#তোমার_তুমিতেই_আমার_প্রাপ্তি
লেখক-এ রহমান
পর্ব ১০
রাতে হালকা বৃষ্টি হওয়ায় সকালের আবহাওয়াটা একটু ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। আবছা অন্ধকারে ছেয়ে আছে এখনো। আলো ফুটতে আর অল্প সময় বাকি। ভোরের হালকা বাতাসটা গায়ে মাঝে মাঝে কাপুনি ধরিয়ে দিচ্ছে। তবুও ঈশা বারান্দায় বসে আছে এক রাশ শুন্যতা নিয়ে। নিস্পলক ইভানের বারান্দার দিকে তাকিয়ে আছে। আজ ১৫ দিন হল ইভান চলে গেছে। যাওয়ার আগে ইভানের মেসেজটা ঈশার মনে একটু হলেও দাগ কেটেছে। যার কারনেই সে প্রতিদিন ভোর বেলা ওড়না মাথায় দিয়ে বারান্দায় এসে বসে থাকে। কিন্তু যার জন্য এই আয়োজন সেই মানুষটা তো নেই। তবুও কেন জানি ঈশার এখানেই বসে থাকতে ভালো লাগে। এক রাশ শুন্যতা আর মন খারাপ নিয়ে। এর কারণটা ঈশার নিজেরও জানা নেই। ফজরের নামাজ পড়ে সে এখানে বসে আর একদম সূর্য উঠলে তবেই ঘরে যায়। এমন সময় ঈশার ফোন বেজে উঠলো। নাম্বারটা দেখেই ফোনটা ধরে ফেলল। ঈশা হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে নার্স হন্তদন্ত করে বলে উঠলো
–ম্যাডাম আপনাকে এখনি একবার হসপিটালে আসতে হবে। বাচ্চাটার অবস্থা ভালো না।
–আমি আসছি।
বলেই ঈশা হন্তদন্ত করে বের হয়ে গেলো। বাইরে বেরিয়ে দেখে রুমা নাস্তা বানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। ঈশাকে এভাবে বের হতে দেখে জিজ্ঞেস করলো
–এতো সকালে কোথায় যাচ্ছ ঈশা?
–হসপিটালে ভাবি। এমারজেন্সি!
ঈশার কথা শুনে রুমা আবারো বলল
–না খেয়ে যাবে?
ঈশা তড়িঘড়ি করে সামনে থাকা পানির একটা গ্লাস তুলে নিয়ে একটু খেয়ে বলল
–আমি ক্যান্টিনে খেয়ে নেব। এখন সময় নেই।
রুমা একটু ভ্রু কুচকে তাকাল ঈশার দিকে। তারপর গম্ভির গলায় বলল
–তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। কখন আসবে?
ঈশা দ্রুত পায়ে দরজার কাছে যেতে যেতে বলল
–দুপুরে চলে আসব ভাবি।
–ঠিক আছে।
কথা শেষ করেই ঈশা বের হয়ে চলে গেলো। এতো সকালে ড্রাইভার আসবে না। তাই রিকশা করেই যেতে হবে। ঈশা রিকশার জন্য অপেক্ষা করছে। এর মাঝেই কয়েকবার ফোন এসেছে। অবশেষে একটা রিক্সা পেলো। সেটাতে উঠে পড়লো। ঈশা বারবার ঘড়ি দেখছে। রিক্সাতে যেতে অনেকটা সময় লাগবে। ঈশার খুব টেনশন হচ্ছে। গত ১৫ দিন ধরেই তারা লিউকেমিয়ায় আক্রান্ত সেই বাচ্চাটাকে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু দিন দিন তার পরিস্থিতি খারাপ হয়েই যাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত হসপিটালে ভর্তি করিয়েছে। তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। ভাবতে ভাবতে সে হসপিটালে এসে পৌঁছেছে। রিক্সা ভাড়া মিটিয়ে এক প্রকার দৌড়ে ভেতরে ঢুকল সে। হাপাতে হাপাতে এসে নার্স কে জিজ্ঞেস করলো
–কি অবস্থা এখন?
