তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই পর্ব_৩২

0
2473

#তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৩২

মাশরাত পেছনে ফিরলো। আধুনিক্তা দাঁড়িয়ে আছে। মাশরাত বিরক্ত হলো। তাবাসসুমের বাবার দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপনি আমার সাথে ইয়ার্কি করছেন?”
তাবাসসুমের বাবা জবাব দিলো না। মাশরাত তাবাসসুমের মায়ের দিকে তাকাল। উনার হেটে গিয়ে বলল-
“আমি আপনাকে খুব সম্মান করি আন্টি। একমাত্র আপনি-ই ছিলেন যে আমার উপর বিশ্বাস করেছিলেন। আপনি জানতেন আমি লোভী মানুষ ছিলাম না। তাই আপনি আমাকে বলেছিলেন শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করতে। আমি চেষ্টা করেছি। কিন্তু শেষে আপনিও আমাকে অবিশ্বাস করলেন।”
তাবাসসুমের মা মাথা নিচু করে ফেললেন। মাশরাত আবার বলল-
“আচ্ছা যা হওয়ার হয়েছে। আমি এখন বিবাহিত। আমার স্ত্রীকে আমি অনেক ভালোবাসি। তাই আপনারা ভাববেন না আমি তাবাসসুমের দাবী করবো। আমি শুধু তার থেকে একটা প্রশ্নের জবাব চাই। তাকে প্লিজ বলুন একবার আমার সাথে দেখা করবে।”
তাবাসসুমের বাবা বললেন-
“তোমার প্রশ্নের জবাব আমাদের কাছেই আছে। কিন্তু তার আগে একটা বিষয় তোমার জানা জরুরি।”
মাশরাত আগ্রহ দৃষ্টিতে তাকাল তাবাসসুমের বাবার দিকে। তাবাসসুমের বাবা হেটে গিয়ে আধুনিক্তার সামনে দাঁড়াল। আধুনিক্তা হাসিমুখে উনাকে জড়িয়ে ধরলেন। তাবাসসুমের বাবা আধুনিক্তার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞেস করলেন-
“আমার মামণি ভালো আছে?”
“আমি একদম ভালো আছি বাবা। কিন্তু পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে না বেশীক্ষণ ভালো থাকবো।”
“তোমার বাবা আছে তো। ভয় পেতে হবে না। সত্য লুকিয়ে রেখে লাভ নেই। আমার সাহসী মেয়ে তুমি তাই না?”
আধুনিক্তা তাবাসসুমের বাবার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল। মাশরাত তব্দা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাবাসসুমের বাবা একমাত্র উনার মেয়েকেই মামণি ডাকতেন। তার মাথা কাজ করছে না। কি সম্পর্ক থাকতে পারে তাদের। তাবাসসুমের বাবা মাশরাতের দিকে হেটে আসলেন। মাশরাতের বরাবর দাঁড়িয়ে বললেন-
“তোমাকে জানিয়ে রাখি, যে তোমার বিয়ে করা স্ত্রী সে-ই আমাদের মেয়ে।”
“দেখুন, আমার মাথা একদম কাজ করছে না। তাই ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে না বলে সোজাসুজি বলুন।”
“বলবো, একদম প্রথম থেকে বলবো।”
“বলুন, আমি প্রস্তুত আছি আপনি বলুন।”
তাবাসসুমের বাবা ঢোক গিললেন। উনার গলা এখনই ধরে আসছে। কোনো মতো নিজেকে সামলে নিয়ে বলা শুরু করলেন।

