তোমাতেই অস্তিত্ব আমার পর্ব-৯

0
2146

#তোমাতেই_অস্তিত্ব_আমার
লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা

৯.

দুদিনের পরিচয়ে কাউকে নিয়ে এতোবার এতোটা ভাবার কারন কি?নিজের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ থেকেই ক্লাস শেষে আরুর সাথে বেরোলাম।
বাইরে দাড়িয়ে দেখলাম ক্লাসের বাইরের বারান্দাতেই মালু,উর্বি,রায়হানও এসেছে।কিছুটা এগোতেই আরু বললো,

-গাইস,ভাইয়া আজও পিক করতে আসবে আমাকে।

আমি মাথা তুলে বললাম,

-তো আমরা নাচি?

মালু আমার মাথায় চাটি মেরে বললো,

-তুই আরমান ভাইয়ার নাম শুনেই জ্বলিস কেনো?

উর্বি বললো,

-ঠিক বলেছিস,ও মেন্টালি এখনো সিক।ভালো মানুষগুলোকে চোখে পরেনা ওর।

-কিহ্!আমি মেন্টালি সিক?আর কি বললি?ভালো মানুষ?

-তো আমার ভাইয়াকে তোর খারাপ মনে হয় মিথি?

-ত্ তা কখন বললাম?

-ভালো নিয়ে তো কোশ্শেন ঠিকই করলি!

মালু বললো,

-ছাড়তো ওর ভালো মন্দের বিচার!কোথাকার কোন সিয়াম না সোডিয়াম এর গাড়িতে চরে বসে!

আশ্চর্য!সিয়ামকে নিয়ে ওরা কি করে জানলো?দেখেছে নাকি?আমি কিছু বলবো তার আগেই রায়হান ওর ঘাড়ের ব্যাগের ফিতা টানতে টানতে বললো,

-অব্ ত্ তোরা বিগ বস সিজন থাউসেন্ট চালায়া যা।আমি আসছি।

বলেই পিছনে ঘুরে একপ্রকার দৌড়ে চলে গেলো।আমরা ওর যাওয়াটা দেখছি তাকিয়ে।

-হ্যালো এভরিবডি।

সামনে তাকাতেই মিস্টার ইশতিয়াক আরমানের সেই হাসোজ্জল মুখ!উর্বি বললো,

-হাই ভাইয়া!কেমন আছেন?

-টপ অফ দ্যা ওয়ার্ল্ড!তোমরা?

-আপনাকে দেখে সেম ফিল আসতেছে।

-হ্যাঁ ভাইয়া,আপনার উপস্থিতিতেই মুড ভালো হয়ে যায় আমাদের।

-রিয়েলি?সবার?

-জ্বী হ্যাঁ,অবশ্য কেউ কেউ বলবে আমার না।অ্যাটিটিউড দেখিয়ে স্বীকার করবে না।

এ কথাটা মালু আমার দিকে তাকিয়েই বললো।আরমান মুচকি হাসলেন।আমি চোখ ছোট করে এদের কথা শুনছিলাম।আরমান বললেন,

-আরু,তোর এই বান্ধবী মাথায় আঘাত পেয়ে চোখ আর মুখ দুটোই কি রিপেয়ারিং এ দিয়েছে নাকি?অলওয়েজ ওমনে আজব ভাবে তাকিয়ে থাকে,সাইলেন্ট মোড!

-মিথি আর সাইলেন্সি?হুহ!তাহলেই হয়েছে।ওর জন্য আজ অবদি লাইব্রেরীতে যাইনাই।

-আরে ভাইয়া,কান ঝালাপালা করে দিতে এক্সপার্ট এই মেয়ে।দু মিনিট ওর কাছে বসলে সাউন্ড পলিউশন রচনা লিখতে আপনার এতোটুকো কষ্ট হবে না।

-তাই নাকি?

-জ্বী ভাইয়া,জাস্ট টপিক তুলে দিলেই গরগর করে তার উপর সমস্ত ঝাল নুন মিশিয়ে সেটাকে শেষ অবদি শুনিয়ে হজম করাবে আপনাকে।

ওদের কথা শুনে রাগে আমার পায়ের নিচের মাটি গরম হয়ে গেছে।এভাবে অপমান করছে আমাকে?তাও এই লোকের সামনে?চেচিয়ে বললাম,

-ওই চুউউউপ!!

