তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি লেখক-এ রহমান পর্ব ১১

0
1139

তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১১

আকাশ কালো মেঘে ঢেকে যাচ্ছে। গোধূলি বেলার গোলাপি আকাশে হঠাৎ করেই যেন সন্ধ্যের আভাষ। হঠাৎ এলোমেলো দমকা হাওয়া কোথা থেকে হানা দিলো। তীব্র গরমে আচ্ছাদিত তপ্ত পরিবেশটা আরামদায়ক হয়ে উঠলো। ঈশা আকাশের দিকে মুখ তুলে তাকাল। দু বাহু মেলে জল কন্যাকে আগমন জানানোর আগেই সে অঝোর ধারায় নেমে এলো। ফোটা ফোটা বৃষ্টি তার চোখে মুখে আছড়ে পড়লো। চোখটা বন্ধ করে ওভাবেই দাড়িয়ে থাকল। বৃষ্টির বেগ বাড়তে থাকল। সাথে ঝমঝম শব্দও। কানে এক অস্বাভাবিক মোহময় শব্দ আর মাটির সেই পরিচিত ঘ্রাণ এক মাতাল করা পরিবেশ তৈরি করেছে। বৃষ্টি বরাবরই ঈশার প্রিয়। আর আজ এমনিতেও তার মন খুব ভালো। এতদিন জমে থাকা মনের বোঝাটা আচমকাই যেন হালকা হয়ে গেলো। এক রাশ সুখে ভরা অনুভুতি খেলে গেলো মনের মাঝে। দু হাত মেলে আগমন জানালো সেই সুখের অনুভুতিকে। আচমকাই একটা হাত তার হাতের উপরে স্পর্শ করতেই চমকে চোখ জোড়া খুলে সেদিকে তাকাল। ইভান পাশে দাড়িয়ে তার হাতের উপরে হাত রেখে বৃষ্টির ফোটা ধরছে। ঈশা ইভানকে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–তুমি?

–অন্য কারও আসার কথা ছিল বুঝি?

হাতের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো ইভান। ঈশা হাত সরিয়ে নিলো। চাপা অভিমান খেলে গেলো। তিন দিন হল ইভানের সাথে তার দেখা হয়নি। ট্রেইনিং থেকে আসার পর পুরো হসপিটালের ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে তার উপরে। সেই সব কিছু ঠিক মতো গুছিয়ে নিতেই সে খুব ব্যস্ত ছিল। এই কয়দিনে দেখা তো দুরের কথা ঈশার সাথে কথাও হয়নি তার। ঈশার রাগ হল। একটু রাগ করে বলল
–এভাবে কেন কথা বল? একটু সহজ হতে পারনা?

ইভান হাতে জমে থাকা পানিগুলো ঈশার মুখে ছুড়ে মারল। চোখ বন্ধ করে ফেলল ঈশা । খানিকবাদেই চোখ খুলে দেখল ইভান অদ্ভুত ভাবে তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের পাতায় বৃষ্টির ফোটা টুপটুপ করে বাড়ি খাচ্ছে। সেই আঘাতে চোখের পাতা কাঁপলেও সে পুরোপুরি বন্ধ করছেনা। যেন পলক ফেললেই নিমেশেই কয়েকটা মুহূর্ত পেরিয়ে যাবে আর তার সেই কয়েক মুহূর্ত প্রেয়সীকে দেখতে না পাওয়ার ব্যথা সারাজীবন আঘাত করেই যাবে। সেই আঘাতের ভার যে সে সহ্য করতে পারবে না। ঈশার হঠাৎ করেই এক রাশ লজ্জা এসে ঘিরে ফেলল। চোখ নামিয়ে নিলো। এভাবে ইভানের চোখে চোখ রেখে কথা বলতো সে। কিন্তু এরকম অনুভুতি তো কখনও হয়নি। তাহলে আজ কেন? ইভান ঈশার মুখটা দেখে নিয়ে বলল
–আমি সহজ হয়ে গেলে নিজেকে সামলে রাখতে পারবি তো?

ইভানের কথার মানে বুঝতে না পেরে ঈশা তার দিকে তাকাল। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল
–কেন সামলাতে পারব না?

