তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি সারপ্রাইজ পর্ব লেখক-এ রহমান

0
1163

#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
সারপ্রাইজ পর্ব
লেখক-এ রহমান

হসপিটালের করিডোরে বাচ্চাটার আত্মীয় স্বজন সহ অনেক লোকজন দাড়িয়ে আছে। স্টাফরাও সেখানে এসে ভিড় জমিয়েছে। সাথে আছে এনজিওর লোকজন। সবার দৃষ্টি এই মুহূর্তে সামনে নত দৃষ্টিতে দাড়িয়ে থাকা লোকটার উপরে। ঈশা হাত গুঁজে নিজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তাক করে দাড়িয়ে আছে সেই লোকটার উপরে। তার চোখ মুখ রাগে লাল হয়ে আছে যেন টোকা দিলেই সেখান থেকে রক্ত ঝরবে। ঈশার এই মুহূর্তে ইচ্ছা করছে ঠাটিয়ে একটা থাপ্পড় মারতে। যেই ভাবা সেই কাজ। সজরে এক গালে থাপ্পড় মেরেও শান্ত হল না ঈশা। আবার আরেক গালে থাপ্পড় মেরে দিলো। গালে হাত দিয়ে নত দৃষ্টিতে দাড়িয়ে আছে নিরব। ঈশা রাগে ফুসতে ফুসতে বলল
–আমার তো ইচ্ছা করছে এই মুহূর্তে তোকে মেরে এখানেই পুতে ফেলতে। তোকে তো আজ আমি মেরেই ফেলবো।

বলেই তেড়ে যেতেই ইফতি তাকে ধরে ফেলল। ঈশা কিছুতেই শান্ত হলনা। ইফতি তাকে জোর করে সেখান থেকে এক প্রকার টেনে হিঁচড়ে নিয়ে এলো। কেবিনে এনে বসিয়ে দিলো। ঈশা হুঙ্কার ছেড়ে বলল
–কেন নিয়ে এলি আমাকে এখানে? আমি ওই জানোয়ারটাকে আজ মেরেই ফেলবো।

ইফতি ঈশার মাথায় হাত দিয়ে বলল
–কাম ডাউন ঈশা!

–তোর কি মনে হয় এরকম পরিস্থিতে শান্ত থাকা যায়? আমি মানতে পারছি না কিছুতেই। নিরবকে খুন না করা পর্যন্ত আমি কিছুতেই শান্ত হতে পারব না ইফতি।

ইফতি অসহায় হয়ে মাথায় হাত দিলো। এই মেয়ে আজ ঝাসির রানির রুপ নিয়েছে। না জানি আবার খুন টুন করে বসে। কিভাবে সামলাবে একে? ঈশা আবারো চেচিয়ে বলে উঠলো
–আমি কিছুতেই শান্ত হতে পারছিনা। আমাকে ওখানে যেতেই হবে। আমি নিজে হাতে ওকে শাস্তি দিবো।

ঈশা উঠতে নিলেই ইফতি তাকে ধরে ফেলে। হাত জোর করে কাঁদো কাঁদো গলায় বলে
–আমার উপরে আর কিছু সময় রহম কর প্লিজ! তারপর যা ইচ্ছা করিস। কিছুক্ষন পর আমার আর দায়ভার থাকবে না। তোকে সামলানো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

ঈশা এতটা রেগে আছে এই মুহূর্তে যে কোন ভাবেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। খুব রেগে গেলে ঈশা চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করে। একটু সময় চুপ করে থেকে কাঁদতে শুরু করলো সে। ফিকরে ফিকরে কাঁদতে কাঁদতে বলল
–ভাবতে পারছিস এই মেয়েকে ধোঁকা দিয়েছে তারপর আবার আমাকে! তার পরেও নির্লজ্জের মতো বলে কিনা ‘ঈশা আমি তোমাকে সবটা বলতে চেয়েছিলাম’।

বলেই আবার কাঁদতে শুরু করলো।
–বলতো তবে বিয়ের পর। যখন আর কিছুই করার থাকতো না।

গলা শুনে ঈশা থমকে যায়। কান্না থেমে যায় তার। বুকের ভিতরে আচমকাই হার্ট বিট খুব জোরে চলতে শুরু করে। ইফতি সস্তির নিশ্বাস ফেলে বাইরে যেতে যেতে বলে
–আর একটু দেরি করলে আজ নিরবের সাথে নির্ঘাত আমিও মার্ডার হয়ে যেতাম।

