তোমাতেই অস্তিত্ব আমার পর্ব-১৮

0
1387

#তোমাতেই_অস্তিত্ব_আমার
লেখনীতে:মিথিলা মাশরেকা

১৮.

-ফ্রন্ট সিটে বসো না তুমি সুহানা।পেছনে বসো,নয়তো অন্য গাড়িতে আসতে পারো।

আরমানের কড়া গলা শুনে গাড়ির দরজা খুলেই আটকে গেলো সুহানা।ভেতরে ওঠার সুযোগটুকো দিলো না ওকে।বললো,

-বাট আরমান…

-আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু হেয়ার এনিথিং রাইট নাও।

সুহানা চুপচাপ পিছনের সিটে উঠে বসলো।আরমানের কাছে কোনোদিনই নিজেকে স্পেশাল মনে হয়নি সুহানার।কখনোই আরমান ওর প্রতি এতুটুকু দুর্বল ছিলো না।যেটুকো আছে তা নিতান্তই শোয়াইবের জন্য।কিন্তু মিথিকে তো দুর্বল করতেই পারে ও।আজকের মতো মিথির সামনে আরমানকে নিয়ে যেটুকো দেখানোর তা শেষ।এভাবে একটু একটু করে মিথিকে বুঝিয়ে দেবে ও যে আরমানকে ও কতটা ভালোবাসে,আর ঠিক আগেরবারের মতোই মিথি নিজে থেকেই সরে যাবে আরমানের জীবন থেকে।

আরমান কোনোদিকে না তাকিয়েই গাড়িটা স্টার্ট দিলো।সুহানা গাড়িতে ওঠার আগেই আরিশা মিথিকে উল্টোদিক ঘুরিয়ে নেয়।তা দেখেই সুহানাকে আটকে দেয় আরমান।আরমানের পাশে বসার অধিকারটা শুধু মিথিরই আছে।অন্যকারো নয়।শুধুমাত্র মিথির জন্য এতোক্ষন সুহানাকে সহ্য করেছে ও।সুহানা বিষয়টা বুঝেছে যে আরমান মিথির সামনে সিনক্রিয়েট চায়নি বলে ওকে কিছু বলেনি।কিন্তু এভাবে কতোদিন?আরমানের এরকম ব্যবহারে তো মিথিকে বোঝানো কষ্টকর হবে যে ও আমার আর আরমানের মাঝে থার্ড পারসোন।নাহ্!আগে আরমানের ব্যবহারেই চেন্জ আনতে হবে।কিন্তু কিভাবে?কিছুক্ষন ভেবে বাকা হেসে সুহানা বললো,

-আরমান।

-হুম বলো।

-তোমার ভাইয়ার কথা মনে পরে না?

আরমান সাথে সাথে ব্রেক করে গাড়ি থামালো।মাথাটা নিচু করে রেখেই বললো,

-হঠাৎ এ কথা বলছো যে?

-বলো না!

-তুমি জানো শোয়াইব ভাইয়া আমার জন্য কি ছিলো।

সুহানা ওর মুখের দিকে তাকিয়েই শান্তি পেলো।যে মানুষটা সবার সামনে এতোটা কঠোর,এ একটা কথাতেই কিভাবে নেতিয়ে গেছে।একটু হেসে বললো,

-ভাইয়া বলেছিলো তোমাকে আমাদের দেখে রাখতে রাইট?

আরমান ওভাবেই মাথা নিচু রেখে বললো,

-হুম।

-একটা জিনিস চাইবো।দিবে?

-চাওয়ার আগেই তো দেওয়ার চেষ্টা করেছি আমি সুহানা।

-এবার না হয় আমি চেয়ে নেই।

আরমান স্টেয়ারিংটা শক্ত করে ধরে কিছুক্ষন চুপ থেকে বললো,

-মিথিকে ছাড়া,তোমাকে চুজ করা এর বাইরে কিছু থাকলে বলো।

সুহানা নিজের ‌মাথার চুলগুলো উল্টে দিয়ে বললো,

-মিথির সামনে আমার সাথে মিসবিহেভ করবা না তুমি।এটলিস্ট আমার কথায় বা কাজে তো একদমই না।ওকে কোনোভাবে বুঝতে দিবা না যে তুমি আমাকে ভালোবাসো না।