আমার চিৎকারে ওরা থেমে গেলো।আমি মালু উর্বি আরুর দিকে তাকিয়ে নখ ঘুরিয়ে বললাম,

-তোদের তো পরে দেখে‌ নিবো।

এরপর আরমানের দিকে ঘুরে বললাম,

-আর এই যে মিস্টার,আমার চোখ মুখ সবই ঠিক আছে।আর কানও।তাই আমাকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কিছু বললে সেটা শুনতে পাবো না এমনটা একদমই ভাববেন না।আবার সেসব কথার পরে আপনার ধারনাকে ঠিক রেখে সাইলেন্ট থাকবো এমনটাও নয়।আমাকে ইনসাল্ট করলে আমি আপনাকে ছেড়ে কথা বলবো কেনো?সমস্যা কি আপনার?আমার সাথে এরকম বিহেভের কারন কি?কোন পাকা ধানে মই দিয়েছি আপনার?

ওরা সবগুলো চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।সবার চোখেমুখে ভয়ের ছাপ।কথাগুলো বলে আমিও হুশে ফিরলাম।নরমাল ড্রেসাপে থাকলেও মানুষটা তো সুবিধের নয়।প্রথমদিনের কথাটা কিভাবে ভুলে গেলাম আমি!নিজেকে প্রস্তুত করছিলাম বড়সর কোনো ঝটকার জন্য।আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে উনি শব্দ করে হেসে উঠলেন।সাথে বাকিরা সবাইও হাসতে লাগলো।আমি তো অবাকের চরম পর্যায়ে। আমাকে কিছু না বলে এভাবে অট্টহাসির মানে কি?হাসির মতো কিছু বলেছি?নাহ্!তা তো নয়।মজার হাসি না হলে কিসের হাসি এটা? তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে আবারো অপমান করছে না তো আমাকে?আবারো রাগ হচ্ছে আমার।উনি পেটে হাত দিয়ে হাসি কিছুটা থামিয়ে আরুকে বললেন,

-আরু,তোর এ বান্ধবী তো আসলেই সাউন্ড পলিউশন রচনা লেখার বেস্ট মোটিভেশন।উর্বি তো ঠিকই বলেছে।

বলে আবারো হাসতে লাগলো।আমি রাগে কটমটে চোখে একবার সবগুলোর দিকে তাকিয়ে বললাম,

-তোরা হাস,আমি আসছি।লেইট হচ্ছে আমার।

ফুসতে ফুসতে সামনে এগোতেই মালু বললো,

-সোডিয়াম আসবে রে মিথি?তাই এতো তাড়া বুঝি?

ওর কথা শুনে মেজাজ আরো বিগড়ে গেলো।নিচদিক তাকিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে যেইনা করিডোরের নেক্সট ডিপার্টমেন্টের ক্লাসের দরজার সামনে দাড়িয়েছি কেউ একজন এসে দুহাতে জরিয়ে আমায় বেশ অনেকটা দুরে সরিয়ে আনে।
ঘটনাটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটেছে যে কিছু বুঝলাম না আমি।এরপর যখন মনে হলো কেউ আমাকে জরিয়ে আছে সর্বশক্তিতে ধাক্কা মেরে দুরে সরিয়ে দিলাম তাকে।সামনের মানুষটা বিরক্তির চোখে তাকিয়ে আছে আমার দিকে,আর আমি অবাক চোখে।আবারো উনি এভাবে আমাকে জরিয়ে ধরলেন।হ্যাঁ,আরমানই আমাকে ওভাবে সরিয়ে আনে।আমি রাগী গলায় বললাম,

-কি সমস্যা আপনার?আপনি আবারো আমাকে এভাবে ছুয়েছেন কেনো?এতোটুকো….

কথা শেষ হওয়ার আগেই কানে বিকট শব্দ আসলো।যেনো হাজার হাজার মানুষ একসাথে জরো হয়েছে।পিছনে তাকিয়ে দেখলাম পাশের ডিপার্টমেন্টের বড় আপু ভাইয়ারা হাতে আবির নিয়ে তেড়ে আসছে।আমার চোখ কপালে!ওরা বসন্ত উৎসব পালন করতেছে নাকি?আরমানের দিকে তাকালাম।উনি এগিয়ে গিয়ে ওদের হাত থেকে দুহাতে আবির মুঠো করে বললেন,

-জুনিয়রদের সাথে আবির মাখলে আমার সাথেও খেলা যায় রাইট?

