তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি লেখক-এ রহমান পর্ব ৮

0
1148

#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ৮

জল কন্যা এখনো তার জলধারা নিয়ে নামেনি ধরনির বুকে। কিন্তু সে তার সমস্ত রাগ যেন ছুড়ে দিচ্ছে ধরণীতে। সেই রাগের আভাতেই ঝলকে ঝলকে উঠছে আশে পাশের আকাশ। গুড়ুম গুড়ুম শব্দে কাঁপছে চারিদিক। রেস্টুরেন্টের এক পাশের টেবিলে মাথা নিচু করে বসে আছে ঈশা। বেশ অপ্রস্তুত ভাবে হাত কচলাচ্ছে সে। সামনে ধোঁয়া উঠা কফির কাপ। আর তার ঠিক সামনে বসে আছে নিরব। ঈশা গাড়িতে বসে তখন নিরবের সাথেই ফোনে কথা বলছিল। নিরব তাকে ফোন করে কথা বলার জন্য ডাকে এখানে। ঈশাকে এভাবে বসে থাকতে দেখে নিরব বলল
–ঈশা।

চমকে তাকাল। পরক্ষনেই আবার নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। সে কিছুতেই নিরবের সাথে দৃষ্টি মেলাতে পারছে না। কিন্তু এক সময় এই মানুষটার চোখে চোখ রেখে কথা বলেছে। অনেক না বলা কথা ওই চোখে পড়েছে। আর আজ এক রাশ অপরাধ বোধ তার মাঝে কাজ করছে।
–তাকাও আমার দিকে ঈশা।

নিরবের শান্ত কথা কানে আসতেই ঈশার চোখ ছল ছল করে উঠলো। চোখের পাতা পিট পিট করে পানি আটকাবার চেষ্টা করলো। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়ে তাকাল তার দিকে। নিরব মলিন চোখে তাকিয়ে আছে। ওই চোখে হাজার প্রশ্ন। ঈশা গলা নামিয়ে বলল
–কিছু বলবে?

–বলতেই তো ডেকেছি।

নিরবের নিরলিপ্ত উত্তরে ঈশা তার দিকে তাকাল। কি বলতে চায় নিরব? নিরব হেসে বলল
–কবে বিয়ে করছ?

নিরবের কাছে বিয়ের কথাটা শুনে ঈশার খারাপ লাগলো। কি বলবে বুঝতে পারল না। সে তো এই বিয়ে করতে চায়নি। সে তো নিরব কে বিয়ে করতে চেয়েছিল। কিন্তু মাঝ পথে কিছু অনাখাঙ্খিত ঘটনা ঘটে যায়। যার ফলে আজ এই পরিস্থিতিতে তাকে দাড়াতে হয়েছে। ঈশা চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে নিয়ে বলল
–সরি নিরব। আমি তোমার সাথে অন্যায় করেছি।

নিরব শব্দ করে হাসল। হাসি থামিয়ে বলল
–অন্যায় টা কি ধরনের ঠিক?

ঈশা অসহায়ের মতো তার দিকে তাকাল। নিরব আবারো হেসে বলল
–আমার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছিলো। আর আমি জতদুর জানি তুমিও আমাকে পছন্দ করতে। তাহলে কি এমন হয়ে গেলো যে এঙ্গেজমেন্টের দিনে তোমার মনে হল যে তুমি ইভান কে ছাড়া বাচবে না। তাকে নিজের জীবনের থেকেও বেশী ভালোবাস। তার সাথেই নিজের জীবন জড়াতে চাও।

ঈশা এবার আর নিজেকে আটকাতে পারল না। চোখ বন্ধ করতেই দু ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো। কান্না জড়ানো কণ্ঠে বলল
–আমি জানি যা করেছি তার কোন ক্ষমা নেই। এই ভুলের সত্যিই কোন ক্ষমা হয়না। তবুও আমি তোমার কাছে নির্লজ্জের মতো ক্ষমা চাইছি। আমাকে মাফ করে দাও নিরব।

–আমি কারণটা জানতে চাই ঈশা। আমি জানি এমন তো কিছু আছে যা তুমি আমার কাছ থেকে লুকাচ্ছ। কারন অল্প কিছুদিন হলেও আমি তোমাকে ভালো করেই চিনেছি। আমার সাথে এঙ্গেজমেন্টের দিনে তুমি কতো খুশি ছিলে। সেটা আমার চোখ এড়ায় নি ঈশা। কি এমন হয়েছিলো যে তুমি হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলে। আর কিছু সময় পরে এসে বললে তুমি ইভান কে ভালোবাসো আর ওকেই বিয়ে করতে চাও। কিন্তু কেন?

