তোকে ঘিরে ❤পর্ব_৬৭

0
1928

#তোকে_ঘিরে ❤
#পর্ব_৬৭.
#ফাবিয়াহ্_মমো .

হাউমাউ করে কান্নার আওয়াজ শুনে পূর্ণতা স্তব্ধ হয়ে গেলো। চোখের সামনে শ্রেয়ার সেই শেষ দৃশ্যটা ভাসছিলো। হাসপাতালের বেডে কয়েক মিনিটের জন্য শ্রেয়া যখন সেন্সে ছিলো সবার আগে পূর্ণতার সাথেই দেখা করেছে। ওটাই ছিলো শেষ দেখা। আখেরী দেখা। দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার মতো শেষ সাক্ষাৎ। এরপর আর শ্রেয়া ফিরেনি। আজীবনের জন্য হারিয়ে গেছে, সবাইকে বিদায় জানিয়ে অজানার কায়নাতে পাড়ি দিয়েছে। ও আর কোনোদিন ফিরবেনা। পূর্ণতা ফোনটা কেটে দিতেই বুঝতে পারলো তার চোখ থেকে আবারও পানি পরছে। পুরোনো দিনগুলো মনে পরছে ভীষণ। শ্রেয়ার কথা মনে পরছে প্রচুর। আজ থেকে কয়েক বছর আগে এভাবেই তো কান্না করে পূর্ণতা মনের সব কথা শ্রেয়াকে বলতো, সমস্যার সমাধান চাইতো, নানা কাজে শ্রেয়ার পুরোদমে সাহায্য পেতো। আজও সেদিনের স্মৃতি ভাসে, মনের অন্দরে বিভৎস দিনের কথা মনে পরে, ভুলে যেতে ইচ্ছে করে সব ঘটনা। একটা ভুল হলেও সেই ভুলের জন্য শ্রেয়ার ক্ষমা হলো না। কিন্তু দিনশেষে মৃত ব্যক্তি আর কখনো জীবিতাবস্থায় ফিরবেনা। পূর্ণতা চোখ কুঁচকে ভেতরের অশান্ত বিষাদের ঝড়টা থামানোর চেষ্টা করলো। ফোনটা মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরে রেখে পাশে থাকা বিছানার উপর বসে পরলো। মিনিটের কাটা তিরতির করে চলে যেতে লাগলো নিঃশব্দে, নিঃশর্তে, নিঃসংশয় হয়ে। পূর্ণতা দ্রুত নিজেকে সামলানোর জন্য গলা শক্ত করে ভেতরে চাপিয়ে রাখা কান্নাটা কয়েক মূহুর্তের মধ্যে শান্ত করে। মনটা একটু শান্ত হলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে চিন্তা করে, সাবিহা এখন কেনো কল করেছে? আয়মান কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে, কি কারন? পূর্ণতা কিছুই বুঝতে পারছেনা এখন। তাড়াতাড়ি সব ঠিকঠাক করার জন্য ফোনটা পার্সে ঢুকিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলো। সদর গেটের কাছে চলে গেলে আবার পা ঘুরিয়ে আয়েশার রুমে গিয়ে প্রণয়কে দেখতে গেলো। ছেলের কাছে ছুটে গিয়ে ওমনেই শ্বাশুড়ির কাছে পুরো ঘটনা খুলে বললো। সব শুনে আয়েশা প্রচন্ড চিন্তিত হয়ে উঠলেন। তিনি উদ্বিগ্ন সুরে পূর্ণতাকে তাড়াতাড়ি সেখানে যেতে বললেন। এদিকে পলাশের রুম থেকে ডাক এলে আয়েশা কিছু সময়ের জন্য সেখানে চলে গেলেন। পূর্ণতা এতোক্ষন পর ছেলের দিকে দৃষ্টি দিলো। প্রণয় তখন বিছানায় পা দুলিয়ে সাইকেলের মতো খেলছে। লাল টুকটুকে গালদুটোতে ভর রেখে নিষ্পাপ হাসি দিচ্ছে। স্বচ্ছ পরিস্কার নির্মল চাহনিতে অবুঝ মায়ায় তাকিয়ে আছে। ছোট ছোট নরম আঙ্গুলগুলো মুখে ঢুকিয়ে মনের আনন্দে খেলছে প্রণয়। তার গায়ের রঙটা ফর্সা, কিছুটা লালচে, কিছুটা রাঙা-রাঙা। গালদুটোয় একদম লালচে আভা। পূর্ণতা পার্সটা বিছানায় রেখে বেবি রেপারসহ কোলে তুলে নিলো প্রণয়কে। বাবার মতো পাওয়া চোখদুটো দিয়ে প্রণয় ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে হাসছে। একটুও বাদ রাখেনি পূর্বের মতো চোখদুটো পেতে। সম্পূর্ণ চক্ষুচাহনি একদম খাপে-খাপে পূর্বের সাথে মিলে। পূর্ণতা পরমাহ্লাদে প্রণয়ের লালচে গালে চুমু খায়। মৃদ্যু হাসি দিয়ে মায়াবী চোখদুটোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,

