তোমাতেই অস্তিত্ব আমার পর্ব-১৯

0
1407

#তোমাতেই_অস্তিত্ব_আমার
লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা

১৯.

আরমানের দুবাহুর মাঝে গাছে পিঠ ঠেকিয়ে ফ্রিজড্ হয়ে দাড়িয়ে আছি।চোখ খিচে বন্ধ করে রয়েছি।তাকাতে পারবো না ওনার দিকে।কিন্তু কেনো?এভাবে অচেনা কারো এতটা কাছে চলে আসাটা কেনো মেনে নিচ্ছি আমি?কেনো কিছু বলতে পারছি না?কেনো আটকে যাই আমি?ওনার কাজে রাগ না করে ভালোলাগা শুরু হয় কেনো আমার?এভাবে অস্বস্তিতে পরেও কেনো বারবার নিজেকে ওনার সাথে,ওনার পাশেই আবিষ্কার করতে ইচ্ছে করে?

-কিছু বলছিলে তুমি।

আরমানের শান্ত কথায় চমকে উঠলাম আমি।ওনার গরম নিশ্বাস চোখে মুখে লাগছে আমার।ওড়নাটা ছেড়ে দিয়ে নিজেকে একটু শক্ত করে কাপতে কাপতেই আড়চোখে পাশে তাকালাম।ওখানে একদল ছেলেমেয়ে আড্ডা দিচ্ছিলো।আমি ওদিকে তাকাতে চোখাচোখি হয়ে গেলো ওদের সাথে।তারমানে ওরা আমাকেই দেখছে।কি ভাবছে সবাই?
কিছুটা সাহস জুগিয়ে আরমানের দিকে তাকালাম এবার আমি।উনি ওভাবেই দাড়িয়ে আছেন আমার কাধের দুপাশে হাত দিয়ে গাছ ছুয়ে,কিছুটা ঝুকে।তার চোখের ভাষা বুঝলাম না,তবে ওই মুখের দিকে তাকালে চোখ ফেরাতে ইচ্ছা করে না আমার।তার চোখে যেনো অসার করে দেওয়ার অদ্ভুত ক্ষমতা আছে।কাছে টানার কোনো এক অলৌকিক শক্তি।

কাদোকাদো মুখ করে একবার আরমানের দিকে ,তারপর আবারো ওই ছেলেমেয়েগুলোর দিকে তাকালাম।উনি আমার চোখ অনুসরন করে যেইনা তীক্ষ্মচোখে ওদিকে তাকিয়েছে,সবগুলো আতকে উঠে নিজেদের মধ্যে স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে শুরু করলো,যেনো কিছু দেখেই নি ওরা।আমি আবারো মাথা নামিয়ে নিলাম।উনি না ছাড়লে এখান থেকে বেরোনো আমার পক্ষে সম্ভব না,ধাক্কাধাক্কি করে উনার সাথে পেরেও উঠবো না আমি।শুধুশুধু সিন ক্রিয়েট হবে ভেবে চুপ করে রইলাম।আরমান এতোটুকো না নড়ে বললেন,

-হ্যাঁ,বলো?কি যেনো বলছিলে?আমাকে কেনো কৈফিয়ত দিবে তুমি রাইট?

আমি চুপ করেই রইলাম।উনি আবারো বললেন,

-শুড আই আন্সার ইট?

-দেন লিসেন,আমাকে কৈফিয়ত না দিলে তোমার ঘুম হবে না মিথি,শান্তুি পাবে না তুমি কোথাও ও!

অবাক হয়ে মাথা তুলে তাকালাম।উনি বললেন,

-যদি আরো কিছু জানতে চাও,নিজের মনকে জিজ্ঞাসা করো।কেনো তুমি আমাকে কৈফিয়ত না দিতে পেরে ছটফট করো।

কথাটা বলে হাত সরিয়ে উনি নিজেও দুরে সরে গিয়ে দাড়ালেন।আমি ওনার কথাতেই আটকে আছি।কি বললেন উনি এসব?কেনোই বা বললেন?নাহ্!আজ ওনাকে সরাসরি বলবো আমি,ওনার এসব কথার মানে কি?একটু দম নিয়ে এবার আমি দু পা এগোলাম।আরমান ভ্রুকুচকে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।একটা শুকনো ঢোক গিলে বললাম,

-আপনার এসব কথার মানে কি?

-সেটাও তুমি জানো।

-না জানি না আমি,বলুন।এভাবে কেনো আমাকে…

-তোমাকে?

-বেশ।তাহলে আগে তুমি বলো।তোমার এ অনুভুতিগুলোর নাম কি?

