তোকে ঘিরে ❤পর্ব_৬৪

0
1502

#তোক_ঘিরে ❤
#পর্ব_৬৪.
#ফাবিয়াহ্_মমো

( অংশ – ০২.)

প্রচণ্ড ব্যথায় সারা মুখ লাল হয়ে উঠেছে পূর্ণতার। সিটের পিছনে মাথা হেলিয়ে চোখমুখ খিচে রয়েছে সে। পেটের যন্ত্রণা প্রসববেদনা হলেও দ্বিতীয় ব্যথাটিও তীব্রভাবে যুক্ত হয়েছে। দ্বিতীয় ব্যথাটার জন্য মনেহচ্ছে নাড়িভুঁড়ি ছিড়ে যাচ্ছে। এদিকে ব্যস্ত সড়কের তুমুল ট্রাফিক জ্যামে গাড়ি যেনো এগুতে পারছেনা। আয়েশা প্রায় হন্য হয়ে গিয়েছেন এমন বিকট পরিস্থিতি দেখে।মাথা চাপড়ানো বন্ধ করে শেষমেশ হাল ছেড়ে দিয়েছেন তিনি। ড্রাইভার সৈকত আহত মুখে কিছুই করতে পারছেনা। যানজটের বৈরী অবস্থা দেখে অশ্রাব্য ভাষায় কিছুক্ষণ গালিগালাজ করলো ঠিকই, কিন্তু উপায় হিসেবে কিছুই সে করতে পারলোনা। পূর্ণতা নিজেকে অটল রাখার জন্য প্রচুর চেষ্টা করছে।একসাথে দুটো ব্যথার যন্ত্রণায় ঠোঁট ভেদ করে চাপা আর্তনাদ বেরিয়ে আসছে। হঠাৎ চোখ খুলে গাড়ির সিলিংয়ের দিকে সে তাকালো। মাথাটা তখনো সিটের পেছনে হেলানো। ডানপাশ থেকে ডানহাতটা আয়েশা ধরে রয়েছে। পূর্ণতার দুই চক্ষুকোলের কোণা থেকে টপটপ করে পানি পরছে। সে মাথাটা ধীরগতিতে ডানে ফিরিয়ে আয়েশার বিহ্বল মুখের দিকে তাকালো। আয়েশার চোখ তখন ছলছল হয়ে দৃষ্টি নত ছিলো। পূর্ণতা গলাটা ভিজিয়ে ব্যথাতুর কন্ঠে খুব আস্তে করে বললো,

– মা, হাসপাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে যদি আমার দম চলে যায় তবুও শেষ চেষ্টা হিসেবে ওকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন।

বিদ্যুৎপৃষ্টের মতো চমকে গেলেন আয়েশা। বিস্ফোরিত দৃষ্টিতে পূর্ণতার হাতটা নির্লিপ্তে কখন ছেড়ে দিলেন খেয়ালও হলোনা। শুধু দরদর করে চোখ থেকে পানি পরতে লাগলো উনার। পূর্ণতা তখনও ব্যথায় নিচের ঠোঁট কামড়ে আয়েশার দিকে শান্তদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলো। চোখের ভেতর নোনাজল ভর্তি হয়ে ঝাপসা হতে লাগলো ওর। আয়েশা কিছু কড়াকথা বলার জন্য মুখ খুললেন ঠিকই, কিন্তু গলার কাছে শব্দগুলো জট পাকিয়ে আটকে গেলো। তিনি নিজেকে সামলে নিয়ে ধাতস্থ সুরে বললেন,

– তোমার তো কিছু হবেনা পূর্ণতা। কেনো এসব আবোলতাবোল বলছো? এভাবে বলেনা মা। এগুলো বলতে নেই। চুপ করো, তুমি চুপ করে থাকো। আল্লাহ্ ব্যবস্থা করবেন তো!! এমন কথা বলে কেনো আমাকে কষ্ট দিচ্ছো?

