তোমাতেই অস্তিত্ব আমার পর্ব-২৬

0
1808

#তোমাতেই_অস্তিত্ব_আমার
লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা

২৬.

আকাশটা আজ বড্ড মেঘলা।মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে।অনেক জোরে বৃষ্টি নামবে।কালকেও তো কতনা রোদ ছিলো ওই আকাশে।ভ্যাপসা গরমের পর হুট করেই আজ এভাবে নিজেকে কালো মেঘের ঘনঘটায় ভরিয়ে তুললো?কাল আরমানের কথা শুনে নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছিলো।মুখে না বললেও,তার চোখে আমার জন্য ভালোবাসাই দেখেছি আমি।তাকে যে আমিও চাইতে শুরু করেছি।নানা অনুভবে জরিয়ে রাখতে শুরু করেছি।তার হুটহাট ছোয়াতে নিজেকে হারাতে শুরু করেছি।এগুলোই কি ভালোবাসার অনুভুতি?তবে কি আমি ভালোবাসি আরমানকে?

হ্যাঁ,ভালোবাসি।ভালোবেসে ফেলেছি আমি তাকে।নিজের কাছে অস্বীকার করার কিছুই নেই।এজন্যই তার কথা,স্পর্শ,কাছে আসা সবকিছুতে ভালোলাগা ছিলো আমার।মনে মনে আনন্দের-খুশির শিহরন বইছিলো।আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে বলবে সেও আমাকে ভালোবাসে।তারপর,তারপর আব্বুর সাথে কথা বলতে বলবো ওনাকে।আব্বুর অনুমতি নিয়ে এক হবো দুজনে।যাকে ভালোবাসি,তাকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে পাবো আমি।এর থেকে বড় পাওয়া আর কি হতে পারে জীবনে?কিন্তু বাসায় পৌছাতেই আমার সবটুকো ভাবনা,দুঃস্বপ্নে পরিনত হয়ে গেলো।নিজেকে বড্ড অসহায় মনে হচ্ছিলো।জীবনে ভালোবাসার রঙগুলো দেখার ঠিক আগমুহুর্তেই সবটা ফ্যাকাশে হয়ে গেলো।

*আগেরদিন,
ভার্সিটি থেকে ফেরার পর ড্রয়িংরুমে সিয়ামকে দেখতে পেলাম।আম্মু মাইশু এককোনে কিছুটা আতঙ্কিত হয়ে দাড়িয়ে,সিয়াম আর আব্বু সোফায় বসে।আমাকে ঢুকতে দেখে আব্বু গম্ভীরভাবে বললেন,

-মিথি,কিছু কথা ছিলো।

আমি আম্মু মাইশুর মুখের দিকে তাকিয়ে এগোলাম।ব্যাগটা সিঙ্গেল সোফায় রেখে বললাম,

-জ্বী বলুন আব্বু।

-ভার্সিটিতে আজ কয়টা ক্লাস ছিলো?

অবাক লাগছিলো।আব্বু কোনোদিন আমার পড়া নিয়ে কোনোকিছু জিজ্ঞাসা করেন না।এমনকি,মেমোরি লসের পর ভার্সিটি যাওয়া নিয়েও কোনো কথা হয়নি।তবে আজ কেনো?

-কিছু জিজ্ঞাসা করেছি।

-ত্ তিনটা আব্বু।

-রায়হান ছাড়া আর কোনো ছেলের সাথে কথা হয় তোমার?

আব্বুর সোজা এমন কথা শুনতে চাওয়ায় এবার তো আমি অবাক হওয়ার সীমাটাই ছাড়িয়ে যাচ্ছি।এসব কথা কেনো বলছেন উনি?আম্মুর দিকে তাকালাম,সে মাথা নামিয়ে নিলো।পাশে বসে থাকা সিয়াম বেখেয়ালিভাবে পেপারের পাতা উল্টাচ্ছে।

-কি হলো মিথি?উত্তর দিতে এতো সময় নিচ্ছো কেনো?

-ন্ না মানে,এসব কথা…

-হ্যাঁ অথবা না তে জবাব দাও।কারো সাথে কথা হয় তোমার?

হাত মুঠো করে জোরে শ্বাস নিয়ে বললাম,

-হ্যাঁ।

উপস্থিত সকলে বিস্ফোরিতো চোখে তাকালো আমার দিকে।যেনো ছোটখাট ব্লাস্ট ঘটিয়েছি আমি।আব্বু বজ্রকন্ঠে বললেন,

-মানে?