উনার কথা শুনে সবগুলো উল্টোদিকে হাটা ধরলো।মালু,উর্বি,আরু ওরাও ওদের সাথে দৌড় লাগালো রঙ নিয়ে।নিমেষেই উধাও সবগুলো,করিডর ফাকা।আমি বুঝি না এ লোককে এতো ভয়ের কি আছে?কিভাবে চেনে সব একে?যদিও সেদিন দেখেছিলাম ভিলেন এর মতোই,কিন্তু এখন তো সাধারন ব্যবহারই করছে তাহলে?নিচদিক তাকিয়ে ওখানেই দাড়িয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই সামনে কারো উপস্থিতি টের পেলাম।মাথা তুলে দেখি আরমান দাড়িয়ে।

-আপনি…

আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে উনি বামহাতের আবির আমার গায়ে ছুড়ে মারলেন,আমি খিচে চোখ বন্ধ করে নিলাম।হুট করে উনি বামহাতে আমায় কোমড় জরিয়ে ধরে একদম কাছে টেনে নিলেন।চোখ মেলে বড়বড় করে তাকালাম আমি।উনি আমার সামনের কিছু চুল কানের পিঠে গুজে দিয়ে আমার পিছন দিয়ে উনার ডানহাত ঘুরিয়ে সামনে আমার ডান গালে রঙ ছোয়ালেন।আমি সাথেসাথে চোখ আবারো বন্ধ করে নিলাম।আরমান তার মুখ আমার একদম কাছে নিয়ে আসলেন।তার নিশ্বাস পরছে আমার মুখে।দম আটকে গেছে আমার।কাপছি আমি।উনি আলতোকরে উনার গাল আমার গালে স্পর্শ করিয়ে স্লাইড করলেন।তারপর আমায় ছেড়ে দিয়ে পকেটে হাত গুজে একটু সরে দাড়ালেন।
চোখ মেলে তাকালাম আমি।উনি হাসছেন।আমাকে তাকাতে দেখে আবারো দু পা এগিয়ে এসে বললেন,

-তোমার জন্য নতুন করে বাচতে শিখেছি আমি।তাই তুমিও শুধু আমারই রঙেই রাঙবে,আমিও একমাত্র তোমাকেই রাঙাবো।

কথাগুলো বলে উনি চলে গেলেন।আমি এখনো রোবটের মতো দাড়িয়ে ভাবছি কি হলো আমার সাথে পাঁচ সেকেন্ড আগে।কোনো দিন তো কোনো ছেলে আমার দু ফুট কাছে অবদি আসতে পারেনি,সহ্য করতাম না আমি।তবে আজ?আজ দ্বিতীয়বারের মতো উনি এভাবে এতোটা কাছ থেকে স্পর্শ করে গেলেন আমাকে।আমি কিছুই বলতে পারলাম না?শক্ত গলায় যাকে জরিয়ে ধরার জন্য কথা শোনাতে যাচ্ছিলাম,তার আচরনে কেনো দূর্বল হয়ে গেলাম আমি?এমনটাও তো কোনোদিন হয়নি!তবে আজ কেনো?

তারথেকেও বড় কথা এসব আমার সাথে আগেও ঘটেছে এমন মনে হচ্ছে কেনো?কেনো মনে হচ্ছে কেউ একজন এভাবেই আগেও রাঙিয়েছিলো আমায়?এ কথাগুলোই বলেছিলো আমায়?বলেছিলো কি?কে বলেছিলো?এই স্পর্শ,কেনো এটা আমার অচেনা লাগে না?কেনো মনে হয় আমার সাথে মিশে আছে এই ছোয়া?প্রতিবারই কেনো নিজের মনটা প্রশান্তি অনুভব করে এই ছোয়ায়?কেনো?
উফফফ্!মাথা ফেটে যাচ্ছে আমার,তবুও এসব কিছু মাথা থেকে নামাতে পারছি না,কিছু মনে করতেও পারছি না।থম মেরে দাড়িয়ে আছি।রায়হান কোথা থেকে এসে বললো,

-কিরে মিথি?তোর এ অবস্থা কেনো?

…….

-কিছু বলছিস না যে?
…….

-কিরে যাবি না?

………

রায়হান সামনে দাড়িয়ে জোরে দুহাতে তালি বাজিয়ে বললো,

-ওয় রুপকথার রাজকন্যার পিসিমা,যাবি তো নাকি?

আমি ধ্যান ছেড়ে বললাম,

-কিছু বললি?

-বলেছি তো অনেক কিছুই।তোর এ অবস্থা কেনো?