আরমান ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সুহানার দিকে।সুহানা একটা ইনোসেন্ট হাসি দিয়ে বললো,

-ডোন্ট ওয়ারি,এটা তো বলতে বলি না যে তুমি আমাকে ভালোবাসো!জাস্ট ওর সামনে আমার সাথে কড়া কথা বলবা না দ্যাটস্ ইট।আমি শুধু চাইনা অন্ত্ত ওর সামনে তুমি আমাকে অপমান করো।তাই এমনটা বলেছি।

আরমান চোয়াল শক্ত করে গাড়িটা স্টার্ট দিলো।ওর হ্যাঁ বলাটা প্রয়োজন মনে করলো না সুহানা নিজেও।যেহেতু রাগ উঠেছে ওর,তার মানে ওর কথা মেনে নিয়েছে ও।মেনে নিতে তো হতোই।একপ্রকার বাধ্য ও।শোয়াইবের কাছে যে ও কথা দিয়েছে।
অফিসে পৌছেই কেবিনে ঢুকে দরজা লক করে দিলো আরমান।আদিবকে কল করে বললো সুহানাকে সবটা এসে সবটা বুঝিয়ে দিতে।যদিও সুহানার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই অফিসিয়াল কোনো কাজেই,তবুও আরমানকে কিছুটা দমাতে পেরে খুশি মনেই আদিবের সাথে সমস্তটা দেখতে লাগলো।

কেবিনের কাচের দেয়ালে হাত রেখে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে আরমান। সুহানার এমন কিছু চাওয়ারই অপেক্ষা করছিলো ও।ও জানতো,যখন ও আরমানকে বুঝাতে ব্যর্থ হবে,মিথিকেই দুর্বল করে দিয়ে ওর জীবন থেকে সরানোর চেষ্টা করবে।বাকা হাসলো আরমান।এমনটাই তো চাইছিলো ও।ঠিক সবটা আগের মতো করে মিথির সামনে আনতে।আগেরবারও তো সুহানা এদেশে এসেই মিথিকে অনেকভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছে যে ও ওকে কতটা ভালোবাসে।মিথিও তো তাই নিজের অনুভুতিগুলোকে অস্বীকার করেছিলো।

‘ কিন্তু এবার তো তা হবে না সুহানা।মেয়েরা সবকিছু সহ্য করতে পারে,কিন্তু আপন মানুষটার পাশে অন্য কাউকে সহ্য করতে পারে না।সে মিথির কিছু মনে থাকুক বা নাই থাকুক।আমার পাশে ও তোমাকে কেনো,কাউকেই মানতে পারবে না।আর আমি যখন ওকে একবার বলেছি তোমাকে ভালোবাসি না,তখন তো আরো না।এবার তুমি সম্পুর্ন অন্য মিথিকে চিনবে সুহানা।যে ভালোবাসাকে স্বীকার না করলেও বিলিয়ে দেবে না।নিজে দুরে থাকলেও আমার কাছে কাউকে ঘেষতে দেবে না।হাহ!তুমি না বললেও আমি এসবের জন্য কিছু বলতাম না তোমাকে সুহানা।আফটার অল,সবটা আমার ইচ্ছামতোই তো হতে হবে নাকি! ‘
কিছু একটা ভেবে আরমান ফোন লাগালো মাহবুব আলমের ফোনে।

-আসসালামু আলাইকুম।

-হঠাৎ?

-কোনটা?ফোন করা নাকি সালাম?

-দুটোই।

-আগে উত্তরটা তো নিন।

-চেচিয়ে বলা প্রয়োজন বোধ করছি না।

আরমান ডেস্কের কাছে এসে পেপারওয়েটটা হাতে নিলো।ওনার সাথে কথা বলার সময় যতোদুর সম্ভব শান্ত থাকতে চায় ও।এই লোকটা সোজা কথার মানুষ না।মিথি একদম ওনার ডিএনএরই ত্যাড়ামো পেয়েছে তা ও নিশ্চিত।বললো,

-কাগজগুলো নিতে চাচ্ছি।

মাহবুব আলম অফিস না গিয়ে ব্রেকফাস্ট শেষে ড্রয়িংয়ে বসে সেগুলোই ঘাটছিলেন।আরমানের কথায় একপলক ভয়ার্তভাবে তাকালেন উনি কাগজগুলোর দিকে।বললেন,

-কেনো এসব করছো আরমান?