ইভান হাসল। এক আঙ্গুলে ঈশার কপালে লেপটে থাকা ভেজা চুল গুলো সরিয়ে দিলো। এক অজানা শিহরণ বয়ে গেলো ঈশার সারা শরীরে। কেঁপে উঠলো হৃৎপিণ্ড সহ সারা শরীর। এই তো কিছুক্ষন আগেও সব ঠিক ছিল। কিন্তু এখন? সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নিঃশ্বাসের বেগ বেড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টির পানি অস্বাভাবিক ভাবে ঠাণ্ডা লাগছে। পুরো শরীর আরেকবার কেঁপে উঠতেই নিচে ধপ করে বসে পড়লো ঈশা। এই কম্পন যে বড়ই অসহ্য। পারছে না সে ঠিক থাকতে। ইভান হাঁটু গেড়ে তার সামনে বসে এক আঙ্গুল গালে ছোঁয়াল। ঈশার শরীর ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছে অথচ ইভানের হাত গরম! ঈশা ইভানের হাত ধরে সেদিকে তাকিয়ে বলল
–তোমার হাত গরম কেন? এতো ঠাণ্ডার মাঝেও এতো গরম?

ইভান মুচকি হাসল। ঈশার একটু কাছে এসে মোহনীয় কণ্ঠে বলল
–জ্বলন্ত অগ্নি কুণ্ড আশে পাশে থাকলে শীতল হওয়া কি সম্ভব? এই বৃষ্টির ফোটাও তোর এই উষ্ণতার কাছে হার মেনে যাবে। তোর এই উষ্ণতা থেকে আমাকে নিস্তার দেবে সে ক্ষমতা কারও নেই।

ঈশা ইভানের হাত ছেড়ে দিলো। চোখ নামিয়ে নিলো। প্রচণ্ড অসস্তি হচ্ছে তার। কিন্তু কেন? এভাবে ইভান আগেও তার সাথে কথা বলেছে। এমন অনুভুতি তো হয়নি। ইভান উঠে দাঁড়ালো। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল
–অনেক হয়েছে। এখন সোজা বাসায় গিয়ে চেঞ্জ কর। নাহলে ঠাণ্ডা লাগবে।

ঈশা ইভানের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সে হাত বাড়াতেই অস্বাভাবিক ভাবে তার শরীর কাপন ধরে গেলো। ইভান হাত শক্ত করে ধরে বলল
–কাপছিস কেন? ঠাণ্ডা লাগছে? বলেছিলাম। তুই কবে বড় হবি বলতো? কবে নিজের খেয়াল রাখা শিখবি?