ঈশা মাথা ঘুরায়। ইভান তার পাশে এসে বসে। হাতের টিস্যুটা তার দিকে এগিয়ে দেয়। ঈশার মস্তিস্ক শুন্য হয়ে গেছে। তার নিউরন এই মুহূর্তে কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। ইভান তার মাথায় হাত দিতেই আচমকা বুক ভরা হাহাকার ভিড় করে বসে। নিজেকে সামলাতে পারেনা। ইভানের বুকে মাথা রেখে হু হু করে কেদে উঠে। ইভান হতাশা ভরা শ্বাস ছাড়ে। ঈশা নিজেও বুঝতে পারেনা এই কান্না কিসের? নিরবের এতো বড় ধোঁকা সামনে আসার পর কষ্টের কান্না নাকি ইভানের হঠাৎ এমন কাছে আসায় সুখের কান্না। ইভান চুলের ভাজে হাত ঢুকিয়ে বলে
–কেন কাদছিস? ওরকম একটা অমানুশের কাছ থেকে কষ্ট পেয়ে নিজের চোখের পানি কেন শুধু শুধু নষ্ট করছিস? ওই ছেলেটা কি কোন দিন তোর যোগ্য ছিল?

ঈশা মাথা তুলে ইভানের দিকে তাকাল। কিন্তু মুহূর্তেই আবার এক রাশ অপরাধ বোধ ঘিরে ফেলল তাকে। ইভান অনেকবার বলেছিল ওই ছেলেটার কথা। কিন্তু ঈশা সেটা কোন ভাবেই বিশ্বাস করেনি। আজও করতো না যদি না নিজের চোখে সবটা দেখত। ওই বাচ্চাটার সাথে সেদিন দেখা না হলে ঈশা হয়ত নিরবের সত্যিটা কোনদিন জানতে পারত না। আর নিরবের সাথে বিয়ে না হওয়ার জন্য সারাজীবন ইভান কে দায়ি করে আসতো। অথচ ইভান তার জীবন নষ্ট হওয়া থেকে বাচিয়েছে। ইভানের কথা বিশ্বাস করে ঈশা যদি তার কাছে প্রমান দেখতে চাইত তাহলে ইভান কে সেদিন এভাবে নাটক করতে হতো না। আর ঈশাও তাকে ভুল বুঝতনা। নিজের উপরেই এখন তার ঘৃণা হচ্ছে। সে জানে ইভান কখনও অন্যায় করতে পারেনা। কিন্তু তবুও সে কিভাবে নিজের এই ভুলটাকে প্রাধান্য দিলো। আবার দু চোখ বেয়ে পানি ঝরতে লাগলো। ইভান এক আঙ্গুলে চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল
–তোর এই চোখের পানি আমাকে ভিতর থেকে জালিয়ে পুড়িয়ে দেয়। সেই জালা যে আমার সহ্য ক্ষমতার বাইরে।

ঈশা থেমে গেলো। সে আর নতুন করে ইভান কে কষ্ট দিতে চায়না। এমনিতেই তার মাঝে অপরাধ বোধের শেষ নেই। পরক্ষনেই আবার কি মনে করে ভ্রু কুচকে ইভানের দিকে তাকাল। ঈশার এমন চাহুনি বুঝতে না পেরে ইভান বলল
–আমি আবার কি করলাম?

–তুমি না লন্ডন চলে গিয়েছিলে?

ঈশা তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল। ইভান উঠে দাঁড়ালো। সামনে গ্লাসে পানি ঢেলে ঈশার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল
–গিয়েছিলাম। আবার চলে এসেছি।

ঈশা গ্লাস হাতে নিয়েই আবার বলল
–তুমি না একবারেই চলে গিয়েছিলে?

ইভান হাসল। টেবিলে বসে ঈশার দিকে একটু ঝুকে বলল
–তোকে ছেড়ে আমি একবারেই চলে যাবো? আমার দারা অসম্ভব। আব্বু যখন আমাকে পড়ালেখা কমপ্লিট করতে বিদেশে যেতে বলেছিল আমি তখনই যাইনি। আর এখন যাবো?

–তাহলে কোথায় গিয়েছিলে?

ঈশা সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকাল। ইভান সোজা হয়ে বলল
–লন্ডন গিয়েছিলাম। কিন্তু দুই সপ্তাহের জন্য। ট্রেইনিং ছিল। কাল সকালে এসেছি।

ঈশা এবার গ্লাসটা জোরে টেবিলে রেখে দাড়িয়ে বলল
–আমার সাথে নাটক করলে কেন?