-সবার ভালোর জন্য।

-ওটা ধ্বংস।

-সেটা যে যে চোখে দেখে তার কাছে তেমন।আপনার চোখে ধ্বংস,অন্য কারো চোখে তা হয়তো নতুন শুরু।

মাহবুব আলম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,

-কোথায় গিয়ে দেবো?

-বাসায় আসি?

কথাটা শুনে ক্ষেপে গেলেন মাহবুব আলম।কঠোর গলায় বললেন,

-ডোন্ট ইউ ডেয়ার!

-আরে আরে,আস্তে।একটু আস্তে বলুন না।নইলে আপনার মেয়েদের আপনার গলার আওয়াজ শুনে আদর্শ বাবার ডেফিনেশনে ভ্যারিয়েশন চলে আসবে কিন্তু!

মাহবুব আলম দমে গেলেন।আরমান বললো,

-ওহ্!আপনার বড় মেয়ে তো এখন মেবি ভার্সিটিতে।ছোটটা কোচিংয়ে।শুনতে পাবে না ওরা।ওকে যান,আসবো না ও বাসায়।এতোটা এক্সাইটেড হয়ে যান কেনো বলুনতো আপনি?

….

-ভালোকথা!আপনি সিসিক্যামগুলো খুলে ফেললেন কেনো বলুন তো?অনেক খবরই পাই না ও বাসার।অবশ্য সময়ও নেই আমার অতো।

মাহবুব আলম দাতে দাত চেপে বললেন,

-কি চাও কি তুমি?

-উফ্!কাজের কথা ছাড়া কিছুই বোঝেন না আপনি।আচ্ছা,শুনুন।কাগজগুলো কোথায় কিভাবে পাঠাবেন টেক্সট করে দিবো আপনাকে।চিন্তা করতে হবে না অতো।

-বেশ।

-ফর হোয়াট?চিন্তা না করার বিষয়ে?আরে আপনি স্ট্রেস ফ্রি থাকবেন একদম।আমি আর কোওওনো ঝামেলা করবো না।

কলটা কেটে গেলো।কিছুটা জোরেই হাসলো আরমান।যদিও ওর কথাই‌ মাহবুব আলমের চিন্তার কারন,তবুও হয়তো ওরই কিছু কিছু কথা কাজের জন্যই উনি কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে পারেন।এমনটা জানে আরমান।আদিবের সাথে বাকি কাজগুলোর শিডিউল সেরে সুহানাকে না নিয়েই বেরিয়ে পরলো ও।

সেকেন্ড পিরিয়ডের ক্লাস চলছে।কোনো এক মহাজ্ঞানী ঠিকই বলেছিলেন ‘ পড়াশোনার প্রত্যেকটা স্টেজে,প্রত্যেকেই নাকের ডগায় চশমাধারী টিচারের সান্নিধ্য লাভ করে ‘
এর ব্যতিক্রম হয়নি আমাদের বেলাতেও।ডিপার্টমেন্টের সবচেয়ে বয়ঃজৈষ্ঠ্য আর বদমেজাজী প্রফেসর মারুফ স্যারের ক্লাস!বইয়ের দু লাইন উচ্চস্বরে পড়েই নাকের উপরের চশমাটা ঠেলা দিয়ে বোর্ডে ইয়া বড় বড় ইকুয়েশনস্ লিখতে শুরু করে দিয়েছেন।আরু ফিসফিসিয়ে বললো,

-এগুলোর তো এবিসিডি ও পড়ে আসি নি আমি আজ!

কিছু বললাম না।কেমন যেনো চিন্তায় পরে রয়েছি আমি।কিছুতেই কনসেন্ট্রেট করতে পারছি না।একেতো মারুফ স্যারের ক্লাসে অন্যমনষ্ক থাকার শাস্তির ভয়,আরেকদিকে অফিসে গিয়ে ওই সুহানা আরো কতোভাবে আরুর ভাইয়ের গায়ে জাপটে পরছে তার দৃশ্য চোখে ভেসে উঠছে আমার।আগের ক্লাসটাও ঠিকমতো করিনি।

-কিরে?কিছু বল?

