তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি লেখক-এ রহমান পর্ব ৯

0
1146

#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৯

‘তোর শেষ ভুলের শাস্তি’ কথাটা বার বার প্রতিধ্বনি হয়ে ঈশার কানে বাড়ি খেতে লাগলো। ঝমঝম শব্দে বৃষ্টি বেগ বাড়াল। নিরব দৃষ্টি ইভানের দিকে স্থির। মানুষটা ভাব্লেশহীন ভাবে দাড়িয়ে আছে। চারিদিকে এতো পানি তবুও তৃষ্ণা বেড়েই চলেছে ঈশার। তাহলে ইভান এখন কি করতে চাইছে? ‘বিয়ে’? না না এটা কিভাবে সম্ভব? এই মানুষটার সাথে ঈশা কিভাবে সারাজীবন কাটাবে। অস্থির ভাবে শ্বাস ফেলছে ঈশা। ইভান তাকে এভাবে দেখে বিচলিত হয়ে গেলো। অস্থির ভাবে বলল
–কি হল জান? শরীর খারাপ লাগছে?

ঈশা ইভানের দিকে অসহায়ের দৃষ্টিতে তাকায়। ইভান শান্ত ভাবে বলে
–অনেক দেরি হয়ে গেছে। চল।

ঈশা আবারো কেঁপে উঠলো। ইভান ঈশার হাত ধরে তাকে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে বলল
–এতো ভিজলে এবার অসুস্থ হয়ে যাবি। আমি তোকে জেনে শুনে কিভাবে অসুস্থ হতে দেই বল।

বলেই নিজে গাড়িতে উঠে বসলো। ঈশার সিটবেল্ট বেধে দিলো। ঈশা চুপচাপ বসে বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে। ইভান গাড়ি ড্রাইভ করতে শুরু করলো। ঈশা ধরেই নিয়েছে ইভান তাকে কাজি অফিসে নিয়ে যাবে। কারন সে যা বলে তাই করে। আর এবার তার ব্যতিক্রম হবে না। কিন্তু ঈশাকে অবাক করে দিয়ে ইভান বাড়ির দিকে নিয়ে গেলো তাকে। কিছুক্ষন ড্রাইভ করার পর তারা বাড়িতে এসে পৌছাল। ঈশা যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে বাড়িতে এসেছে। এদিক সেদিক তাকিয়ে দেখছে।
–নাম।

ইভান কঠিন গলায় বলতেই ঈশা গাড়ি থেকে নেমে গেলো। ইভান নেমে দাঁড়ালো। ঈশা দ্রুত পায়ে বাড়ির দিকে যাওয়ার আগেই ইভান তার হাত টেনে ধরল। হাত টেনে কাছে এনে চোখে চোখ রেখে বলল
–কি ভেবেছিলি সারাজীবনের জন্য তোকে জোর করে বেধে রাখবো। আমি তো তোকে জোর করতে চাই না জান। যা করেছি সেটা কোন ভুল ছিল না। তুই কখনও না কখনও অবশ্যই সত্যিটা জানতে পারবি। আমি নিজের সাফাই দিচ্ছি না। একটা কথা বলি মনে রাখিস সব সময়। কাউকে তোর উপরে জোর করতে দিস না। আর নিজের মনের উপরে জোর করিস না। যা সিদ্ধান্ত নিবি একদম ভেবে সিধান্ত নিবি। ভুল কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে জীবনটাকে এলোমেলো করে ফেলিস না।

ঈশা মনোযোগ দিয়ে শুনল। কিন্তু কেন বলল এসব কথা সেটা বুঝতে পারল না। ঈশার হাত টেনে আংটিটার দিকে তাকিয়ে বলল
–এটা তোর কাছে শিকলের মতো তাই না জান?