ঈশার মনের মাঝে আজ উথাল পাথাল ঢেউ। চোখ নামিয়ে রেখেছে কিন্তু ইভানের চোখে তাকিয়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে

~~~আমি বড় হতে চাইনা। চাইনা নিজের খেয়াল রাখা শিখতে। নাহলে যে তোমার এই ছোট ছোট যত্ন গুলো হারিয়ে যাবে। এই যত্ন পাওয়ার লোভে বৃষ্টির সাথে শরীরের সখ্যতা হোক! বারবার কেঁপে উঠুক এই অজানা শিহরণে। আর এই কম্পমান হাত শক্ত করে ধরে তুমি বল ‘আমি আছি তো খেয়াল রাখতে! ভয় নেই কোন।’~~~

————-
শরীরটা কেমন নেতিয়ে পড়েছে। মাথাটাও হালকা ব্যাথা। তবুও এক প্রকার জোর করেই বিছানা ছেড়ে উঠলো ঈশা। আজ ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে। তাড়াতাড়ি যেতে হবে। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়ে রেডি হয়ে ঘর থেকে বের হল। টেবিলের পাশে দাড়িয়ে পানির গ্লাসটা হাতে নিতেই চোখ পড়লো সোফায়। তার বাবার সাথে গল্প করছে ইভান। তার মানে তাকে নিতেই এসেছে। ঠোটের কোনে ক্ষীণ হাসি ফুটে উঠলো। ইভান গল্পে এতটাই মশগুল যে তার দিকে খেয়াল করেনি। ঈশা সেদিকে তাকিয়েই এক চুমুক পানি খেয়ে গ্লাসটা রেখে দিলো। পাশে তাকাতেই দেখল রুমা ঠোট টিপে হাসছে। ঈশা একটু লজ্জা পেলো। চোখ নামিয়ে নিতেই রুমা বলল
–অনেক্ষন এসেছে। অনেক তো হল। এবার অপেক্ষার প্রহরটা শেষ করো।

ঈশা হাসতেই ঈশান এসে তার মাথায় মেরে বলল
–কি নিয়ে এতো হাসাহাসি হচ্ছে শুনি?

ঈশা বোকার মতো দাড়িয়ে থাকল। রুমা একটু হেসে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–সময় হলেই জানতে পারবে।

ঈশান নাছোড়বান্দা! সে এখনি সব শুনবে। ঈশা অসস্তিতে পড়ে গেলো। কি বলবে? কিভাবে শুরু করবে? তাই কথা চেপে যেতে বলল
–আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে ভাইয়া। আমি যাচ্ছি।

বলেই সামনে এগিয়ে গিয়ে সোফার কাছে দাঁড়ালো। ঈশার দিকে ইভান একবার চোখ তুলে আশরাফ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলল
–আমরা আসি আঙ্কেল। ঈশার দেরি হয়ে যাবে।

আশরাফ সাহেব হেসে ইভানের মাথায় হাত দিলো। ইভান হাসল। তিনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আল্লাহ যেন তার মেয়েকে ইভানের জীবন সঙ্গি হিসেবেই পাঠিয়েছেন। মেয়েকে নিয়ে আর কোন চিন্তা নেই তার। ইভান আর ঈশা দুজনেই বের হয়ে গেলো। বের হয়েই ঈশা জিজ্ঞেস করলো
–কখন এসেছ?

–অনেক্ষন।

গম্ভীর গলায় বলল ইভান। ঈশা আবারো প্রশ্ন করলো
–ফোন দাওনি কেন?

ইভান কঠিন দৃষ্টিতে তাকাল। ধমকের সুরে বলল
–বলেছিলাম না ফোন দিবনা।

ঈশা মুখ কালো করে নিচের দিকে তাকাল। একটু পর ওই অবস্থা থেকেই বলল
–ওসব তো অনেক আগের কথা। ভুলে যেতে পারনা?

ইভান তার দিকে একবার তাকাল। কিছু বলল না। তার ফোন বেজে উঠলো। ফোনে কার সাথে যেন কথা বলেই যাচ্ছে। কোন কিছু নিয়ে বেশ ব্যস্ত সে। ঈশাও কোন কথা বলছে না। দুজনে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। ইভান গাড়িতে বসেও ফোনেই কথা বলছে। ঈশার শরীর আগের থেকে আরও খারাপ হয়ে আসছে। মাথাটাও ভারি লাগছে। সিটে মাথা রাখতেই হাচি দিলো সে। পাশ ফিরতেই চোখে পড়লো ইভানের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। অপরাধির মতো তাকিয়ে আবার আগের দিকে ঘুরে গেলো। ইভান তখনো ফোনেই ব্যস্ত। ঈশা সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। গাড়ির ঝাঁকুনিতে হালকা তন্দ্রা ভাব আসল। কিছুক্ষন পর শীতল স্পর্শে চমকে উঠলো। ইভান হাতের পিঠ গলায় ঠেকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ঈশা মাথা তুলতে নিতেই ইভান হাত সরিয়ে মাথা আবার সিটের সাথে লাগিয়ে দিয়ে কঠিন গলায় বলে
