তোমার নামে আমাকে ডাকো পর্ব ১১

0
226

#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-১১|
রাজস্থানের একটি আলিশান হসপিটালে এডমিট আছে বর্তমান সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী ইধা চৌধুরী। শোনা যায় শুটিং করার সময় হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়ে ইধা চৌধুরী। সঙ্গে সঙ্গে ডিরেক্টর এবং তার সহকর্মীরা ইধা চৌধুরী কে হসপিটালে এডমিট করেন। হসপিটালের সামনে হাজারো ভক্তের ভিড়। ইধা চৌধুরীর অসুস্থতার খবর পেয়ে ছুটে এসেছে তার ভক্তরা।

ভার্সিটির অফিস রুমে নিজের কলিগদের সঙ্গে কথা বলছিল ইরা। হঠাৎ করে খবরটা শুনে চমকে তাকায় টিভির দিকে। আজ নিয়ে দুদিন হল ইধা শুটিংয়ের জন্য রাজস্থান গেছে। এরমধ্যে কি থেকে কি হয়ে গেল ভেবে পায় না ইরা। ইরার ঘোর কাটে ওর কলিগ আসমার কথায়। ইরা তাকিয়ে দেখে আসমা টিভির দিকে তাকিয়ে আফসোসের সুরে বলল,

‘ বলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে এই একটা মেয়ে আছে যে মানসম্মত এবং রুচিশীল মুভি করে। না জানি মেয়েটার কি হয়েছে?’

ইরা আসমার থেকে চোখ সরিয়ে অফিস রুম থেকে বেরিয়ে করিডোর এ গিয়ে দাঁড়ায়। ফোন করে তুষার কে। ফোন বেজে বেজে কেটে যাচ্ছে। তৃতীয়বারে ফোন রিসিভ করে তুষার। ইরা কিছু জিজ্ঞেস করার আগে তুষার ক্লান্ত গলায় বলল,

‘ ম্যাম, ইধা ম্যাম এখন সুস্থ আছে। অতিরিক্ত তেল মশলাযুক্ত খাবার খাওয়ার জন্য শুটিং স্পটে হঠাৎ করে বুকে ব্যথা ওঠে। চোখের পলকে সেন্সলেস হয়ে যায়। ডিটেক্টর এবং আমরা তৎক্ষণাৎ ম্যামকে হসপিটালে এডমিট করি। এখন ম্যাম আগের থেকে সুস্থ আছে। ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে তাই এখন ঘুমিয়ে আছে।’

ইরা সব কথা শুনে শান্ত গলায় বলল,

‘ তুষার ভাই আপনাকে একটা কথা বলব, কথাটা রাখতে পারবেন আপনি?’

তুষার কিছুক্ষণ চিন্তা করে, ছোট করে বলল,

‘ কী কথা?’

ইরা নিঃশ্বাস নিয়ে একপলক আশেপাশে তাকিয়ে বলল,

‘ আপুকে হসপিটাল থেকে ডিসচার্জ করিয়ে সোজা আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসুন। আপু রানিং মুভির শুটিং এর টাইম কিছুটা পিছিয়ে নিন ডিটেক্টরের সঙ্গে কথা বলে। যদি খুব বেশি দরকার পড়ে তাহলে আমি ডিটেক্টর এর সঙ্গে কথা বলছি। আপনি যে করে পারুন আপুকে তাড়াতাড়ি বাড়িতে নিয়ে আসুন। রাখছি আমি এখন। দরকার পড়লে আমায় জানাবেন।’

ইরা ফোন রেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভার্সিটির মাঠের দিকে তাকায়।

কিছুক্ষণ আগে বাংলাদেশে এসে পৌঁছেছে নিলাংশদের পরিবার। এয়ারপোর্টের সব ফর্মালিটিস পূরণ করে বেরিয়ে পড়ে তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। সবার মাঝে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে কখন তারা ইধার দেখা পাবে? আজকে রাতে নিজেদের বাড়িতে বিশ্রাম নিয়ে কাল সকালে বেরিয়ে পড়বে জমিদার বাড়ির উদ্দেশ্যে।