– তুই অবিকল তোর বাবার প্রতিরূপ পেয়েছিস। একদম তোর বাবার মতো চোখদুটো। এই চোখ দিয়ে যে, বড় হয়ে কতজনকে নাশ করবি জানা নেই। তোর বাবার চোখদুটোর জন্য আমি কখনো রাগ পুষে থাকতে পারিনি। চোখের দিকে তাকালেই আমি রাগ ভুলে যেতাম। তোকে পেটে নিয়ে সারাক্ষন তোর বাবার কথাই চিন্তা করতাম। একটুও শান্তি পাইনি প্রণয়। না তোকে শান্তি দিয়েছি, না আমি স্বস্তিতে থেকেছি। তোর বাবার কথা চিন্তা করলে বুকটা শুকিয়ে যায়। জেলে কম কষ্ট করেনি। আমি ওর জায়গায় থাকলে কি করে টিকতাম? তোর জন্য কিছু না করলেও নিজের সবটা শেষ করে দিয়েছে এই ব্যক্তি। জানিস, তোর বাবার মতো রাশভারী মানুষকে একমাত্র তুই কাঁদিয়েছিস। তোকে কোলে তুলে আমার সামনেই অশ্রু ঝরিয়ে ফেলেছে। রাতে কতবার তোর আঙ্গুল ধরে চুমু খায় সে হিসেবে তুই জানবিনা প্রণয়। এখনো ওকে কাঁদতে দেখি। চোখদুটো ভেজা থাকে। শুধু তোর দিকে তাকিয়ে তাকে। চোখ দিয়ে টলমল করে পানি পরে। ওর বুকে যে কি নিয়ে এখনো দুঃখ, আমি জানিনা বাবা। ওইটুকু বুকটার মধ্যে কি কি ও লুকিয়ে রেখেছে আমাকে কিছুই বলেনা। তোর বাবাটা মুখচাপা মানুষ। আমার কাছে সহজে কিছু বলেনা। তুই যেদিন দুনিয়ায় আসলি সেদিন ওকে যা-তা করে বকেছি। ও আমাকে পাল্টা করে কিছুই বলেনি। অন্যকেউ হলে সত্যিই আমাকে ফেলে চলে যেতো। জেল থেকে বেরিয়ে হাসপাতালে গিয়েছে, এটাই আমাকে বলেনি। এখনো শার্ট-পান্ঞ্জাবীর হাতা গুটায় না। স্লিভ নামিয়ে রাখে। এখনো সবার কাছ থেকে হাতদুটো লুকিয়ে রাখে। ডান হাতের প্লাস্টার খুলা হয়নি। বাম হাতের কনুইয়ে এখনো কালো হয়ে আছে। মলম লাগাতে গিয়ে প্রচুর ব্যথা পায় তবুও একটা টু শব্দ উচ্চারণ করেনা। অথচ দ্যাখ, ওই দুহাতেই দাবড়ে বেরিয়ে কাজ করছে, তোকে কোলে নিচ্ছে, সবার খেয়াল রাখছে। সারাদিন শেষে রাতের বেলার যখন ঘুমাতে আসে তোর মুখটা যেনো ওর ক্লান্তি কাটিয়ে দেয়। তুই তোর বাবাকে কোনোদিন কষ্ট দিবিনা। যদি আমি নাও থাকি তবুও তোর বাবাকে দেখে রাখবি প্রণয়। আমি চাই তুই তোর বাবার মতোই হ, কঠিন হ, রাগী হ। তুই ওয়াসিফ পূর্বের মতোই পুরো দাপট নিয়ে চলবি, সামনে-পিছে তাকাবিনা। ও যেমন কাউকে পরোয়া করে চলেনা তেমনি বেপরোয়া হবি। শুধু সত্যের জন্যই বেহায়া হবি, মিথ্যার জন্য আদবে চলবিনা। তোকে দুনিয়ায় দেখাটা তোর বাবার শেষ ইচ্ছা। আর বিশ্বাস কর, আমি স্বার্থক। ও তোকে আমার চেয়ে বেশি ভালোবাসে। একটু বড় হলেই বুঝবি তোর বাবা মানুষটা কেমন। আচ্ছা, তোর বাবার চেয়ে রাগী হবি? তোর চুল যে এতো খাড়া-খাড়া, আমি যে এখনই চিন্তায় মরছি! আবার হাসি? খালি হাসি। এতো খিলখিলিয়ে হাসলে তো সমস্যা। তুই সব বুঝে গেলি নাকি?

