#তোমাতেই_অস্তিত্ব_আমার
লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা
২০.
সন্ধ্যার কিছুটা পর পড়তে বসেছি।বিকেলে আব্বু বেরিয়েছেন,এখনো ফেরেন নি।সন্ধ্যাবেলায় আমার হাতে বানানো চা ছাড়া নাকি আব্বুর দিনটাই বেকার বেকার লাগে।নতুন করে ভার্সিটিতে যাওয়া শুরুর পর থেকে আব্বুও সেই আগের মতোই প্রতি সন্ধ্যায় আমার হাতের চা খাবেন,পেপার পড়বেন।আজ এ সময়,এতোক্ষন আব্বুর বাইরে বেরোনোটা তাই আজব লাগছে।তবে ওনার খুব জরুরি কিছু দরকার না থাকলে যেতেন না উনি।আমি চুপচাপ বইয়ের পাতায় চোখ বুলাচ্ছি,মিশু সোফায় বসে উচ্চস্বরে ট্রি প্লান্টেশন প্যারাগ্রাফ মুখস্ত করছে।যে কারনে ওকে রুম থেকে বের করলাম,এখনো অতো জোরেই পরছে।বিরক্তি নিয়ে চেচিয়ে বললাম,
-ওগো ডেকোরেটরের দোকানী,ভলিউমটা কমান।
উত্তর আসলো,
-জোরে না পরলে মুখস্ত হয় না আমার।
-পরে পড়।আমার কনসেন্ট্রেশন নষ্ট হচ্ছে।
-পরে কেনো পড়বো আমি?তোমার পড়াই পড়া?আমারটা কি পড়া না?
তেড়ে উঠে এলাম।মাইশুর কান ধরে বললাম,
-এতো কথা বলিস কেনো তুই?
-লজ্জা করে না তোমার আপু?এতোবড় একটা মেয়ের গায়ে হাত তোলো?আহ্!কানটা ছাড়ো।
-তো বল ধীরে পড়বি?আমার মনোযোগ নষ্ট করবি না।
-পড়া নিয়ে চিন্তা থাকলে কানের কাছে এসে হিরো আলমের গান বাজালেও কনসেন্ট্রেশন নষ্ট হয় না।
-কি,আমার চিন্তা নাই?আর তোর গলার আওয়াজ কোন অংশে কম রে?জ্ঞান যে দিচ্ছিস,এটা জানিস,আশেপাশের সবাই তোকে মাহবুব আলমের মেয়ে,মাহফুজ স্যারের ফিমেল ভার্সন বলে চেনে?
-খারাপ গলা বলে শেষমেশ ওই লোকের সাথে তুলনা?
-হুম খোজ নিয়ে দেখিস।
মাইশুর চেহারাটা দেখার মতো।ও সত্যিই ধরে নিয়েছে সবাই ওর আওয়াজ নিয়ে মজা করে।গাল ফুলিয়ে সপাৎ সপাৎ বইয়ের পাতা উল্টিয়ে গুনগুন করে পরতে লাগলো।আমিও হেসে রুমে চলে এসে পড়ার টেবিলে বসলাম।
বেশ কিছুক্ষন পর মাথায় কারো স্পর্শ অনুভব করলাম।উপরে না তাকিয়েই বুঝলাম এটা আব্বু ছাড়া কেউ নয়।ওনার উপস্থিতি টের পাই আমি।এমনো সময় আছে আব্বু কলিং বেল বাজানোর আগেই দরজা খুলে দিয়েছি আমি।হেসে বললাম,
-কখন এসেছেন?
-মাত্রই।
আমি একটু হেসে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়িয়ে আব্বুর হাত ধরে বেডের দিকে টেনে নিয়ে গেলাম।বললাম,
-বসুন না।
উনি চুপচাপ বসে গেলেন।কেমন যেনো ক্লান্ত দেখাচ্ছে ওনাকে।মুখে একটা তৃপ্তির হাসি একবার উকি দিচ্ছে আবার বিলীন হয়ে যাচ্ছে।মাহবুব আলমকে আরমান নিজে গাড়ি করে বাসায় পৌছে দিয়ে গেছে,কোনোরকম ঝামেলা ছাড়াই।আবার ওর ব্যবহারেও অনেকটা পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন উনি,শান্তশিষ্ট।যা ওকে একদম মানায় না।তবে সবটাই শেষ?নাকি কাগজগুলো পাওয়ার পর নতুন কোনো ঝামেলা করবে ও?