….

-অ!তারমানে তুই এটাও অ্যাডভান্সড্ পরে নিয়েছিস?

…..

আরু এবার বেশ জোরে একটা ধাক্কা মেরে বললো,

-ওই!কিছু বলবি তো?কোথায় তুই?

-তোর ভাইয়া ওই গায়ে পরা বিলেতি মেয়েটাকে কিছু বলে না কেনো রে?

-কি বললি তুই?

-মানে ওই সুহানাকে এতো…

আরুর দিকে তাকিয়েই চুপসে গেলাম।আনমনে এটা কি বলে ফেললাম আমি?ইয়া আল্লাহ্,ম্যানেজ করার তৌফিক দাও।আর জীবনেও কোনোদিন মারুফ স্যারের ক্লাসে অন্য কোনোকিছু ভাববো না,এটা ওনার ক্লাসে অন্যচিন্তা করারই ফল।আগেই বলেছেন উনি, ‘ ক্লাসে অন্যচিন্তা করবা,তো সেই চিন্তা তোমার উপর ভারী পরবে।হোক সেটা আমার পক্ষ থেকে বা অন্য কোথাও। ‘ আজ মেবি আরুই রয়েছে আমার শনি হিসেবে।

-সুহানা আপুকে কি?

আমি মেকি হাসি দিয়ে বললাম,

-ক্ কিছু না রে আরু।

-তাই?

-হুম।

আরু আর কিছু বললো না।মুচকি হেসে নোটস্ উঠাতে লাগলো।আমি ওর এতো স্বাভাবিক রিয়্যাক্ট একদম আশা করি নি।তবে ব্যাপারটা তো আমার জন্যই ভালো।তাই আমিও চুপচাপ রইলাম।ক্লাস শেষে বাইরে বেরিয়ে এসে দাড়ালাম।মালু আসেনি আজ।উর্বি,রায়হানের সাথে বসেছিলাম,তবে তেমন কোনো কথাই বলিনি।থার্ড ক্লাস শুরু হবে।আরু বললো,

-চল।ক্লাসে?

-তুই যা।যাবো না আমি।আগের ক্লাসেই দম আটকে আসছিলো আমার!

-কেনো?

-কিছু না।তুই ক্লাসে যা,নয়তো কেউই নোটস্ পাবো না।আমি একটু আসছি।

-কোথায় যাবি তুই?

-ক্যাম্পাসের উত্তরে। কৃষ্ণচূড়াতলায়।

-ওখানে কেনো?ওখানে তো লোকজন কম!

-এজন্যই তো যাবো,একটু প্রকৃতির মাঝে থাকবো।একাকী।

-ওকে তুই যা।আমি ক্লাস শেষে আসছি।

-হুম।

ওরা চলে গেলো।আমি টুকটুক করে এসে কৃষ্ণচূড়ার তলায় বসে আছি।দু পা গুটিয়ে,গাছের সাথে হেলান দিয়ে।গাছের দু হাত দুরেই পুকুর।বাধানো পাড়।ভর্তি পানি একদম।উপর থেকে বসেই হাত বাড়ালে ছোয়া যায়।এদিকে আসলেই লোকজন কম।গাছটার নিচে তো কেউই নেই।এতসুন্দর জায়গাটা এভাবে কিভাবে সবার চোখ এড়ায় সেটা বেশ ভাবনার বিষয়।তবে আপাতত আমি কিছু ভাববো না।অতোটা কোলাহল নেই।ভালোলাগছে।