পূর্ণতা নির্বিকার দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই সহসা ব্যথার তীব্রতায় চোখ খিচ মেরে বন্ধ করলো। অসহায় ভঙ্গিতে নিঃস্ব পথিকের মতো আয়েশা পূর্ণতার হাতটা আবার কাছে টেনে নিলেন। শাড়ির ব্লাউজে চোখ মুছে জানালার বাইরে একটু তাকাতেই তিনি প্রচণ্ড চমকে উঠে দুই ভ্রুর মাঝে অনেকগুলো ভাঁজ ফেললেন। তিনি বুঝতে পারলেন না কি হচ্ছে এখন! সবকিছু এলোমেলো লাগছিলো যেনো! থেমে থাকা গাড়িগুলো হঠাৎ এক-এক করে স্থির অবস্থা ছেড়ে দিয়েছে। অজানা এক অস্থিরতায় উতলা হয়ে আয়েশা চারপাশের চলন্ত গাড়ির দিকে তাকিয়ে দিশেহারা হয়ে গেলেন। এদিকে নিজেদের গাড়িটাও শান বাজিয়ে ছুটার জন্য ইন্ঞ্চিন চালু হয়ে গেছে। আয়েশার বারবার মনে হচ্ছিলো এই বিশাল জ্যামটা কেউ নিজের হাতে ছুটিয়েছে। কেউ তো এগিয়ে এসেছে এমন জায়গায়। মনের ভেতর তীব্র অস্থিরতায় ফেটে পরলেও কারনটা জানার আর উপায় ছিলো না। ড্রাইভার সর্বোচ্চটা দিয়ে গাড়ি খুব কায়দা করে চালাতে লাগলো। কিন্তু আয়েশার ব্যকুল মন জানালার বাইরে সেই কারণ উদ্ঘাটনের জন্য যখন চোখ রাখলো, তখন তিনি দেখলেন ট্রাফিক পুলিশের স্ট্যান্ডপোস্টের ওদিকে গোল করে ভিড়। কিন্তু সেখানে কি হচ্ছে দ্রুত গাড়ি টানার জন্য সেটা দেখা যায়নি।
রাস্তার জ্যামটা কেটে গেলে গাড়িটা তাড়াতাড়ি হাসপাতালে চলে আসে। একটু আগের ঘটনা নিয়ে আয়েশা প্রচণ্ড উদ্বেগপূর্ণে জর্জরিত হয়ে তালগোল হারিয়ে ফেলছেন। তিনি গাড়ি থেকে বেরুতেই হাতের ফোনটা সেখানে ফেলে এলেন। পূর্ণতাকে গাড়ি থেকে বের করে একটা নার্স দ্রুত ডেক ওকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। নার্সটা চেয়ার ঠেলে জলদি পায়ে পূর্ণতাকে ভেতরে নিয়ে যেতে লাগলো। গাড়ি থেকে হাসপাতালের রিসেপশন পযর্ন্ত আসতেই আয়েশার হাঁটুতে মারাত্মক টনটন করে উঠলো। ব্যথা সহ্য করতে না পেরে আয়েশা তৎক্ষণাৎ হাঁটু ধরে নিচে ঝুঁকলো। হাঁটুর গিটে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব হচ্ছে আবার। বিদ্যুতের মতো ঝিমঝিম করে উঠছে। তিনি কয়েক মিনিট নিরব থেকে আবার শক্তি সন্ঞ্চার করে সোজা হয়ে দাড়ালেন। চোখ বন্ধ করে জোরে নিশ্বাস ছাড়তেই উনার খেয়াল হলো গাল গড়িয়ে কিছু একটা পরছে। তিনি গালের উপর আঙ্গুল বুলাতেই বুঝতে পারলেন সেগুলো নোনাপানির ফোঁটা ছিলো, যা চোখ থেকে টুপটাপ বৃষ্টির মতো অজান্তেই গড়িয়ে পরছে। ভারাক্রান্ত দেহটা খুব দূর্বল লাগছে। তবুও তিনি শক্ত হয়ে দাঁতে দাঁত আটকে রিসেপশনে গিয়ে ফর্মালিটিস পূরণ করতেই সেখানকার টেলিফোন থেকে খোদেজাকে খবর পাঠান। খোদেজা সবকিছু ফেলে দ্রুতপায়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এসে প্রথমে পূর্ণতাকে অপারেশন থিয়েটারে পাঠায়, এরপর আয়েশাকে লিফটে করে ওটির সামনে এনে সিটে বসায়। তিনি আয়েশাকে শান্ত হতে বলে একজন পরিচিত নার্সকে বললেন আয়েশার দিকে খেয়াল রাখতে। আয়েশা নিজের শূন্য হাতের দিকে লক্ষ করতেই হঠাৎ মনে পরে উনি ফোনটা গাড়িতে ফেলে এসেছেন। এই মূহুর্তে আয়মান ও সাবিহাকে ফোন দেওয়া দরকার। আয়েশা চটজলদি নার্সের কাছ থেকে ফোন চেয়ে আয়মানকে কল করে সব জানিয়ে দিলেন। একটু স্বস্তির নিশ্বাস অনেকক্ষন পর ছাড়তেই আবারও সেই চাপা অস্থিরতা শুরু হলো। বারবার মনে হচ্ছিলো সেই স্ট্যান্ডপোস্টের ভিড়টা অর্নথক ছিলো না। কেউ বিপদ থেকে উদ্ধারের জন্যে জ্যাম সরাতে ঝাঁপিয়ে পরেছিলো। কিন্তু কে ছিলো সেই ব্যক্তি এসব নিয়ে চিন্তামগ্ন হতেই খোদেজা কেবিন থেকে ওটির পোশাকে পরে মুখে মাস্ক লাগিয়ে বের হলেন। হাতে হলদে গ্লাভস টেনেটুনে পরতেই আয়েশাকে অস্থির কন্ঠে বললো,