–ইভান আমাকে বাধ্য করেছিলো বো……

–ঈশা তোমাকে কোন কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নয়।

আচমকা গলার আওয়াজ পেয়ে নিরব ঈশা দুজনি সেদিকে ঘুরে তাকায়। নিজের কথা শেষ করতে পারেনা ঈশা। ইভান রাগি চোখে তাকিয়ে আছে। নিরব উঠে দাড়ায়। ইভান কে দেখে বলে
–ইভান আমি আসলে শুধু জানতে চেয়েছিলাম ঈশা কেন এমন করলো আমার সাথে। তোমরা একে অপরকে ভালবাস সেটা তো আমাকে আগে জানালেই পারত। এভাবে অনুষ্ঠান করে অপমান করার তো কোন মানে ছিলোনা।

ইভানের রাগটা চরম ভাবে চেপে গেলো। রক্ত চোখে ঈশার দিকে একবার তাকাল। ওই চাহুনি দেখে ঈশা ভয়ে চুপসে গেলো। তারপর নিরবের দিকে তাকিয়ে দাতে দাত চেপে বলল
–তোমার কিছু জানার থাকলে সেটা আমাকে জিজ্ঞেস করবে। কারন ঈশার জীবনের সাথে এখন আমার জীবন জড়িয়ে গেছে। ওর সব কথার উত্তর আমার কাছে আছে। আর ও কার সাথে কথা বলবে আর কার সাথে বলবে না সেটা আমি ঠিক করবো। ঈশাকে দেখা করতে ডাকার আগে তোমার আমার কাছ থেকে পারমিশন নেয়া উচিত ছিল। আফটার অল শি ইজ মাই ফিওন্সি।

ঈশা কেঁপে উঠলো ইভানের কণ্ঠস্বর শুনে। এভাবে কথা বলা মানে অনেক কিছু হতে পারে এই মুহূর্তে। ইভান যে কোন ধরনের সিন ক্রিয়েট করতে পারে। ঈশা উঠে দাড়িয়ে ইভানের দিকে তাকিয়ে করুন সুরে বলল
–কোন সিন ক্রিয়েট করনা প্লিজ! আমরা ঠাণ্ডা মাথায় কথা বলব।

–জাস্ট শাট আপ! তোর সাথে তো আমি পরে কথা বলব।

দাতে দাত চেপে বলল ইভান। নিরবের দিকে তাকিয়ে আঙ্গুল তাক করে বলল
–ফারদার এরকম কিছু ঘটলে সেটা ভালো হবে না।

একটু হেসে নিরবের ঘাড়ে হাত রেখে বলল
–আর আমি জানি তোমার অনেক প্রশ্ন আছে। সেগুলর সব উত্তর তুমি আমার কাছে পাবে। অযথা আমার হবু বউকে যখন তখন ডেকে বিরক্ত করবে না। ইউ নো আই ডোন্ট লাইক ইট।

বলেই ঈশার হাত টেনে সেখান থেকে বের হয়ে এলো। গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজের ড্রাইভিং সিটে বসলো। খুব যত্নে ঈশার সিট বেল্ট বেধে দিলো। তারপর গাড়ি স্টার্ট দিলো। অনেক জোরে গাড়ি চালাচ্ছে ইভান। ঈশা বেশ ভয় পাচ্ছে। কোন কথা বলছে না সে। কিছুক্ষন পর ঈশা ইভানের দিকে তাকাল। ইভান বুঝতে পারল ঈশা তার দিকে তাকাচ্ছে। সে অনেক জোরে গাড়ি ব্রেক করলো। ঈশা ভয় পেয়ে গেলো। ইভান খুব শান্ত দৃষ্টিতে ঈশার দিকে তাকাল। ঈশা ইভানের ওভাবে তাকানর কারণটা বুঝতে পারল না। কৌতূহলী চোখে তাকিয়ে থাকল ইভানের দিকে। ইভান একটু হেসে ঈশার দিকে ঝুকে এসে বলল
–আমাকে এতো ভয় পাস কেন বলতো? আমি কি বাঘ না সিংহ যে তোকে খেয়ে ফেলব?

ঈশা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। ইভানের এতো শান্ত আচরন করার মানেটা তার কাছে স্পষ্ট না। ঈশাকে এভাবে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতে দেখে ইভান আবার বলল
–সারাটা জীবন আমাকে ভুল বুঝে আসলি। তোর কাছ থেকে এটাই কি আমার প্রাপ্য ছিল জান?

