তোমার নামে আমাকে ডাকো পর্ব ১০

0
234

#তোমার_নামে_আমাকে_ডাকো
#লেখিকাঃ সারজীন ইসলাম

|পর্ব-১০|
আবছা অন্ধকার ভোরে ইধা একা একা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে কাউকে কিছু না বলে। উদ্দেশ্য আজ অনেক বছর পর নিজের গ্রামটাকে ঘুরে ঘুরে দেখবে। মৃদু বাতাস গায়ে মেখে ধীর পায়ে এগিয়ে চলেছে ছোটবেলার স্মৃতির খোঁজে। পূর্ব দিগন্তে রক্তিম সূর্যের আবা দেখা দিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো মেঘের আড়াল থেকে সূর্য বেরিয়ে পড়বে। কিছুদূর মাঠে কয়েকজন কৃষককে দেখা যাচ্ছে। ইধা ঘুরে ঘুরে একে একে সব কিছুর সৌন্দর্য উপভোগ করছে। ইধা হাঁটতে হাঁটতে একেবারে গ্রামের শেষ সীমানায় চলে আসে। জায়গাটা তার ভীষণ পরিচিত। কত এসেছে এখানে সে ছোটবেলায়। আষ্টেপিষ্টে স্মৃতি জড়ানো জায়গাটার সঙ্গে তার। এই রাস্তা ধরে আর একটু এগিয়ে গেলেই মস্ত বড় এক বটগাছ দেখা মিলবে, সেই বট গাছে ঝুলিয়ে রাখা দোলনায় কত দোল খেয়েছে ইধা আর প্রাণ প্রিয় বান্ধবী অন্তরা। অন্তরার বাড়ি তো এই বট গাছের আশেপাশে থাকার কথা? ইধা উদ্দীপনা চোখে আশেপাশে তাকায়। না এই ভোরবেলায় আশেপাশে কাউকে দেখতে পাচ্ছে না ইধা। আফসোসের নিঃশ্বাস ফেলে ইধা ধীর পায়ে এগিয়ে যায় বট গাছটার দিকে। যে কয় পা এগিয়ে যাচ্ছে বটগাছটার দিকে ইধার মনে হচ্ছে ও তত বেশি এগিয়ে যাচ্ছে ওর ছোটবেলার স্মৃতির কাছে। এই বটগাছটার নিচে বসে ও আর অন্ত মিলে কতনা খেলেছে। অন্তরা কে ভালোবেসে অন্ত বলে ডাকত ইধা। ইধা আলতো হাতে বটগাছের দোলনায় হাত রাখে, আস্তে-ধীরে বসে পড়ে দোলনায়। এর পরপরই মৃদু বাতাসের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দোলাতে শুরু করে ইধা। দোলনার গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ইধার ঠোঁটের হাসি ও প্রসারিত হতে শুরু করে।

কয়েকজন ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করে ইধা অন্তর বাড়ির ঠিকানা পায়। কলস ভর্তি করে পানি নিয়ে ফিরছিল তারা নদী থেকে, তখন ইধা তাদের কাছে জিজ্ঞেস করে নেয় তার প্রাণপ্রিয় বান্ধবীর বাড়ির ঠিকানা। ইধার স্কাপ দিয়ে মুখ ঢাকা থাকায় গ্রামের ভদ্রমহিলারা তাকে চিনতে পারিনি। ইধা তাদের হাসিমুখে ধন্যবাদ জানিয়ে পা বাড়ায় অন্তর বাড়ির দিকে।

বিস্তর উঠানে সামনে দাঁড়িয়ে আছে ইধা। একটু একটু করে মনে পড়ছে সবকিছু। এই বাড়িটাই তো অন্তদের বাড়ি। ছোটবেলায় কতবার এসেছে এই বাড়িতে সে। ইধা চার কদম এর মত এগিয়ে গেলে উঠনের এর পাশে ছোট্টো ঘর থেকে কাদের কথা বলার শব্দ শুনতে পায়। ইধা কৌতুহল চোখে সে দিকে তাকায়। দুজন মেয়ে নিজেদের মধ্যে কিছু নিয়ে কথাবার্তা বলছে। ইধা পিছন দিক থেকে তাদের মুখ দেখতে পারছে না। তবে সম্ভবত এই বাড়ির মেয়ে হবে। তাহলে নিশ্চয়ই ওরা অন্ত কে চিনবে? এই ভেবে ঠোঁটে হাসি নিয়ে ইধা গলা পরিষ্কার করে বলল,

‘ শুনছেন!’

কারো কণ্ঠস্বর শুনে মেয়ে দুটো পিছন ফিরে তাকায়। সাত সকালবেলা তাদের বাড়িতে অচেনা শহুরে মেয়েকে দেখে খানিকটা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকায়। উজ্জ্বল বর্ণের গায়ের রঙের মেয়েটা ইধার দিকে তাকিয়ে কৌতুহলী গলায় বলল,

‘ জি, আপনি কী আমাদের ডাকছিলেন? আপনাকে তো আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ছে না? আপনি কী পথ হারিয়ে ফেলেছেন?’