– আমি ভেতরে যাই বেয়াইন। দোয়া করবেন। আল্লাহ্ যেনো সব বালা-মসিবত দূর করে দেন। পূর্ব যে আসলো না এখন কি হবে বলুন? বারবার নাকি আওড়াচ্ছে ও মরে যাবে, আমার সামনে এ কথা বললে আমি কিভাবে থাকবো বেয়াইন? ওর কিছু হলে…

খোদেজার গলা ও কন্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে এলো।ছিটকে আসা কান্নাটা তৎক্ষণাৎ সামলে নিয়ে এক প্রকার পালিয়ে যাওয়ার মতো ওটিতে ঢুকলেন।। আয়েশা জীর্ণ মুখে চুপ করে বসে রইলেন সিটে। থরথর করে কেপে উঠা ঠোঁট এবং ছলছল করে আসা চোখ দুটোই সামলানোর জন্য তিনি তখন ব্যতিব্যস্ত।

.

ঘন্টাখানেকের মধ্যে হাসপাতালের ভেতর আয়মান ও সাবিহা চলে এলো। ঠিক পনের মিনিটের মাথায় কবিরও সব কাজকর্ম ছেড়ে হাসপাতালে ছুটে এলো। সবাই যখন একত্র হয়ে ওটির সামনে জমায়েত হলো তখন সবার মধ্যে প্রচণ্ড চিন্তা এবং উদ্বেগের দীর্ঘশ্বাস দেখা দিচ্ছিলো। তীব্র উৎকন্ঠায় সবার প্রাণই যেনো আটকে আছে। দম নেবার ফুরসত নেই, সব যেনো পানসে লাগছে। কবির একটু পরপর মাথার পাক খাওয়া সাদা চুলের মধ্যে আঙ্গুল চালাচ্ছে। আয়মান লম্বা পথটুকুতে উদ্বিগ্ন ভঙ্গিতে অনবরত পায়চারী করছে। সাবিহা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে নিশব্দে চোখের পানি ফেলছিলো, কিন্তু কান্নার সুরটা যখন নিচু থেকে উঁচুতে চড়লো তখন আয়মান পায়চারী থামিয়ে ধমকের সুরে চেঁচিয়ে বললো,

– তোমাকে এই টাইমে ভ্যা ভ্যা করতে করতে বলছে কে? চুপ করতে পারো না?