–বের হওয়ার সময় মেডিসিন নিলে কি ক্ষতি হতো? অবেলায় বৃষ্টিতে ভিজেছিলি জ্বর আসতে পারে সেটা মাথায় রাখা উচিত ছিল। তাহলেই এখন সেটা বাড়ত না।

ঈশা এবার বুঝতে পারলো তার এতো খারাপ লাগার কারন। শরীরে জ্বর। সে খেয়াল করেনি। নাহলে মেডিসিন নিয়েই বের হতো। খেয়াল করেনি ভালই হয়েছে। মেডিসিন নিলে কি ইভানের এমন কেয়ার দেখতে পেত? মুচকি হাসল সে। এমনিতেই জ্বরের কারনে ইভানের মেজাজ খারাপ তার উপর আবার এই হাসি দেখে আবার রাগ বেড়ে গেলো। দাতে দাত চেপে বলল
–এখানে কি কমেডি শো চলছে? এভাবে হাসার কি হল?

ঈশা মাথা নাড়াল। হালকা ভাবে মাথায় নাড়তেই ঈশা চোখ বন্ধ করে ফেলল। শরীর ঝিমিয়ে আসছে। এক সময় গাড়ি থেমে গেলো। ঈশা চোখ খুলল। ইভান তার দিকে তাকিয়ে আছে। বোঝার চেষ্টা করছে তার অবস্থা। ঈশা ক্লান্ত ভাবে বলল
–তেমন কিছু হয়নি তো? মেডিসিন নিলেই ঠিক হয়ে যাবে।

ইভান কিছু বলল না। গাড়ি থেকে নেমে ঈশার হাত ধরে ভিতরে ঢুকল। ঢুকতেই মেঘলার সামনে পড়লো। মেঘলা তাদের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে করুন ভাবে। ইভান সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ঈশাকে নিয়ে সোজা নিজের কেবিনে গেলো। তাকে চেয়ারে বসে দিলো। মেডিসিন খাইয়ে দিলো। ঈশার মাথায় হাত দিয়ে বলল
–একটু রেস্ট নে। জ্বরটা কমুক।

–রেস্ট নিতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। ইম্পরট্যান্ট ক্লাস আছে।

ইভান কঠিন ভাবে তাকাল। ঈশা ক্লান্ত চোখে তাকিয়ে বলল
–মেডিসিন নিয়েছি। একটু পরেই জ্বর নেমে যাবে। এতো টেনশন করার কিছু নেই তো।

ইভান গম্ভির গলায় বলল
–আর ইউ সিওর?

ঈশা মাথা নাড়ল। ইভান একটা শ্বাস ছেড়ে বলল
–বেশী খারাপ লাগলে আমাকে ফোন করবি।

ঈশা একটু হেসে মাথা নাড়ল। ঈশার হাসি দেখে ইভানও মলিন হাসল। ঈশাকে নিয়ে খুব চিন্তা হচ্ছে তার। ঈশা আর কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি বের হয়ে ক্লাসে গেলো।

অনেকটা সময় পার হয়ে গেছে ঈশা মেডিসিন নিয়েছে। কিন্তু কেন জানি তার এখনো অনেকটা খারাপ লাগছে। মেডিসিন নেয়ার কিছুক্ষন পরেই যেখানে জ্বরটা কমে যাওয়ার কথা ছিল সেখানে মনে হচ্ছে এখনো জ্বর কমেনি। সব কিছু কেমন যেন লাগছে। হাত পা ঝিমিয়ে আসছে। চোখের পাতা ভারি হয়ে গেছে। একবার চোখ বন্ধ করে খুলতেই চারিদিকে কেমন আবছা হয়ে গেলো। আবছা অন্ধকার ছেয়ে যাচ্ছে। ধিরে ধিরে সেই অন্ধকার গাড় হল। মাথার ভার সইতে পারলো না সে। একটা বড় শ্বাস টেনে নিতেই নেতিয়ে পড়লো। অস্পষ্ট সরে উচ্চারন করলো
–ইভাআআনন!

চলবে……

(একটা বিষয় একটু ক্লিয়ার করতে চাই। ইভান জানে ঈশা তাকে মনে মনে ভালোবাসে কিন্তু ইভান সব সময় ঈশার আশে পাশে থাকাতেই ঈশা তার মনের কথা বুঝতে পারেনি। কাউকে মিস করার জন্য তার অনুপস্থিতির প্রয়োজন হয়। ইভান যখন ১৫ দিনের জন্য চলে গিয়েছিলো তখন ঈশা একটু হলেও তার অনুপস্থিতি বুঝতে পেরেছিল। আর ইভান এই জন্যই তাকে সত্যি কথা না বলেই চলে গিয়েছিলো যাতে ঈশা তার মনের কথাটা একটু হলেও বুঝতে পারে। এটাই কি কম শাস্তি? আশা করছি বিষয়টা নিয়ে আপনাদের এখন আর কোন কনফিউশন নেই।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here