ইধা ঢেকে থাকা মুখের আড়ালে হাসে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ইধা মৃদু স্বরে বলল,

‘ অন্ত।’

মেয়ে দুটো চোখ বড় বড় করে তাকায় ইধার দিকে। ইধা সেদিকে কর্ণপাত না করে আবার বলল,

‘ এমন হা করে তাকিয়ে আছিস কেন? চিনতে পারছিস না আমাকে? অবশ্য না চেনারই কথা। একটা কিংবা দুইটা দিন তো নয় অনেকগুলো বছর পর তোর সঙ্গে আবার দেখা।’

অন্ত নিজেকে সামলে নিয়ে অবাক গলায় বলল,

‘ কে আপনি? আর কী সব বলছেন আপনি?’

ইধা স্কাপ পরিহিত অবস্থায় হেসে বলল,

‘ নীরার কথা মনে আছে তোর? ছোটবেলায় তোর খেলার সাথী ছিল।’

অন্ত অবাক গলায় বলল,

‘ তা আপনি জানেন কিভাবে?’

ইধা আবার বলল,

‘ তা আমি জানব না তো আর কে জানবে? আমি নীরা, তোর ছোট বেলার খেলার সাথী।’

অন্ত অবাক চোখে তাকায় ইধার দিকে, ইধা ধীরে ধীরে মুখের স্কাপ খুলে ফেলে। চোখের সামনে অবিশ্বাস্য কিছু দেখতে পেয়ে‌ চমকে উঠে অন্ত। অন্তর চোখে-মুখে বিস্ময় ছাপ দেখে ইধা ঠোঁট কামড়ে হাসে।

ঘড়ির কাঁটা এসে আটটার ঘরে ঠেকেছে। বাড়ির সবার মাঝে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। বাড়ির আদরের মেয়ে কত বছর পরে বাড়িতে ফিরে এসেছে অথচ আজ আবার তাকে ফিরে যেতে হবে। জমিদার রাহাত খান চৌধুরীর স্ত্রী আশা খান চৌধুরী সেই কাকভোর থেকে তোড়জোড় শুরু করেছেন। তার আদরের নাতনি যত্ন-আত্তি নিতে যেন কোনো কমতি না হয়। নীরার পছন্দের খাবারগুলো একে একে সাজানো হচ্ছে বিস্তর খাবার টেবিলে। অনেকটা সাবেকি ইলাহি আয়োজন। যাকে নিয়ে এত আয়োজন সেই মধ্যমণি এখনো উপস্থিত হয়নি খাবার টেবিলের চত্বরে। আশা খান চৌধুরী বাড়ির কাজের লোকদের তাড়া দেয় নীরা কে ঢেকে আনার জন্য। বাড়ির কাজের লোক রহিমার মা হতাশা মুখের ফিরে আসে জানায়, ‘নীরা আপা ঘরে নাই, দরজা ভিতর থেকে ভেজানো ছিল। কখন বের হয়েছে তা জানে না কেউ।’ সেই ঘটনা শোনা মাত্র বাড়ির পুরুষগুলো একত্রিত হয়। কোথায় গেলো মেয়েটা কাউকে কিছু না বলে? তুষার ইতিমধ্যে আশেপাশে খোঁজ শুরু করে দিয়েছে।

ঘন্টা দুয়েক খোঁজাখুঁজির পরে খবর এলো গ্রামের রহমত আলীর বাড়িতে আছে তাদের আদরের নাতনি। ছোটবেলার সই এর সঙ্গে দেখা করতে গেছে বলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে জমিদার রাহাত খান চৌধুরীর স্ত্রী আশা খান চৌধুরী। বেলা বাড়ার আগেই সবার আড়ালে ইধা আর অন্ত চলে এসে চৌধুরী বাড়িতে। খান চৌধুরী বাড়ির লোকজন এবং হাতে গোনা দুই একজন ছাড়া তেমন অন্য কেউই জানেনা ইধা বিডিতে আছে।

অন্ত সেই সকাল থেকে ইধার সঙ্গে আছে। মাঝেমধ্যে তাঁর বিশ্বাস করতে দ্বিধা হচ্ছে আদৌ তার ছোট বেলার খেলার সাথী বর্তমান সময়ের সেলিব্রেটি নায়িকা ইধা চৌধুরী কী না। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি ইধা ছোট বেলার খেলার সাথী নীরা।