তুষার হসপিটালে কেবিনের সামনে সমানে পায়চারি করে যাচ্ছে। দুই-এক ঘণ্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরবে ইধার। এদিকে রুহি এবং তার পরিবার দিল্লি থেকে রাজস্থানের উদ্দেশ্যে ফ্লাইটে উঠে পড়েছে। হয়তো ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই পৌঁছে যাবে এখানে। তুষার এক নজরে আসে পাশে তাকায়। টাইট সিকিউরিটির ব্যবস্থা করেছে তুষার। অজ্ঞাত লোকজন কিংবা মিডিয়ার লোক যেনো ইধার কেবিন এর আশেপাশের ঘেঁষতে না পারে তার জন্য এই ব্যবস্থা। কেবিনের সামনে চেয়ারে বসে থাকা ডিরেক্টর মিস্টার সেনের দিকে এগিয়ে যায় তুষার।

‘ মিস্টার সেনে আপ চাহে তো যা সাকতে হে। ম্যাম জাব হোসমে আয়েগি মে ইনফর্ম করুঙ্গা।’

মিস্টার সেনে কিছুক্ষণ তুষারের দিকে তাকিয়ে চোখের চশমা খুলে বলল,

‘ জাব মে ইটনে শামাসে ইন্তেজার কার রাহাহু, মে থোরা অর ইন্তেজার করুঙ্গা। জাব ইধা কা হোস আয়েগি মে উসে মিলুঙ্গা ফির বাপাস জাউঙ্গা।’

তুষার মাথা নাড়িয়ে ওখান থেকে একটু দূরে সরে দাঁড়ায়।

পর পর কয়েকটা গাড়ি এসে থামে হসপিটালে সামনে। কয়েকজন ডিরেক্টর প্রোডিউসার এসেছে হসপিটালে। ইতিমধ্যে রুহির পরিবার পৌঁছে গেছে হসপিটালে। সঙ্গে আছেন ডক্টর পূজা মিত্র। ইধার যাবতীয় ট্রিটমেন্ট ডক্টর পূজা মিত্র করে থাকে। তাই ইধার অসুস্থতার খবর শুনে ছুটে এসেছে।

দিঘী ক্লাস শেষ করে বন্ধু-বান্ধবীর সাথে বের হয়েছে। দিঘীর বন্ধু রাজুর কোথায় সবাই ভার্সিটির মাঠে আড্ডা দিতে বসে যায়। দিঘী অপেক্ষা করছে ইরার জন্য। ইরা এখন অন্য ডিপার্টমেন্টের ক্লাস নিচ্ছে। ক্লাস শেষ করে দুজনে একসাথে বাড়িতে ফিরবে। ভার্সিটি টা ঢাকা শহর থেকে খানিকটা দূরে অবস্থিত। তাতেও সুনামের কোনো কমতি নেই ভার্সিটির। শহরের অনেক নামিদামি ব্যক্তিবর্গের ছেলে-মেয়ে রা এই ভার্সিটির হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। আড্ডার মাঝে আগমন ঘটে রিয়াজের। রিয়াজের বড় ভাই একজন নামকরা মডেল এই নিয়ে অহংকারের কমতি নেই রিয়াজের। সারাক্ষণ সবাইকে নিচু দেখাতে দু’কদম এগিয়ে থাকে। রিয়াজ এবং তার সাথের বন্ধু-বান্ধবদের দেখে দিঘী আর ওর বন্ধুদের মেজাজ বিগড়ে যায়। দিঘী বিরক্ত হয়ে তাকায় অন্যদিকে। রিয়াজ ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ হেই তোমরা এখানে কী করছো? আর দিঘী আমি তোমাকে কখন থেকে খুঁজে যাচ্ছি? কই থাকো তুমি? এখন চলো আমরা সাথে কথা আছে তোমার সাথে।’

দিঘী রিয়াজের কথা শুনে রেগে চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

‘ আমি এখন কোথাও যেতে পারবো না ভাইয়া। কিছুক্ষণের মধ্যে ইমন ভাইয়া আমাকে আর আপুকে নিতে ভার্সিটিতে আসবে।’

ইমনের কথা শুনে রিয়াজের গলা শুকিয়ে যায়। রিয়াজের সঙ্গে যারা আছে তাদের তাড়া দিয়ে ওখান থেকে চলে যায়। রিয়াজের চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে দিঘীর বন্ধুরা মুখ টিপে হাসে।