আয়মানের ক্রুদ্ধ আওয়াজে সাবিহা একটু মিইয়ে গেলো। সকলের সামনে এভাবে বলাতে সাবিহার মনে সুক্ষ অভিমান জমলো।সে হালকা গোলাপীর সুতির আচঁলটা টেনে ভেজা গালটা যখন মুছে নিচ্ছিলো, ঠিক ওই মূহুর্তে লিফটের দিকে চোখ আটকে গেলো ওর। হাত থেকে আঁচলটাও ধীরে-ধীরে খসে পরলো। অজান্তেই মুখের চোয়াল হা হয়ে গেলো ওর। চমকিত চাহনিতে কিছু বলতে যেয়ে তোতলাতে লাগলো সাবিহা। আয়মান এতোক্ষন খেয়াল না করলেও হঠাৎ সাবিহার তোতলামি শুনে সে দ্রুত দৃষ্টি ফিরিয়ে দেখলো, সাবিহা প্রচণ্ডরূপে আশ্চর্য হয়ে চোয়াল কাঁপিয়ে তোতলাচ্ছে। ওর তোতলানো একটা কথাও স্পষ্ট না। আয়মান সাবিহার দিকে লক্ষ রেখে পিছু ফিরে তাকাতেই মূহুর্ত্তের মধ্যে ঝড়ের যেনো প্রবল ঝাপটা লাগলো। আয়মান হতবুদ্ধির মতো তাকিয়ে থাকলে ততক্ষণে লিফট থেকে আগত মানুষটা ওর সামনে এসে দাড়াল। সেই গাম্ভীর্যে ভরা মুখ, শক্ত চাহনির দুইচোখ, গায়ের সেই শুভ্র আর্দশের পান্ঞ্জাবীটা দেখে সকলের ভারাক্রান্ত দৃষ্টি যেনো কৌতুহলে বশীভুত এখন। আয়েশা প্রচণ্ড উদ্বিগ্ন হয়ে সিট থেকে দাড়িয়ে পরেছেন, কবিরের মুখ হতবাক, সাবিহা এখনো নিজের জড়তা কাটিয়ে শান্ত হতে পারেনি।। ক্ষণিকের জন্য সকলের স্থবির দৃষ্টি দেখে শক্ত চাহনীর মানুষটা এক-এক করে সবার দিকে তাকালো। সবাই হতভম্ব, সবাই স্তব্ধ। হয়তো কেউ আশা করেনি পূর্ব আজ আসবে, এই মূহুর্তে উপস্থিত হবে, ঠিক হাসপাতালে ও আগমন করবে। নিরবতার ক্ষণকাল চিড়ে সবার আগে সাবিহাই বিষ্ময়সূচকে তোতলিয়ে বলে,

– ও-য়া-সি-সি-ফ পূ-র্ব … এ-এখানে?

সাবিহার ওইটুকু কথাতে সবার সৎবিৎ যেনো ফিরে এলো। পূর্ব তখনও চুপ করে দাড়িয়ে ছিলো। তার বাম কপালের কোণে ক্রস করে দুটো সাদা ব্যান্ডেজ লাগানো। আজ ব্যতিক্রম হিসেবে পান্ঞ্জাবীর হাতা কনুইয়ে গুটায়নি পূর্ব। ফুল স্লিভ ছেড়ে দেওয়ার কারনে কবজি পযর্ন্ত ঢেকে আছে। পূর্ব গম্ভীর কন্ঠে আয়মানকে ছোট্ট প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে,

– ও ভেতরে?

‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়লেও চুপ করে তাকিয়ে রইলো পূর্বের দিকে। আয়েশা নিজের আবেগান্বিত অবস্থাকে সংযত করে পূর্বের সামনে এসে কঠোর গলায় ঝাঁঝিয়ে বললেন,

– আজ কেনো এলি? তুই তো জেল থেকে আজ বের হসনি, তাহলে এতোদিন পর কেন এলি? স্বার্থপরের মতো কেনো নিজের চেহারা দেখাচ্ছিস! তুই আমাকে শেষ করে দিলি পূর্ব! তুই আমাকে তিলেতিলে শেষ করে দিলি! নিজের গর্ভবতী স্ত্রীকে রেখে তুই অন্য জায়গায় মাসের পর মাস কাটালি, অথচ একদিনও বাড়িতে এসে দেখা করে গেলিনা। তোর কোন্ ইচ্ছাটায় আমি মই দিয়েছি বল? তোর কোন্ চাওয়া আমি অপূর্ণ রেখেছি? তুই কিভাবে পারলি নিজের বউকে একা ফেলে এতোদিন দূরে থাকতে? আমি কি নিষ্ঠুর ছেলে পেটে ধরেছিলাম? আমাকে তুই কি উপহার দিলিরে পূর্ব?

আয়েশার রুদ্ধ কন্ঠস্বর কান্নায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। হু হু করে তিনি কেদেঁ উঠলেন ওই মূহুর্তে। বয়সের ভারে ভেঙ্গে আসা শরীরে তিনি আর নিজেকে সামলাতে পারলেন না তখন। ভেতরে সকল দুঃখ যাতনা তীব্র অশ্রুধারায় প্রকাশ করলেন তিনি। পূর্ব এতোটা চুপ হয়তো আগে কখনোই থাকেনি। আজ নিজের চোখের সামনে মাকে কাঁদতে দেখেও সে আড় ভেঙ্গে কথা বলেনি। সেইযে কঠোর দৃষ্টি নিয়ে এখানে আসলো, শেষ পযর্ন্ত ওইভাবেই দৃষ্টিকোণ বজায় রেখেই চললো। সবার সাথে ভালোমন্দ কথাবার্তা যা একটু বললো, তাও খুবই মাপযোগ করে স্বল্প উত্তরে সারলো। আয়েশা তখন একটু শান্ত হয়ে ক্লান্ত দেহে সিটে বসে পরলেন। পূর্ব আয়েশার সাথে কথা বলতে এলে তিনি মুখ ঘুরিয়ে না-শোনার ভান করে সাবিহার সাথে কথা বলেন। এদিকে কবিরের সাথে টুকটাক কথা সারতেই পূর্ব যখন প্রস্তুত হলো ঠিক তখনই ওটির দরজা খুলে খোদেজা বাইরে বেরুলো। লাবণ্যহীন মুখে খোদেজা মাথার টুপিটা যখন খুলতে গেলো সেও পূর্বকে সামনে দেখে থতমত খেয়ে হা হয়ে গেলো। কৌতুহল চাপতে না পেরে তিনি সবাইকে জিজ্ঞেস করে বসলেন,

– ওও ককখন এলো?

কথাটা তালগোল পাকিয়ে গেলো উনারও।আয়মান উত্তরটা দেওয়ার জন্য তৎপর হলে তার আগেই পূর্ব নিজের কথাটা স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পেশ করে বললো,

– ভেতরে যেতে পারবো?

খোদেজা আশ্চর্য ভঙ্গিতে একবার পূর্বের দিকে তাকাচ্ছেন, আরেকবার দৃষ্টি ফিরিয়ে সকলের শান্ত চাহনি দেখছিলেন। কিন্তু আগামাথা কিছুই তিনি ওই মূহুর্তে ঠাহর করতে পারছিলেন না। কাঙ্ক্ষিত উত্তর না পেয়ে পূর্ব আবার জিজ্ঞেস করলো,

– আমি কি ভেতরে যাবো?