-মানে রায়হান ছাড়াও ভার্সিটির স্যার,দাড়োয়ান মামা,রিকশাওয়ালা মামা,দোকানদার মামা আরো অনেকের সাথে কথা হয় আমার আব্বু।ফুল নিয়ে আসা একটা ছেলে নিলুকেও তো সিয়াম দেখেছেন।তাইনা সিয়াম?

সিয়াম মাথা তুলে তাকালেন আমার দিকে।তারপর আব্বুর দিকে তাকিয়ে একটু হেসে পেপারটা সামনের টি টেবিলে রাখলেন।উঠে দাড়িয়ে শার্টটা টেনে ঠিক করে বললেন,

-যা শোনার,শুনে নিয়েছি আমি।আপনারা কথা বলুন।আমি আসছি।আর হ্যাঁ আঙ্কেল,মতামতটা আমাকে জানিয়েন।

আব্বু হাসলেন।সিয়াম আরেকবার আমার দিকে তাকিয়ে উঠে বেরিয়ে গেলেন।আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না।কি হলো?কি শুনলো?কিসের মতামত?শুধু না বুঝে জানার আগ্রহ নিয়ে আব্বুর দিকে তাকালাম।আব্বু এগিয়ে এসে বললেন,

-আমি জানতাম,তুমি আমাকে দেওয়া কথা ভুলবে না।আমি যাকে তোমার জন্য ঠিক করবো,তাকে তোমারও পছন্দ হবে।গর্ব হয় আমার তোমাকে নিয়ে মিথি।গর্ব হয়।

কথাগুলো বলে আব্বু রুমে চলে গেলেন।হতবিহব্বলের মতো আমিও রুমের দিকে পা বাড়ালাম।তারমানে আব্বু আমাকে বলার সুযোগটাও দিলেন না।নিজের মত জানিয়ে দিয়ে গেলেন।তারমানে আমার জীবনে সিয়াম আসতে চলেছে।আমার ভবিষ্যৎ বেছে নিয়েছেন আব্বু।আরমানকে নিয়ে আর ভাবার সময়টুকো পেলাম না আমি।নাই বা পেলাম আব্বুকে বলার সুযোগ।আচ্ছা,এমনটাই তো হওয়ার ছিলো।আমার তো এমনটাই কথা দেওয়া ছিলো‌ আব্বুকে।তাহলে?কেনো এমন হলো?সবটা বুঝেও কি করে আমি এভাবে জরিয়ে গেলাম আরমানের সাথে?কেনো ওনার স্পর্শগুলোকে মেনে নিতে থাকলাম,কেনো সুহানাকে ইস্যু বানিয়ে জেলাস হতাম,কেনো ওনার কালকের কথায় আমি স্বস্তি পেয়েছিলাম?কেনো?সবকিছুর একটাই উত্তর।আমার অজান্তে যে আমি আরমানকে…

*

-আপু,তুমি এখনো ওঠো নি?

চমকে মাইশুর দিকে তাকালাম।আম্মু সকালে রুমে এসে জানালা খুলে দিয়ে যায়।ঘুম ভেঙে বিছানায় বসে জানালায় তাকাতেই দুরের মেঘলা আকাশ চোখে পরলো।গায়ে চাদর জরিয়ে রাতের স্পর্শগুলোকে অনুভব করছিলাম আর এসবই ভাবছিলাম।দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো একটা।নামাজটাও পরি নি।

-কি হলো আপু?

-হুম?কিছু না।

-ওকে,মশারী খোলো আজ।প্রতিদিন আগে উঠে যাও,এই কাজটা আমার করতে হয়।আজ পারবো না।

-হুম।

-শোনো,বিছানাটাও ঠিক কইরো।

-আচ্ছা।

-কিয়ের হুম আচ্ছা লাগিয়েছো?তোমার থেকে রিজোয়ানের কথাও স্পষ্ট বেশি।

জানি,ও আমাকে স্বাভাবিক করতেই এভাবে বলছে।কালকের ঘটনার পর থেকে ওভাবে কথা বলিনি ওর সাথে।নইলে একবেলা একে অপরকে না পচালে আমাদের একসাথে থাকাটাই বেকার।একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর দিকে তাকিয়ে বললাম,

-যা বলছিস করবো।যা বলেছিস ঠিক বলেছিস।হয়েছে এবার?