অতীতের অংশ……
তাবাসসুমকে সকাল থেকে বাবা মা দেখে নি। মেয়েটা ঘর থেকে বের হয় নি আজ। ড্রইংরুমের সোফায় বসে বাবা ছিলেন। চা খেয়ে কাজে বের হবেন। তাবাসসুমের মা চা নিয়ে এসে টি-টেবিলে রাখলো।
“মেয়েকে গিয়ে ডাকো। অনেক হয়েছে আর ভালো লাগছে না।”
“হয় তো ওর মন খারাপ। তুমি ওর মোবাইলটা কেন নিলে?”
“কারণ আমি চাই না ও সেই ছেলেটার সাথে যোগাযোগ করুক।”
মা কিছু বললেন না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। হঠাৎ নুপুরের শব্দ আসলো। তাবাসসুম বাহিরে কোথাও যেতে হলে নুপুর পড়ে। বাসায় পড়ে না কারণ বাবা মা পছন্দ করে না। মা বাবা দু’জনই মেয়েকে দেখে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। তাবাসসুম এসে বলল-
“আম্মু আব্বু আমি তাহলে আসি। সন্ধ্যার মধ্যে ফিরে আসবো ওয়াদা রইল।”
“কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
“কোথায় যাচ্ছি মানে? আম্মু তুমি আব্বুকে কিছু বলো নি?”
মা কনফিউজ হয়ে গেলেন। তাবাসসুমের কথা উনার মাথার উপর দিয়ে গেল। তাবাসসুম মাকে চোখের ইশারায় বলল তার কথার তালে তাল মিলাতে।
“আম্মু তুমি ভুলে গেলে আমি তোমাকে বলেছিলাম একটা বান্ধবীর বিবাহ বার্ষিকীতে যাব।”
“ও হ্যাঁ, আমি ভুলে গিয়েছিলাম মামণি। আমার ডায়াবেটিসের ঔষধ খেয়ে ঘুমাতে হয় জানোই তো। ঘুম থেকে উঠলে অনেক কথা-ই ভুলে যাই।”
“আচ্ছা সমস্যা নেই। এখন আমি যাই।”
বাবা আবার বলল-
“তোমার সাথে প্রমাণ আছে তুমি তোমার বান্ধবীর অনুষ্ঠানে যাচ্ছো?”
“আব্বু তুমি আমাকে সন্দেহ করছো?”
“তোমার উপর আমার বিশ্বাস যতটুকু ছিল তাও শেষ।”
“ঠিক আছে, উঠো তৈরী হও। তোমরাও আমার সাথে যাবে।”
“তুমি ভালো মতমত জানো আমার গার্মেন্টস যেতে হবে কর্মচারীদের বোনাস দিতে।”
“কাল দিয়ে দিও, আজ তো মেয়ের উপর সন্দেহ করছো। তাই সন্দেহ দূর করার জন্য তোমাকে আমার সাথে যেতেই হবে।”
“হয়েছে হয়েছে, তুমি আমার একমাত্র মেয়ে বলে বিশ্বাস করলাম। সন্ধ্যার মধ্যে আমি তোমাকে বাসায় চাই।”
“ওকে আব্বু ওকে”
তাবাসসুম গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। মিথ্যে কথা বলার জন্য তার খুব কষ্ট হচ্ছে। বাবাকে ছেড়ে মাকে জড়িয়ে ধরলো। মা জানে না মেয়ে সারাজীবনের জন্য চলে যাচ্ছে। উনি মনে করছেন শুধু দেখা করতে যাচ্ছে বিয়ে করবে সেটা জানে না। তাবাসসুম বাবা মাকে বিদায় দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে পরলো।

বর্তমানে…..
“তারপর? তারপর কি হলো বলুন।”
“তারপর কি হলো এটা তোমাকে উনি বলবেন।”
মাশরাত আধুনিক্তার বাবার দিকে তাকাল। বাবা শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মাশরাত বাবার দিকে হেটে গিয়ে বলল-
“বাবা, উনি বলছেন আপনি বলবেন পরে কি হয়েছিল। প্লিজ বলুন।”
আধুনিক্তার বাবা এক নজর আধুনিক্তাকে দেখে আবার নিজের স্ত্রীর দিকে তাকালেন। তারপর মাশরাতের দিকে তাকিয়ে বললো-
“আমি সে..সেদিন অফিসে ছিলাম। হঠাৎ আব্বুর কল আসে। আব্বু আ..আমাকে বলে খেলতে গিয়ে আ..আধুনিক্তা ব্যাথা পে..পেয়েছে। সে প্রায় সেন্সলেস। আমি যেন পা..পাগল হয়ে গিয়েছিলাম এ..এসব শুনে।”
“আপনার কথাগুলো বাজছে কেন বাবা? নিশ্চয়ই আপনি বানিয়ে বলছেন কথাগুলো।”
“না আমি একদম সত্যি বলছি বিশ্বাস করো।”
“ঠিক আছে বলুন।”
“আমি তারাহুরো করে অফিস থেকে গাড়ি নিয়ে বের হই। হসপিটাল যাওয়ার পথে আমার হাতে একটা রিকশার এক্সিডেন্ট হয়ে যায়। রিকশাচালক কম আহত হলেও যাত্রী খুব বেশী আহত হয়। আর ওই যাত্রী আর কেও নয় তা..তাবাসসুম ছিল।”
মাশরাত হাতমুঠো শক্ত করে রেখেছে৷ আধুনিক্তার বাবা মাথা নিচু করে ফেলল। মাশরাত একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে বলল-
“তার মানে তাবাসসুম সেদিন কাজী অফিস যাওয়ার জন্য বের হয়েছিল। কিন্তু ও পৌছাতে পার নি সেখানে। এরপর কি হয়েছে? কেন উনি বার বার আধুনিক্তাকে তাবাসসুম বলছে। প্লিজ আমাকে সব খুলে বলুন।”
আধুনিক্তা ধীরপায়ে এগিয়ে এসে মাশরাতের বরাবর দাঁড়াল।
“এখন তোমাকে যা বলার আমি বলবো।”
মাশরাত আধুনিক্তার দিকে তাকিয়ে রইলো। আধুনিক্তা চোখের পানি মুছে বলা শুরু করলো।
“আমার যখন জ্ঞান ফিরে নিজেকে হসপিটালে পাই।”