কি বলবো ওকে?আরুর ভাই এমনটা করেছে বললে খারাপ ভাবে নিতে পারে।বললাম,

-সিনিয়রস্ রা বসন্ত উৎসব পালন করছিলো।তাই গায়ে লেগে গেছে।

-কিসের বসন্ত উৎসব?প্রিন্সিপাল তো মানা করে দিছে এসবের জন্য।তাইতো কিছু করলাম না আমরা।

-তাহলে?ওরা তো আবির নিয়ে…

-বেশি সাহস দেখাইছে।একবার যাক স্যারের কানে,বুঝবে।তোকে এভাবে মেখে দিয়ে গেছে গালে?

আমি গালে হাত বুলালাম।জীবনে প্রথমবার কেউ আজ এভাবে ছুয়েছে আমায়,এতোটা কাছে এসে।সেই মানুষটাই যাকে দুদিন আগে চড় মেরেছিলাম আমি।কিন্তু উনি এসব কেনো বলে গেলেন?মালু উর্বি তো বললো উনার ভালোবাসার কেউ আছে।তাহলে?আমার এতোটা কাছে কেনো আসলেন উনি?

-কিরে?তোর সমস্যা কি?এতো চিন্তা কিসের তোর?

-ইয়ে কিছুনা।চল।

-মালু উর্বি কই?আরু?

-হেয়ার উই আর।

তিনজনই এসে গেছে।কিন্তু ওরা তো আবির খেলতে গিয়েছিলো।তাহলে?একফোটা আবির নেই কারো গায়ে। রায়হান বললো,

-কই গেছিলি তোরা?

আরু বললো,

-তুমি কি যাওয়ার সময় বলে যাও কই গেছিলা?

রায়হান আর কিছু বললো না।আরু বললো,

-ভাইয়া গাড়িতে ওয়েট করছে।আমি আসছি।বাই গাইস।

বাই বলে ও বেরিয়ে গেলো।আমি এখনো সবটা ভাবছি।আমাকে ভাবতে দেখে উর্বি বললো,

-কিরে মিথি?কি ভাবছিস?

আরুর ভাইয়ার কথা ওদের বলাটা ঠিক হবে কি না তা বুঝে উঠতে পারলাম না।মালু বললো,

-এই রঙটঙ নিয়ে বাসায় কি বলবি?

-কেনো?যা সত্যি তাই।সিনিয়রস্ রা বসন্ত উৎসব সেলিব্রেট করেছে।

-গুড।

ওদের সাথে কথা বলে গেইট অবদি আসলাম।সেদিনের বিশাল কালো গাড়িটা চোখে পরলো।ওটা আরমানের।উনি যাননি এখনো?আরু তো এসেই গেছে।কারো জন্য ওয়েট করছেন নাকি?করুক।তাতে আমার কি?রিকশা করে বাসায় চলে আসলাম।আপিকে সবটা না বলা অবদি শান্তি নেই আমার!

আরিশাকে নিয়ে ড্রাইভ করছে আরমান।ইচ্ছে করেই ওকে পিছনে বসিয়েছে।আজকের ঘটনায় ওর মুখে লেগে থাকা হাসি আরিশার চোখে পরলে ও কথা শুনিয়ে শুনিয়ে জ্বালিয়ে মারবে ওকে,তাতে মোমেন্টস্ গুলো ভাবতে ডিসটার্ব ফিল হবে ওর।পেছনে আরিশা বসে ফোন স্ক্রল করছে আর উকি মেরে ভাইকে দেখছে।আজ যেনো হাসি সরছেই না তার মুখ থেকে।উপচে পরছে খুশি একদম।আরিশা বললো,

-বাব্বাহ্,ভাইয়া তুই…

-আরেকটা কথা বললে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিবো।

-কেনো?বললে কি?

-এজন্যই পিছনে বসিয়েছি তোকে।একদম চুপ থাকবি।আমি সবটা বারবার ভাববো।একদম ডিস্টার্ব করবি না।

-করলে?

-তোর পকেটমানি অফ,মোবাইল রিচার্জ অফ আর ফোনটাও হারিয়ে যাবে।

আরিশা হাতে থাকা ফোনটা শক্ত করে ধরলো।এটা ছাড়া ও থাকতে পারবে না।কাদোকাদো গলায় বললো,

-তুই সবসময় এমন করিস!