আমার কথাগুলো ভালো লাগেনি ওর।তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,

-আপু,কিছু হয়েছে তোমার?

-না।
-কি হয়েছে আপু?কাল বিকেল থেকে…

-না রে,কিছু হয়নি মাইশু।তুই নাম বিছানা থেকে,আমি ঠিক করছি।

-আপু,সিয়াম ভাইয়াকে তোমার পছন্দ না তাই না?

বিস্ময়ে তাকালাম ওর দিকে।ও বললো,

-জানি আপু,এমনটাই স্বাভাবিক।আর তুমি হয়তো আব্বু পছন্দ বলেই মানা করবে না তাইনা?

-এমনটাই স্বাভাবিক মানে?

মাইশু একটু ঘাবড়ে গেলো।আমতা আমতা করে বললো,

-ও,ও কিছু না।ওই লোক পছন্দ করার মতোই না।আব্বু যে কেনো…

-থাক মাইশু,একটা কথা মনে রাখবি,আব্বু কখনো আমাদের খারাপ চান না।

মাইশু একটু তাচ্ছিল্য নিয়ে হাসলো।আব্বুর কাজ নিয়ে ওর অমন হাসিটা সহ্য হলো না আমার।ঝারা গলায় বললাম,

-মাইশা!এটা মোটেও ওভাবে হাসার কথা ছিলো না।

ও চুপ করে মাথাটা নিচু করে ফেললো।আর কিছু না বলে সকালের কাজগুলো শেষ করে নিলাম।ব্রেকফাস্ট করার সময় স্বাভাবিকভাবেই টেবিলে বসেছি।নিজেকে শক্ত করে খাবার গিলে চলেছি।আজ মনে হচ্ছে,আমার ঘরবন্দি একমাসের জীবনের চেয়েও কষ্টের সময় দেখতে হলো আমাকে।যা থেকে নিজেকে আজীবন বাচিয়ে রাখতে চেয়েছিলাম,না চাইতেও জরিয়ে গেলাম এই ভালোবাসা নামক বস্তুতে।কি করে ভুলবো আমি আরমানকে?ওনার কথাগুলোকে?কাজকে?স্পর্শকে?
খেতে খেতেই আব্বু বললেন,

-মিথি,তোমার সেমিস্টার এক্সাম কবে?

কথাটা শুনে ভেতরটা ধক করে উঠলো।বললাম,

-এখনো ডেইট দেয়নি আব্বু।

এরপর আর কিছু বলেন নি উনি।চুপচাপ খাবারটা শেষ করে উঠে আসছিলাম।আম্মু বললো,

-মিথি,আজ ভার্সিটি থেকে একটু তাড়াতাড়ি আসিস।

-আজ ভার্সিটিতে যাবো না আম্মু।

-কেনো?শরীর খারাপ?

কি করে যাবো?গেলেই যে ওই‌ মানুষটাকে ফেইস করতে হবে।নাহ্!আজ পারবো না।নিজেকে একটু সময় দেওয়া দরকার।সময়ের সাথে যদি পারি নিজেকে গুটিয়ে নিতে।আরমানও হয়তো আমার অনুপস্থিতে সামলে নিবেন নিজেকে।মুখে বললাম,

-না এমনি।অনেক তো ক্লাস করলাম।তুমি তাড়াতাড়ি আসতে বলছিলে যে?

আব্বু বললেন,

-আজ সিয়ামের আব্বু আসবে।লান্চ করবে আমাদের সাথে।সিয়ামের বাবার সাথে সেই আটবছর আগে দেখা হয়েছিলো আমার।ভাবতেও খুশি লাগছে আমার এতো পুরোনো বন্ধু আশরাফ আসছে।এতোদিন পর।ছেলেটাকে কতো করে বলিয়ে রাজি করালাম।এ পর্যন্ত কথাও হয়নি ভালো করে আশরাফের সাথে আমার।