অতীতের অংশ…..
আধুনিক্তা ধীরে ধীরে চোখ খুললো। চোখ খুলে পাশে মাকে দেখতে পেল। মা চুপচাপ মাথা নিচু করে বসে আছে। আরমান তখন দু বছরের বাচ্চা। দাদী আরমানকে ফিডারে দুধ পান করাচ্ছে। আধুনিক্তা ধীরে ধীরে হাত বাড়িয়ে মায়ের হাত ধরলো। হঠাৎ আধুনিক্তার ছোঁয়া পেয়ে মা অশ্রু ভরা চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন। আধুনিক্তা তাকিয়ে আছে মায়ের দিকে৷ মা খুশীতে আত্মহারা। উনার গলা দিয়ে শব্দ বেট হচ্ছে না। আধুনিক্তার মাথায় হাত রেখে কপালে চুমু বসালো। আবার সোজা হয়ে বসে দাদীকে জানালো আধুনিক্তার কথা। দাদী দ্রুত চেয়ার ছেড়ে আধুনিক্তার বিছানার দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়ালেন। আধুনিক্তা মুচকি হাসলো দাদীকে দেখে। দাদী ইচ্ছে মতো আদর করে দিলেন নাতনিকে।
“আম্মু, আব্বু আর দাদাই কোথায়?”
মা চুপ হয়ে গেলেন। উনি যেন ভয় পেয়ে গেলেন এই প্রশ্নটা শুনে। আধুনিক্তা ভ্রু কুঁচকে বলল-
“কি হলো তুমি চমকে গেলে কেন?”
“ক..কই না তো”
“আম্মু উনারা কোথায়?”
“আছে মা আছে, দাদাই মসজিদে গিয়েছেন তোমার নামে দোয়া পড়াতে। আর তোমার আব্বু অফিসে।”
“আমি অসুস্থ আর আব্বু অফিসে? আমি এটা কখনো বিশ্বাস করবো না। কোথায় আব্বু বলো।”
মা দাদীর দিকে তাকালেন। দাদীর ইশারায় বললেন এখন কিছু বলতে না।।মা কিছু না বলে উঠে দাঁড়ালেন। আধুনিক্তা মাকে ডাকলো কিন্তু মা জবাব দিলেন না। উনি গিয়ে ডাক্তারকে ডেকে আনলেন। ডাক্তার আধুনিক্তাকে দেখে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে দিলেন। কারণ আধুনিক্তা বাবা আর দাদাইকে না দেখে হাইপার হয়ে যাচ্ছে প্রশ্ন করতে করতে। আধুনিক্তা ঘুমিয়ে পরলো কিছুক্ষণের মধ্যেই।
“মা আপনি ওর খেয়াল রাখুন আমি পুলিশ স্টেশন গিয়ে দেখি কি হচ্ছে ওখানে।”
“তোমার শ্বশুর আব্বু তো গিয়েছে। তুমি চিন্তা করো না সকালের মধ্যেই জামিন পেয়ে যাবে।”
“আমার খুব ভয় করছে। সেই মেয়েটার বাবা অনেক রেগে আছেন। যদি জামিন বাতিল করিয়ে দেন উনি?”
“তা জানি না, দোয়া করি মেয়েটা সুস্থ হয়ে যাক।”
“ডাক্তার বলেছে মেয়েটা খুব বেশী আহত হয়েছে। বেঁচে গেলেও পাগল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ মাথায় লেগেছে ওর।”
দাদী জবাব দিলেন না। মা কিছুক্ষণ পর হসপিটাল থেকে বেরিয়ে পুলিশ স্টেশন চলে গেল। সেখানে তাবাসসুমের বাবা ছিল৷ উনি পুলিশকে বার বার বলছেন যেন এই মানুষটা জামিন না পায়৷ আধুনিক্তা মা গিয়ে উনার স্বামীর পাশে দাঁড়ালেন। আধুনিক্তার বাবা রাগী কন্ঠে বললেন-
“তুমি এখানে কি করছো?”
“মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে।”
“সত্যি বলছো?”
“হ্যাঁ, তোমাকে খুঁজছে। ডাক্তার বলেছে ওর হাইপার হওয়া চলবে না। তাই ঘুমের ইনজেকশন দিয়েছে।”
“ও সুস্থ থাকলেই চলবে। তুমি ওর খেয়াল রেখো।”
“আমি একা পারবো না, তোমাকে আসতেই হবে।”
“আমার জামিন বাতিল হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশী। আমি জানি না এই কেস থেকে বের হতে পারবো কিনা।”
আধুনিক্তার মা কিছু বলল না। তাবাসসুমের বাবার দিকে হেটে গেলেন। তাবাসসুমের বাবা মুখ ঘুরিয়ে ফেললেন। রাগে উনার গা জ্বলছে। আধুনিক্তার মা বললেন-
“ভাই, আমি ডাক্তারদের সাথে কথা বলেছি। উনারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছে আপনার মেয়েকে বাঁচানোর। এটা কিন্তু হিট এন্ড রান কেস না। কারণ উনি কিন্তু এক্সিডেন্ট করে পালিয়ে যায় নি। এক্সিডেন্ট উনি ইচ্ছে করে করেনি।”
“শুনুন, এই এক্সিডেন্টের কারণে আজ আমার পরিবারের এই অবস্থা। আমার মেয়ের জ্ঞান ফিরেনি। ১৫ ঘন্টা হয়ে গিয়েছে ওর এক্সিডেন্টের। ডাক্তার কি বলেছে শুনেন নি? জ্ঞান না ফিরলে আমার মেয়ে প্যারাইলজড হয়ে যাবে। মরেও যেতে পারে আমার মেয়ে। আপনাদেরও একটা মেয়ে আছে। সেও এখন অসুস্থ। একবার ভেবে দেখুন আপনার মেয়ের কিছু হয়ে গেলে আপনারা কি করবেন? আমি আর আমার স্ত্রী আমাদের মেয়ের জন্যই তো বেঁচে আছি। তার কিছু হয়ে গেলে আপনার স্বামীকে আমি ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিব।”
“এইভাবে বলবেন না দয়া করে। আমি ওয়াদা করছি আপনার মেয়ের কিছু হতে দিব না।”
“আপনি না তো ডাক্তার না ভবিষ্যত জানেন৷ তাই এমন ওয়াদা করবেন না দয়া করে।”
আধুনিক্তা মা শব্দহীন কাঁদলেন। আধুনিক্তার বাবা এসে স্ত্রীর হাত ধরে বললেন-
“তুমি চিন্তা না করে আধুনিক্তার কাছে যাও। আর উনার মেয়ে, মানে তাবাসসুম। ওরও খেয়াল রেখো। উনার স্ত্রী না-কি মেয়ের অবস্থা দেখা পর থেকে চুপচাপ বসে আছেন।”
“তুমি তারাতাড়ি ফিরো, মেয়েকে সামলাতে পারবো না আমি।”
আধুনিক্তার বাবা মুচকি হেসে স্ত্রীর চোখের পানি মুছে দিলেন। মা পুলিশ স্টেশন থেকে বের হয়ে হসপিটাল চলে আসলেন।