প্রণয় মুখের কাছে আঙ্গুল এনে পূর্ণতার দিকে হাসি দিয়ে তাকিয়ে হাসছে। হাসিমাখা চোখে পিটপিট চাহনিতে এমন ভাবে দৃষ্টি দিয়ে আছে, যেনো পূর্ণতার সব কথা সে বুঝে ফেলেছে। পূর্ণতার বুকটা শান্তিতে ছেয়ে যাচ্ছিলো। অদ্ভুত শীতলতার পরশ পেয়ে মনের ভেতর ঠান্ডা হচ্ছিলো। মুখ নামিয়ে ছেলের কপালে গাঢ় করে চুমু খেলো ও। কয়েক মিনিটের মধ্যে আয়েশা এসে পরলে প্রণয়কে রেখে পূর্ণতা রওনা দিলো।

আকাশটা কালো মেঘে ঘনিয়ে আসছে। চারধার ভয়ঙ্কর অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে। আড়াল হয়ে যাচ্ছে সূর্যের আলো। চারদিক থেকে মানুষের মনে শঙ্কার উদ্ভব হলো। পূর্ণতা গাড়িতে বসে জানালার বাইরে দৃষ্টি রেখেছিলো। এতো ভয়াবহ অন্ধকার আগে কখনো দেখেনি। নির্মল আকাশকে নির্মমভাবে গ্রাস করে নিচ্ছে কালো মেঘ। এমন আবহাওয়া দেখে গা-টা কেমন শিরশির করে উঠছে। পূর্ণতার মনে একমাত্র ভয়টা শুধু পূর্বকে নিয়েই হলো। সকাল থেকেই পূর্বের কোনো লাতাপাতা নেই। কল দিলে কল ধরছেনা, কোথায় আছে খবর নেই। পূর্ণতা ঢোক গিলে পূর্বকে আরেকবার কলে দিলো, মনেমনে সুস্থতার জন্য জপ করছিলো। কিন্তু মনের উৎকন্ঠা হ্রাস না হয়ে আরো বেগতিক হয়ে উঠলো। পূর্ব কল ধরলোনা। ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে সামনে দৃষ্টি দিয়ে জিজ্ঞেস করে দিলো পূর্ণতা,

– আকবর চাচা, সকালে তো আপনি দারোয়ানের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলেন। আপনি কি পূর্বকে যেতে দেখেছেন?

প্রবীণ বয়সী আকবর সর্তক ভঙ্গিতে গাড়ি চালাতেই পূর্ণতার জন্য সরল গলায় উত্তর দিলো,

– বাবা তো ফোনে কথা কইতে কইতে গাড়িত চড়তাছিলো। হেরপর গাড়ি চালু দিয়া কই জানি চইলা গেলো, আমি আর দেখিনাই।

