দৃষ্টিনন্দনে তুমি পর্ব ১৯

0
407

#দৃষ্টিনন্দনে_তুমি
কলমে: লাবণ্য ইয়াসমিন
পর্ব:১৯

গোলনাহার বানুর হাত ধরে বসে আছে আরাফাত। অক্সিজেন দেওয়া আছে তবুও ভদ্রমহিলা ওর হাত ছাড়ছে না। আবির আর হৈমন্তী পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। সকালে ভদ্রমহিলার অবস্থা বিশেষ ভালো ছিল না। বারবার আরাফাতকে দেখতে চেয়েছিল তাই বাধ্য হয়ে আবির ওদের দুজনকে নিয়ে এসেছে। মোটামুটি ঝগড়া ঝামেলার অবসান ঘটেছে। রাজীব আসতে চেয়েছিল কিন্তু বিশেষ কাজ থাকার জন্য আসেনি। সময় করে আসবে। আরাফাত আসতে চাইছিল না হৈমন্তী বুঝিয়ে এনেছে। আসার পর থেকেই গোলনাহার বানু ওর হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে কান্নাকাটি করছে। বারবার ক্ষমা চাইছে। মহিতের এখনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। তার মধ্যেই আবার আরেক ঝামেলা এসে হাজির হয়েছে। জেলের মধ্যে রাসেল ভুলভাল বকছে। হয়তো মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। সারাদিন ঘুম খাওয়া বন্ধ করে অরনীর নাম জপে যাচ্ছে। ক্ষমা চাইছে।কখনও আবার নিজের চুল নিজেই ছিড়ছে। থানা থেকে পুলিশ ফোন করেছিল ওকে ডাক্তার দেখানোর জন্য আবেদন করতে। কিন্তু কেউ তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। জুলেখা কাজী দুই ছেলের শোকে পাথর তারপর আবার মায়ের এই অবস্থা সব মিলিয়ে উনি ঘর বন্দি জীবনযাপন করছেন। খাওয়া দাওয়া বন্ধ । হৈমন্তী চুপচাপ দাদি শাশুড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আবির ওর পাশেই আছে। হৈমী ফিসফিস করে আবিরকে বলল,

> রাসেল ভাইয়ার খোঁজ নিয়েছেন?

> প্রয়োজন নেই। যা করেছে এটাই ওর শাস্তি।

> আপনি জানতেন কিভাবে রাসেল ভাইয়া এসবের পেছনে আছে? একটু বলুন না শুনি।

>বাইরে চলো বলছি।

আবির হৈমন্তীর হাত ধরে বাইরে বেরিয়ে আসলো। হৈমন্তী অধির আগ্রহে অপেক্ষা করছে সবটা শোনার জন্য। আবির ওকে নিয়ে নিজের কেবিনে গিয়ে বসতে বসতে বলল,
> অরুনীর মৃত্যুর দিন হঠাৎ করেই রাসেল গায়েব হয়ে গিয়েছিল। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি। মাথায় ছিল না। আমি সন্দেহভাজন সবাইকে টেস্ট করেছি শুধুমাত্র ওকে ছাড়া। তারপর থেকে আমি বাড়ির সবাইকে প্রশ্ন করে জেনেছি ও সব সময় আমাদের বাড়িতে থাকতো। অরুনীর কাছাকাছি থাকতে দাদিজানের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক তৈরী করে। প্রথমে সন্দেহ না হলেও পরে আমি সন্দেহ করি। তারপর ও যখন বাড়িতে ফিরলো টেস্ট করে জেনে গেলাম। যতটা সহজে বলছি এতটা সহজ ছিল না। অনেক ঝামেলায় পড়তে হয়েছে। তাছাড়া মহিতের বিষয়ে আমি বেশ চিন্তিত। তোমাকে বলা হয়নি ওই ছেলেটার মাথার উপরেও ঝামেলা ঘুরছে। কয়েকদিন আগে একটা মেয়ের বডি পেয়েছে পুলিশ। মেয়েটাকে ওরা বন্ধুরা মিলে খুন করেছে। সেসব পুলিশের কাছে সাক্ষ্য প্রমাণ সহ জমা আছে।
হৈমন্তী ভ্রু কুচকে বলল,

> বিপদ জেনে ওকি পালিয়েছে? কোথায় যেতে পারে?

> আমি জানিনা কোথায় আছে। হয়তো পালিয়েছে নয়তো পুলিশের হাতে জিম্মি। যাইহোক ফুপির জন্য কষ্ট হচ্ছে। বেচারী তো বুঝতেই পারেনি নিজের ছেলের এই কর্মকাণ্ড।

> মহিত ভাইয়ার বিষয়ে কিভাবে জেনেছেন?