আব্বুকে ভাবতে দেখে পাশে বসে বললাম,
-আপনি কি টায়ার্ড আব্বু?
আব্বু হেসে বললেন,
-না মিথি।আজ বরই খুশি আমি।
-তাহলে চোখমুখের ও অবস্থা কেনো?
-ও্ ও কিছু না।
-বলবেন না আমাকে?
আব্বু ছলছল চোখে তাকালেন আমার দিকে।তার চোখজোড়া দেখে আমারও চোখ ভরে উঠলো।উনি বললেন,
-মিথি,কোনোদিন আমাকে ভুল বুঝিস না মা।
-আব্বু?
-লেট মি ফিনিশ মিথি।আমি জানি তুমি মুক্তভাবে বাচতে ভালোবাসো,তারপরও তোমাকে একটা মাস আটকে রেখেছিলাম।কষ্ট দিয়েছি তোমাকে।কিন্তু বিশ্বাস করো,সবটা তোমার ভালোর জন্যই।আমি তোমার ভালো ছাড়া অন্য কিছু চাইনা।
কথাগুলো বলতে বলতেই আব্বুর চোখ থেকে পানি ঝরতে শুরু করলো।কলিজা ফেটে যাচ্ছে আমার।ওটা যে সহ্য হয় না,পারি না সহ্য করতে তার চোখের পানি।আব্বু আরো বলতে চাইলে আমি তাকে জরিয়ে ধরে কেদে দিয়ে বললাম,
-প্লিজ আব্বু,কাদবেন না আমার সামনে।আপনাদের কোনো কাজে কোনোদিনই কষ্ট পাইনি আমি,কারন আপনারা কোনোদিনই আমাকে কষ্ট দিতে কিছু করেননি।আর ভুল বোঝা?ভুল মানুষ তখন বোঝে যখন সামনের মানুষটা ভুল করে।আমার আব্বু কোনোদিন ভুল করতে পারেন না।আমি জানি আব্বু,আপনার কোনো কাজ কখনো ভুল হয়না।তাই আপনাকে কোনোদিন কোনো কাজে ভুল বোঝার মতো ধারনাও আমি করতে পারি না।পাপ হবে আমার।
…
-যা ছিলো তা অতীত।আমি জানি সবটা আমার ভালোর জন্যই ছিলো,এখনো সবটাই ঠিক আছে।আমার দিক থেকে কোনো ভুল হলে ক্ষমা করে দিন আমাকে,প্লিজ।
আব্বু আমাকে ছাড়িয়ে হাত ধরে বললেন,
-না।তোমার কোনোদিনও কোনো ভুল ছিলো না মিথি।কোনো ভুল করো নি তুমি।ভুল করতে পারোই না তুমি।
-তাহলে নিজেকে কেনো এভাবে কষ্ট দিচ্ছেন আব্বু?এখন তো সবটাই ঠিক।
আব্বু চোখের পানি মুছে দিলেন আমার।হাতের পিঠে নিজের চোখের পানিটাও মুছে বললেন,
-যদি কখনো কেউ এসে বলে আমি ভুল?
আমি হেসে বললাম,
-সে নির্ঘাত পাবনা থেকে আসবে।
আব্বুও মৃদ্যু হাসলেন।তারপর আবার গম্ভীরভাবে বললেন,
-না মিথি,যদি কখনো তোমার মনে হয় আমি কোথাও ভুল ছিলাম,কি করবে তুমি?
-আমিতো বলেছি আপনাকে,আপনি ভুল করতেই পারেন না।আর হ্যাঁ,এটাও বলছি,যদি একদিকে পুরো পৃথিবী এসে দাড়ায় অন্যদিকে আপনি থাকেন,আমি চোখ বন্ধ করে আপনাকেই সঠিক মানবো।অন্য কাউকে নয়।
আব্বুর মুখে আবারো হাসি ফুটলো।শান্তির হাওয়া বয়ে গেলো মনপ্রান দিয়ে।কেনো জানি না আমার কিছুটা চাপা কষ্টও অনুভব হলো হঠাৎ।পুরো পৃথিবী?সবাইকে ছাড়তে পারবো আমি?হ্যাঁ,পারবো।কারন যাদের ভালোবাসি তাদের ছাড়ার মতো পরিস্থিতি আমার আব্বু তৈরী করবেন না।এমনটা হতেই পারে না।আর এমন সিচুয়েশন,আব্বু যার এগেনেস্টে,সে কখনো আমার ভালোবাসার কেউ হতেই পারে না।আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আব্বু উঠে দাড়ালেন।বললেন,
-বেশ,পড়ো তুমি।ডিনার রেডি হলে চলে এসো।
আমি ঘাড় নাড়লাম।এরমধ্যে রিজোয়ান দৌড়ে এসে বললো,
-আব্বু?আপ্পাই আমাকে মেরেছে!
