন। নিঃশ্বাস চলছে না। প্রচন্ড রাগ হতে শুরু করলো। টেবিলের উপর রাখা ছুরি দিয়ে উনার সমস্ত শরীর ছি’ন্নভি’ন্ন করতে লাগলাম। শরীর তখনও গরম, সদ্য মা’রা গেছে। ক্ষ’ত থেকে র’ক্ত পড়তে লাগলো। কিছুক্ষণ পৈ’শা’চি’ক আনন্দ উপভোগ করে ওখান থেকে পালিয়ে এলাম। বাড়ির কেউ কিছু জানতেও পারলো না। ”

” তাহলে বাবাকে কে মে’রে’ছে?”

” আপনার ফুফু আর কাকা। ”

” না এসব মিথ্যে কথা। আমরা কাউকে মা’রি’নি। আমাদের উপর দোষ চাপানো হচ্ছে। ”

কাকা মিনতি করতে লাগলেও ফুফু দমে যায়নি। কর্কশ গলায় বললো, ” আপনাদের কাছে কি প্রমাণ আছে? বিনা কারণে এমন করছেন কেন? গ্রামের সহজ-সরল মানুষ পেয়ে আমাদের উপর দোষ চাপাচ্ছেন আপনারা। ”

বাদশা বাবু মুচকি হাসলো। ফুফুর দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো, ” আপনাকে দেখে সহজ-সরল মানুষ মনে হচ্ছে না। সেজন্য আপনার উপর দোষ চাপাচ্ছি। তাছাড়া বিনা প্রমাণে দোষ চাপালে তো আমাকে চৌদ্দ শিকের ভাত খাওয়াবেন। ”

” বাদশা বাবু হেয়ালি করবেন না। পরিষ্কার করে বলুন। তুলির সঙ্গে বাবার কি সম্পর্ক? বাবা তো তুলিকে চিনতেন না। ফুফু আর কাকা কেন বাবাকে খু’ন করেছে?”

” সবকিছু বলবো বলেই আপনাদের এখানে ডেকে এনেছি। ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করুন। ”

ভাইয়া ডান দিকে মাথা কাত করে সম্মতি জানালো। বাদশা বাবু এসব কোথা থেকে জানলেন? সবকিছু অদ্ভুতভাবে এক জায়গায় করা হয়েছে। আস্তে সবকিছু পরিষ্কার হয়ে যাবে। ২৪-২৫ বছরের তরুনীর সঙ্গে ৬৫ বছরের বৃদ্ধর এমন কি সম্পর্ক থাকতে পারে?

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here