-তাহলে চুপ থাক।

আরিশা চুপ করেই রইলো।আরমান একহাতে স্টেয়ারিং ধরে ওপরহাতে মাথার চুলগুলো উল্টে দিলো।ঠোট কামড়ে হেসে মনে মনে বললো,

-মনে পরে তোমার মিথি,এভাবেই প্রথম ছুয়েছিলাম তোমায়।সেদিনও আজকের মতো বসন্ত উৎসব ছিলো না,তবুও রাঙিয়েছিলাম তোমাকে আমার রঙে।

সেদিন ভার্সিটিতে ফোর্থ ইয়ার র্যাগ ডে ছিলো।মিথিকে দেখার আরেকটা সুযোগ পাবে ভেবে বলার সাথে সাথেই রাজি হয়ে গিয়েছিলো কালচারাল ফাংশন অ্যাটেন্ড করতে,যদিও সেটা ওর বাবার প্রক্সিতে।আরুকে নিয়ে পৌছে যায় ভার্সিটিতে।কমলা সাদার গাউনে সেজেছিলো মিথি।ছাড়া চুলে দুটো ছোট পাথরের ক্লিপ,ঠোটে লিপস্টিক,বরাবরের মতোই কাজল ছাড়া চোখ।
গেটে মালিহা,উর্বির সাথে আরুর জন্য ওয়েট করছিলো মিথি।আরমান গাড়ি থেকে নেমে ওকে দেখে আটকে যায়।কি মায়াবী লাগছে আজ মিথিকে।আরু ওকে জরিয়ে ধরে বললো,

-বাব্বাহ্!আজ তো স লোগোকি জান লে লোগে মেরে জান!

-কেনো?সেজেছিস তো তুই।নিজেরটা শোনার জন্য বুঝি এই চাল?হুম?

-ধুর!না সেজেই যা করেছিস,আমি নিজেই ফিদা।

মালু বললো,

-ঠিক বলেছিস আরু,মিথিকে অল্প সাজেও যা মায়াবি লাগছে না।তুইও তো কম যাস না।

উর্বি বলে উঠলো,

-ওহ্!তারমানে পার্লার গেছিলাম বলে আমাকেই কথা শোনাচ্ছিস তোরা নাকি?আবে ভাই আমি সিঙ্গেল মাইয়া,ফিলস্ কষ্ট!

-ইশশশ্!!থাক,আর কষ্ট পেতে হবে না।যা সেজেছিস আজ তোদের তিন সিঙ্গেলের খবর আছে।মিথি তুইও!

-হুম,তার আগে তো তোদের লিস্টের সেন্সলেস ছেলেগুলোকে হসপিটালাইজড্ করে এ সাজটুকো ঠিক রাখতে পারি কিনা তাই দেখি।

ওরা হাসলো।মিথি এবার আরমানের দিকে তাকালো।অনেকক্ষন হলো একজোড়া চোখ তাকে দেখে যাচ্ছিলো এমনটা মনে হচ্ছিলো।আরমানের দিকে তাকাতেই চোখাচোখি হয়ে যায় তাদের।সে সাদা শার্ট এর উপর কোটসুট পরে এসেছে।আরিশা বললো,

-আব্বুকে গেস্ট হিসেবে আসতে বলেছিলো।কিন্তু দেশের বাইরে তো,তাই ভাইয়াকেই প্রক্সিতে ডেকেছে।এছাড়াও ভাইয়ার অনেক জুনিয়রস্ আছে তো।

উর্বির বললো,

-বেশ তো।চল এগোই আমরা।

ওরা চারজন সামনে একসাথে হাটছে।কিছুটা পিছিয়ে পাশ আরমান হাটছে আর মিথিকে দেখছে।সেদিকে কোনো খেয়ালই নেই মিথির,খারাপ লাগছে ওর।মিথির কাছে গিয়ে বলতে পারছে না কতটা সুন্দর লাগছে ওকে।তো বান্ধবীর সাথে যেনো হাজার বছরের ব্যবধানে না বলা কথার মাঝে হারিয়ে আছে।
দু পা এগোতেই অনেকগুলো ছেলে দৌড়ে এগিয়ে আসে।কিছু না বুঝে সাইডে সরে যায় মিথিরা।ছেলগুলো আরমানকে মালা পরিয়ে একরকম উল্লাস করতে করতে নিয়ে যায়।

কালচারাল ফাংশন শেষে সবাই আবির মাখামাখি করছিলো।যদিও চেনাজানা কয়েকটা আপু মিথিকেও জোর করে,কিন্তু ও যায় না।আরমান ছেলেদের গ্রুপের মধ্যমনি হয়ে একপ্রকার বাধ্য হয়ে অসহায়ের মতো দাড়িয়ে আছে,ছাড়ছে না ওকে কেউই।তবে চোখ রাঙানিতে এখনো কেউ আবির ছোয়াতে পারেনি।মেয়েরা আলাদা গ্রুপ করে নাচছে সবাই।ইতিমধ্যে মালিহা উর্বিও যোগ দিয়েছে,আরু বেশ কিছুক্ষন হলো ওয়াশরুমে যাচ্ছি বলে নিখোজ।মিথি এবার বিরক্ত হচ্ছে।নাচতে গেলেই আবির দিয়ে ভুত বানিয়ে দেবে।দুরে দাড়িয়ে বান্ধবীদের সাথে মজা করবে,ওরাও বিভীষনের মতো আচরন করছে।