-তাই?আচ্ছা চলো।বকে দিচ্ছি মাইশা কে।
-ওই আপ্পাই না।বড় আপ্পাই।
আব্বু ভ্রুকুচকে আমার দিকে তাকালেন।বাসায় রিজোয়ান অনেক আদরের।মাইশাকে মার লাগালেও ওকে আমি বা আমরা কেউই মারি না।দু একসময় মাইশুটা দেয়।ওকে একটু বেশি জ্বালায় বলে।আমি অবাক হয়ে বললাম,
-এই মিথ্যেবাদী,কথাটা পরিস্কার না,মিথ্যেটা তো একদম ক্লিয়ার।আমি কখন মারলাম তোকে?
আব্বু গম্ভীরভাবে বললেন,
-মিথ্যে বলতে নেই রিজোয়ান।
মাইশু দৌড়ে এসে বললো,
-হ্যাঁ,হ্যাঁ।সব তো আমারি দোষ।এ বাসার নন্দ ঘোষ আমি।রিজোয়ান নিজেমুখে বললো,তাও আমাকেই দোষাচ্ছে সব।
ওর দিকে চোখ ছোট ছোট করে বললাম,
-তো তুইই তো মারিস রিজোয়ানকে।
-তো ও তোমার নাম বললো কেনো?
-তুই শিখিয়ে দিয়েছিস।ধীরে পড়তে বলে এলাম না,তাই শোধ তুলছিস।লাভ নেই,আব্বু জানেন আমি রিজোয়ানকে মারি না।
-ইহ্!ঠেকা পরছে আমার।কই এর আগে তো বলে নি তোমাকে?
-মনে নেই?সামিয়ার জন্মদিনে তোকে সাজিয়ে দেই নি বলে তুই রাগ করে ওকে দিয়ে এই কথাটাই বলিয়েছিলি।আম্মু কি বকাবকিটা করেছিলো আমাকে বাসায় এসে!
আমার কথা শুনে ওরা এমনভাবে তাকালো যেনো আকাশ থেকে পরেছে।আব্বু মাইশু দুজনেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে।কি এমন বললাম আমি?এভাবে রিয়্যাক্ট করলো কেনো ওরা?মাইশু বললো,
-আপু,সামিয়ার বার্থডের কথা তোর…
-মাইশু,যাও পড়তে বসো।
-আব্বু?আপু…
-যাও।
আব্বুর গম্ভীর গলা শুনে মাইশু চমকে উঠে বেরিয়ে গেলো।রিজোয়ান গিয়ে টেবিল থেকে আমার একটা বই নিয়ে বেডে বসে নাড়তে লাগলো।আব্বু বললেন,
-সামিয়ার কোন বার্থডের কথা বলছো তুমি মিথি?
কোন বার্থডে?ঠিকই তো।কথাটা তো বলে ফেললাম,কিন্তু কবেকার কথা এটা?লাস্ট ইয়ার?নাকি তারো আগের?মনে তো পরছে না কিছুই।তবে এই ঘটনাটা ঘটেছিলো,সামিয়ার বার্থডে তেই।কিন্তু কবে?সেটা তো মনেই পরছে না।মাথা নিচু করে ভাবতে লাগলাম।আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি বললেন,
-কি হলো?বলো?
মাথা তুলে আব্বুকে বললাম,
-মনে পরছে না আব্বু।তবে এটা মনে হলো এসব ঘটেছে।
আব্বু জোরে একটা শ্বাস ফেলে বললেন,
-আচ্ছা বেশ,পড়ো তুমি।মনে করতে হবে না হুম?
আমি হ্যাঁসুচক মাথা নাড়লাম।আব্বু কিছুটা চিন্তিতমুখে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।আচ্ছা,আমি কি এমন কিছু বলেছি যেটা বলা উচিত ছিলো না,নাকি ওনাদের কাছে আনএক্সপেক্টেড ছিলো?মাইশু কি বলতে চাচ্ছিলো?আমি কি হারানো দেড় বছরের মধ্যেকার কোনো কথা বললাম?কোনোভাবে কি আমার ওগুলো মনে পরতে শুরু করেছে?