থেমে গেলাম।এর উত্তর তো আমার অজানা।

-কি হলো?বলো?

-প্রশ্নটা আমি আগে করেছি।

উনি নির্বিকারচিত্ত্বে বললেন,

-ট্রায়াল।

আবারো অবাক হয়ে তাকালাম উনার দিকে।বললাম,

-কিসের ট্রায়াল?

উনি গা ছাড়া ভাব ধরে বললেন,

-একচুয়ালি,সুহানা বলেছে আমি নাকি কোনো মেয়ের সাথে কথাই বলতে পারি না।ওর সাথে তো একদমই না।এখানে এসেছিলাম,তুমি একা আছো।তাই ভাবলাম একটু প্র্যাকটিস করেই দেখা যাক।ওকে খুশি করতে হবে তো!তাই আরকি…

সুহানার কথা শুনে গায়ে আগুন জ্বলে উঠলো আমার।কিছুক্ষন আগের সবটা মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে।আবার!আবার ওই সুহানার নাম নিচ্ছে এই লোক?খুশি করতে হবে মানে?ওকে কেনো খুশি করতে হবে?উনি সাদাসিধে মানুষের না বুঝে ওই‌ মেয়েকে একটু বেশিই পাত্তা দিচ্ছেন।আমি তো বেশ বুঝতে পারছি,এমন দিন বেশি দুরে না যে দিন ওই মেয়ে ওনাদের রিলেশনের নাম ব্রো টু বর বানিয়ে দেবে।

-বাই দ্যা ওয়ে,হাউ ওয়াজ ইট?

-হ্যালো?

-কি?

-হোয়াট আবাউট মাই কোশ্শেন?

-কিসের কোশ্শেন?

উনি একটু হাসলেন,কিছু বললেন না।আমি বিরক্তি আর রাগ নিয়ে অন্যদিক তাকাতে যাবো হুট করেই উনার হাতের দিকে চোখ গেলো আমার।গা ঝারা দিয়ে উঠলো আমার।ব্যান্ডেজ নেই।কাটা দাগগুলো অনেক বাজে দেখা যাচ্ছে।যেনো মনে হচ্ছে প্রতিদিনই ওখানে আঘাত করেন উনি।দুদিন হয়ে গেলো!দুবার দেখাও হলো! একটাবারো জিজ্ঞাসা করি নি ব্যথাটা কমেছে কি না।আচমকা বুকের ভেতরটা মুচড়ে উঠলো।

-এ্ এটা?

-হুম?

-ব্ ব্যান্ডেজ খুলেছেন কেনো?

-তাতে তোমার কি?

-আমার কি মানে?আপনারই তো কষ্ট!

-সেটাই তো।আমার কষ্ট,তাতে তোমার কি?

কিছু বলার থাকে না সেখানে আর।আমার কিছু তো!কিন্তু সেটা কি আমি নিজেও জানি না।

-কি?বলবা না?

-তারপর কি আবার লেগেছিলো?

-না।আসলে এর আগে লেগেছিলো,না লাগিয়েছিলাম।তাই আগের পরের দাগগুলো মিলে ওমনটা দেখা যাচ্ছে।নয়তো,ইটস্ ওকে।ব্যথা নেই।

ইটস্ ওকে?কিভাবে বলতে পারেন উনি ইটস্ ওকে?আরো কিছু বলতে যাবো এরমধ্যেই আরু আর উর্বি চলে আসলো।আমি একটু পিছিয়ে দাড়ালাম।আরু বললো,

-কিরে ভাইয়া?কখন এলি?

-এইতো সবেই।

-সুহানা আপু কই?

মুহুর্তেই একরাশ রাগ জরো হলো আবার মনে।এই ভাইবোনের মুখ থেকে মেমসাহেবের জপ তো সরছেই না।আরমান বললেন,

-অফিসে।কাজে আটকে গেছে।

-ওহ্!তো ওকে…

আমি আরুকে থামাতে বললাম,

-আরু,এই লাস্ট ক্লাসটার নোটস্ দে।

-কেনোরে?তোর মাথায় কি আর কিছুই নেই নোটস্ ছাড়া?

নেই আবার?তোর এই কাকতাড়ুয়ার মতো লম্বু ভাই হুটহাট কেমন কেমন বিহেভ করে সেগুলো সহ্য করি,সুহানার গায়ে পরা সিনগুলো সহ্য করি,তোদের দু ভাইবোনের মুখে সবসময় ওই বিলেতফেরত মেয়ের নাম শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা আমার।বিরবির করে বললাম।

-কিছু বললি?