এটুকু শুনে আর প্রশ্ন করার অবস্থা রইলো না। শুকিয়ে আসা গলা কোনোমতে ঢোক গিলে ভেজানোর চেষ্টা করলো পূর্ণতা। বুকটা ভয়ংকর ভাবে ধুকধুক করছে। যদি কিছু হয় —! গুমোটপূর্ণ আকাশের দিকে করুন দৃষ্টি রাখলো সে। পূর্ব হয়তো আবারও পুরোনো রাস্তায় ফিরে গিয়েছে। এটুকু ভাবতেই অস্থির হয়ে উঠেছে পূর্ণতা। এসির ভেতরে চুইয়ে ঘামতে শুরু করেছে সে। আর ভাবতে পারলোনা পূর্ণতা। চোখ বন্ধ করে ফেললো তৎক্ষণাৎ। এক বোতল পানি পুরোটা খেয়ে ফেললো। ওমনেই গাড়ি এসে পৌঁছলো শিকদার বাড়িতে। বোতলটা ডাস্টবিনে ফেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকেই গায়ের লোম দাড়িয়ে গেলো পূর্ণতার! সাবিহার অবস্থা খুবই খারাপ! মাথা ঘুরে পরে গিয়ে বেকায়দায় বমি করে রুম ভাসিয়েছে। রুম একদম নষ্ট হয়ে গেছে। এদিকে বাড়িতে দ্বিতীয় কেউ নেই। আয়মানের নানা হাসপাতালে ভর্তি বিধায় আফিয়া মূলত সেখানেই গিয়েছে। সাবিহাকে জোরাজুড়ি করেও সঙ্গে নিতে পারেনি। সাবিহার মুখ শুকিয়ে কয়েক ঘন্টার মধ্যে বির্বণ আকার ধারণ করেছে। হাত-পা ঠান্ডা হয়ে চোখ ঘোলাটে দেখাচ্ছে। এদিকে হাত-পা ঠান্ডা হওয়া ভালো লক্ষণ না, পূর্ণতা তাড়াতাড়ি সাবিহাকে শাড়ি পাল্টাতে বলে রান্নাঘরে চলে এলো। তাক থেকে খুজেঁ-খুজেঁ চিনির বয়াম বের করে মূহুর্তের মধ্যেই চিনির পানি গুলিয়ে আনলো। ততক্ষণে সাবিহার দূর্বল, ক্লান্ত, নেতানো দেহ বিছানায় সেঁটে গেছে। পূর্ণতা ওকে চটজলদি চিনির পানি খাইয়ে দেয়। কয়েক মিনিট যেতেই আবার ভক করে বমি করে সাবিহা। বিছানার চাদর নষ্ট করে ফেলে। অত্যধিক দূর্বলতার জন্য চোখ খুলেও তাকাতে পারছেনা সে। পূর্ণতা মাথায় হাত দিয়ে চরম বিপাকে ফেঁসে গেছে। আয়মানকেও অনবরত কল করতে থাকে। শেষে নিরুপায় হয়ে ডাক্তার ডেকে আনে। ডাক্তার এসে সাবিহার পালস রেট চেক করে, চোখের পাতা মেলে দেখে এবং পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত সুরে বলে,

– ক্লিনিকে টেস্ট করানো দরকার। বাসায় রেখে অবস্থা বোঝা যাচ্ছেনা।

পূর্ণতা হতবিহ্বল হয়ে চিন্তায় ক্লিষ্ট হয়ে যায়। কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে কিছু একটা মনে পরার ভঙ্গিতে জবাব দেয়,

– ওর পেটে সমস্যা? প্রচুর বমি করছে যে। পেটে গ্যাস হলো কিনা বুঝতে পারছিনা। আপনিই কিছু করুন।

পূর্ণতার চিন্তান্বিত মুখ দেখে ডাক্তার ছোট্ট নিশ্বাস ছাড়ে। সাবিহার দিকে একপলক তাকিয়ে শেষে পূর্ণতার দিকে দৃষ্টি দিয়ে বলে,

– মনে তো হচ্ছে অন্তঃসত্ত্বা।

প্রথমে বজ্রাহতের মতো তাকালো পূর্ণতা, পরক্ষনে তীব্র খুশিতে চোখ টলমল করে হেসে দিলো সে। ডাক্তার পূর্ণতার অভিব্যক্তি দেখে একটু হেসে বললেন,