ইধার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। এরপর থেকে একের পর এক ঝড়ের সম্মুখীন হচ্ছে। কখনো ইধার বাবাই আবার কখনো ইধার মামনি আবার কখনো রুহি সমানে বকাবকি করে যাচ্ছে ইধার। ইধা অসহায় চোখে সবার দিকে তাকিয়ে কোন লাভ হয়নি। তারা তাদের বকাবকির কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কয়েকজন ডিরেক্টর, প্রোডিউসার এবং সহ অভিনেতা অভিনেত্রীরা এসে দেখা করে গেছে ইধার সঙ্গে।

গতকাল রাত থেকে খান চৌধুরী বাড়ির সবার মন মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। নীরা অসুস্থ। নীরা কে দেখতে পরিবারের সবাই রাজস্থান যেতে চেয়েছিল কিন্তু নীরা সবাইকে বারণ করে দিয়েছে। নীরা জানিয়েছে তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে দেশে ফিরে এসে সবার সঙ্গে দেখা করবে। মানতে নারাজ থাকা সত্ত্বেও সবাই মেনে নেয় নীরার সিদ্ধান্ত।

তৌফিক চৌধুরী এসেছে জমিদার বাড়িতে। এই মুহূর্তে বাড়ির ছেলেরা কেউ বাড়িতে নেই। জমিদার রাহাত খান চৌধুরী বেরিয়েছে বিচার সভায়র উদ্দেশ্যে। তৌফিক চৌধুরী বসার ঘরে বসে আছে। বাড়ির দুজন কাজের লোক এসে নাস্তা পানি দিয়ে গেছে। কিন্তু বাড়ির লোকজনের কোনো দেখা নেই। এরমধ্যে মালা রান্নাঘর থেকে মাথায় কাপড় দিয়ে এসে বলল,

‘ আসসালামু আলাইকুম। বাবা তো এখন বাড়িতে নেই কখন আসবে তাও জানিনা। আপনি না হয় আপনার সমস্যার কথা কাগজে লিখে রেখে যায়। বাবা বাড়িতে আসলে আমি নিজ দায়িত্বে তার কাছে কাগজটা পৌঁছে দেবো।’

তৌফিক চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

‘ ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি যদি খুব ভুল করে না থাকি আপনি মামুনের স্ত্রী।’

মালা অবাক হয়ে বলল,

‘ জ্বী, আপনি ঠিক বলেছেন। কিন্তু আপনি কি আমাদের পরিবারের পরিচিত কেউ?’

তৌফিক চৌধুরী উত্তর না দিয়ে বলল,

‘ আপনার শাশুড়ি মা কোথায়? তাকে একটু ডেকে দিতে পারবেন? তাঁর সঙ্গে আমার কিছু কথা ছিল?’

মালা কিছুক্ষণ ভেবে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে চলে যায় তার শাশুড়ি মাকে ডেকে আনতে।

রাহাত খান চৌধুরী সাহেবের বিচার সভা শেষ করেছে এর মধ্যে তাঁর স্ত্রী আশা খান চৌধুরী ফোন করে তার কাছে। তার স্ত্রীর সব কথা শুনে রাহাত খান চৌধুরী স্মিতবাক হয়ে যায়।

প্রায় দুই যুগের বেশি সময় ধরে তারা জেনে এসেছে তার বাড়ির বড় বৌমা মৃত। কিন্তু আজ সব হিসেবে গড়মিল হয়ে যাচ্ছে। রায়হান যখন বড় বৌমা কে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তার এক সপ্তাহ পরে বৌমা তার পুরো পরিবারের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ফ্লাইটে উঠে। মাঝপথে বিমানটি ব্লাস্ট হয়ে যায়। এত বাজে ভাবে ব্লাস্ট হয়েছিল যে বিমানটির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেই সূত্র ধরে কতৃপক্ষ সবাইকে মৃত হিসেবে ঘোষণা করেছিল। তাহলে বড় বৌমা কিংবা তার পরিবার কোথা থেকে আসবে? সেই দুর্ঘটনায় তারা যদি বেঁচে গিয়ে থাকে তাহলে এত বছর ধরে তারা ছিলোই বা কোথায়? এইসব কথা চিন্তা করে ধর ধরিয়ে ঘামতে শুরু করে।

চলবে….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here