-ন্যাহ্!যা চাইলাম,দিয়ে উদ্ধার করেন আমাকে।

-কিছু হয়েছে তোর?

-আমার আবার কি হবে?

-কিছুতো একটা হয়েছে তোর!

উর্বি বললো,

-ঠিকই বলেছিস।নইলে কইন্ন্যা এসময় একা একা কৃষ্ণচূড়ার তলে অপেক্ষারত কেনো?

-থামবি তোরা?

-বলবি না?নাকি স্বীকার করবি না?

আরমান মাথাটা চুলকে ধীরে ধীরে বললেন,

-ওটা বুঝলে বা স্বীকার করলে তো সমস্যাটাই মিটে যেতো।

উর্বি বললো,

-বাব্বাহ্!মিথি বুঝছে না?এমনও হয়?তারমানে তো ব্যাপারটা আসলেই কমপ্লিকেটেড!

-আরে না না,তোমার ওকে নিয়ে আই থিংক কিছু ভুল ধারনা আছে। নিব্বিরাও ভালো বোঝে ওর চেয়ে।

এতক্ষন আহম্মকের মতো ওদের কথা শুনলেও এবার আমি চোখ কটমটে তাকালাম আরমানের দিকে।উনি একটু থতমত খেয়ে বললেন,

-আ্ আরু,আ্ আমি আসছি গাড়ি নিয়ে।তুই এগো।

কথাটা বলে একপ্রকার তাড়াহুড়ো করেই চলে গেলেন উনি।উর্বি আরু হেসে দিলো।কিছু না বুঝে ভ্রুকুচকে তাকালাম ওদের দিকে।

-তোরা হাসছিস কেনো?

আরু হাসতে হাসতেই বললো,

-ওই যে ভাইয়া বললো না তুই কম বুঝিস এই নিয়ে।

-তোর ভাইয়ার তো আর কোনো কাজ নেই আমার লেগপুল করা ছাড়া।ডাক ওনাকে আবার,দেখি আরেকবার বলে দেখাক এই কথা।

আমার কথা শুনে আবারো ওরা হাসতে লাগলো।এদিকে ওদের কারনছাড়া হাসি দেখে রাগ উঠছে আমার।

-উর্বি,আরু তোরা…

এরমধ্যে আরমান গাড়ির হর্ন বাজালেন।আরু হাসতে হাসতে দৌড়ে চলে গেলো।গাড়িতে গিয়ে উঠলো।পাশে তাকিয়ে দেখি উর্বিটাও নেই।গাল ফুলিয়ে রিকশা ডেকে আমিও চড়ে বসলাম।মনে মনে রাগ হচ্ছে সুহানা নামক মেয়েটার খুশি নিয়ে আরমানের চিন্তা দেখে।আবার ওনার কাটা হাতের কথাও মনে পরছে।কি এমন দরকার ছিলো এতো তাড়াতাড়ি ব্যান্ডেজ খোলার?তার উপর সুহানা নামক অসহ্যকর বস্তুর ভাবনা তো আছেই।আরমানের এভাবে কাছে আসাটার কারন খুজে পাইনা,তার পাশে অন্য কাউকে দেখতে পারি না।আজ এমন দিনও দেখতে হচ্ছে আমাকে।কি নাম এই অনুভুতির?কি কারন এসব চিন্তার?

ওই সুহানা!ও কেনো এতো কাছে আসবে ওনার?আচ্ছা,আরমানের লাইফে কে আসলো কে গেলো তাতে আমার কি?কেই বা ওনাকে ফাসালো তাতেই বা আমার কি?আরে আরে,উনিতো আরুর ভাই।বান্ধবির ভাই!সুহানা ওনার লাইফে আসলে ছেচড়ামো করেই পাকিয়ে রাখবে ওনাকে।বিলেতি নেউলটা আরমানের যোগ্য না।তবে উনিও তো এসবই ডিসার্ভ করেন।জ্বালিয়ে মারেন আমাকে।কিন্তু তবুও,সারাজীবনের তরে এতোবড় শাস্তি?সুহানা তো শাস্তিই?হ্যাঁ তাই।এটুকু উপকার করতেই পারি আমি তার।ওকে আমি আরমানের কাছে ঘেষতে দেবো না দ্যাটস্ ইট!রিকশায় বসেই সিদ্ধান্ত পাকাপোক্ত করে বাসায় পৌছালাম।

বিকেল!অফিসে আদিবের কাজের চাপে প্রথমদিনেই হাপিয়ে উঠেছে সুহানা।বুঝতে বাকি নেই আরমান ইচ্ছে করেই ওকে রেখে চলে এসেছে।রাগে দপদপ করতে করতে সুহানা জামান ম্যানশনে ঢুকলো।চিৎকার করে বললো,

-আরমান?