আব্বুর কথা শুনে চোখ ভরে উঠলো আমার।তারমানে আজকেই হয়তো সিয়ামের সাথে আমার জীবনটা জুড়ে যাবে।আরমান সরে যাবে।চিরতরে।বহুদুরে।তবুও আব্বুর চেহারায় খুশি দেখে চোখের পানি সংবরনে সক্ষম হলাম।এককথা,ওনার খুশিতেই আমি খুশি।বাধ্য আমি।
খাবার কোনোরকমে শেষ করে রুমে চলে এলাম।ভার্সিটিতে না গেলে ওনাকে ফেস করতে হবে না।কিন্তু এভাবে কয়দিন?ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে আমার।ওই মানুষটাকে কষ্ট দেবো ভাবতেও বুক ফেটে কান্না আসছে।কিন্তু কিছুই করার নেই আমার।শুধুশুধু ওনার সামনে গিয়ে নিজেকে দুর্বল দেখাতে পারবো না,আমার কঠিন কথাগুলোতে তাকে ভেঙে পরতে দেখতে পারবো না।
দুপুরের আগে রিয়াপি,কবির আঙ্কেল,আন্টি সবাই এসেছেন।আন্টি রান্নাঘরে আম্মুর সাথে।আঙ্কেল আব্বুর সাথে ড্রয়িংয়ে কথা বলছেন।রিয়াপি আমার রুমে আমাকে বুকে জরিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।ঘাপটি মেরে রয়েছি ওভাবেই।
-পাখি?

-হুম।

-তুমি স্যাড?

-আব্বু হ্যাপি হলে আমি স্যাড হতে পারি?

-ডোন্ট ইউ থিংক?এ ব্যাপারে তোমার মতামত নেওয়া উচিত ছিলো?

-আব্বু অনুচিত কিছু করেন না আপি।

-হুম।বাট তুমি এমন করছো যেনো আজই তোমার বিয়ে!আমাদের ছেড়ে চলে যাবে!

বিয়ের কথা শুনে আবারো চোখ বেয়ে পানি পরতে লাগলো।রিয়াপি আমার মাথা উচু করে ধরে বললো,

-আরে!বিদায়ী কান্না শুরু?আরে আজ তোমাকে দেখতে আসছে।কোনো এনগেইজমেন্ট বা বিয়ের জন্য না।

এমনভাবে বলছে যেনো ওগুলো হবেই না।এটাই তো প্রথম ধাপ।এরপরপরই তো আমাকে…

-সিয়ামের সাথে তো তোমার বিয়ে হবেই না।

চমকে উঠলাম আমি।মাইশুও পাশে দাড়িয়ে ছিলো।ওউ বিস্ফোরিত চোখে আপির দিকে তাকিয়ে আছে।আপি নিজেকে সামলে বললো,

-মানে যদি তুমি না চাও মিথি।আঙ্কেলকে…

-না আপি।প্লিজ।এসব থাক।

আপি আর কোনো কথা বললো না।আম্মু এসে বললো,

-রিয়া,মিথিকে একটু সাজিয়ে দাও।সিয়াম আর ওর আব্বু যখন তখন চলে আসবেন।

রিয়াপি ঘাড় নারালো।বাইরে মেঘের গর্জন শোনা গেলো একবার।সাথে আমার মনের মধ্যেও তুফান শুরু হলো।আমি এই মুহুর্ত থেকে আপনার পর হয়ে যেতে শুরু করলাম আরমান।আফসোস একটাই,মুখ ফুটে একবারও বললেন না ভালোবাসি তোমায় মিথি।তাহলে হয়তো গল্পটা অন্যরকম হতো!

-চলো মিথি,রেডি করিয়ে দেই তোমাকে।শাড়ি পরাবো।

আপির দিকে একনজর তাকিয়ে রোবটের মতো উঠে দাড়ালাম।আর মনে করতে চাইনা কিছু।না ওদের বুঝতে দিতে চাই আমার অবস্থা।রিয়াপি আলমারী থেকে একটা হালকা জামদানী শারি বের করলো।পুরোটাই টকটকে লাল।মোটা সুতায় কাজ করা।শাড়িটা আমার আলমারীতে দেখে অবাক হলাম কিছুটা।আমি নিজেও জানতাম না আমার আলমারিতে ওরকম শাড়ি আছে।মাইশু কিছুটা চমকে উঠে বললো,

-এটা!

রিয়াপি ওকে থামিয়ে দিলো।বললো,

-হ্যাঁ,এটাই পরাবো।

-কিন্তু রিয়াপি!