–খুব একটা ভালো অবস্থা না ম্যাম। লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়েছে। ইফতি স্যার আছেন সেখানে।
ঈশা আর দেরি না করে সেখানে গেলো। ইফতি ঈশাকে দেখে তার কাছে এলো। ফিস ফিস করে বলল
–অবস্থা ভালো না। বেশী সময় সারভাইভ করতে পারবে বলে মনে হয়না।
ঈশা করুন চোখে তার দিকে তাকাল। ইফিতরও খুব খারাপ লাগছে। ঈশা চিন্তিত হয়ে বলল
–ওর মায়ের শেষ সম্বল। বাচ্চাটার কিছু হলে মেয়েটার কি হবে?
ইফতি আশ্বাসের সুরে বলল
–ভাবিস না ঈশা। মানুষের জিবনে এমন অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটে যা কোন ভাবেই কাম্য নয়। তবুও সে বেঁচে থাকে। মেয়েটার বয়স অনেক কম। তার পুরো জীবনটা পড়ে আছে।
ঈশা আর ইফতি সেখানে না দাড়িয়ে বের হয়ে এলো। ঈশা হাটতে হাটতে বলল
–জানিস ইফতি মেয়েটা সিঙ্গেল মাদার।
ইফতি বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো
–কি বলিস? বাচ্চার বাবা নেই?
ঈশা হতাশ হয়ে বলল
–আছে কিন্তু……।
ইফতি দাড়িয়ে গেলো। ভালো করে ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–জানিস আমার প্রথম দিন থেকেই মনে হচ্ছিল কোন একটা ঘটনা আছে। মেয়েটার সাথে কোন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে।
ঈশা নিচের দিকে তাকিয়ে বলল
–তুই ঠিক ধরেছিস। মেয়েটা বিয়ের আগেই প্রেগন্যান্ট হয়ে যায়। তার বয়ফ্রেন্ডকে বিষয়টা জানানোর পরে ছেলেটা তার বাবা মার সাথে কথা বলে। কিন্তু তার বড়লোক বাবা মা তাদের এই সম্পর্ক মেনে নেয়না। উলটা ছেলেটার অন্য মেয়ের সাথে বিয়ে ঠিক করে। আর এই মেয়েকে অনেক টাকা দিয়ে এবরশান করাতে বলে। কিন্তু মেয়েটা তার বাচ্চাকে মারতে চায়নি। তাই কাউকে না বলে তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে নিজের পরিচয় গোপন করে লুকিয়ে থাকে। বাচ্চাটা জন্ম নেয়ার পরে জানতে পারে তার বাচ্চার এই অবস্থা। যেই বাড়িতে ভাড়া থাকতো সেখানেই একটা এনজিও ভাড়া থাকতো। তারাই বিষয়টা জানতে পেরে সাহায্যের জন্য ফেসবুকে পোস্ট করে।
ইফতি একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে সামনে তাকিয়ে বলল
–একটা মেয়ের দায়িত্ব নিতে পারবে না অথচ প্রয়জনে তাকে ঠিকই ব্যাবহার করেছে। মেয়েটাকে বিয়ে করে নিলেই পারত। প্রেম করার সময় কি মাথায় ছিল না বাবা মা মেনে নিবে কিনা। অদ্ভুৎ মানুষ।
ইফতির কথাটা শেষ হতেই কান্নার আওয়াজ কানে আসল। ইফতি ঈশা দুজনি সামনের দিকে তাকাল। মেয়েটা জোরে জোরে কেদেই যাচ্ছে। মায়ের কাছে সন্তান হারানোর কষ্টটা যে কি সেটা অন্য কেউ কোনদিন উপলব্ধি করতে পারবে না। ঈশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে গেলো। মেয়েটাকে কি বলে সান্তনা দিবে সে সেই ভাষা তার জানা নেই।
————
ক্লান্ত শরীর আর ভাঙ্গা মন নিয়ে বাসায় ফিরল ঈশা। তাকে বিধ্বস্ত দেখে আশরাফ সাহেব জিজ্ঞেস করলো
–কি হয়েছে মামনি?