আফরোজ জামান সোফায় বসে পেপার পড়ছিলেন।একপলক সুহানার দিকে তাকিয়ে আবারো পড়ায় মন দিয়ে মুখে বললেন,

-এ বাসায় ভদ্রভাবে থাকতে শেখো সুহানা।

সুহানা ওভাবেই চেচিয়ে বললো,

-আঙ্কেল আরমান আমাকে…

-সেটা তুমি ওকেই বলো।আর গলা নামিয়ে কথা বলো।আরমান তোমাকে কিছু বলবে না এরমানে এই নয় যে আমিও তোমাকে শাসন করতে ভুলে যাবো।

সুহানা ছোট ছোট চোখ করে দাত কিরমিরে ওনার দিকে তাকিয়ে সিড়ি বেয়ে সোজা আরমানের রুমের দিকে উঠে গেলো।আরমান বেডে শুয়ে ছবিগুলোতে চোখ বুলাচ্ছিলো।সুহানা খোলা দরজা পেয়ে রুমে ঢুকে কড়া গলায় বললো,

-হোয়াট ইজ অল দিস ননসেন্স আরমান?

ছবি থেকে চোখ সরিয়ে সুহানার দিকে তাকালো আরমান।বললো,

-হোয়াট হ্যাপেন্ড?

-আমাকে অফিসে একা রেখে চলে এসেছো কেনো?

আরমান বিছানা ছেড়ে উঠে ছবিগুলো টেবিলে রাখলো।সুহানার সামনে দাড়িয়ে বললো,

-তুমি বাচ্চা নও যে তোমাকে কোলে করে নিয়ে আসবো।

-তো অফিসের কাজগুলোও আমার একার জন্য রেখে আসলে?

আরমান ব্যালকনির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো,

-ওগুলো তোমার একারই করার কথা।মাই পোর্শন ওয়াজ ডান।তাই চলে এসেছি।

-ভার্সিটিতে মিথির কাছে গিয়েছিলে?

আরমান পিছন ফিরে বিরক্তি নিয়ে বললো,

-তোমাকে কেনো বলবো?

-বেশ।নাই বললে।বাট লেট মি টেল ইউ,তুমি যার জন্য এতোকিছু করছো সে মিথি কখনো তোমার কাছে আসবে না।কোনোদিন না।

-ওহ!রিয়েলি?

-হ্যাঁ।

আরমান দুহাত পকেটে গুজে বললো,

-এতোটা বিশ্বাস নিয়ে বলছো যে?

-আই নো হার।

-আমার চেয়ে বেশি নয়।

-ইউ অলসো নো দ্যাট,ও ফিরিয়ে দেবে তোমাকে।ডোন্ট ইউ?

আরমানের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠলো এবার।ঝারা মেরে বললো,

-গেট আউট অফ হেয়ার সুহানা!

-আই নিউ,আমার কথার জবাব নেই তোমার কাছে।তাই‌ বেরিয়ে যেতে বলছো।ইটস্ ওকে।আ’ম গোয়িং।তবে তুমিও জানো এটা আরমান,মিথির এখন আগের কিচ্ছু এনে নেই আর যেখানে ওর বাবা তোমাকে মানতে পারবেন না,তুমি শত চেষ্টা করেও মিথিকে তোমার করতে পারবে না।সো এই ইলিউশন থেকে বেরিয়ে আসো এজ সুন এজ পসিবল।

কথাগুলো বলে সুহানা চলে গেলো।ও চেয়েছিলো ওকে ফেলে আসার জন্য আরমানকেও কষ্ট দিতে।ও জানে,ও সফলও হয়েছে।আর ওর কথাগুলো শুনে হাত মুঠো করে দাড়িয়ে আছে আরমান।মাহবুব আলমের ফোনে দেখা করার জন্য ম্যাসেজ করে নিজেও বেরিয়ে গেলো।আট বছরের কালো অতীতকে এবারও আগেরবারের মতো তাড়া করতে দিবে না ও।কোনো ভাবেই না।কাজটা ফেলে রাখাটা রিস্কি হয়ে যাবে তা ভালোমতোই বুঝছে ও।গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরলো অতীতের তাড়নাকে শেষ করবে বলে।