এবারটা প্রশ্নটা ঝাঁজালো সুরে বললো পূর্ব। খোদেজা মৃদ্যু কায়দায় শিউরে উঠতেই অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে এক-বারের জায়গায় ছয়বার মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। পূর্ব দাম্ভিকতাপূর্ণ পদচারনায় খোদেজার পাশ কাটিয়ে ওটির দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো। এদিকে খোদেজা পূর্বের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ দেখে বেশ অবাক হলেন। কখনো উঁচু স্বরে কথা বলা তো দূর, সে নিচু কন্ঠেই চুপচাপ থাকা পছন্দ করে। ওটির বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে এরপর দৃষ্টি ঘুরালো সবার দিকে। সবার চোখেই কৌতুহল, সবার চোখেই উদ্বেগ।

.

কেবিনের কামড়ায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে পূর্ণতা। সাদা রঙের পাতলা কম্বল ওর গলা পযর্ন্ত ঢাকা। কতক্ষণ পর সে চোখের পাতা খুললো তা অবশ্য অনুমান করা যাচ্ছেনা। পূর্ণতা চোখ খুলতেই বুঝতে পারলো সে এখন ওটির কামড়ায় নেই। নরমাল কেবিনের নরম বেডে সে শুয়ে আছে। শরীর খুব পাতলা এবং ক্লান্তিকর লাগছে। মাথাটা বেশ ভারী মনেহচ্ছে। একা কেবিনে থাকার যন্ত্রণাটা খুব কষ্টের। কেউ পাশে থাকেনা একটাবার হাত ধরার জন্য। সাহস ও বিশ্বাস বাড়ানোর জন্য কেউ হাসিমুখে কেবিনের ভেতর ঢুকেনা। আজ পূর্ব নামক মানুষটার ইচ্ছা পূরণ করে দিলো পূর্ণতা। তবুও কেনো সৃষ্টিকর্তা ওকে বাঁচিয়ে রাখলো? পূর্ণতা অস্বচ্ছ দৃষ্টিতে চোখ বন্ধ করতেই টুপ করে বালিশের উপর অশ্রুজল পরলো। নিঃশব্দে একের-পর-এক বড় বড় অশ্রুফোঁটা বর্ষনের মতো ঝরতেই হঠাৎ পাশ কেউ বলে উঠলো,

– কাঁদছো কেন?

সমস্ত গা কাঁপিয়ে শিউরে উঠে পূর্ণতা। তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে সে শব্দউৎসের দিকে তাকায়। দূর্বল শরীরটা রক্তশূন্যের মতো ঠান্ডা হয়ে আসছে ওর। বুকের ভেতর সবকিছু নিংড়ে ছিড়ে আসছে। কান্নার স্ফুলিঙ্গ যখন দুই ঠোঁট চেপে আটকানোর জন্য তুমুল চেষ্টা করা হচ্ছিলো তখন সেই কন্ঠটা আবারও বলে উঠলো,

– খারাপ লাগছে তোমার?

টলটল করে দুচোখ ছাপিয়ে অশ্রু-বর্ষন চলতে লাগলো পূর্ণতার। পাশে বসা ব্যক্তির কোলে সদ্য জন্ম নেওয়া শিশুকে দেখে পূর্ণতা চোখ কুঁচকে কেদেঁ দিলো। কান্নার হিড়িকে পূর্ণতা ফুপিয়ে উঠলো তখন। শরীরের দূর্বলতার দিকে আর পরোখ করার সময় ও পেলো না। যার জন্য মাসের-পর-মাস সে অপেক্ষা করতে-করতে ভেঙ্গে পরেছে, সে আজ চোখের সামনে এইভাবে উপস্থিত! পূর্ব পূর্ণতার মাথার কাছ থেকে সরে এসে ওর নেতানো হাতের কাছে বসলো। পূর্ণতার মুখোমুখি হয়ে দুহাতের ডোরে রাখা নবজাতকের কপালে চতুর্থ চুমুটি খেলো পূর্ব। ঘুমন্ত নবজাতকের দিকে তাকিয়ে থাকতেই পূর্ব তৎক্ষণাৎ ঝাপসা দৃষ্টি নামিয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে নিচু সুরে বললো,

– আমার ছেলে…

– চলবে

#FABIYAH_MOMO

( নোটবার্তা : ছোটপর্ব দেওয়ার জন্য দুঃখিত ? )

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here