খাতার একটা পাতা ছিড়ে নৌকা বানালাম,ভাসিয়ে দিলাম সে পানিতে।
কিছুক্ষন একটু চোখটা বন্ধ করে আছি।দু একটা পাখির আলাদা আলাদা ডাক,দুরে চানাচুর বিক্রেতার হাক,পাশে ক্যাম্পাসের একদল তরুনের আড্ডার মাঝে গিটারের শব্দ,মেয়েদের গ্রুপের কলকল হাসির রব কানে ভেসে আসছে।হঠাৎ পানিতে কিছু পরার আওয়াজ!চোখটা খুলে সরাসরি পানির দিকে তাকালাম আমি।আমার কাগজের নৌকা এখনো অবদি ঠিক আছে।তবে নৌকাটার মধ্যে লাল লাল পাপড়ি দেখা যাচ্ছে।আমি এগিয়ে গেলাম।নৌকাটা একটু দুরে বলে ধরতে পারলাম না।ভালো করে দেখে বুঝলাম নৌকাটার উপরে কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ছড়িয়ে আছে।এতো তাড়াতাড়ি এতোগুলো পাপড়ি পরলো ওটাতে?নাকি কেউ ছড়িয়েছে?কে ছড়ালো?দাড়িয়ে গিয়ে চারপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে পেলাম না অমন।আবারো এসে গাছের সাথেই হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসলাম।

-টায়ার্ড লাগছে?

আচমকা গলাটা শুনে অবাক হয়ে গেলাম।এই স্বর!এটাতো,,তাড়াতাড়ি চোখটা মেলে আবারো আশেপাশে তাকালাম।কেউ নেই।‌মনের ভুল ভেবে আবার কাগজের নৌকার দিকে তাকালাম।

-গাছের এপাশেও তো দেখবে নাকি?বুদ্ধু একটা!

চমকে উঠলাম আবারো ওই স্বর শুনে।আমি তাড়াতাড়ি হেলান দিয়ে গাছের পিছনটার দিকে তাকালাম।আরমান আকাশের দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে হাসছেন।নিজের হাতে চিমটি কেটে,চুল টেনে পরখ করলাম কোনোভাবে স্বপ্ন দেখছি কি না?কিন্তু নাহ্!ব্যথায় মুখ দিয়ে ‘ আহ্ ‘ শব্দটা বেরই হলো।তারমানে উনি সত্যিই এখানে?চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছি।উনি?এখানে?এসময়?কেনো?ওনাকে ছাড়লো ওই ছেচড়া মেয়েটা?ওই বা কই?
আরমান পাশ ফিরে কিছুটা কাত হয়ে গাছের সাথে মাথা ঠেকিয়ে বললেন,

-তুমি যখন,যেখানে,আমিও তখন,সেখানে!সুহানা অফিসেই।

আমার চোখ আরো বড়বড় হয়ে গেছে।এই লোক সত্যিই মাইন্ড রিড জানে।আরমান একটু হেসে আমার চোখে জোরে একটা ফু দিলো।চোখ খিচে বন্ধ করে নিলাম আমি।পিটপিট করে কিছুক্ষন পর চোখ মেলে তাকিয়ে দেখি উনি কেমন ঘোরের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।ওই চাওনিতে যে আমিও হারিয়ে যাই।নাহ্!এমনটা হতে দেওয়া যাবে না।আমি নিজেকে সামলে তাড়াতাড়ি উঠে দাড়ালাম।আরমানও উঠে দাড়িয়ে শার্টটা ঝেরে বললেন,

-বললে না তো তুমি টায়ার্ড কি না!

……

-নাকি টেন্সড্?

…….

-উমমম্!নাকি ইন্সিকিওর ফিল করছো?

অবাক হয়ে তাকালাম ওনার দিকে।কি করে পারেন উনি?একটা কথাও ভুল না ওনার।অনিচ্ছা সত্ত্বেও এসব কিছুই ঘিরে ধরেছে আমাকে।কিন্তু না,এসব প্রকাশ করা যাবে না।অন্যদিক তাকিয়ে বললাম,

-তা জেনে আপনার কি?

-না মানে রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থা করতাম আরকি!

-আপনাকে এতো ভাবতে হবে না।আরু ক্লাসে আছে,আমি যাইনি,একা থাকতে চাচ্ছিলাম।আপনি আসতে পারেন।

-তো তুমি বলে দেবে যে আমি কোথায় যাবো?