– যদিও নাড়ি টিপে ধারণা দিলাম। বাকিটা ক্লিনিকে গিয়ে টেস্ট করলেই জানতে পারবেন।

বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। আকস্মিক বৃষ্টিতে প্রকৃতির সব ধূলো-ময়লা পরিস্কার হয়ে যাচ্ছে। নির্মল হয়ে উঠছে গাছের সবুজ নব্য পাতা। আকাশে শুরু হয়েছে মেঘের হুঙ্কার। ফুলে ফেঁপে উঠছে মেঘ পুন্ঞ্জীভূত কালো আকাশ। কেঁপে উঠছে মাটি, বৃষ্টির তীব্রতায় দুলে উঠছে গাছ। পূর্ণতা বৃষ্টির মধ্যেই ক্লিনিকে নিয়ে গেলো সাবিহাকে। ইতিমধ্যে রাস্তায় পানি জমতে শুরু করেছে। মানুষ বৃষ্টি মাথায় দৌড়াচ্ছে গন্তব্যের দিকে, কেউ ছুটছে ছাউনির উদ্দেশ্যে। ক্লিনিকে এনে দ্রুত টেস্ট করালো সাবিহাকে। সত্যি-সত্যি ধরা পরলো সাবিহা প্রেগনেন্ট! নিজের গর্ভবতী হবার খুশিতে পূর্ণতাকে জাপটে ধরে কেদেঁ দিলো সাবিহা। খুশির জোয়ার উপচে পরলেও ক্ষণিকের মধ্যে মুখ ভার হলো সাবিহার। পূর্ণতা শিকদার বাড়িতে ফিরতে ফিরতে সাবিহার কাছে পুরো ঘটনা শুনলো। আয়মান ইদানিং খিটখিটে স্বভাবের হয়ে গেছে, কাজের মধ্যে ব্যস্ত হয়ে নাস্তানাবুদ অবস্থা। সাবিহাকে পাসপোর্ট করার জন্য তাগাদা দিলে ও পরিস্কার শব্দে বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে নাকোচ করে দেয়। সাবিহা বিদেশ যেতে ইচ্ছুক না। কিন্তু আয়মানও এ কথায় নারাজ। সে কিছুতেই এদেশে থাকতে রাজি নয়। সব কাজ গুটিয়ে বিদেশে পাড়ি দিয়ে সেখানেই সেটেল হতে চায়। আফিয়া অনেক বুঝিয়েও ছেলেকে রাজি করাতে পারেনি। আয়মান এককথায় অটল, অনড় এবং অবিচল হয়ে রইলো। সাবিহা যখন শ্বাশুড়ি ও দেশ ছেড়ে সঙ্গে যেতে না করলো, আয়মান তখন আর ওকে বাধা দিলো না। সে নিজেই ভিসা কনফার্ম করে টিকিট কেটে চুপচাপ লাগেজ গুছিয়ে বিদায় হলো। এমন দিনেই রওনা দিলো, যেদিন আফিয়াও বাড়িতে নেই। সাবিহার অনেক জোড়াজুড়ির পরও আয়মান থাকেনি। উপায়ন্তর না পেয়ে শেষে পূর্ণতাকে কল দিয়ে সাবিহা বাড়িতে আনে। কিন্তু শারীরিকভাবে সপ্তাহ খানেক ধরে সাবিহা বেশ অসুস্থ ছিলো, এ ব্যাপারে কাউকে জানায়নি। ব্যস্ত হয়ে থাকা আয়মান সাবিহার দিকে পরোখ করেনি। পূর্ণতা চুপচাপ সবটা শুনে সাবিহাকে শান্ত হতে বলে বিছানায় শুতে বললো। একটু ঘুমানোর চেষ্টা করতে বলে পূর্ণতা বারান্দার দিকে চলে এলো। ফোনের পাওয়ার বাটনটা অন করতেই বুঝতে পারলো আয়মানের ফ্লাইট এতোক্ষনে টেক-অফ করে ফেলেছে। ফোন এখন টোটালি বন্ধ থাকবে। ইউএসের এয়ারপোর্ট পযর্ন্ত পৌঁছতে আটচল্লিশ ঘন্টা লাগবে। এরপর কাঙ্ক্ষিত স্টেটের ফ্লাইটে লাগবে আরো ছয়ঘন্টা। আয়মানের সাথে তিনদিন পযর্ন্ত কোনো যোগাযোগ সম্ভব না। পূর্ণতা ওর নাম্বারে মেসেজ ছেড়ে দিলো। বৃষ্টিমুখর আকাশের দিকে তাকিয়ে মনটা কেমন উদাস, বিষণ্ণ এবং বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। কেমন শূন্যতা ভর করলো মনের আঙিনায়, যেন কিছু নেই-কিছু নেই ভাব। আকাশ থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে সাবিহার দিকে একপলক তাকালো পূর্ণতা। বদ্ধ চোখের দুই চক্ষু কার্নিশ বেয়ে অশ্রুফোঁটা ঝরছে। ঈষৎ ভঙ্গিতে কান্নার দোলে সাবিহার বুক উপর-নিচ কাঁপছে। এদিকে পূর্ণতার ফোনে প্রণয়ের জন্য তাড়াতাড়ি ফেরার তাগিদ আসলে সাবিহার জন্য চিন্তায় পরলো পূর্ণতা।কলটা পূর্বিকার নাম্বার থেকে এসেছে। কলটা রিসিভ করে পূর্ণতা কানে ফোন দিতেই পূর্বিকা কেমন সর্তক সুরে বললো,