> রিপোর্ট তৈরী আমি করেছি। পুলিশের সঙ্গে এই বিষয়ে আমার কথাবার্তা হয়েছে। একটার পরে একটা খারাপ খবর আসছে। কিভাবে যে সবাইকে শক্ত রাখবো বুঝতে পারছি না। আর রফিক তোমাদের ওখানে বসে মজা নিচ্ছে। ছেলেটা এমন ছন্নছাড়া কিভাবে হলো কে জানে। আমাদের বংশে ওরকম মাথামোটা আর একটাও নেই। মাধ্যমিক ফেল শুধু একবার না। তিনবার পরীক্ষা দিয়েছে কোনো ফল হয়নি। এখন বখাটে ছেলেদের নিয়ে রাজনীতিতে নেমেছে। মাথা খারাপ করে দিচ্ছে। ভাবছি ভাইয়ার কাছে পাঠিয়ে দিব। কয়েক বছর বাইরে থাকলে যদি একটু মানুষ হয়।

আবির একদমে কথাগুলো বলে থামলো। হৈমন্তী মনোযোগ সহকারে শুনলো। লোকটা সবাইকে নিয়ে চিন্তা করে বিষয়টা ওর বেশ ভালো লাগলো। হৈমন্তীর হঠাৎ একটা কথা মনে পড়তেই ও ভ্রু কুচকে বলল,

> আচ্ছা বিয়ের আগের দিন রাতে রফিক ভাইয়াকে কে আটকে রেখেছিল সে খবর কি পাওয়া গেছে? কে করতে পারে এমন শত্রুতা?

আবির এবার নড়েচড়ে বসলো। ওর কপালে দুটো ভাজ পড়েছে হৈমন্তীর কথা শুনে। মেয়েটা কখন কি বলতে হয় জানেনা। আবিরকে চুপচাপ দেখে হৈমন্তী আবারও প্রশ্ন করলো। আবির এবার ভ্রু কচকে বলল,

> আফসোস হচ্ছে রফিকের জন্য? আহারে মাধ্যমিক ফেল মাজাই হাতছাড়া হলো।

হৈমন্তী ঠোঁট গোল করে বলল,

> বললাম কি আর উত্তর ‍দিচ্ছেন কি? সব কিছু সামনে আসছে তাই ভাবলাম এটাও সামনে আসবে। আফসোস তো প্রতিনিয়ত হচ্ছে। হিটলারের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে। কপালে এই ছিল।

আবির ক্ষুব্ধ হলো হৈমন্তীর কথা শুনে। মেয়েটা আফসোস করছে কতবড় সাহস। ও হাতের মুঠো শক্ত করে হৈমন্তীর হাতটা নিজের মুঠোয় নিয়ে বলল,

> সামনে বর বসে আছে তার দিকে মন দাও। আজেবাজে চিন্তা করলে পা ভেঙে ঘরে বসিয়ে রাখবো। ফাজিল মেয়ে,বরবের মাথা খারাপ করার চিন্তা করছো।

আবিরের ধমক শুনে হৈমন্তীর রাগ হলো। সাধারণ একটা কথা জিঙ্গাসা করেছে। এভাবে রিয়েক্ট করার কি আছে ও বুঝতে পারছে না। হৈমন্তী মুখ ভার করে উঠে আসতে গেলো কিন্তু পারলো না। আবির পেছনে থেকে আলগোছে ওর হাতটা ধরে নিয়ে নিজের বুকের সঙ্গে টেনে নিয়ে বলল,

> সরি রে বাবা, এমন আর হবে না। কিছু বিষয় না জানলেই ভালো হয়। তবুও যখন বলছো একদিন বলবো কিন্তু এখন না প্লিজ। আর রফিকের সঙ্গে একদম কথাবার্তা বলবে না। দেবরের সঙ্গে আলাপচারিতার কোনো দরকার নেই। তুমি শুধু বরের সঙ্গে কথা বলবে। যখন দরকার হবে ফোন করবে। আমি দ্রুত তোমাকে বাড়িতে নিয়ে আসবো।
হৈমন্তী মুখ ভেঙচি দিয়ে আবিরকে ছাড়িয়ে দিয়ে বলল,

>মনে হচ্ছে পৃথিবীতে বউ আপনার একার আছে। ঢঙ দেখলে বাঁচি না। লজ্জা শরমের মাথা আগেই খেয়ে ফেলেছেন।

> রঙ ঢঙ না করে যে উপাই নেই। একটামাত্র বউ আমার যদি পালিয়ে যায় কি হবে আমার? কাজী বাড়ির ছেলে আমি। বাবা জীবন থাকতে দ্বিতীয় বিয়ের অনুমতি দিবেন না।

হৈমন্তী মলিন মুখে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল,

> ধাপে চাপে মানিয়ে নিয়ে সংসার করে কাজ নেই। যদি ভালোবেসে বলেন তবেই আপনার সঙ্গে থাকবো তার আগে না। এমনিতেই ছোঁয়া আপু বলেছে আমাকে কেউ কখনও প্রপোজ করেনি,ভালোবাসার কথা বলেনি। আমি কারো যোগ্য না।