ইভানের কথা গুলো কেমন গোলমেলে। ঈশার বুঝতে খুব অসুবিধা হচ্ছে। ঈশাকে নিরবের সাথে দেখে ইভানের যতটা রিয়াক্ট করার কথা ছিল তার কিছুই করছে না সে। কিন্তু কেন? ইভান এমন বদলে গেলো কেন? ঈশা ইভান কে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বলল
–আমি আসলে যেতে চাইনি। নিরব আমাকে জোর করেছিলো।

–তোকে সবাই জোর করে জান। কি অদ্ভুত ভাগ্য তোর। দেখ আমার জোর করার কারনে আজ তুই আমার জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছিস।

ঈশা আবারো অবাক হল। এবার না চাইতেও জিজ্ঞেস করে ফেলল
–তুমি ঠিক আছো তো?

ইভান শব্দ করে হাসল। হাসি থামিয়ে বলল
–কতো দিন পর জানতে চাইলি আমি ঠিক আছি কিনা। এতদিনে তোর মনে হয়নি আমি ঠিক নাই?

ঈশা উত্তর দিলনা। সত্যিই এতদিনে তার একবারও মনে হয়নি যে ইভান খারাপ থাকতে পারে। কারন সে তো নিজে ভালো থাকার জন্য সবাইকে জোর করে।
–তাহলে সেই মানুষটা কিভাবে খারাপ থাকতে পারে তাই তো?

ঈশা অবাক হয়ে তাকাল। এই কথাটা সে মাত্রই ভেবছে। কিন্তু তার আগেই ইভান কিভাবে বুঝে গেলো? ইভান গাড়ির দরজা খুলে বলল
–বৃষ্টি হচ্ছে। ভিজবি?

ঈশা কোন কথা বলল না। ইভান তাকে গাড়ি থেকে বের করে আনল। সামনে দাড়া করাল। তারপর নিজে গাড়িতে হেলানি দিয়ে শান্ত ভাবে বলল
–আমি জানি তোর বৃষ্টি পছন্দ। আর আমার অনেক দিনের সখ ছিল তোর সাথে বৃষ্টিতে ভেজার। সেটাই পুরন করার ইচ্ছা মাত্র।

সব কিছু ঈশার মাথার উপর দিয়ে গেলো। ইভানের কথা তার আচরন আগা মাথা কিছুই বুঝতে পারছে না ঈশা। এবার ঝাঝাল কণ্ঠে ঈশা বলল
–তুমি পাগল হয়ে গেছ। এরকম আচরন করার মানে কি?

ইভান হাসল। হেলানি দিয়েই ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–আমি তোর জন্য পাগল। আর কেউ না জানুক কিন্তু তুই সেটা জানিস। আর থাকল এরকম অদ্ভুত আচরনের কথা! কি বলেছিলাম মনে আছে?

ঈশা ভ্রু কুচকে মনে করতে চেষ্টা করলো। অনেক কিছুই তো বলেছিল সে। ইভানের কোন কথাই সে মনে রাখতে চায়না। তাই কোন কথা বলছে সেটা বুঝতে পারছে না। ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেলল।
–দ্বিতীয় বার ভুল করলে কি হবে মনে পড়েছে?

ঈশা চোখ খুলে ফেলল। আঁতকে উঠলো। সত্যি এই বিষয়টা তার মাথায় ছিল না। কাপা কাপা গলায় বলল
–আমি করতে চাইনি। বিশ্বাস করো।

ঈশার এমন আকুতি শুনে ইভান শান্ত হয়ে বলল
–রিলাক্স জান! আমি তোকে বিশ্বাস করি। কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব তোকে সবাই নিজের মতো জোর করে আর তুই সেসবের স্বীকার হস? কেন? নিজের উপরে কোন কন্ট্রোল নাই তোর? যে যাই বলে তাই শুনিস? তুই কি মাদার তেরেসা যে সবার দায়িত্ব নিজের মাথায় নিয়ে রাখছিস? কেন? নিজেকে এতো সস্তা বানিয়ে রেখেছিস। কোন দাম দিস না কেন? তোর নিজের ইচ্ছার কোন দাম নাই?

ঈশা কঠিন গলায় বলল
–দাম দিয়েছ আমার ইচ্ছার?

–দেইনি বলেই তো আজ হিসাব করতে বসলাম। তোর সাথে অনেক হিসাব বাকি আছে আমার। জীবনের হিসাব। তোর সব কিছুর দাম আজ দিয়ে দেব।

ইভানের কথা শুনে ঈশা করুন চোখে তাকাল। চোখ বেয়ে দুই ফোটা পানিও পড়লো। বৃষ্টির পানিতে সেই পানি আলাদা করা সম্ভব না হলেও ইভানের চোখে ঠিকই ধরা পড়লো। ঈশা অসহায়ের মতো বলল
–আর কিসের হিসাব বাকি আছে?

–তোর শেষ ভুলের শাস্তি!

চলবে…………

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here