ঈশা একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তার পাশে বসে পড়লো। হতাশ হয়ে বলল
–ওই যে তোমাকে বাচ্চাটার কথা বলেছিলাম না আব্বু? ওই বাচ্চাটা সারভাইভ করতে পারবে না মনে হয়।
কথাটা শুনে ঈশার বাবার মন খারাপ হয়ে গেলো। তিনি মেয়ের মাথায় হাত রেখে বললেন
–জন্ম মৃত্যু সৃষ্টি কর্তার হাতে মামনি। আমাদের এখানে কিছুই করার নেই।
ঈশা মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে যেতে যেতে বলল
–আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।
বলেই চলে গেলো। ঘরে গিয়ে ওয়াশ রুম থেকে গোসল করে বের হল। বের হয়েই দেখে রুমা তার বিছানায় বসে আছে। ঈশা একটু রুমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলো
–ভাবি কিছু বলবে?
রুমা উঠে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিলো। ঈশা অবাক হল রুমার কাজে। তবুও কিছু না বলে মনোযোগ দিলো তার কথা শোনার জন্য। রুমা ঈশার সামনে দাড়িয়ে গম্ভির গলায় বলল
–যা যা জিজ্ঞেস করবো একদম সত্যি কথা বলবে।
ঈশা ভ্রুকুচকে বলল
–বল কি শুনতে চাও?
রুমা হাত গুঁজে দাড়িয়ে বলল
–ইভান কেন লন্ডনে চলে গেলো?
ঈশা প্রশ্ন শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। রুমা এভাবে প্রশ্ন করার কারন তার বোধগম্য হলনা। সে উলটা প্রশ্ন করে বসলো।
–হঠাৎ এমন কথা কেন জিজ্ঞেস করছ ভাবি?
রুমা ঈশার হাত টেনে সামনে ধরে বলল
–তোমার আংটি কোথায়?
ঈশা এবার তার প্রশ্নের কারন বুঝতে পারল। কিন্তু কি উত্তর দিবে সেটা বুঝতে পারল না। চুপ করে দাড়িয়ে থাকল। রুমা ঈশার দিকে তাকিয়ে বলল
–তোমার আর ইভানের মধ্যে কি চলছে ঈশা? আমি আগেই আন্দাজ করেছিলাম। কিন্তু ঠিক সময়ের অপেক্ষা করছিলাম। এবার তো পুরোটা পরিষ্কার! তোমার হাতে আংটি না থাকা আবার ইভানের এভাবে লন্ডনে চলে যাওয়া কোন ভাবেই কো-ইন্সিডেন্স হতে পারেনা। আমি সবটা জানতে চাই ঈশা। আমাকে খুলে বল।
ঈশা রুমাকে বিছানায় বসাল। নিজেও বসে তারপর বলল
–ভাবি ইভান আমাকে ছোটবেলা থেকে পছন্দ করতো। আমি বিষয়টাকে সেভাবে গুরুত্ত দেইনি কখনও। কিন্তু ইভান আমাকে প্রপোজ করে। আমার মনে কখনও তার জন্য সেরকম অনুভুতি ছিলোনা। তাই আমি না কর দেই। এর মাঝেই নিরবের সাথে আমার বিয়ের কথা শুরু হয়। আমি আর নিরব বিয়ের আগে দুজন দুজনকে জানতে চেষ্টা করি। বেশ কথা বার্তা হয় আমাদের মাঝে। ধিরে ধিরে দুজনের প্রতি ভাললাগা তৈরি হয়। তাই বাসায় নিরবের কথা জিজ্ঞেস করলে আমি হ্যা বলে দেই। কিন্তু এঙ্গেজমেন্টের আগের দিন ইভান আমাকে নিরব সম্পর্কে অনেক বাজে কথা বলে। আমি সেগুলোর কিছুই বিশ্বাস করিনি। কারন আমি তো নিরবকে জানি সে কেমন ছেলে। তাই সেসব নিয়ে নিরবের সাথে কথাও বলার প্রয়োজন মনে করিনি। কিন্তু এঙ্গেজমেন্টের দিন ইভান আমাকে ফোন করে শেষ বার দেখা করার অনুরধ করে। অনেক জোর করায় আমি নিরুপায় হয়ে চলে যাই।
কথাটা বলেই থেমে গেলো। রুমা মনোযোগ দিয়ে শুনছিল তার কথা। ঈশা থেমে যাওয়ায় সে আবার বলল
–তারপর?