.
আট বছর আগে,

সবে ভার্সিটিতে ভর্তির সময়টা বেশ কাটছিলো আরমানের। পরোপকারি ছিলো ও আগে থেকেই। একসময় বন্ধুদের সাথে মিলে প্লান করে সোশাল ওয়ার্কিংয়ের মতো নিজেরা কিছু করবে।যেমন ভাবা তেমন কাজ।আটজনের একটা গ্রুপ করে ফেলে ও।লিডারশিপে আরমান নিজে ছিলো।ওদের পরিকল্পনা ছিলো শহরের বস্তিতে থাকা পরিবারগুলোর কিছুটা হলেও আর্থিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়ানো।
আরমান ওর বাবার টাকা কন্ট্রিবিউট করার পাশাপাশি বন্ধুদের সাথে একটা ফান্ড তৈরী করে।যা থেকে বেশ ভালোভাবেই কিছু এলাকায় নিজেদের আর্থিক সেবা দিয়ে যাচ্ছিলো।আরমানের সবচেয়ে বড় ইন্সপিরেশন ছিলো সুহানার বড় ভাই শোয়াইব।আরমানের থেকে বয়সে মাত্র দুবছরের বড় হলেও শোয়াইব যথেষ্ট দায়িত্ববান একটা ছেলে।অতিমাত্রায় দেশভক্তির জন্য বাবা মার সাথে বিদেশে পাড়ি না জমিয়ে দেশেই পুলিশের চাকরীতে জয়েন করে ও।আরমান শোয়াইবকে দেখেই পরোপকার করার শিক্ষাটা পেয়েছে।আরমানের প্রতিটা কাজেই শোয়াইবও ওর পাশে থেকে উৎসাহ দিতো ওকে।

আরমানেরা যে বস্তিতে ওদের ফান্ডের টাকা কন্ট্রিবিউট করতো,ওখানে আচমকাই সরকারী রিট হয় যে উচ্ছেদ কার্যক্রম চালিয়ে ওখানকার লোকজনদের সরিয়ে নিয়ে নতুন কোথাও হাউজিং প্লান করা হয়েছে।ওরা বেশ খুশি ছিলো।কিন্তু শোয়াইব একটু অভিজ্ঞতাসম্পন্ন হওয়ায় অতোটা সহজে মানতে পারে নি বিষয়টি।নিজের মতো করে খোজ লাগাতে থাকে।ও ওর সিক্রেট সোর্স থেকে জানতে পারে সরকার যে টাকা হাউজিং এর জন্য যাদের দিচ্ছে তারা বেশিরভাগই দুর্নীতিবাজ,সন্ত্রাস সমর্থক।সবটাকাই বিল্ডার্সদের পেট পুর্তিতে যাবে।অর্থাৎ সবটাই বে আইনি।হয়তো বস্তিবাসীদের থাকার জায়গাটুকো নিয়ে নেওয়ার পর হাউজিং এর ব্যবস্থা আটকেও যেতে পারে।তাই ওরা আরমানদের ইউজ করে জায়গাটা দখল করতে চায়।ওদের প্লান ছিলো,যেহেতু আরমানরা এলাকার সবার সাথে ভালোভাবেই মিশে গেছে,ওদের মাধ্যমেই জমি দখলের কাজটা করিয়ে নেবে।একদিকে জমিটাও‌ পাওয়া হবে,দোষটা যাবে ফান্ডের উপর,অন্যদিকে হাউজিং এর টাকাটা খরচের চাপ থাকবে না।

একদিন বরাবরের মতো বস্তির ফান্ডের জন্য করা কুড়েঘরের ক্লাবে সবার সাথে আড্ডা দিচ্ছিলো আরমান।কয়েকটা গাড়ি এসে দাড়ায় ওদের ক্লাবের সামনে।এদের সাথেই হাউজিং এর বিষয়ে কথা বলেছিলো আরমান।ওরা কাগজপত্র রেডি করে আরমান আর ওর বন্ধুদের হাতে ধরিয়ে দেয় বস্তির লোকদের কাছ থেকে সই আনাতে।সরকারী কর্মকর্তা ভেবেতাই সাতপাচ না ভেবে,ওদের কথামতো বস্তির জমির দলিল দস্তাবেজ ওদের হাতে তুলে দেয়।
শোয়াইব সবটা জেনে আরমানকে জানাতে চলে আসে ওখানে।কিন্তু ততক্ষনে সবগুলো কাগজপত্র ওদের হ্যান্ডওভার করা শেষ।একমাত্র শোয়াইবই ছিলো যে সবটা জানতো।পুলিশ ইন্সপেক্টর হয়ে যেই না সেদিন জোর গলায় বলতে গিয়েছিলো কোনো অন্যায় হতে দেবে না,আরমানের সামনে ওরা শোয়াইবের উপর গুলি চালিয়ে পালিয়ে যায়।দরিদ্রের উপকার করার বিনিময়ে জীবন দিতে হয়েছিলো শোয়াইবকে।মৃত্যুর আগে শোয়াইব দুটো জিনিসই চেয়েছিলো আরমানের কাছে।এক,ওর ফ্যামিলিকে দেখে রাখা।দুই,সমাজসেবা থেকে নিজেকে আলাদা না করা।