ঈশা তাকাল ইভানের দিকে। ইভান আংটির দিকেই তাকিয়ে আছে। হঠাৎ এক টানে সেটা খুলে ফেলে ঈশাকে দূরে ঠেলে দিলো। খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল
–তুই মুক্ত আজ থেকে। এই শিকল আর তোকে জড়িয়ে রাখবে না। আমার ভালবাসার অধিকার নামক যন্ত্রণা থেকে তোকে একবারেই মুক্তি দিলাম জান। আর কোন বাধা কোন পিছুটান থাকল না তোর।

ঈশা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। ইভান একটু হেসে বলল
–সেই দিনের পর থেকে তোর চঞ্চলতা তোর হাসি সব কেড়ে নিয়েছিলাম। কিন্তু আজ সেই সব কিছু ফেরত দিতে চাই। আমি তোকে মুক্ত করে দিলাম ঠিকই কিন্তু বিনিময়ে তোর কাছে কিছু চাই।

ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। সে কি চায় সেটা জানতে চায় ঈশা। ইভান আবারো বলল
–তুই একদম আগের মতো হয়ে যাবি। আমার আগের ঈশা। হাসি, ঠাট্টা, খুনসুটি সবটা ঠিক আগের মতো।

ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান হতাশ হয়ে বলল
–আমি চলে যাচ্ছি ঈশা। লন্ডনে। কাল সকালে আমার ফ্লাইট। তোর সাথে আর দেখা হবে না। ভালো থাকিস। আমার ইচ্ছাটা পুরন করবি না?

ঈশা মাথা নাড়াল। ইভান তাকে ভিতরে যেতে ইশারা করলো। ঈশা ভিতরে যেতে নিলেই ইভান আবার বলে উঠলো
–যাওয়ার আগে একবার কথা বলবি না আমার সাথে?

ঈশা পিছনে ঘুরে দাঁড়ালো। ইভানের দিকে তাকিয়ে বলল
–আমি ভালো থাকবো। তুমিও ভালো থেকো।

–‘ভালো থেকো’ বলাটা খুব সহজ কিন্তু সেটার কারন হয়ে সারাজীবন থাকাটা অনেক কঠিন। আমার ভালো থাকার দিন শেষ ঈশা।

বলেই গাড়িতে উঠে বসলো ইভান। ইভানের শেষ কথাটা ঈশার খুব খারাপ লাগলো। কিন্তু কোথাও একটা ভাললাগা কাজ করছে। মুক্ত হওয়ার ভাললাগা। ঈশা দ্রুত পায়ে বাড়ির ভেতরে ঢুকল। তার মা টেবিলে খাবার দিচ্ছিলেন। ঈশাকে ঢুকতে দেখে তার দিকে বড় বড় চোখে তাকাল।
–এতো ভিজলি কি করে?

ঈশা থমকে দাঁড়ালো। এতো কিছুর মাঝে ভেজার কথাটা মাথাতেই নেই। মায়ের দিকে তাকিয়ে দাত কেলিয়ে বলল
–ওই গাড়ি থেকে নেমে আসতেই ভিজে গেছি।

–এতোটুকু রাস্তা আসতেই এতো ভিজে গেলি?

তার মা সন্দিহান চোখে তাকাল। ঈশা বুঝতে পারছে পরিস্থিতি বেগতিক হতে যাচ্ছে। এখান থেকে তাড়াতাড়ি কেটে পড়তে হবে। তাই বিরক্ত নিয়ে বলল
–আমার ঠাণ্ডা লাগছে তো। এরপর অসুস্থ হয়ে যাব।

বলেই দ্রুত পায়ে ঘরে ঢুকে গেলো। নিজের সমস্ত কাপড় পালটে নিলো। মাথার চুল ঠিক মতো মুছে নিলো। নিয়েই বের হয়ে এলো ঘর থেকে। কারও দিকে না তাকিয়েই একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল
–তাড়াতাড়ি খেতে দাও। ক্ষুধা পেয়েছে।

ঈশার গলার সর শুনে তার বাবা তার দিকে তাকাল। ঠাণ্ডা সরে জিজ্ঞেস করলো
–ঈশা আজ না একটা অপারেশন ছিল? কেমন হয়েছে?

ঈশা মুখে খাবার নিয়েই বলল
–ভালো হয়েছে আব্বু। এখনও সুস্থ না তবে টেনশন করার মতো কিছু নেই।

–ইভান তো মনে হয় কাল সকালে চলে যাচ্ছে।

আশরাফ সাহেব খাবার মুখে তুলতে তুলতে কথাটা বললেন। ঈশা খাওয়া বন্ধ করে দিলো। খুব শান্ত ভাবে ‘হুম’ বলল। ঈশার মা একটু চেচিয়ে বলল
–কোথায় যাচ্ছে?