হ্যাঁ,তাই।তাইতো সবটা মনে করতে পারছি না।আগের ঘটনা হলে সবটাই মনে করতে পারতাম আমি।কিন্তু আব্বু মন খারাপ কেনো করলেন?আমার মনে পরাতে তো ওনার খুশি হওয়ার কথা।কিন্তু মাইশুকেও বলতে দিলেন না,নিজেও কিছু বললেন না কেনো?মেবি জোর করে মনে করাতে চান না উনি।হয়তো উনি আমাকে প্রেশারাইজ করতে চান না তাই।যাই হোক,নিজের এতোটুকো উন্নতি টের পেয়ে আমারই ভালো লাগলো।খুশিমনে পড়া শেষে ডিনার সেরে ঘুমিয়ে পরলাম।
•
সকালে ঘুম থেকে উঠে আবারো শরীর জুরে সেই স্পর্শের অনুভুতি।ঘ্রান লেগে আছে নাকে একদম।আচ্ছা, কোনো অশরীরী নয়তো!ভুত বা জীন?কিন্তু এসব তো বাস্তবে হয় না।ধ্যাৎ! হয় না কেনো বাস্তবে?কি হতো এসব থাকলে?লাইফটা কতো ইন্টারেস্টিং হতো!দাদী বলতো হয় নাকি,তো হলেও সামনে আসে না কেনো?কতো ইচ্ছা আমার ‘ আও কাভি হাওয়েলি পে ‘ গানে আত্মা ফাত্মার সাথে নাচবো।এ ইচ্ছাটা অপুর্নই থেকে যাবে আমার।এই মনের ভুল নিয়েই থাকতে হবে।ধুর!ব্রেকফাস্ট শেষ করে রেডি হয়ে নিলাম ভার্সিটির জন্য।রিয়াপি এরমধ্যে ফোন করলো।
-হ্যাঁ আপি বলো।
-কেমন আছো পাখি?
-আলহামদুলিল্লাহ ভালো,তুমি?বাসার সব?
-হুম,সব্বাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো।পাখি রেডি হয়েছো ভার্সিটির জন্য?
-হুম।কেনো বলোতো?
ওর সাথে কথা বলতে বলতেই ডোরবেলটা বেজে উঠলো।
-আপি,ওয়েট কেউ এসেছে।
গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই সিয়াম ভেতরে ঢুকলেন।মেজাজ বিগরে গেলো সকাল সকাল।গলা টেনে আব্বুর দিকে তাকিয়ে সালাম দিলেন উনি।এরপর আমার দিকে তাকিয়ে দাত কেলিয়ে বললেন,
-কেমন আছো?
-আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো।
এটুকো বলেই ফোন নিয়ে রুমে চলে আসলাম।আপি বললো,
-কে এসেছে মিথি?
-সিয়াম।
-ওহ!পাখি তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।
ভেবেছিলাম আপি সিয়ামকে নিয়ে কিছু বলবে,বললো না।ও কিছু বললে আমি নিজেই বা ওকে দিয়ে আব্বুকে কিছু বলানোর কথা বলতাম।একটা জোরে শ্বাস ফেলে বললাম,
-চলে আসো আপি।আমারো তো ইচ্ছে করছে।
-না পাখি,এখন না।তুমি তো বাইরেই যাবে।একটা কাজ করো,আঙ্কেলের ফোন দিয়ে একটা ভিডিও কল দাও।
আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম,
-ওকে।
আব্বুর কাছে গিয়ে ফোনটা এনে কথা বললাম ওর সাথে।মন ভালো করার ওষুধ আমার।কথা শেষে ফোনটা ফেরত দিতে গেলাম।সিয়াম বললেন,
-এখন ভার্সিটি যাবে?
-জ্বী।
উনি পরে কিছু বলতে যাবেন আমি তখনই আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললাম,
-আমি আসছি আব্বু।লেইট হচ্ছে আমার।
তড়িঘড়ি করে উঠে আসছিলাম।সিয়াম বলে উঠলেন,
-আমি ড্রপ করে দেই?