হৈমন্তীর কথা শুনে আবির ভ্রু কুচকে বলল,

> তোমার খালামনির মেয়েটা আস্তো পাজি। তুমি ওর আশেপাশেও থাকবে না। আমার বউকে ভুলভাল বুঝিয়েছে। ওকি জানে আমার বউ কতটা লক্ষ্মী।

হৈমন্তী উত্তর দিতে গেলো কিন্তু পারলো না। আরাফাত ফোন দিচ্ছে এখুনি যেতে হবে। হৈমন্তী আর অপেক্ষা করলো না। দ্রুত আবিরের থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
______________________
হালকা গোলাপি রঙের শাড়িতে নিজেকে দারুণভাবে সাজিয়ে নিয়েছে অরিন। যদিও শাড়ি পরতে চয়নিকা ওকে সাহায্য করেছে। মেয়েটা এমনিতেই সুন্দরী তারপর আবার শাড়ি পরেছে আরও সুন্দর লাগছে। আজ মাসুদের গায়েহলুদ। হৈমন্তী হলুদ রঙের গাউন পরেছে। মুখে তেমন প্রসাধনী নেই। হালকা সাজে ওকে বেশ লাগছে। অরিন চড়া করে ওষ্ঠে লিপস্টিক দিয়েছে। হৈমন্তী দেখলো আর মিষ্টি করে হাসলো। পরিচিত অপরিচিত অনেকেই এসেছে গায়েহলুদের অনুষ্ঠানে। মেয়েটা ঘুরঘুর করে একাজ ও কাজ করছে। আরাফাত বাঁকা চোখে দেখছে। মেয়েটার মতিগতি ওর সুবিধার লাগছে না। কি করতে চাইছে বোঝার চেষ্টা করছে। আমেনা বেগমের একটা আত্মীর ছেলে তমাল এসেছে সেই ছেলেটা জুটেছে অরিনের সঙ্গে। আঠার মতো চিপকে থাকার চেষ্টা করছে। মেয়েটাও পাত্তা দিচ্ছে। হেঁসে হেঁসে কথাবার্তা বলছে । এটা দেখেই রাগে বোম হচ্ছে আরাফাত। ওদের বাড়ির মেয়ে বউরা বাইরের লোকদের সঙ্গে এভাবে কথাবার্তা বলে না। আরাফাত ওর আশেপাশে থাকার চেষ্টা করছে। অরিন দেখতে কিন্তু প্রতিক্রিয়া করছে না। নিজের মতোই আছে। গায়ে হলুদের মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে তমাল অরিনকে বলল,
> সেলফি তুলবেন আমার সঙ্গে?
অরিন মিষ্টি হেসে মাথা নাড়িয়ে সাড়া দিতেই ছেলেটা ফোন বের করে যেই ক‍্যামেরা অপেন করলো তখনই আরাফাত এসে হাজির। দুজনে মাঝখানে দাঁড়িয়ে দাঁতে দাঁত চেপে অরিনর কানে ফিসফিস করে বলল,

> আম্মা দেখলে কিন্তু আস্ত রাখবে না। কি সব বাচ্চাদের মতো কাজকর্ম করছো?

অরিন সরল মুখ করে বলল;

> কি করেছি আমি? তমাল বলল একটা সেলফি উঠবে আমার সঙ্গে। আসলে আমাকে খুব সুন্দরী লাগছে কিনা।

অরিনের বোকাবোকা কথা শুনে আরাফাত ওর পা থেকে মাথা পযর্ন্ত চোখ বুলিয়ে বলল,
> কে বলেছে তোমাকে এসব আজগুবি কথাবার্তা? আয়না দেখেছো একবার? পেত্নীর মতো ভয়ংকর লাগছে। যাও চেঞ্জ করে ড্রেস পরে আসো। যতসব পাগলের কারখানা।

আরাফাত ভয়ংকর ভাবে মুখ বেঁকিয়ে কথাগুলো বলে চলে গেলো। ও যেতেই অরিনের চোখ ফেঁটে পানি এলো। এতো যত্ন নিয়ে নিজকে সাজিয়ে তুলল আর আরাফাত ওকে পেত্নী বলল অরিন মানতে পারছে না। ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। প্রিয়জনের থেকে প্রশংসা শুনতে কার না ভালোলাগে কিন্তু যদি সে প্রশংসার বদলে এমন খারাপ কথা বলে তখন তার মনের অবস্থা কেমন হতে পারে। অরিন কোনো সান্ত্বনা পেলো না। ওর মনে হলো অরুণীর মতো নিজেকে শেষ করে দিতে। বেঁচে থেকে লাভের লাভ তো কিছুই হচ্ছে না। বেঁচে থাকতে কদর না কারলেও মারা যাওয়ার পরে ঠিকই কদর বাড়বে। কথাটা ভেবে ও এক দৌড়ে রুমে গিয়ে গায়ের শাড়িটা টান দিয়ে খুলে ফেলল। একে একে গায়ের গহনাও ফেলে দিয়ে সোজা বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো।

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here