শোয়াইবের মৃত্যুর আট আটটা বছর অনুশোচনা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে আরমানকে।এখনো অবদি ওর মনে হয় ওর জন্যই শোয়াইব ওই ঘটনায় জরিয়েছিলো।আরমানদের কাছ থেকে যে জমির দলিল ওদের ঠকিয়ে নেওয়া হয়েছে,এটার প্রমান শোয়াইবের কাছে ছিলো বলেই ওকে প্রান দিতে হয়েছে।এ ঘটনার সবটাই‌ জানতো সুহানার পরিবার।কিন্তু কেউই আরমানকে দোষ দেয়নি কোনোদিনও।কারন ওরাও জানতো শোয়াইব নিজে থেকেই জরিয়েছিলো এসবে।শোয়াইবের মৃত্যর কিছুদিন পর পরই নিখোজ হন শোয়াইবের বাবাও।ওদের বিজনেসেরও অনেক বড় লস হয়। এলোমেলো হয়ে যায় সবটা। আফরোজ জামান আইনি সবটা সামাল দিলেও রাগ মেটেনি আরমানের।শোয়াইবের মৃত্যর ব্যাপারটা ধামাচাপা পরে যায়,ওর নিখোজ চাচাকেও খুজে পেতে ব্যর্থ হয় পুলিশ।কোনোরকম পড়া চালিয়ে নিজেকে ইনকাম করার যোগ্য করে তোলে আরমান,লক্ষ্য শোয়াইবকে দেওয়া কথা রাখা,নিজের টাকায়।

আন্ডারগ্রাউন্ড গ্যাং এর পাশাপাশি আরমান তৈরি করে নিজের ওপেন গ্যাং।যার মাধ্যমে সামনাসামনিই লোকেদের অন্যায়ের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা করতো ও।শোয়াইবের মৃত্যুর ঠিক দু বছরের মধ্যে ওর হত্যকারীদেরও শাস্তির ব্যবস্থা করে আরমান।ওর মতো করে।কিন্তু বস্তির জমি দখলের ঘটনায় নিজেকে নির্দোষ প্রমান করতে পারে নি এখনো।
মাহবুব আলম আরমানকে শুধুমাত্র নামকরা গ্যাং এর মাথা হিসেবেই চিনতেন,ঘৃনা করতেন ওকে।কিন্তু মিথির সাথে জরিয়ে যাবার পর খোজ নিয়ে জানতে পারেন ওনার আট বছর আগের প্রোজেক্টে অভিযুক্ত ফান্ডের মেম্বার আরমান,ওর প্রতি তখন ঘৃনাটা আরো বেড়ে যায় ওনার।আট বছর পর মিথির খোজ নিতে গিয়ে আরমানও জানতে পারে ওর রিপোর্টের সবটা মাহবুব আলম হ্যান্ডেল করেছেন।মিথিকে আপন করতে তাই আগে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করা জরুরি সেটা বুঝে গিয়েছিলো ও।ছ মাস আগে কাগজগুলো চেয়ে পাঠালেই মাহবুব আলম দেন নি ওকে।চারমাস আগে,মিথির এক্সিডেন্টের আগে শেষ চেষ্টাও করেছিলো ও,তাতেও কাজ হয়নি।তাই বাধ্য হয়ে মিথির জীবন থেকে সরে যাওয়ার ছলনার আশ্রয় নিতে হয় ওকে।আজ চারমাস পর আবারো মাহবুব আলমের সামনাসামনি হবে ও।

ব্রেক করে গাড়ি থামিয়ে ফার্মহাউজের গেইটের ভেতরে ঢুকলো আরমান।আদিব এগিয়ে এসে বললো,