-নো নিড।পারবো আমি।
আব্বু বললেন,
-তর্ক করো না।লিফট্ দিতে চাচ্ছে চলে যাও।রিকশায় গরম বেশি।
অসহায়ভাবে তাকালাম আম্মুর দিকে,ডাইনিং গোছাচ্ছিলো সে তখন।আমার দিকে চোখ বন্ধ করে ঘাড় দুলিয়ে যেতে ইশারা করলো আম্মু।আমি কিছু না বলে বেরিয়ে আসলাম।আব্বু যখন বলেছেন,মানা করলে আবার,,থাক,চলে যাই সাথে।বরং এমন কিছু একটা করতে হবে যাতে এই আমাকে কোনোদিন নিয়ে যেতে না চায়।চুপচাপ গাড়িতে উঠে বসলাম।সিয়ামও কিছুক্ষন পর এসে দাত কেলিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন।
-আজ ভালোলাগছে তোমাকে।
-আপনার ডিউটি নেই?
আমার এমন কথা আশা করেন নি উনি।এ কথায় উনি একপলক চমকে তাকিয়ে থেকে হেসে বললেন,
-এটাও আমার একটা ডিউটি তো।
দেখাচ্ছি তোর ডিউটি পালন!গাড়ির জানালার কাচ তুলে দিলাম আমি।উনি বললেন,
-কি হলো?তুলে দিলে কেনো?
আড়চোখে তাকালাম,কিছু বললাম না।
-না মানে,বাতাস আসছিলো তো!
-ও!তাই?
-ত্ তোমার ভালো না লাগলে থাক।ওমনই থাকুক।
-ইয়া আল্লাহ্!এটা কি?গাড়ি থামান।থামান বলছি!
চিৎকার শুনে সিয়াম গাড়িতে ব্রেক করেছেন।আমি ততক্ষনে সিটবেল্ট খুলে গাড়িতে বসেই ধরফর করতে শুরু করেছি।সিয়াম বারবার বলছেন কি হয়েছে,কি হয়েছে,চেচাচ্ছো কেনো,সবাই কি ভাববে।কিচ্ছু কানে নেই নি।এরপর সিয়াম এগিয়ে এসে যেইনা আমার গালের দিকে হাত বাড়িয়েছে,আমি হাতের কনুই ব্যাগে পেচিয়ে ইচ্ছা করে গাড়ির জানালার কাচে দুম করে বারি মেরে দিলাম।ভেঙে গেলো ওটা,একদম চুর্নবিচুর্ন যাকে বলে।
পিনপতন নিরাবতা।কাদোকাদো হয়ে তাকিয়ে আছি সিয়ামের দিকে।লোকটা মাথার চুল উল্টে ধরে তব্দা খেয়ে ভাঙা জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন।
-এটা কি করলে তুমি?
-আ্ আসলে…
-কাচটা ভাঙলে কেনো?
-ও্ ওই,মানে,গ্ গাড়িতে ত্ তেলাপোকা…
-মানে?গাড়িতে কোথথেকে আসবে তেলাপোকা?
– ছিলো।আমি স্পষ্ট দেখেছি।তাইতো ভয় পেয়ে…
সিয়াম এবার ভারী গলায় বললেন,
-তুমি তেলাপোকায় ভয় পাও?
এইরে!বুঝে গেলো নাকি?কি করে জানলো?নইলে আমি ভয় পাই কি না জিজ্ঞাসা করলো কেনো?আমি তো সত্যিই ভয় পাই না।নাটকটা ধরে ফেললো?
-ত্ তো,তেলাপোকায় ভয় পায় না এমন কেউ আছে দুনিয়ায়?অন্তত মেয়ে মানুষ তো নেই।নাকি সিটবেল্ট লাগাতে পারি বলে আপনার দেখা সিটবেল্ট বাধতে না পারা নায়িকাদের মতো আমার তেলাপোকায় ভয় পেতে নেই।
উনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।মনটা ছোট করে আবারো গাড়ি স্টার্ট দিলেন।চেহারা দেখে যা হাসি পাচ্ছে না আমার।এটুকোতেই এই দশা?আরেকদিন আমাকে লিফট্ দিতে আসিয়েন,নানি ইয়াদ দিলাউঙ্গি।হুহ!