একসময় দেখলো মালিহা উর্বি দু জন দুদিক থেকে হাত পিছনে লুকিয়ে এগিয়ে আসছে ওর দিকে।বুঝতে আর বাকি রইলো না ওদের হাতে আবির।একছুটে মিথি যেইনা পালাবে,কিছুদুর যেতেই কেউ হেচকা টানে ওকে জরিয়ে ধরে ফেলে।কিছুক্ষন পর আরমান ছেড়ে দিয়ে আলতোকরে ওর গালে আবির মাখায়,নিজের গালে স্পর্শ করে আজকের বলা কথাগুলো বলেই চলে আসে।সেদিনও মিথি আজকের মতোই ঠায় মেরে দাড়িয়ে ছিলো।সেদিনও আরমানের কাছে যাওয়াতে,স্পর্শ করাতে মিথি আজকের মতোই কাপতে শুরু করেছিলো।সেদিনও আরমান শুনেছিলো ওর হার্টবিট,আজকের মতোই।

অতীতের কথা ভেবে মুচকি হেসে গাড়ি থামায় আরমান।ভালোলাগার মানুষকে প্রথমবারের মতো স্পর্শ করার একেকটা মুহুর্ত স্পষ্ট মনে আছে ওর,যেনো ভাসছে চোখের সামনে।আরিশাকে সাথে নিয়ে বাসার কলিংবেলে চাপ দেয়।হাসিমুখে গেট খুললেন মিসেস জামান।ভেতরে ঢুকতেই সোফায় দেখতে পেলো আফরোজ জামান কে।আরিশা খুশিতে দৌড়ে গিয়ে জরিয়ে ধরলো বাবাকে,কান্না শুরু করে দিলো।আফরোজ জামানও আবেগে মেয়েকে জরিয়ে কাদছেন।
আরমান দরজাতেই আটকে গেছে।সত্যিই আট বছর পর ওর বাবা দেশে এসেছেন।ভিডিও কলে কথা হওয়ার চারমাস পর দেখছে নিজের বাবাকে।আনন্দ,অনুতাপ,কষ্ট সব অনুভুতি একসাথে ভর করেছে।আফরোজ জামান হাত বারিয়ে দিলেন।এবার আরমানও এগিয়ে গিয়ে উনাকে জরিয়ে ধরলো।মিসেস জামান পাশে দাড়িয়ে বাবা ছেলেমেয়ের এ অপুর্ব সুখের মুহুর্তকে দেখে নিজেও কাদছেন।মনে মনে আল্লাহর শুকর করে মিথিলাকেও একবার দোয়া করে নিলেন উনি।ওর ফিরে আসাটাই এসব সম্ভব করেছে।আফরোজ জামান বললেন,

-বেশ লম্বা হয়ে গেছো আরমান।

আরমান বাবাকে ছেড়ে চোখ মুছে বললো,

-তুমি তো আরো ইয়াং হয়ে গেছো।

-হতেই তো হবে,দু দিন পর যখন তোমার ছেলেমেয়েরা আমার কাধে উঠতে চাইবে,মানা করলে তো মানসম্মান থাকবে না।

সবাই হাসলো।আরু কোমড়ে হাত দিয়ে বললো,

-ও,এখন আমার কথা মনে নেই তাইনা আব্বু?

-কেনো?তুই কি স্মরনীয় কিছু করেছিস যে মনে থাকবে তোকে?

-ভাইয়া!একদম বাজে বকবি না।আব্বু,দেখো না তোমার ছেলে…

আফরোজ জামান হাসলেন।ছেলের এমন পরিবর্তনে মনে তার শান্তি আসলো।হেসে বললেন,

-হ্যাঁ হ্যাঁ,আরমান,তুমি আমার গুড়িয়াকে জ্বালাচ্ছো কেনো?

-অ!এবার আমি কেউনা?

-কি শুরু করলি কি তোরা বলতো?আরু,আরমান,দুজনেই রুমে যা।ফ্রেশ হয়ে আয়।তারপর কথা হবে।

দুভাইবোন যে যার রুমে চলে গেলো।আফরোজ জামান বললেন,

-ছেলেটাকে এভাবে দেখে যে আমার কি সুখ হচ্ছে!