ইভান খুব স্বাভাবিক ভাবে বলল
–কেন তোর ভালো লাগেনি? প্রতিদিন যে ভোর বেলা আমার জন্য বারান্দায় বসে থাকিস। জানিস আমি নাই তবুও অপেক্ষা করতিস আমার জন্য। কোথাও একটা সুপ্ত আশা ছিল। ভালো লাগত না অপেক্ষা করতে?

ইশা খানিকটা লজ্জা পেলো। ইভান এসব জানল কেমন করে? চোখ নামিয়ে নিতেই ইভান তার কাছে এসে দাঁড়ালো। এক আঙ্গুলে থুত্নি ধরে মুখটা উপরে তুলে বলল
–আমি সত্যি সেদিন অপেক্ষা করে ছিলাম তোকে দেখার জন্য। কিন্তু তুই দরজা খুলেও বাইরে আসিস নি। সেদিন তোর অভিমানটা তুই না বুঝলেও আমার বুঝতে বাকি ছিল না। তোর এই অভিমানটাই আমাকে সেদিন তোর মনের কথা জানিয়ে দেয়। আমি তোর মনের সেসব কথাও জানি যা তুই জানিস না। বুঝতেও পারিস না।

ছেড়ে দিয়ে একটু দূরে গিয়ে দুষ্টুমির সুরে বলল
–তাই তো আগুনে ঘি ঢালার মতো একটা এস এম এস পাঠিয়ে দিলাম। যাতে অপরাধির মতো প্রতিদিন আমার জন্য অপেক্ষা করিস।

ঈশা এবার রেগে গেলো। ইভানের কলার টেনে ধরে বলল
–কি পেয়েছ আমাকে? নিজের মতো এভাবে আমার মনকে নিয়ন্ত্রন করবে? যখন যেভাবে তুমি চাও সবটা সেভাবেই হবে?

–আমি কি তোকে বাধ্য করেছিলাম? বলেছিলাম আমার জন্য অপেক্ষা কর? তুই নিজে থেকেই বেছে নিয়েছিস।

ঈশার হাত আলগা হয়ে গেলো। কলার ছেড়ে দিয়ে চোখ নামিয়ে নিলো। আসলেই তো! ইভান তাকে বাধ্য না করার পরেও কেন অপেক্ষা করতো তার জন্য? এই কথার উত্তর ঈশার কাছেও নেই। ইভান মুচকি হেসে বলল
–তুই কেন আমার জন্য অপেক্ষা করিস বল তো? প্রেমে টেমে পড়িস নি তো আবার?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকাতেই আবার নিরবের কথা মনে পড়ে গেলো। আবার হুঙ্কার দিয়ে বলল
–আমি তো আজ নিরবকে খুন করে তবেই শান্ত হবো।

–কেন খুন করবি? তোর না পছন্দের মানুষ ছিল এক সময়। তোর বাবার যোগ্য পাত্র।

ইভানের এমন তাচ্ছিল্য ভরা কণ্ঠ শুনে ঈশা দমে গেলো। কারন ইভানের কথা এক বিন্দুও মিথ্যে নয়। ঈশা মুখ কালো করে ইভানের দিকে তাকাল। ইভান আবার বলল
–কি ইনটেলিজেন্ট তোর বাপ! মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র বেছে এনেছে। আর মেয়ে সেই পাত্রের প্রেমে হাবু ডুবু খাচ্ছে। এতই গভির প্রেম যে চোখ দিয়ে সব দেখিয়ে দিলেও চোখে পড়েনা। ইনটেলিজেন্ট বাপের ইনটেলিজেন্ট মেয়ে।

ঈশা এবার আর চুপ থাকতে পারল না। চাপা রাগটা তুলে একটু চেচিয়ে বলল
–কি বলছ এসব? আমি কখন বললাম যে প্রেমে পড়েছি? হ্যা এটা ঠিক যে ভালো লাগত কিন্তু সেটা প্রেম ছিলোনা।

–তাই নাকি? কই আমাকে তো তোর কোনদিন ভালো লাগেনি? আর চোখের সামনে এতো যোগ্য পাত্র থাকতেও তোর বাপকে বাইরে থেকে ছেলে আনতে হচ্ছে মেয়ের জন্য। ভালই হয়েছে তোর বাপের মেয়ের বিয়ে দেয়ার সাধ মিটেছে না?