–লন্ডন।

আশারাফ সাহেব বললেন। ঈশা হাতে থাকা খাবারটা মুখে পুরে দিতেই তার মা আবারো জিজ্ঞেস করলেন
–কবে আসবে?

ঈশার বাবা খাবার বন্ধ করে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা মুখে খাবার ধরে আছে। তিনি গম্ভির গলায় বললেন
–তোমার মেয়ে সব জানে। তার কাছে শুনে নাও।

ঈশার গলায় খাবার আটকে গেলো। সে পানি খেয়ে একটু বসে থাকল। তার বাবার এমন কথা বলার ধরনটা ঈশার কেমন খটকা লাগছে। তাহলে কি তিনি সব জানেন? নিশ্চয় ইভান তার বাসায় বলেছে আর সেটা আঙ্কেল তার বাবাকে বলেছে। ঈশার ইভানের উপরে খুব রাগ হল। জীবন থেকে চলে গিয়েও মুক্তি দিলনা। যন্ত্রণা করেই যাচ্ছে।

————-
ঈশা রাতের বেলা বারান্দায় দাড়িয়ে চা খাচ্ছিল। বেশ ফুরফুরে বাতাস বইছে। এলোমেলো চুল আনমনে উড়েই যাচ্ছে। সামনের দিকে চোখ পড়তেই দেখল ইভানের গাড়ি ঢুকছে। ঈশাদের বাড়ির একদম সামনে রাস্তার অপরপাশের বাড়িতেই ইভানরা থাকে। ইভান গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির ভিতরে গেলো। বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছে তাকে। বেশ কিছুক্ষন পর ইভানের ঘরের লাইট অন হল। ঈশা উকি ঝুকি দিয়ে ইভান কে দেখার চেষ্টা করছে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে না। সামনের জানালার কাঁচটা টেনে দেয়া। ইভান সেখানে দাড়িয়েই ঈশাকে দেখছে। এখানে দাড়িয়েই মাঝ রাত অব্দি সে ঈশাকে দেখত। কিন্তু কালো থাই গ্লাস ভেদ করে ঈশা কিছুই দেখতে পেতনা। ঈশা অনেকদিন বারান্দায় আসেনি। আজ হঠাৎ করেই তাকে বারান্দায় দেখে কিছুক্ষনের জন্য ইভান থেমে গেলো। কিন্তু আবার পরক্ষনেই কিছু একটা ভেবে জানালার পর্দা টেনে দিলো। একটু হেসে বলল
-তোর নামের কোন অভ্যেস আমি আর করতে চাইনা।