-হুম!সবটাই আল্লাহর্ রহমত।তার ইচ্ছাতেই মিথি ফিরে এসেছে আরমানের সুখ নিয়ে।

রাতে ডিনার শেষে প্রতিদিনের মতো রুমে রাখা ছবিগুলোতে চোখ বুলাচ্ছে আরমান।একেকটাতে তার ভালোবাসার মানুষটার একেক ভঙ্গিমা,প্রত্যেকটাই ওর অজান্তে তোলা ছবি।আফরোজ জামান দরজায় দাড়িয়ে বললেন,

-আসবো?

-আরে অনুমতি কেনো নিচ্ছো আব্বু?ভেতরে আসো না।নাকি ক্ষমা করতে পারোনি এখনো আমাকে?

আফরোজ জামান ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললেন,

-তেমনটা নয়,সবারই কিছু পারসোনাল স্পেস আর সময় থাকে।তোমারও…

-এভাবে বলো না আব্বু।আমি তো…

-থাক আরমান।তোমার কোনো কথার কোনো কৈফিয়ত আমি কোনোদিনও চেয়েছি বলো?আমি জানি,তুমি কি করতে পারো।তাইতো তোমাকে নিয়ে সবসময় গর্বই হয় আমার।

আরমান ওর আব্বুকে জরিয়ে ধরলো।আফরোজ জামান বললেন,

-কাদেরকে কবে ধরছো?

-আর কিছু‌দিন আব্বু,মিথি ও‌ বাসায় সেইফ না।আমি আগে ওকে সুস্থ্য করে এ বাসায় আনি,তারপরই ওই লোক আর তার চামচা মুখোশধারী লোককে চরম শাস্তি দিবো।

-এরমধ্যে যদি ওরা জেনে যায়?বা কোম্পানিতে কোনো সিন ক্রিয়েট করে?

-করবে না,করতে পারবে না।আমি করতে দেবো না।

আফরোজ জামান একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-আরমান,বাবা আমার!তুই যাই‌ করিস,তাতে যেনো তোর কোনো ক্ষতি না হয়।একটু সাবধানে থাকিস।আমার এটুকু কথা রাখ।

আরমান বাবার দু কাধে হাত রেখে বললো,

-চিন্তা করো না আব্বু,কিচ্ছু হবে না আমার।কিচ্ছু হবে না।

আফরোজ জামান চোখের দুফোটা পানি মুছে বললেন,

-তো এখনও যাস নি যে?

আরমান বড় বড় চোখ করে তাকালো।

-ওভাবে তাকিয়ে কি দেখছিস?এখনো বাসায় কেনো তুই?

-এ্ এখন আ্ আবার ক্ কোথায় যাবো আব্বু?ব্ বাসায়ই তো থাকার কথা!

-হুম,জানা আছে আমার তোর কোথায় থাকার কথা এখন!যা। বেশি রাত করলে সময় কম পাবি।

আরমান ঘাড়টা চুলকে বললো,

-আব্বু তুমিও না।

আফরোজ জামান হাসলেন।

-ও বয়সটা আমারো ছিলো বেটা।যাই হোক গাড়ি নিয়ে যাবি?

-নোপ!বাইক নিয়ে।

-ওকে,সাবধানে যাস কেমন?তাড়াতাড়ি ফিরিস।ব্যাপারটা রিস্কি।মাহবুব টের পেলে রক্ষে নেই।

-ডোন্ট ওয়ারি।টের পাবেন না উনি।

-হুম,জানি তো।কাচা কাজ করার ছেলে আমার না।আচ্ছা,তুই যা।

-ওকে আসছি।গুড নাইট।

-গুড নাইট।

বাইকের চাবিটা ঘুরাতে ঘুরাতে বেরিয়ে গেলো আরমান।গন্তব্য তার সুখের একমাত্র ঠিকানা।দিনশেষে এক চিলতে সুখের আশায় কাছের মানুষটাকে জরিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে বাইক স্টার্ট দেয় আরমান।

ডিনার শেষে কল লাগালাম আপির ফোনে।একটাবারো কথা হয়নি আজ।

-হ্যালো।

-আপি,কেমন আছো?

-এইতো ভালো,তুমি?

-আছি আলহামদুলিল্লাহ ভালো।আপি,কালরাতে ও বাসায় কি হয়েছে?

-পাখি,কোথাকার কোন বুইড়া বেটা এসে বলে তার নাতি নাকি আমার প্রেমে পাগল।একটা সুইসাইড নোট দেখিয়ে বললো,সে ছেলে নাকি আমার জন্য সুইসাইড অ্যাটেম্প্ট করেছে।

-কিহ?