রাহাত খান চৌধুরী স্ত্রী আশা খান চৌধুরী সকাল থেকে এক রাশ অভিমান করে আছে তার আদরের নাতনি সঙ্গে। সেই কাক ভোরে উঠে বাড়ির কাজের লোকদের সঙ্গে নিয়ে নীরার পছন্দের খাবার রান্না করেছিল সে, কিন্তু নীরা? সে সকাল বেলা বন্ধুর বাড়ি থেকে নাস্তা করে এসেছে। এই নিয়ে এসে প্রচুর অভিমান করে আছে নীরার সাথে।

গুটি গুটি পায়ে এসে ইধা দাঁড়ায় জমিদার রাহাত খান চৌধুরীর শোবার ঘরের দরজায়। কিছুক্ষণ পরে সে চলে যাবে এখান থেকে। আবার কবে না কবে দেখা হয় তার প্রিয় মুখগুলোর সঙ্গে তা তাঁরও জানা নেই। ইধা চায় না এই অল্পসময়ের জন্য তার দাদিমা তার জন্য কষ্ট পাক। ইধা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে দাদিমার ঘরে প্রবেশ করে। মুহূর্তেই দমকা শীতল হাওয়া শরীরে ইধার শরীরকে। কত বছর পরে আবার আজ এই ঘরে পা রাখল ইধা। নয় নয় করেও অনেকগুলো বছর। ইধা এসব আকাশকুসুম ভাবতে-ভাবতে সম্পূর্ণ ঘরে চোখ বুলায়। না, তার প্রাণাধিক প্রিয় দাদিমা ঘরে নেই! কিন্তু আসার সময় দীঘি যে বলল দাদিমা ঘরে? দু কদম এগিয়ে গিয়ে ঘরের মাঝ বরাবর দাঁড়ায় ইধা। ওহ তাহলে জমিদার গিন্নি বেলকুনিতে! মৃদু হেসে ইধা পা বাড়ায়।

নিজের পাশাপাশে কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে পিছন ফিরে তাকায় জমিদার গিন্নি। তার আদরের নীরা কে তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে অভিমানে মুখ ফিরিয়ে নেয় জমিদার গিন্নি। ইধা আলতো করে হাত রাখে তার দাদিমার কাঁধে। মৃদু স্বরে বলল,

‘ আমার উপরে এত অভিমান করে আছো কেন তুমি? কিছুক্ষণ পরে তো চলেই যাব। এখনো অভিমান করে থাকবে?’

দাদিমা অভিমানী গলায় বলল,

‘ আমি তোর কে যে তোর উপরে আমি অভিমান করে থাকবো? আমি তো কেউ না, একদম কেউ না।’

ইধা হাসে। হেসে বলল,

‘ তুমি জানো এবং তোমার অন্তরাত্মা জানে আমি তোমার কে? সুতরাং এসব ইমোশনাল কথাবার্তা বলে আমাকে কনফিউজ করতে পারবে না।’

দাদীমা মোলায়েম গলায় বলল,

‘ তাহলে কেন এমন করছিস দিদি ভাই? এসেছিস পর থেকে বাড়ির কারও সঙ্গে ঠিকভাবে কথা বলিসনি, তোর বাবা ভাইরের দিকে তো এক পলকের জন্য তাকাতে দেখি নি। আমি এত কষ্ট করে রান্না করলাম তাও খেলি না। কেনো? বলবি আমায়?’

ইধা আবারো হাসে, হেসে বলল,

‘ আমি তোমার রান্না করা খাবার খাইনি এজন্য বুঝি তোমার মন খারাপ? আচ্ছা চলো, আমি বরং এখনই তোমার হাতের রান্না করা খাবার খাব।’

দাদিমার চোখ খুশিতে জ্বলজ্বল করে উঠে, ঠোঁটে একফালি হাসি নিয়ে বলল,

‘ সত্যি তুই খাবি? কিন্তু সকালের নাস্তা তুই এখন খেলে দুপুরের খাবার কখন খাবি? এখন যে সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চলল।’

ইধা ধীর গলায় বলল,

‘ এই সামান্য বিষয় নিয়ে এত চিন্তা? আমি তোমার বানানো রান্না থেকে একটু একটু খাবো। তাহলে হবে তো?’

দাদিমা বিস্তর হেসে বলল,

‘ চল, নিচে চল। আজ আমি তোকে নিজের হাতে খাইয়ে দেবে।’

সকালের গোছগাছ শেষের দিকে, কাল সকাল সকাল সকলে রওনা দিবে বিডির উদ্দেশ্যে। তাজ যবে থেকে তার দিদুনের মুখে শুনেছে তারা সবাই তার তথাকথিত ইধা ভাবির সঙ্গে দেখা করতে যাবে তখন থেকে তাজের উত্তেজনার শেষ নেই। ইশা চৌধুরী উদাসীন মনে নিজের সব কাজ গুলো করছে। কোথাও যেন কিছু থেকেও নেই। অবশ্য তার মন ভালো করার জন্য সর্বক্ষণ তাজ বিচ্ছু তার সঙ্গে আছে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here