•
নব দিনের সুচনা!বিছানায় খালি গায়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে প্রতিদিনের মতোই রাতে মিথিকে জরিয়ে রাখার ওই অল্প কিছু মুহুর্তকেই বারবার মনে করছে আরমান।মিথির চুলের ঘ্রান এখনো ওর নাকে।সকালের আলো ফোটার আগেই মিথিকে ছেড়ে চলে আসার কষ্টটা প্রতিদিন ওর সাথে দেখা হওয়ার আগ অবদি খোচায় ওকে।তাইতো আরুকে ছাড়ার বাহানায় ভার্সিটি গিয়ে একনজর দেখে আসে। মাহবুব আলমের কাগজগুলো হাতে পেয়ে আরো স্বস্তি মিলেছে ওর!বিছানা ছেড়ে উঠতে যাবে ম্যাসেজের টুংটাং শব্দ।ম্যাসেজটা দেখে হাসলো ও।
‘ ওহ্!মিস্টার আলম,আপনি নিজেকে যতটা চালাক ভাবেন ততটাও কিন্তু নন আপনি।কালকের পর এমনটা করবেন তা জানতাম আমি।আপনার মনে ভয়,কাগজ পেয়ে আমার স্বার্থসিদ্ধি হয়ে গেছে,এখন যদি মিথিকে,,,হা হা হা,বোকামো!এজন্যই মাঝে মধ্যে করুনা হয় আমার আপনার প্রতি।আরে,একটু আপডেটেড থাকুন না।না।আপনি কি না শেষে…যাই হোক,ইফ ইউ বিহেভ লাইক দিজ,আমাকেও তো তার উপর গুটি সাজাতে হয়।ইউ নো,আপনাকে আন্ডারেস্টিমেট করে নয়,খেলাগুলো এবার আপনার প্রতিটা স্টেপের সাথে চেকমেট হিসাবে রাখবো আমি। ‘
মনে মনে কথাগুলো বলে রেডি হয়ে নিচে নামলো ও।ব্রেকফাস্ট করে ডাক লাগালো সুহানা কে।অফিসের জন্য রেডি হচ্ছিলো সুহানা।মনে মনে বেশ খুশি ও আজ।অন্তত আরমান ওকে আর একা অফিসে রেখে আসবে না,কালকে যথেষ্ট শুনিয়েছে ওকে।আরমানের গলায় নিজের নাম শুনে শক পেয়েছে বড়সর। একপ্রকার দৌড়ে নিচে নামলো ও।
নিচে নেমে ড্রয়িংরুমে দেখলো আরিশা আরমান রেডি হয়ে বসে আছে।সাথে আফরোজ জামান আর মিসেস জামানও বসে চা খাচ্ছেন।প্রত্যেককেই কোনো কারনে বেশ খুশি দেখাচ্ছে।জামান ম্যানশনের প্রত্যেকের চেহারায় খুশির ঝলক দেখে ওর হাসিটা আপনাআপনিই বিলিন হয়ে গেলো।এদের খুশির একমাত্র কারন যে মিথি তা ও জানে।কিন্তু হয়েছে টা কি?সুহানাকে নামতে দেখে আরমান দাড়িয়ে বললো,
-রেডি?যাওয়া যাক?
সুহানা একপ্রকার নেচে উঠে বললো,
-আজও একসাথে যাবো আমরা?
-ইয়াহ্!আমি তো ডেইলি যাওয়ার কথাই বলেছি।এনি প্রবলেম?
-রিয়েলি আরমান?
আরিশা উঠে বললো,
-হেয়ালি ছাড়ো সুহানা আপু,লেইট হচ্ছে আমার।চলো।তোমাদেরও লেইট হচ্ছে।
-সুহানা,এই ড্রেসে ভালো লাগছে না তোমাকে।
আরমানের কথায় আবারো অবাক সুহানা।ওর ড্রেসের বর্ননা দিচ্ছে আরমান?ও কি সত্যিই তাকিয়েছে ওর ড্রেসের দিকে?আজ কি হলো ওর?
-ত্ তুমি…
-আর ড্রেস নেই তোমার।
-আছে।তবে সবগুলো এরকমই।যেরকম মিথি পরে।যেরকম তুমি চাও।
আরিশা ওর বাবা মা তিনজনই ঠোট টিপে হাসলেন।কিচেন থেকে সহকর্মী রোজি খালার ফিক করে হেসে দেওয়ার আওয়াজ শুনতে পেলো সুহানা।আরমান বললো,
-আরু,আজ তোকে ছেড়ে দিয়ে সুহানাকে নিয়ে শপিং করতে যাবো।সুহানা,যাবে তুমি?
বাকিসবের চোখমুখ ঠিক থাকলেও সুহানার মুখ হা হয়ে গেছে।বিশ্বাস হচ্ছে না ওর নিজের কানকেই।নিজের পায়ে নিজে একবার পারা দিয়ে বাস্তবতা পরখ করে বললো,
-রিয়েলি আরমান?
