দোলনচাঁপা পর্ব ১১

0
71

#দোনলচাঁপা
কলমে : #ফারহানা_কবীর_মানাল
পার্ট -১১

বলতে বলতে কারেন্ট চলে গেল। মোবাইলের আলোয় ড্রয়ার থেকে মোমবাতি বের করলাম।আজ মোমের আলোয় চিঠি লিখবো।

রিপা,
প্রিয় বলে সম্মোধন করার অধিকার আমার নেই। এ অধিকার চাইতে পারি না, ভয় হয়। কেন এমন অনুভূতি? কিসের সম্পর্ক আমাদের? জানা নেই। তবে তোমায় আপন ভাবতে ইচ্ছে করে, ভীষণ আপন। জানতে চাও কেমন? তবে শোনো দিশেহারা বিপদের দিনে জড়িয়ে ধরার মতো। যাকে জড়িয়ে ধরলে শত শত চিন্তা ভুলে থাকা যায়। যার স্পর্শ জাদুকরী মলমের কাজ করে।

এতটুকু লিখে কাগজ টেনে ছিঁড়ে ফেললাম। রিপার উদ্দেশ্যে প্রেমপত্র লেখার ইচ্ছে নেই, তাহলে এসব লিখছি কেন? এগুলো তো আমার মনের কথা নয়। এ প্রশ্নের উত্তর জানা নেই। পৃষ্ঠা উল্টে পুনরায় লিখতে আরম্ভ করলাম।

রিপা,
সেদিন আমার কথা শেষ হয়নি। তাড়াহুড়ায় সম্পূর্ণ ঘটনা বলতে পারিনি। আজ বলবো। জানো রিপা? আমার বাবা মা’রা যায়নি। উনাকে মে’রে ফেলা হয়েছিল, বি’ষের সাহায্য। খুব সর্তকভাবে বি’ষ দেওয়া হতো। বহুদিন ধরে একটু একটু করে বি’ষ দেওয়া হতো। এভাব বাবাকে মৃ’ত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিল। কে মে’রেছিল জানো? মনির চৌধুরী। হ্যাঁ, তুমি ঠিকই পড়ছো। মনির চৌধুরী। লোকটার নজর ছিলো মা’য়ের দিকে। মেলায় ঘোরার দিন বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচতে উনার গুদামঘরে আশ্রয় নিয়েছিলাম। সেখানেই প্রথম দেখা। প্রথম দেখায় মা’য়ের রূপে মুগ্ধ হয়ে গেছিলেন। বলা বাহুল্য মা সুন্দরী ছিলেন। মায়ের চোখজোড়া অসম্ভব সুন্দর। সে-ই চোখের মায়ায় পড়েছিলেন লোকটা, সেজন্যই তো বাবাকে হারালাম। মা’কে অনেক সময় অনেক রকমের প্রস্তাব দিয়েছে। বাবাকে ছেড়ে উনার কাছে চলে আসার জন্য অনুরোধ করেছে বহুবার। মা কখনো রাজি হয়নি। বাবাকেও জানিয়েছে। বাবা বিশ্বাস করতেন না। চাপা হেসে বলতেন, ” মনির অমন ফাজলামো করে, তুমি কিছু মনে করো না। আমি ওকে বলে দেবো। ”

লোকটা মা’য়ের প্রত্যাখান মেনে নিতে পারতেন না। বাঁকা চোখে মা’য়ের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। হিংসার বি’ষ অনেকদূর পর্যন্ত চলে গেছিলো। উনি শেষ পর্যন্ত বাবাকে মে’রে ফেলার পরিকল্পনা করেন। জানো কিভাবে? খাবার পানিতে আর্সেনিক মিশিয়ে। দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা। অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়। লোকটা শেষ পর্যন্ত নিজের কাজে সফল হলেন। বাবার মৃ’ত্যুর প্র’তি’শোধ নিতে উনাকে মে’রে ফেলতে চেয়েছি। চেষ্টাও করেছি। সফল হতে পারিনি। আফসোস!
রিপা, তুমি ভালো আছো তো? কেন যেন মনে হয় তুমি ভালো নেই। মনের মাঝে কোন কিছু চেপে রাখলে ভালো থাকা যায় না। আমিও ভালো ছিলাম না। মনের মাঝে লুকিয়ে রাখা কথাগুলো প্রতিনিয়ত ছু’রির ফলার মতো আ’ঘা’ত করতো। র’ক্তা’ক্ত হৃদয়ে গুমরে ম’র’তা’ম। আজ সে-ই কষ্ট থেকে মুক্তি পেলাম। শান্তি লাগছে, অনেক শান্তি।