এ লোককে কিছু বলাই যায় না।গাল ফুলিয়ে আমিই চলে আসছিলাম।তখনই,

-হোয়াট আ ভিউ!কৃষ্ণচূড়ার ফুল,স্তব্ধ বাধানো পুকুর পাড়,পুকুরের স্বচ্ছ পানি!সুহানা দেখলে তো খুশিতে পাগলই হয়ে যেতো।

আমি চলে যেতে গিয়েও থেমে গেলাম।আবার সুহানা?উনি কি বোঝেন না ওই মেয়ে উনাকে কি চোখে দেখেন?আরমান নিজের ফোনটা বের করলেন।এখন কি ওই মেয়েটাকেও এখানে ডেকে আনবেন নাকি?যাবো না এখান থেকে আমি।ডাকুক না ওই সুহানা কে।কি ভিউ এন্জয় করে দুজনে মিলে তাও দেখবো আমি।পা চালিয়ে আবারো পুকুরের সামনে বুকে হাত গুজে দাড়ালাম।উনি ভ্রুকুচকে বললেন,

-কি হলো?চলে যাচ্ছিলে আবার এলে যে?

-আমার ইচ্ছা।

উনি গম্ভীরভাবে বললেন,

-ভার্সিটিতে একা একা এভাবে দাড়িয়ে থাকার ইচ্ছা পালনের অনুমতি কে দিয়েছে তোমাকে?

আমি তাকালাম তার দিকে।মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না মজা করছে।

-কি হলো?বলো?

-আমার ইচ্ছা,আমি নিজেই নিজেকে অনুমতি দিয়েছি।

-তুমি আছো নিজের মধ্যে?

-মানে?

উনি শান্ত গলায় বললেন,

-তুমিতো তোমাতে নেই মিথি।

-রিয়েলি?তা আপনি কি করে জানলেন তা?

-ম্যাজিক।যাকগে। এটা বলো,আরুর সাথে থাকতে ভালোলাগে না তোমার?

-তা কখন বললাম?ক্লাস ভালো লাগছিলো না তাই এসেছি।

-তো আরুকে নিয়েই আসতে।

-একজন ক্লাস না করলে নোটস্ পাবো কিভাবে?ওয়েট আ মিনিট!আমি আপনাকে এসবের কৈফিয়ত কেনো দিচ্ছি বলুনতো?

আরমান দু পা এগোলেন।আমি তিন পা পিছিয়ে গাছের সাথে লেগে গেলাম।কি এমন বললাম আমি?কি চান উনি?এভাবে বারবার কাছে চলে আসেন কেনো উনি আমার?মাথা নামিয়ে এসবই ভাবছি।সামনের একজোড়া তীক্ষ্ম চোখের ইয়া লম্বা মানুষটা বুকে হাত গুছে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।আবারো গুলিয়ে যাচ্ছি আমি সকালের মতো।গরমে ঘামছি,তবে জমে যাওয়ার মতো দাড়িয়ে আছি।একচুলও সরতে পারছি না।আরমান আরেকটু এগিয়ে এসে আমার বা কাধের পাশ দিয়ে একহাত গাছে লাগিয়ে দাড়ালেন।মাঝের দুরুত্বটা আছে এখনো।তবুও শ্বাস এবার থেমেই গেছে আমার। উপরে না তাকিয়ে যেইনা অন্যদিক দিয়ে সরে আসবো,উনি আবারো অন্যহাত গাছে লাগিয়ে আটকে দিলেন আমাকে।তার দুবাহুতে আটকে গেছি আমি।

পুরো শরীর ঘেমে একাকার।এবার আর মাঝের দুরুত্বটাও নেই।ঘামা হাতে ওড়নাটা মুঠো করে ধরলাম।যে হাতে আমার ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেওয়ার কথা ওনাকে,সে হাত আপনাআপনি কোথাও আবদ্ধ হয়ে গেলো।অন্যকোনোদিন,অন্যকেউ হলে আমি এতোক্ষনে হয়তো তাকে মারপিট শুরু করে দিতাম।কিন্তু আজ!!!আজ যেনো আরো নুইয়ে গেলাম আমি।না আছে নড়ার শক্তি,না আছে মুখ দিয়ে এতোটুকো শব্দ বের করার ক্ষমতা,নাই বা আছে চোখ তুলে তাকানোর সাহস।কেনো হচ্ছে এমনটা?কেনো?

#চলবে…

®

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here