-তোমাকে মিথ্যা কেনো বলবো?যাবে কি না সেটা বলো।
সুহানা তাড়াতাড়ি উপরে নিচে ঘাড় দুলালো।আরমান জানতো,এ বিষয়ে মানা করার পাব্লিক সুহানা নয়।ওকে ওর ভাষাতেই হ্যান্ডেল করতে হবে।মুচকি হেসে বেরিয়ে পরলো গাড়ি নিয়ে।
•
ভার্সিটিতে গেইটের সামনে গাড়ি থামালেন সিয়াম।আমি নেমে পাশের দোকান থেকে চকলেট নিলাম।ভেতরে ঢোকার সময় পিছনে একবার তাকালাম।বেচারা সিয়াম বাইরে বেরিয়ে কোমড়ে হাত দিয়ে গাড়ির কাচের দিকে তাকিয়ে আছে। পাশেই মালু গোলআলুর মতো বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে সিয়াম আর ওনার গাড়ির দিকে তাকিয়ে এগোচ্ছে।তা দেখতে এতটাও ব্যস্ত যে আমাকেই পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছিলো ও।আমি ওর হাত টেনে ধরে বললাম,
-বেবি,কাচভাঙার কাহিনি শুনবা?
মালু চকচকে চোখে তাকালো আমার দিকে।বললো,
-ওওওও!তোর কীর্তি?
-জ্বী
-কেমনে করলি?
-ভেতরে গিয়ে বলি?
-না রে,এখনই বল।সিন টা ইমাজিন করে লোকটার হালাতের সাথে মিলাবো।উফফফ্ কি যে এক্সাইটেড।বল বল।
আমি হেসে ওকে ধীর গলায় সবটা বললাম।মালু আগে একদফা হাসলো।তারপর বললো,
-ওয়েট,পার্টি পরে করছি।আগে মৌচাকে ঢিল ছুড়ি।
-মানে?
-ওর কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দেবো।দেখ তুই।
লোকটা ওভাবেই দাড়িয়ে এখনো।এতো শোক কাচ ভাঙার?নাকি যাবে যাবেই না?আমি মালুর হাত টেনে ধরে বললাম,
-না মালু,ছেড়ে দে।বেচারা।
ও আমার হাত ছাড়িয়ে বললো,
-আরে আরে তুই কেনো এখানেনে থাকবি।সাইডে গিয়ে এন্জয় বেব।
-মালু,উনি পুলিশ কিন্তু!
-আরে ধুর!আছে তো সিভিল ড্রেসে।সোডিয়াম,তু তো গ্যায়া!
হাতের তালু ঘষতে ঘষতে,মাস্কটা পরে মালু এগোলো।আমি আড়ালে দাড়ালাম।জানি ও মজার কিছু করবে।আর এই লোককে ঝামেলায় দেখলে শান্তি লাগবে আমার।মালু এগিয়ে গিয়ে সিয়ামের সামনে দাড়িয়ে বললো,
-এই যে মিস্টার।এসব সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস এখানে রেখে শো অফ করছেন?এ ভার্সিটির কেউ পটবে না এই কাচভাঙা গাড়ি দেখে।
সিয়াম বড়বড় করে তাকালেন মালুর দিকে।বললেন,
-হোয়াট রাবিশ?
-দেখুন,একদম ইনজেরি ঝারবেন না,ওটাতেও এ ভার্সিটির কেউ পটবে না।
আমি পেট ধরে মুখ চেপে হাসছি।কপালের ভাজটা ওই বেকুবের চেহারায় বেশ মানিয়েছে।রাগে কিছুটা চেচিয়ে বললেন,
-দেখো তুমি চেনো না আমাকে,আমি…
-ওমা ওমা ওমা!ইন্ট্রোও দিবেন এখন।আরে যান যান,এসব অন্য কোথাও বলবেন।এখানে চলছে না।রাইট গার্লস?
পাশে একদল মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললো মালু।সিয়াম রাগে আরো কিছু বলতে যাবেন তখনই পাশের মেয়েগুলো শব্দ করে হেসে দিলো।উনি ওদের দিকে তাকাতেই ওরা চুপ।সে সুযোগে মালু এক দৌড়ে ভার্সিটির ভেতরে।দুজনে মিলে অনেকদুর এসে হাসতে লাগলাম জোরে জোরে।কিছুক্ষন পর আমি হাসি থামিয়ে বললাম,
-আব্বুর জন্য কিছু বলি না,এর সাথে আসতে ভালোলাগে না আমার মালু।
-ডোন্ট ওয়ারি,এর নিজে থেকে না তে আসতে চাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
-তারমানে?কিছু ভেবেছিস তুই?