– পূ-পূ-পূর্ণতা —

সাড়া দিতে গিয়ে বেশ হোচট খেলো পূর্ণতা। অদ্ভুত শোনাচ্ছে পূর্বিকার কন্ঠটা। প্রচণ্ড কৌতুহল কাজ করলো ওর। পূর্ণতা তৎক্ষণাৎ পূর্বিকাকে পাল্টা প্রশ্ন করলো,

– আপু কিছু কি হয়েছে?

প্রশ্ন করার পর পূর্বিকার উত্তরটা আসলো না। পূর্ণতা কান থেকে ফোন সরিয়ে স্ক্রিন দেখে কলের টাইম এখনো কন্টিনিউ চলছে, কিন্তু পূর্বিকা কোনো সাড়াশব্দ করছেনা। পূর্ণতা কৌতুহল চাপতে না পেরে অস্থির হয়েই জিজ্ঞেস করলো,

– আপু? আপু কি শুনতে পাচ্ছো? কি হয়েছে? আপু বাড়িতে সব ঠিকঠাক আছে? প্রণয় কি কান্না করছে? হ্যালো? আপু জবাব দাও!

অনেকগুলো প্রশ্ন শেষে হাপিয়ে উঠার মতো শ্বাস টানতে লাগলো পূর্ণতা। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে! পূর্বিকার কন্ঠ অদ্ভুত শোনাচ্ছে! পূর্বও বাড়ি নেই! আবার কোনো শত্রু আসলো কিনা! প্রণয় বাড়িতে একা! এসব কিছু চিন্তা করতেই মারাত্মক অস্ঋইর হয়ে পূর্ণতা। এদিকে পূর্ণতার এমন অপ্রকৃতিস্থ অবস্থা দেখে সাবিহা ওকে শান্ত হতে বলে। কিন্তু পূর্ণতা আর শান্ত হয়না। সাবিহা ওকে দ্রুত ওয়াসিফ ভিলায় যেতে বললো। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সেখানকার পরিস্থিতি দেখা উচিত। সাবিহার এ কথা শুনে স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে পূর্ণতা দৌড়ে নিচে নামলো। গাড়ির দরজা খুলে এক্ষুনি ওয়াসিফ ভিলায় যেতে বললো। ড্রাইভার মাথা ঘুরিয়ে পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে আহত সুরে বললো,

– মা, বাইরে এহন প্রচুর বৃষ্টি। রাস্তায় পানিও জমছে। একটু পর বাইর হইলে ভালো হয়না?

কোনো কথা শুনতে পূর্ণতা রাজি না। সে পরিস্কার কন্ঠে জানিয়ে দিলো রাস্তায় টাইফুন শুরু হলেও গাড়ি যেনো না থামে। এই মূহুর্তে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে যেনো ওয়াসিফ ভিলায় সোজা রওনা দেয়। পথে কোনোভাবে যদি গাড়ি থামে তাহলে পূর্ণতার রূঢ় আচরণ দেখবে! ড্রাইভার পূর্ণতার রণচন্ডীর অগ্নিমুখ দেখে কোনো কিছু বলার সাহস পেলোনা। সে ইন্ঞ্জিন চালু দিয়ে পানি ভেঙে এগুতে থাকে। বৃষ্টির জন্য যেখানে পাঁচ মিনিটের পথ পনের মিনিট লাগে, আজ সেখানে একঘন্টার পথ আড়াইঘন্টা লাগছে। বৃষ্টির প্রখরতা একটু যেনো কমেছে, কিন্তু পূর্ণতার অস্থিরতা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। কাউকে ফোন দিয়ে সে পাচ্ছেনা। পূর্বিকা, আয়েশা, নূরানী, ময়না কেউ কলটা ধরছেনা।