ঈশা বড় বড় চোখে তাকাল ইভানের দিকে। একটু থেমে বলল
–বাচ্চাটা?

–বাচ্চাটা ঠিক আছে।

ঈশার মুখে হাসি ফুটে উঠলো। হালকা হেসে বলল
–তুমি দেখেছ?

ইভান হেসে বলল
–আমি কাল সারা রাত ওর কাছেই ছিলাম। প্রথমে অবস্থা খারাপ ছিল এখন ঠিক আছে।

ঈশা অবাক হল। সত্যিই ইভানের মতো মানুষ হয়না। ঈশা এবার ইভানের দিকে তাকাল। খুব শান্ত ভাবে জিজ্ঞেস করলো
–নিরব এখানে আসল কিভাবে?

–আমি কাল রাতে বাচ্চার মার সাথে দেখা করতে গিয়ে তাকে দেখেই চিনে ফেলি। ভয়ে ও এতদিন নিজের মুখ বন্ধ রেখেছিলো। তাই ওর সাথে আর কথা বলিনি। এনজিওর লোকজনদেরকে সবটা জানাই। ওরাই বাচ্চার পরিচয়ের জন্য তার বাবাকে প্রমান সহ খুজে আনে। আসলে মেয়েটা সব পরিচয় এমন ভাবে গোপন করেছিলো নিরব নিজেও জানতোনা যে তার বাচ্চা বেঁচে আছে।

ঈশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ইভান একটু হেসে বলল
–বিয়েটা হলে কি ভালো হতো বল। একটা রেডিমেড বাচ্চা পেতিস। তোকে কোন কষ্টই করতে হতোনা। আবার সাথে একটা সতীনও পেতিস। ঝগড়া করার সাথি।

ঈশা রেগে গেলো। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকাতেই ইভান ঠোট টিপে হাসল। ঈশা আরও রেগে গেলো। ইভান বুঝতে পারল ঈশা এবার কেদে ফেলবে। তাই এগিয়ে এসে তার মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরল। আদুরে গলায় বলল
–‘নেচার অফ রিভেঞ্জ’ বলে একটা কথা আছে। নিরব মেয়েটার সাথে যা করেছে তুইও ওর সাথে সেরকম কিছুই করেছিস। আরও বেশিই করেছিস। তুই না জেনেই ওকে ওর প্রাপ্য শাস্তিটা দিয়েছিস।

ইভানের কথা শুনে ঈশার মনটা হালকা হয়ে গেলো। সে এতক্ষন এভাবে ভাবেনি। মাথা তুলে ইভানের দিকে তাকাল। কি অদ্ভুত মানুষটা! সব কিছুর সহজ সমাধান তার কাছে আছে। একটা মানুষের মন কতটা ভালো হলে এভাবে ভাবা সম্ভব সেটা ঈশা আন্দাজও করতে পারছে না। ইভান হালকা হেসে বলল
–এভাবে তাকাতে ভয় লাগেনা?

ঈশা তার কথার মানে বুঝতে না পেরে ভ্রু কুচকাল। ইভান হেসে বলল
–যদি প্রেমে পড়ে যাস।

ঈশা কোন কথা না বললেও তার মাঝে এক অদ্ভুত অনুভুতি হচ্ছে। চোখ নামিয়ে হাসল। ইভান এক আঙ্গুলে ঈশার গালে আলতো করে স্পর্শ করে বলল
–ভালবাসি বলতে হবে না। তোর এই অনুভুতিগুলই আমার কাছে সব। একটু একটু করে এই অনুভুতি গুলো প্রকাশ করবি আমি সেটা নিয়েই সারাজীবন পার করে দিবো।

চলবে………
(আমি আপনাদেরকে সারপ্রাইজ গেস করতে বলেছিলাম। আপনারা বাচ্চার বাবা গেস করেছেন। খুব ভালো লেগেছে যে সবাই আগেই বুঝতে পেরেছেন। আমি আসলে ইভানের ফিরে আসা সারপ্রাইজের কথা বলেছি। আমি আপনাদের কমেন্ট পড়ে মুগ্ধ। তাই আপনাদের জন্য ছোট্ট করে এই সারপ্রাইজ পর্ব। সবাইকে অনেক ধন্যবাদ। আর হ্যা যত ভালো ভালো কমেন্ট করবেন তত এরকম সারপ্রাইজ পর্ব পাবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here