-হ্যাঁ।বলছে আমাকে এখন বাসায় না পেলে পুলিশ ডাকবে।ওই ফাউল লোকের কথায় আব্বু নিয়া আসছে আমাকে তোমাদের বাসা থেকে।

-বেটা খচ্চর!বদমাশ!বেয়াদ্দপ!এতোবড় থ্রেট দিয়েছে আঙ্কেল কে?

-তাহলে আর বলছি কি তোমায়?এরপর আমিও অবশ্য শুনিয়ে দিয়েছি অনেক কথা!রিয়াকে ওভাবে বলা!

আপির কথায় বুঝলাম সে লোকের উপর রাগের রেশ এখনো বিদ্যমান।তাই মেজাজ চরানো কথা বলাই যাবে না এখন ওকে।আপি বললো,

-তোমার ভার্সিটি আজ কেমন ছিলো মিথি?

-হুম?হ্যাঁ,ভালো ছিলো।আপি ওই সিয়াম লোকটা…

আপি হন্তদন্ত হয়ে বললো,

-হ্যাঁ,কি?

-আপি,আসলে উনি,,,,

আপি শান্ত তবে রাগের স্বরে বললো,

-মিথি বলো,কি হয়েছে?কিছু বলেছে ওই লোক তোমাকে?বলো আমাকে।

-আপি,ওই লোকের চাওনি একদম ভালোলাগে না আমার।আমি চাইনা ওনার সাথে কথা বলতে।আজ আব্বুর কথায় উনি আমাকে ভার্সিটিতে ড্রপ করতে গিয়েছিলেন।আমাকে গোলাপ অফার করেছিলেন।আর…

-আচ্ছা।রিল্যাক্স!উনাকে কি আঙ্কেল রেগুলার ছাড়তে বলেছেন তোমাকে?

-না,তা নয়।

-ওকে,তাহলে চিন্তা করো না।ইটস্ আন্ডার কন্ট্রোল।

-কিন্তু আপি…

-আহা,কোনো কিন্তু পারোন্তু না।পড়বে না ঘুমাবে?

-পড়বো।

-আচ্ছা,তাহলে পড়ো।এসব নিয়ে ভাবতে হবে না তোমাকে হুম?

-আচ্ছা।আপি?

-কিছু বলবে.

-ন্ না।গুড নাইট।

-হুম।গুড নাইট।

ফোন রেখে আমি একধ্যানে চেয়ে রইলাম ফোনের দিকেই।আজ আমার সাথে এতবড় ঘটনা ঘটলো, কেউ এভাবে জরিয়ে ধরে আবির মাখালো,এসব কথা আপিকে বললাম না।কেনো বললাম না?আপি রেগে ছিলো তাই?নাকি এসবের ঝামেলায় নিজের স্বাধীনতা হারাতে চাইনা তাই?নাকি এসব হারাতে চাইনা তাই?কোনোভাবে আমি কি আরমানের সাথে জরিয়ে যাচ্ছি?তার কাজে ভালোলাগা শুরু হয়েছে আমার?এটাও সম্ভব?কিছুক্ষন এসব ভেবে আবার মাথা থেকে ঝেরে পড়তে বসলাম।ঘন্টা তিনেক পর ড্রয়ারে রাখা ঔষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পরলাম।
রুমে ঢোকে আরমান।বন্ধ জানালার পাশে কয়েলের ধোয়ায় বসে সবটা শুনে নিয়েছিলো সে।মুখে সেই তৃপ্তির হাসি নিয়ে আবারো দুহাতে জরিয়ে ধরলো মিথিকে।যে মিথি পিপড়ার কামড় খেলেও রিয়াপিকে জানাতে ভোলে না,সে আজ ওর এতোবড় কথাটা বললো না।
তুমি আমার মায়ায় জরিয়ে গেছো মিথি।আমার মতো ‘তোমাতেই অস্তিত্ব আমার’ সঙ্গায় নিজেকে সঙ্গায়িতো করতে চলেছো তুমি।খুব তাড়াতাড়ি তুমি সুস্থ্য হয়ে যাবে দেখো,এক হয়ে যাবো আমরা।আর সিয়াম,তোকে তো আমি ছাড়বোই না।নিজের নোংরা খেলার মাঝে ইশতিয়াক আরমানের কলিজায় হাত দিয়েছিস তুই।তোর জীবন যদি জাহান্নাম না বানিয়েছি তো আমিও আরমান নই।

#চলবে…

®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here