-হি ইজ হেয়ার।

মুচকি হাসলো আরমান,এগোলো বাড়িটার ভেতরে।মিথিকে নিয়ে সবটা জানলেও আট বছর আগের ঘটনায় মাহবুব আলমের সম্পৃক্ততা জানতো না আদিব।আরমানের পেছন পেছনে ওউ ভেতরে আসলো।
মাহবুব আলম আরমানের ম্যাসেজ পেয়েই চলে আসেন ওখানে।যে ভাবেই হোক,আরমান নামক এই কালো ছায়া তার মেয়ের উপর পরতে দিবেন না উনি।যে ছেলেটা বাইরের জগতে গুন্ডা নাম নিয়ে বাচে,টিনেজার বয়স থেকেই সন্ত্রাসদের হয়ে কাজ করে এসেছে,এমন একটা ছেলেকে কোনোদিনও মিথির পাশে মানতে পারবেন না উনি।ব্রিফকেসে কাগজগুলো শক্ত করে ধরে বসে আছেন।হাউজিং এর রিট ওনার হাত দিয়েই পাস হয়েছিলো।তাই এই রিলেটেড সব কাগজপত্র ওনার কাছেই ছিলো এতোদিন।এ কাগজগুলো কোনোভাবেই আরমানের কাজের নয় এমন দৃঢ় বিশ্বাস ওনার,কারন দোষটা আরমানই করেছে।উনি এমনটাই জানেন এবং মানেন।উনি এটাও জানেন আরমান চাইলে এখন উনি বাসায় নাও ফিরতে পারেন,কিন্তু মিথিকে কষ্ট দিবে না আরমান আর মিথির জীবন থেকে ওকে‌ সরানোর অন্যকোনো উপায় নেই তাই ওখানে এসেছেন উনি।

-আসলেন তবে?

মাহবুব আলম মুখ তুলে তাকালেন।আরমান সানগ্লাসটা চোখ থেকে খুলে কালো নীল চেকের শার্টটার হাতা ফোল্ড করতে করতে বললো,

-ইটস্ গ্রেট টু সি ইউ এগেইন মিস্টার আলম।

……

-হুউউউম!চারমাস!চারমাস মিস্টার আলম।এ চারমাসে চার চার বার আপনার মেয়ের সাথে আমার এনিভ্,,

-স্টপ দ্যাট টপিক।

হাতা ফোল্ড করতে থেমে গেলো আরমান।একটু হেসে আবারো হাতা উঠাতে উঠাতেই বললো,

-এটা কি শুধুই একটা টপিক মিস্টার আলম?

-না।শুধু একটা টপিক না,ওটা মিথির জীবনের দুঃস্বপ্ন ছিলো।

আরমান হাসলো।মাহবুব আলমের চেয়ারের উপর হাত রেখে বললো,

-শুধুমাত্র স্বপ্নদৃষ্টাই জানে সেটা দুঃস্বপ্ন ছিলো নাকি জীবনের সবথেকে সুন্দরতম স্বপ্ন ছিলো মিস্টার আলম।কিন্তু হায়,আপনি তো সেই স্বপ্নদৃষ্টাকে স্বপ্ন দেখার অধিকারটাই‌ দেননি।

মাহবুব আলম কিছু বলার মতো খুজে পেলেন না।ওনাকে চুপ থাকতে দেখে আরমান মুচকি হেসে ওনার হাতের ব্রিফকেসটা দেখিয়ে বললো ,

-কাগজগুলো এখানে?

-কি করবে তুমি এই কাগজ দিয়ে?

আরমান তখনো ঠোট টিপে হাসলো।

-কি হলো?বলো?

আরমান এবার একটু জোরে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো,

-কি আজব তাইনা?চারমাস আগে আমি কতোভাবে বলতে চেয়েছি আপনাকে,একপ্রকার মাথা ঠুকেছি বলার জন্য,আপনি শুনতে প্রস্তুত ছিলেন না।আজ নিজে থেকেই জিজ্ঞাসা করছেন!

-সোজাভাবে বলো আরমান।ওই লোকগুলো অনেক কষ্টে ওদের স্বর্বস্ব ফিরে পেয়েছে।তুমি কি কোনোভাবে আবার ওদের…

আরমান একহাতে একটা চেয়ার টেনে মাহবুব আলমের সামনে বসে বললো,

-এটা আপনাদের জীনগত রোগ তাইনা?একদম বংশগত সমস্যা যাকে বলে।না আপনার মেয়ে বুঝলো আমাকে,না আপনি!

মাহবুব আলম দাড়িয়ে গেলেন।বললেন,

-মিথিকে এসবে টানবে না।তোমার কথামতো এখানে এসেছি।ইউ শুড রিমেম্বার ইওর প্রমিজ।

-প্রমিজ?ওয়াজ ইট আ প্রমিজ?