রিয়াপি একপ্রকার চোখ রাঙিয়ে বললো,

-এটাই‌ পরাবো মাইশু।

মাইশু চুপ করে গেলো।এভাবে ওদের কথার কোনো মানে বুঝলাম না।নাই বা বুঝলাম আলমারীতে এই শাড়ীর উপস্থিতির কারন।তবুও চুপ করেই রইলাম।রিয়াপি বললো,

-মিথি চলো।

আপি শাড়িটা পরিয়ে দিলো।চুলগুলো ছাড়া,চোখে কাজল,ঠোটে লিপস্টিক,কানে ছোট দুল,গলায় ছোট একটা স্টোনের পেন্ডেন্ট ওয়ালা চেইন।এ সাজ যে অসহ্য লাগছে আমার।কার জন্য সাজলাম আজ আমি?তার জন্যই কি সাজতে চেয়েছিলাম কোনোদিন। রিয়াপি আমার ড্রেসিং টেবিলের এক ড্রয়ার থেকে কিছু একটা বের করে বললো,

-বাহ্!এটা তো বেশ!কবে কিনেছো মিথি?বলো নি তো।

আমি তাকালাম ওটার দিকে।টকটকে লাল কাচের চুড়ি।ওটা সেই চুড়িটা যেটা আরমান সেদিন দোকানে আমাকে পরাতে চেয়েছিলো।তারপর উনি কখন এটা ব্যাগে দিয়েছিলেন,জানি না।বাসায় এসে ব্যাগ খুলে পেয়েছিলাম।রেখে দিয়েছিলাম।দাতে দাত চেপে,হাত মুঠো করে চুপ করে রইলাম।চোখের পানি আমার একান্ত বাধ্য এখন,যেমনটা আমি আব্বুর।মাইশু বললো,

-হ্যা তাইতো!এটা?

ও আর কিছু বললো না।আপি এবারো চোখ দিয়েই থামিয়ে দিয়েছে ওকে।ও নিজেও কিছু না বলে চুড়িগুলো পরিয়ে দিলো আমাকে।ওই চুড়ির শব্দে আরো বেশি কান্না আসছিলো আমার।তবুও‌ চুপ করে থাকার মতো ধৈর্য্য উপর ওয়ালা দিয়েছিলো আমাকে।লাখ শুকরিয়া তার।কিছুক্ষন পর আমাকে ডেকে নেওয়া হয় ড্রয়িংরুমে।বাঙালি মেয়েদের গুন বজায় রেখে মাথা নিচু করে সামনে গিয়ে সালাম দেওয়া থেকে শুরু করে ভাইভা পর্ব,চুল দেখানো,হেটে দেখানো সবটাই করেছি আমি।নিজের উপরই নিজের তাচ্ছিল্য হচ্ছিলো তখন আমার।এভাবে মেয়ে দেখে এখনকার লোকজনও,জানা ছিলো না আমার।

আস্চর্যজনকভাবে এসবের কেন্দ্রবিন্দু সিয়াম আসেননি।শুধুমাত্র ওনার বাবা কে কেনো পাঠিয়েছেন তা বোধগম্য হলো না আমার।অন্যান্য দিন তো ছেচড়ামোর সীমা থাকে না এ বাসায় ঢোকার জন্য।সিয়ামের বাবার সাথে দুজন লোক এসেছিলেন আরো,পরিচয় আমি শুনি নি।তবে সে লোকটা বড়ই অস্বস্তি নিয়ে বসে ছিলেন আব্বুর সাথে।আমার সাথে তার ব্যবহারও কিছুটা আজব লেগেছে আমার।আব্বুর তথাকথিত বন্ধু হিসেবে আব্বুর সাথেও সেভাবে কথা বলেন নি উনি।সবাই একসাথে লান্চ করা শেষে একটু বসে ওনারা চলে গেলেন।তার পরপরই রিয়াপিরাও চলে গেলো।
যোহরের পর থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।গুরিগুরি বৃষ্টি ঝরিয়ে আকাশ তার কান্না দেখাচ্ছে সবাইকে।আর আমি?ঠোটে হাসি ঝুলিয়ে লান্চ শেষ করলাম।রুমে মাইশু আলমারিটা খুলে এটা ওটা বের করছে,দেখছে,আবার রেখে দিচ্ছে।ব্যালকনি সোজা জানালার গ্লাস সরিয়ে নিচের সেলফের উপর বসে দুরে চেয়ে আছি।ব্যালকনিতে গেলে বৃষ্টির ফোটা গায়ে লাগবে।চোখের পানি ধরে রাখতে পারবো না আমি আর তখন।মিশু বললো,

-শাড়িটা চেন্জ করবে না?