আকাশটা এখনো হিংস্রভাবে কালো হয়ে আছে। প্রকৃতি কেমন গুমিয়ে গেছে এই রূপ দেখে। গাড়িটা ওয়াসিফ ভিলার গেট ভিরিয়ে পার্কিং সাইডে থামতেই পূর্ণতা গাড়ি থেকে বাড়ির গেট পযর্ন্ত দৌড়ে ভেতরে ঢুকলো। এরপর মাথা ঝেড়ে কাপড় ঠিকমতো ঝাট দিতেই চোখ তুলে গ্রাউন্ড ফ্লোরের দিকে দৃষ্টি আটকালো। ওমনেই ভ্রুঁ কুঁচকে এলো ওর। বাইরে মেঘের জন্য ঘুটঘুটে অন্ধকার, অথচ বাড়িতে কেউ লাইট জ্বালায়নি। বাদলার দিনে এমন অন্ধকার অবস্থা আগে কখনো হয়নি। এমন কেনো হচ্ছে দিনটা? সব বিপদের আভাস কি আজই আছড়ে আসছে? পূর্ণতা গলা তুলে পা এগিয়ে আয়েশার উদ্দেশ্যে ডাকে,

– আম্মা? আম্মা আপনি কোথায় আছেন? আম্মা আপনি কি ঘরে? আম্মা?