-নাহ্!ভাবতে কতোক্ষন।তুইও ভাব।
একটু চুপ থেকেই আমি বলে উঠলাম,
-বেবি!তুমি নাকি সিয়ামের বাবার বন্ধুর মেয়ে?
-ওই!না না,আমি না।বুঝে যাবে দেখে।
-মুখ দেখে নাই তোর!
-তাও আমি না।আরু?
-পাগলাইছোস তুই?ওর যে ভাই!
-উম উম্,আরমান ভাইয়ার কথাও মনে রাখছো তুমি?
থতমত খেয়ে গেলাম।মুখে বললাম,
-তো মিথ্যা বলেছি কিছু?ডিপার্টমেন্টের কারো সাথে কথা বলতে দেয় না তুই জানিস?
-কি রে?কিসের আলোচনা হচ্ছে এখানে?
উর্বি বসতে বসতে বললো।সাথে রায়হানও এসেছে।আমি আর মালু দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে বিশ্বজয়ের হাসি দিলাম। সিয়ামকে জব্দ করার মাস্টারপ্লান ইজ হেয়ার।রায়হান বললো,
-তোদের এই হাসি সুবিধের লাগছে না আমার।
আমি আর মালু ওভাবেই হাসছি।এখনই ওদের কিছু জানাবো না,আগে ঠিকমতো প্লানটা করি,দেন জানাবো।নইলে এরা যে পাব্লিক!জেলের ঘানি টানতে হবে আমাদের।।এরমধ্যেই আরু একটু দুর থেকে বললো,
-হাই গাইস!
ওকে আসতে দেখেই আমার নির্লজ্জ চোখ আশেপাশে তাকিয়ে কাউকে খুজতে শুরু করেছে।উর্বি কাধে চড় মেরে বললো,
-কারে খুজোস?
-ক্ কই?না তো।
মালু আরুকে বললো,
-কিরে?আরমান ভাইয়া এলো না?
-না।ও সুহানা আপুকে নিয়ে শপিং এ গেছে।
কথাটা শুনে কান দিয়ে ধোয়া বেরোচ্ছে আমার।ওই মেয়েকে আবারো এতোটা পাত্তা দিচ্ছে?কি দরকার ওমন বিহেভের?ও মেয়ে এমনি গায়ে পরা,বিদেশী কালচার নিয়ে পরে থাকা নেউল!ওকে এতো টাইম দেওয়ার কি আছে?অফিস গিয়েও তো ওর সামনেই থাকতে হয়,আবার আলাদা করে আজ শপিং নিয়ে গেছে?আমি কিনা ওর হাত থেকে ওনাকে বাচানোর জন্য মনে মনে কতো কি ভেবে রেখেছি,আর উনি!
-এই সুহানা আপুকে আবার শপিং এ কেনো নিয়ে গেলো রে?
-জানি না রে মালু।বাট সুহানা আপু এতে খুব খুশি।যতই হোক,পছন্দের মানুষের সাথে টাইম স্পেন্ড করবে বলে কথা।আসলে ও ভাইয়াকে পছন্দ করে তো!
ঠিক যেমনটা ভেবেছিলাম।তাইতো হলো!ওই অতিরিক্ত গায়ে পরা মেয়েটা তারমানে সত্যিই আরমানকে পছন্দ করে।লোকটা বোঝে না নাকি?ওনার মাথায় নারিকেল ফাটাতে পারলে শান্তি লাগতো আমার।আমার সাথে ওমন আজব ব্যবহার করে সুহানার সাথে ঢলাঢলি?আমি কোনো স্পেশাল টেশাল ফিল করি না ওনাকে নিয়ে।একদম না।কিন্তু তবুও ওই সুহানাকে তো একদমই কাছে আসতে দেবো না ওনার।আরেকবার দেখা হোক,বুঝাবো ওকে ,গায়ে পরা মেয়েদের মিথি কিভাবে হেনস্তা করে।আর ওই লোকটা!একে তো আমি,,,,দেখা হোক একবার!ওনার খবর আছে!!
#চলবে…
®