বলেই ওয়াশ রুমে চলে গেলো। বের হয়ে এসে বারান্দার দরজাটা আটকে রুমের লাইট অফ করে দিলো। লাইট অফ হতেই ঈশার মনটা কেমন খারাপ হয়ে গেলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরে চলে এলো। টেবিলে কাপটা রাখার সময় হাতে চোখ পড়লো। এতদিন আংটিটা ছিল কেমন গুমোট লাগত সব কিছু। এলোমেলো লাগত। কিন্তু আজ অনেকটাই ভালো লাগছে। নিজেকে মুক্ত লাগছে। ঈশা সব কিছু ঠিক করে নিয়ে শুয়ে পড়লো। বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করলো কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসছিল না। এদিক সেদিক করেই রাতটা পার করে দিলো সে। খুব ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে গেলো তার। পাশ হাতড়িয়ে ফোনটা খুজে তাতে সময়টা দেখে নিলো। উঠে বসে চোখ ডলে ঘুম কাটিয়ে ওয়াশ রুমে গেলো। অজু করে ওয়াশ রুম থেকে বের হল। নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষ করে আবার বারান্দায় দাঁড়ানোর জন্য দরজাটা খুলতেই চোখে পড়লো ইভান তার বারান্দায় একটা টুলে বসে আরেক টুলে পা দিয়ে চা খাচ্ছে। কেবল মাত্র ভোরের আলো ফুটেছে। এই সময় ইভান বারান্দায় মানে বোঝা যাচ্ছে সে রাতে ঘুমায় নি। তাহলে রাতে ওভাবে লাইট আর দরজা বন্ধ করে দেয়ার মানে কি? মনের মাঝে হালকা অভিমান ভর করলো। একটু ভেবে আর বারান্দায় দাঁড়ালো না। আধ খোলা দরজাটা বন্ধ করে দিলো। বিছানায় বসে ফেসবুকের নিউজ ফিড স্ক্রল করতে লাগলো। হঠাৎ করেই একটা ছবিতে চোখ আটকে গেলো তার। একটা বাচ্চার ট্রিটমেন্টের জন্য তার মা সাহায্যের আবেদন জানিয়েছে। বাচ্চাটা অনেক ছোট। এক বছর বয়স হয়েছে কিনা কে জানে। বাচ্চাটা লিউকোমিয়ায় আক্রান্ত। তার ব্লাড গ্রুপ রেয়ার। তাই ব্লাড ম্যানেজ করে দিতে হবে। সেখানে ফোন নাম্বার সহ দেয়া আছে। ঈশা ফোনটা হাতে নিলো। নাম্বারটা টুকে নিয়ে ফোন করলো সেই নাম্বারে। প্রথমবার রিং হয়ে কেউ ধরল না। পরের বার রিং হতেই এক মহিলা ধরল। ওপাশ থেকে গম্ভির গলায় মহিলা ‘হ্যালো’ বলেতেই ঈশা ছোট্ট করে নিজের পরিচয় দিলো।
–আমি ডক্টর ঈশা। আপনার বাচ্চার ব্লাড এর জন্য আপনি যে পোস্ট দিয়েছিলেন সেটা নিয়ে একটু কথা বলতে চাই।

মহিলাটা উতফুল্য হয়ে বলল
–জি জি অবশ্যই।

ঈশা মহিলার কণ্ঠের আকুলতা বুঝতে পারল। বড় করে শ্বাস টেনে বলল
–আমাদের মেডিকেল টিম থেকে আমরা আপনাদের হেল্প করতে চাই। যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আপনাদের বাড়ির ঠিকানাটা দিতেন। আমরা গিয়ে দেখা করে আসতাম।

মহিলাটি হন্তদন্ত হয়ে তার বাড়ির ঠিকানা দিলেন। ঈশা তার বন্ধুদের ফোন করে জানিয়ে দিলো সব কিছু। সবাই মিলে ঠিক করলো তারা সেই মহিলার বাড়িতে যাবে। ঈশা তাড়াতাড়ি করে নাস্তা করছে। তাকে বের হয়ে সেই মহিলার বাড়িতে যেতে হবে আবার সেখান থেকে ক্লাসে যেতে হবে। খাবারটা মুখে তুলতেই তার ফোনে একটা মেসেজ আসল। সে খাবার চিবুতে চিবুতেই মেসেজটা ওপেন করল।

~~ভেবেছিলাম ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় তোর মায়া ভরা মুখটা দেখে নিজের দু চোখ তৃপ্ত করে তারপর যাবো। সেই আশায় সারা রাত বারান্দায় বসে অপেক্ষা করছিলাম। ভোর বেলা ওড়না মাথায় দিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াবি। ওড়নার ফাকে ফাকে বেরিয়ে থাকা কয়েকটা চুল ভোরের হালকা বাতাসে উড়ে বেড়াবে। কিন্তু আফসোস সেই রুপ দেখার ভাগ্য আমার নেই। তোকে না দেখেই চলে যেতে হল। তোর প্রতি আমার কোন অভিযোগ নেই। নেই কোন অভিমান। শুধু নিজের প্রতি আছে করুণা। আমি আমার ভালবাসা তোকে বোঝাতে পারিনি। খুব ভালো থাকিস জান। সুখে থাকিস। আমার ভাগের সুখটাও তোর হোক। তোকে খুব ভালবাসি জান। নিজের থেকেও বেশী। সারাজীবন ভালবেসেই যাবো। তোর জন্য আমার মনের জায়গাটা কোনদিন পরিবর্তন হবে না।~~

চলবে………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here