যেদিন এই চিঠি হাতে পাবে সেদিনই আমাদের শেষ দেখা। সবার কাছ থেকে হারিয়ে যেতে চাই, বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। বসে থাকার সময় নেই। ভালো থাকবে, সবসময়!

ইতি,
রঞ্জু

চিঠিটা ভাজ করে বুক পকেটে লুকিয়ে রাখলাম। ভাবী দেখলে সমস্যা হবে। না জানি কখন ঘর পরিষ্কার করতে চলে আসে।

মেঘ কেটে গেছে, আকাশের বুকে তারা ফুটে উঠেছে। তারা দেখতে ইচ্ছে করছে। সবসময় নিজের ইচ্ছেকে গুরুত্ব দিতে নেই। মোমবাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করে ঘুমের অপেক্ষায়!

ফজরের আজান কানে আসতেই ঘুম ভাঙলো। চারিদিকে অন্ধকার। কিছুক্ষণে মধ্যে অন্ধকার কেটে যাবে। বাথরুম থেকে ওজু করে নামাজ পড়ে নিলাম। আজ নতুন জীবনের সূচনা। ভোরের আলো ফোটার আগে বেরিয়ে পড়তে হবে। রিপা কাছে চিঠি পৌঁছে দিয়ে বাস ধরবো। ফিরতে হবে শেকড়ের টানে!

এতো সকালে গাড়ি পাওয়া সহজ কথা নয়। চারদিকে আবছা অন্ধকার, পায়ে হেঁটে এগিয়ে যেতে লাগলাম। বেশ ভালো লাগছে। সকালবেলা হাটাহাটি করলে নাকি শরীর ভালো থাকে। রিপাদের বাড়ি পৌঁছুতে ঘন্টা খানেক সময় লাগলো। এতো তাড়াতাড়ি পৌঁছে যাব ভাবতেও পারিনি। বাড়ির ভেতর গিয়ে কি বলবো? ভাবী পাঠিয়েছে, না থাকলে কেন পাঠিয়েছে, কোন কাজে নানান কথা। এতো সকালে এখানে কেন এলাম সেই কারণ জানতে চাইবে।
ঝামেলা হয়ে গেল। রিপাকে কল দিয়ে বাড়ির বাইরে আসতে বললে ভালো হতো। কিন্তু মোবাইলে টাকা নেই। রিচার্জ করার সময় পাইনি

রিপাকে খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। বোধহয় শিউলি ফুল কুড়তে এসেছিল। ওদের বাড়ির সামনে মস্ত শিউলি গাছ, প্রতিদিন ভোরে গাছে তলাটা সাদা ফুলে ভরে থাকে। রিপা আমায় দেখে দৌড়ে এলো। উৎফুল্ল গলায় বললো, ” রঞ্জু সাহেব, সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছেন? ”

” তোমার কাছে এসেছি। ”

” বাবাহ! আমার কাছে? ভাবতেই অবাক লাগছে।”

” হ্যাঁ। সত্যি বলছি। তোমার কাছে এসেছি।”

” বিশেষ কিছু? ”

পকেট থেকে চিঠিখানা বের করে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে তরল গলায় বললাম, ” না না।গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। তোমাকে এই চিঠিটা দিতে এলাম। শর্ত হলো আমার সামনে এটা খুলতে পারবে না। পড়তেও পারবে না। এমনকি অন্য কারো সামনে পড়া চলবে না। চিঠি খানা শুধুমাত্র তুমি পড়বে। ”

” চিঠিতে এমন কি লেখা আছে শুনি?”