…….

-আপুউউ!শাড়িটা পাল্টাবে না?

চোখ নামিয়ে হাটুতে থুতনি রেখে বললাম,

-একটু পর।

ফোনটা বেজে উঠলো হঠাৎ।এসময় কে ফোন করতে পারে।কথা বলার কোনো আগ্রহ নেই আমার।আমার কোনো হেলদোল নাই দেখে মাইশুই রিসিভ করলো ফোনটা।

-হ্যালো?

….

-হ্যালো কে বলছেন?

……

-কথা বলেন না কেনো?হ্যালো?

মাইশু রাগ করে ফোনটা কেটে দিয়ে বললো,

-আপু,আননোন নাম্বার।কথা বলে না।

কিছু বললাম না।কোনো কিছুতেই ভালো লাগছে না আমার।ফোনটা এগিয়ে দিলো মাইশু।গিয়ে বিছানায় বসলো।খুব ইচ্ছে করছে,এই বৃষ্টির সাথে আমার কান্নাটাকে বইয়ে দিতে।ধুয়ে দিতে মনের কষ্টগুলো।কিন্তু বৃষ্টির সাথে বিরহশোক পালন ছেড়ে হাসিমুখে আজই ছেলেপক্ষের সামনে গেলাম আমি!কারন আজ বাধ্য মেয়ে,বাধ্য বোন আমি।কোনোকাজে কোনোভাবে ওদের বুঝাতে চাইনা ভেতরটার তোলপাড়।নিজেকে গুটয়ে চোখ বন্ধ করে সহ্য করছিলাম সবটা।

বৃষ্টিটা জোরে শুরু হয়েছে।মাইশু বসে থেকে থেকে কম্বল মুড়িয়ে শুয়েছিলো,ঘুমিয়েও গেছে,ওয়েদারটাই এমন।আব্বুর রুমে দরজা খোলার আওয়াজ পেয়েছি অনেক আগেই।হয়তো উনিও টিভি ছেড়ে রুমে গিয়ে শুয়েছেন।ওভাবেই জানালায় বসে ছিলাম,মনেও হচ্ছে না শাড়িটা চেন্জ করি।একাকিত্ব আর জোরে নামা বৃষ্টি দেখে চোখের পানির বাধ ভেঙে গেছে এবার।এমনটা না হলেও পারতো!কি হতো আরমান যদি আমাকে আরেকটু আগে ভালোবাসি বলতেন?কি হতো সিয়াম আমার লাইফে না আসলে?কি এমন ক্ষতি হতো সবটা আমার দেখা স্বপ্নগুলোর মতো হলে?রাতে জরিয়ে রাখা লোকটার হদিশ যে আমি আরমানের বুকেই পেয়েছি।কি করে ভুলে যাবো এসব?ফোনের রিংটোনে তাকালাম স্ক্রিনে।আননোন নাম্বার।মুখ ফিরিয়ে নিলাম।আরো দু বার রিং হয়েছে।রিসিভ করি নি।পরেরবার তাকিয়ে দেখলাম আরু নামে সেভ করা নাম্বারটা থেকে কল।কান্নাটা বেড়ে গেলো আমার।আরু কেনো ফোন করবে এখন?আরমানই কি তবে .ভার্সিটি যাইনি বলে টেনশন করছেন উনি?রিসিভ করলে তো দুর্বল হয়ে পরবো।কথা বলতে পারবো না আমি ওনার সাথে।কিন্তু কথা না বললে তো আরো চিন্তা করবেন উনি!হতেও তো পারে এটা আরুই!নিজেকে সামলে রিসিভ করে বললাম,

-হ্যালো?

-একবার ছাদে আসবে?

গলাটা শুনে আতকে উঠলাম আমি।এটা আরমান।উনি কেনো ফোন করলেন?ছাদে মানে?কেনো বলছেন বৃষ্টিতে ছাদে যেতে?কথাটা শুনে আর কিচ্ছু ভাবি নি।জানি না কি হলো আমার,ফোনটা রেখে শাড়ি পরেই একপ্রকার দৌড় লাগালাম।যে আমি শাড়িতে হাটতে পারি না,দৌড় লাগিয়ে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলাম।চোখের পানি মুছতে মুছতে ছাদের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলাম।

#চলবে…

®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here