পূর্ণতার এক ডাকেই হড়হড় করে সাড়া দেয়া ব্যক্তিটা আজ এতো ডাকেও সাড়া দেয়নি। পূর্ণতার বুকটা কেমন কামড়ে এলো, অদ্ভুত ভাবে গা শিরশির করে উঠলো। পুরো গ্রাউন্ড ফ্লোর যেই অন্ধকার, তার চেয়ে আরো বীভৎস অন্ধকার হয়ে গেছে দোতলায়। পূর্ণতা সবাইকে ডাকতে-ডাকতে রুমে চেক করলো। পূর্বিকা নেই, আয়েশার রুমে আয়েশা নেই, পলাশের রুম শূন্য, প্রণয়ের জন্য পূর্ণতা ভয়ে কেঁপে উঠলো। পূর্ণতার অনুপস্থিতিতে কেউ এসেছিলো? কেউ কি সবাইকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে গেছে? পূর্ণতা এটুকু ভাবতেই এক চিৎকার দিয়ে ‘ আম্মা, আপু, নূরানী ‘ বলে ডাকতে লাগলো। তন্নতন্ন করে প্রতিটা রুমের বাথরুম, বারান্দা চেক করতে লাগলো। কেউ নেই, কেউ নেই এখানে। আকাশটা যেনো পৈশাচিক হাসি দিয়ে বিকট গর্জন করছে। একেকটা ভয়ংকর বজ্রপাত ভূমিতে এসে দাপট দেখাচ্ছে। শো-শো করে হাওয়ার তেজ বাড়ছে, সেই সাথে তাল মিলিয়ে বৃষ্টিও মুষড়ে পরছে। প্রকৃতির এমন তান্ডবলীলায় পূর্ণতা হাউমাউ করে কেদেঁ উঠলো। বাড়ির মানুষগুলো কোথায় গেলো? ওয়াসিফ ভিলায় এতো অন্ধকার আগে কখনো দেখেনি পূর্ণতা। ক্রমশ অন্ধকার যেনো আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবার চোখে লাইট ছাড়া কিছু দেখা সম্ভব না। পূর্ণতা হাতের ফোনটা থেকে ফ্ল্যাশ অন করলো। ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দোতলায় উঠলো। করিডোরে আলো ফেলে দেখলো সেখানে সুনশান অবস্থা। পুরো বাড়িটার মধ্যে পূর্ণতা কেবল একা! চোখ মুছতেই আবার অশ্রুতে ভরে উঠলো ওর। ফ্ল্যাশ অন করা হাতটা উঁচু করে নিজের রুমের দিকে এগুলো। রুমের সামনে আসতেই দেখলো দরজা বন্ধ করা। অথচ যাওয়ার পূর্বে দরজা খোলাই ছিলো। পূর্ণতা কান্নার হিড়িকে কাঁপতে-কাঁপতে কম্পমান হাতটা দরজার নবে রাখলো। মৃদ্যু একটা ঢোক গিলে নব মোচড় দিতেই দরজা খুলে ফেললো। দৃষ্টি ভেতরে দিতেই শরীরের প্রতিটি পশম কাটা দিয়ে উঠলো ওর! বিস্ফোরিত চাহনিতে তাকিয়ে থাকতেই গলা রুদ্ধ হয়ে এলো। ওর শরীরে কেউ যেনো বরফ রেখে দিয়েছে, এমন থরথর করে পূর্ণতা কাঁপছে। রুমের সেন্টারে ছোপ ছোপ রক্ত। কিছু রক্ত একটা জায়গায় লম্বা হয়ে লেপ্টে আছে। মনে হচ্ছে কাউকে টানতে-টানতে নিয়ে গেছে। পূর্ণতা নির্বাক দৃষ্টিতে রোবটের মতো দাড়িয়ে পরলো। কান্না, ভয়, চিৎকার সব এক লহমায় ভুলে গেলো। উচুঁ করে রাখা হাতটা ধপ করে নিচে পরলো তখন। ফোনটা ধীরে-ধীরে হাত থেকে ছেড়ে দিলো। মৃদ্যু আওয়াজে পায়ের কাছে ফোনটা পরে যেতেই নিস্তেজ পরিবেশে আবদ্ধ হয়ে গেলো পূর্ণতা। সময়ের কাটা কয়েক মিনিট ওভাবেই চলে গেলো, কিন্তু পূর্ণতা আর আগের মতো অস্থির হয়ে উঠলো না। ধীরে-ধীরে পা ফেলে রক্তিম স্থানটার দিকে এগুলো। চোখের কাছে স্থানটা এগুতে-এগুতে একপর্যায়ে ঠিক পায়ের কাছে আটকে গেলো। চোখ নিচু করে রক্তমাখা ফ্লোরে দৃষ্টি ছুড়লো। আকাশ চিড়ে বিদ্যুপৃষ্ট হতেই বিকট শব্দ করে জানালা দিয়ে আলো এসে আবার ঘুটঘুটে অন্ধকার ছেয়ে গেলো। পূর্ণতা একটুও নড়লো, শব্দ করলো না, চলেও গেলো না। হঠাৎ মনেহলো কেউ ওর শাড়িটা পেছন থেকে ধরেছে। কাধের কাছে আচঁলটায় মৃদ্যু টান লাগছে। কানে কারো চুপিচুপি আসার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। বৃষ্টির কারনে মনের ভ্রম ভেবে পূর্ণতা সেদিকে মনোযোগ দিলো না ঠিকই, কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের মাথায় কোমরে হাতের স্পর্শ পেলো পূর্ণতা। আকস্মিকভাবে শিউরে উঠে সাথেসাথে মাথা নুয়ালো। দেখার জন্য রুমে আলো নেই, বাইরের বিদ্যুপৃষ্ঠের জন্য অপেক্ষা করতেই ততক্ষণে হাতটা কোমর ছেড়ে পেটের উপর অস্তিত্ব বোঝালো। ঠিক ওই সময় বাইরে থেকে বিদ্যুপৃষ্ট হতেই রুম আলোকিত হয়ে হাতটার গড়ন দেখা গেলো। ঢোক গিলতেই মাথা সোজা করে হাতটার উপর নিজের হিম হওয়া কম্পিত হাতটা রাখলো। ওমনেই কানের কাছে শিহরণ জাগিয়ে ঠান্ডা সুরটা যেনো এলো,

– হাত এতো ঠান্ডা কেন?

শীতের প্রবলতা এবং ঠান্ডা কথা দুটোই দারুণভাবে আক্রমণ করলো ওকে। পূর্ণতা অন্তঃসারশূন্য হয়ে নেতিয়ে পরলো ফ্লোরে। নেত্রপল্লব বন্ধ হয়ে গেলো আপনা-আপনি। কোনোকিছু দেখতে পেলো না স্পষ্টরূপে।

চলমান .

#FABIYAH_MOMO .

বিশেষ নোটবার্তা : শেষ পর্বটি নিয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ যেই সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছিলো সেটা দূর করার জন্য নতুন করে পোস্ট করা হলো। এবং, দ্বিতীয় অংশটি সন্ধ্যায় পোস্ট করা হবে ❣

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here