” পড়লেই বুঝতে পারবে। তোমার হাত ওগুলো শিউলি ফুল নাকি?”

” হ্যাঁ। ফুলগুলো বেশ সুন্দর। কমলা রঙের বোটা, সাদা পাপড়িগুলো অদ্ভুত কোমল। মিষ্টি সুবাস। সবকিছু মিলিয়ে পছন্দ করার মতো। ”

” ওগুলো আমায় দেবে? ”

” হ্যাঁ, নিশ্চয়ই। কিন্তু এগুলো নিয়ে আপনি কি করবেন?”

” বুক পকেটে রেখে দেবো। তোমার কথা মনে পড়লে ওদের দেখবো। ওদের স্পর্শ করলে মনে হয় তোমায় স্পর্শ করছি। ”

রিপা কি বলবে বুঝতে পারছে না। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে। পায়ের আঙুল দিয়ে মাটিতে আঁচড় কাটার চেষ্টা করছে।

” কোন সমস্যা? ”

“না। কোন সমস্যা নেই। এগুলো আপনার কাছে রাখতে পারেন। ”

রিপা এগিয়ে এসে বুক পকেটে ফুলগুলো রেখে দিলো। হঠাৎ করে ওর হাত ধরতে ইচ্ছে হলো, নিজের ইচ্ছে গুরুত্ব দিয়ে ডান হাতটা চেপে ধরলাম। রিপার হাতের আঙুল থরথর করে কাঁপছে। মেয়েটা আমায় বড্ড ভালোবাসে। হাত ছেড়ে দিলাম। লজ্জিত মুখে বললাম, ” দুঃখিত। ”

রিপা এক মুহুর্ত দাঁড়ালো না। দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে গেল। এখন নিশ্চয়ই ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেবো। চিঠি খুলে পড়তে আরম্ভ করবে চিঠি পড়তে পড়তে অনুভূতিগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। রঞ্জুর মুচকি হাসলো। উল্টো ঘুরে হাঁটা শুরু করলো। রিকশা পেলে মন্দ হতো না।

রিপা ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। চিঠি খুলে পড়তে আরম্ভ করলো।
কিন্তু এসব কি লিখেছেন উনি! না না এমন চিঠি তো আমি চাইনি। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেলার শক্তি আমার নেই। রঞ্জু! এমন করলেন কেন? আমার অনুভূতিগুলো স্বপ্ন দেখিয়ে অন্ধকার কুঠুরিতে তালা বন্ধ করে দিলেন। কখনো ক্ষমা করতে পারবো না আপনাকে। কখনোই না।

রিপা চিঠিখানা ছিঁড়ে কুটিকুটি করে জালানা দিয়ে ফেলে দিলো। চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস নিয়ে আকাশের দিকে তাকালো। সূর্য উঠতে শুরু করেছে। চোখের পানি মুছে ফেলার উপযুক্ত সময়।

* * *

ফাহাদের মোবাইল বাজছে। তনিমা কাছেপিঠে নেই। রান্নাঘরে, রুটি বানাচ্ছে। ফাহাদ তখন ঘুমোচ্ছ, রিংটোনের শব্দ আড়মোড়া ভেঙে বিরক্ত গলায় বললো, ” তনিমা, দেখো না কে কল করেছে। ”

” কি হলো, মোবাইলটা বন্ধ করে রাখো। ”

চোখে খুলে দেখলো তনিমা ঘরে নেই। রুটি ভাজার মিষ্টি পোড়া গন্ধ নাকে লাগছে। ঘড়িতে সকাল সাতটা। এতো সকালে কার কি প্রয়োজন পড়লো? খোশগল্প করার জন্য কেউ এতো সকালে কল দেয় না। নম্বরটাও অপরিচিত। ফাহাদ কল ব্যাক করলো। দু’বার রিং হওয়ার পর কল রিসিভ হলো।

” হ্যালো, কে বলছেন?”