ঈশা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল
–সুযোগের সদব্যাবহার করে আমাকে তুলে নিয়ে যায়। আমাকে সেখানে আটকে রেখে হুমকি দেয়। আমি যদি নিরবের ভালো চাই তাহলে যেন এই সম্পর্কটা ভেঙ্গে দেই। নাহলে সে নিরবের যে কোন ধরনের ক্ষতি করবে। এমনকি তাকে মেরে ফেলতেও ভাববে না। আমি সেদিন ইভানের নতুন রুপ দেখেছি ভাবি। একদম অন্য রকম রুপ। আমাকে টর্চার করে বাধ্য করেছে সবার সামনে বলতে যে আমি তাকে ভালবাসি আর তাকেই বিয়ে করতে চাই। কিন্তু আমি তো নিরবকে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম। ইভান কে নয়। সে আমাকে বাধ্য করেছে। তার অত্যাচারে বাধ্য হয়েই আমি বাসায় ফিরে সবার সামনে বলেছি যে আমি ইভান কে বিয়ে করতে চাই নিরব কে নয়।
রুমা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল
–আগেই বুঝেছিলাম কিছু একটা ঘটনা আছে। যাই হোক। এখন কেন ইভান চলে গেলো?
–আমি যে এই সম্পর্কটা মেনে নিতে পারিনি। আমি যে তাকে ঘৃণা করি সেটা সে ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে। তাই তো আংটি খুলে নিয়েছে নিজে থেকেই। আর বিষয়টাকে বাড়াতে চায়না সে। তাই লন্ডনে চলে গেছে একবারে।
রুমা ছোট ছোট চোখে ঈশার দিকে তাকাল। ক্ষীণ হেসে বলল
–তুমি কি সিওর ইভান একবারে চলে গেছে?
ঈশা নিচের দিকে তাকাল। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হতাশ হয়ে বলল
–হুম।
–তোমার এতো খারাপ লাগছে কেন ইভান চলে যাওয়ায়?
রুমার কথাটা মাথায় ঢুকতেই ঈশা ভাবল আসলেই তো তার মন খারাপ হয়ে গেলো কেন? কিন্তু সে তো এটাই চেয়েছিল। আর কোন কথা বলল না ঈশা। রুমা উঠে চলে গেলো। ঈশা শ্বাস ছেড়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলল। একটু তন্দ্রা আসতেই ফোনের শব্দে চমকে উঠলো। সেটা হাতে নিয়েই দেখল ইফতি। ফোন কানে দিয়েই বলল
–বল?
ইফতি বেশ শান্ত। কিভাবে কথা শুরু করবে ভেবে পাচ্ছে না। ঈশা বিরক্ত হয়ে বলল
–কি হল ইফতি? কথা বলছিস না কেন?
ইফতি অপ্রস্তুত ভাবে বলল
–ঈশা বাচ্চার বাবা এসেছে। তুই একবার আয়। মানুষটাকে তোর দেখা দরকার।
–আসছি।
বলে ফোনটা কেটে দিলো ঈশা। সে যেতে চায় এই মানুষটাকে দেখতে। কে সেই মানুষ যার নিজের বাচ্চার উপরে কোন মায়া নেই? একটা মেয়েকে এভাবে মাঝ পথে ছেড়ে দিলো। দায়িত্ব জ্ঞানহিন এই মানুষটাকে সে দেখতে চায়।
চলবে………
(একটা সারপ্রাইজ আছে। গেস করেন তো সবাই)