একটু চিন্তার চেহারা করে বললো আরমান।রাগে কাপছেন মাহবুব আলম।আরমান হেসে চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে বললো,

-আই টোটালি রিমেম্বার হোয়াট আই সেড।আপনাকে দায়িত্ব নিয়ে মনে করাতে হবে না।মেয়েকে তো এখনো বাড়িতেই পাচ্ছেন।কোনো ঝামেলা করেছি কি?মেয়ে বলেছে আপনাকে?আপনার অন্যতম সিসি ক্যাম,মিথির আনলকড্ ডায়েরী,রিয়াপিকে জিজ্ঞাসা করতে পারেন।এখনো অবদি আমার বলা প্রতিটা কথামতোই সবটা চলছে।

মাহবুব আলম একটু শান্ত হলেন।কথাগুলো সত্য।আরমান বললো,

-সব কাগজ এনেছেন?

-প্রেজেন্ট ওনারশিপ বাদে সবটা।

-ওটা কেনো আনেন নি?

-ছিলো না।

-নাকি আপনি অন্য কারো হস্তগত করেছেন?

মাহবুব আলম চমকে উঠলেন।কাগজগুলো তিনি সিয়ামকে দিয়েছেন।সিয়াম বলেছিলো ওগুলো ওর কাছেই বেশি নিরাপদ।আরমান এ কথা কি করে জানে?

-রিল্যাক্স মিস্টার আলম।থাক লাগবে না ওটা।আই উইল ম্যানেজ।এনিওয়েজ,এগুলো আপনার সামনেই চেক করবো।ততক্ষন কফি খাবেন?

মাহবুব আলম চোখ রাঙিয়ে তাকালেন।আরমান বললো,

-আরে আরে!ওভাবে তাকাইয়েন না।আপনাকে তো সুগার ছাড়া কফি দিতে হবে।নইলে মিথি আবার আপনার সুগার আপ দেখে ব্যস্ত হয়ে পরবে।বসুন আপনি।

পা দিয়ে চেয়ারটা ঠেলে দিলো আরমান।।এমনভাবে দিলো যেনো একদম ওনার সামনেই থামে।মাহবুব আলম মুখ ঘুরিয়ে নিলেন।আরমান কাগজগুলো দেখতে লাগলো। মাহবুব আলম দাড়িয়ে আছেন ওভাবেই। একটু পর আরমান এগিয়ে গেলো ওনার কাছে।হাত দিয়ে চেয়ারটা ঘুরিয়ে দিয়ে নম্রভাবে বললো,

-সরি মিস্টার আলম।প্লিজ সিট।

আরমানের মুখে সরি আর প্লিজ শুনে চরমমাত্রায় অবাক হলো মাহবুব আলম।কিছু না বলে চুপচাপ বসলেন ওখানে।আরমান আবারো কাগজগুলো দেখতে লাগলো।
আদিব এখনো বড়সড় কোনো শকে আছে।মাহবুব আলম আরমানের ব্যাপারে এসব জানেন?আট বছর আগের কাজের জন্য ওকে দোষারোপ করে যাচ্ছেন?সবটা না জেনে ওকে সবার মতোই দোষী ভেবে বসে আছেন?ছেলেটাকে নিজেকে নির্দোষ প্রমান করার একটা সুযোগও দেননি?উল্টো সাধারনভাবে বাচার জন্য যখন ও মিথিকে আকড়ে ধরতে চায় উনি মিথিকেও সরিয়ে দিচ্ছেন?

ছেলেটা কি করে এতোসব সহ্য করে বেচে আছে?কিসের দায় ওর এতো?ও তো চাইলেই সবার ধারনার মতো মাহবুব আলমের ধারনাকেও অগ্রাহ্য করতে পারে।মিথিকে নিয়ে আসতে পারে নিজের কাছে।তারপরও নিজেকে ওর থেকে এভাবে দুরে রেখে,কষ্ট পেয়েও সবটা মুখ বুজে মেনে নিচ্ছে।শুধুমাত্র মিথিকে ভালোবাসে বলে!ওর চোখে নিজের জন্য ঘৃনা দেখতে পারবে না বলে!ওকে খুশি রাখবে বলে।এভাবেও ভালোবাসা যায়?এজন্যই হয়তো আরমানের অস্তিত্বই মিথি,এজন্যই হয়তো আরমানের বলা ভালোবাসার সঙ্গায় মিথিকে নিয়ে বলা,’তোমাতেই অস্তিত্ব আমার’ .

#চলবে…

®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here