” আমি বাদশা। থানা থেকে। আপনার বাবার খু’নের কারণ জানতে পেরেছি। দয়া করে থানায় চলে আসবেন। ”

” জ্বি, আচ্ছা। কখন আসবো? ”

” যখন খুশি, সকাল দশটার দিকে চলে আসুন। ”

” ঠিক আছে। রঞ্জু সাহেব কোথায়? উনার মোবাইল বন্ধ। ”

” ঘরেরই আছে। হয়তো ফোনের চার্জ শেষ। ”

” আচ্ছা। সময় মতো চলে আসবেন।

কল কেটে গেল। ফাহাদের একবার মনে হলো ওদের ডেকে কথাগুলো জানালে মন্দ হতো না। পরক্ষণেই কি ভেবে তোয়ালে হাতে বাথরুমে চলে গেল।

সকাল দশটা। ফাহাদ থানায় বসে বাদশার জন্য অপেক্ষা করেছে। লোকটা এখনও আসেনি। একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। তনিমাকে এখানে আসার ব্যাপারে জানানো হয়নি। সকালের রান্না সেরে একগাদা কাপড় নিয়ে বাথরুমে ঢুকেছে। সারাদিন বসে ওসব কাপড় ধুয়ে রোদে শুকাবে। সামান্য মেঘের দেখা পেলেই কাপড় নিয়ে ঘরে চলে আসবে। রোদ উঠলে ছাঁদে মেলে দিয়ে আসবে। এসব করতে করতে ওর সময় কেটে যাবে।

” একি! ফাহাদ সাহেব একা এলেন যে? বাকিরা কোথায়?”

” রঞ্জুর শরীর খারাপ। দরজা লাগিয়ে ঘুমিয়ে আছে। তনিমা কাপড় কাচতে ব্যস্ত। ”

” অদ্ভুত ব্যাপার!”

” সত্যি বলতে ওদের জানানো হয়নি। চোখের সামনে পড়েনি কেউ। ”

” খু’নের কারণগুলো কি আমার মুখ থেকে শুনবেন নাকি উনাদের ডাকবো?”

” আপনিই বলুন। ওদের দেখতে ইচ্ছে করছে না। ”

” সেদিন রাতেই ওরা গ্রাম থেকে শহরে এসেছিল। জায়গাজমির ব্যাপারে। ওদের বাড়িটা আপনার বাবার নামে। ভদ্রলোক বেশ চতুর ছিলেন। কায়দা করে সমস্ত সম্পত্তি নিজের নামে করে নিয়েছিলেন। এসব নিয়ে ভাই-বোনদের মধ্যে তর্কাতর্কি শুরু হয়। তর্কের এক পর্যায়ে আপনার ফুফু উনাকে থা’প্প’ড় মা’রেন। এরপর শুরু হয় হাতাহাতি, হাতাহাতির এক পর্যায়ে উনাকে বালিশ চাপা দিয়ে হ’ত্যা করা হয়। দেখবেন নাকি?’

” কি দেখবো?”

” হাসালেন। আপনিই তো বলেছিলেন আপনার বাবার ঘরে ক্যামেরা লাগানো আছে। ”

” হ্যাঁ। বাবার কয়েকদিন ধরে সন্দেহ হচ্ছিল উনার ড্রয়ার থেকে টাকা-পয়সা চুরি হচ্ছে। রঞ্জুর উপর সন্দেহ ছিল। সেজন্য ক্যামেরা লাগাবেন বলেছিলেন। তবে কখন লাগিয়েছেন জানতাম না। ব্যাপারটা মনেও ছিলো না। ”

বাদশা বাবু মুচকি হাসলেন। ফাহাদের চোখ-মুখে হাসির ছিটেফোঁটা নেই।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here