সকাল ৯ টা, কারো ডাকে মায়ের ঘুম ভাঙলো। উনি চেয়ারেই আধুনিক্তার পাশে শুয়ে ছিলেন। মাথা তুলে স্বামীকে দেখে দাঁড়িয়ে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। আধুনিক্তার বাবা হাসিমুখে স্ত্রীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
“এখন কান্না থামাও, মেয়ে কেমন আছে?”
মা উনার স্বামীকে ছেড়ে চোখের পানি মুছে বললেন-
“সুস্থ আবার সুস্থ না, আধুনিক্তার হৃদপিণ্ডের উপর আঘাত লেগেছে। সেখানে কিছুটা ঘা সৃষ্টি হয়েছে। সেটার অপারেশন করতে হবে। কিন্তু অপারেশন করা খুব রিস্ক হবে।”
“ঔষধের সাহায্যে ঘা ঠিক করা যাবে না।”
“ঘা ঠিক হবে কিন্তু হার্ট দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এমনও হতে পারে ভবিষ্যতে ওর হার্ট ট্রান্সফার করা লাগবে।”
“এ কেমন পরীক্ষা দিচ্ছি আমরা। সেখানে সেই পরিবারও খুব কষ্টে আছে। তাবাসসুম প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে সারাজীবনের জন্য। এর চিকিৎসা দেশে নেই। ডাক্তার বলছে সিঙ্গাপুর যেতে হবে। সেখানে চিকিৎসা আছে। কিন্তু উনাদের পরিস্থিতি ভালো হলেও চিকিৎসার জন্য খুব খরচ হবে। উনারা ভেবে নিয়েছে দেশে যা কিছু আছে সব বিক্রি করে চলে যাবে সিঙ্গাপুর। আমি বলেছি তাবাসসুমের চিকিৎসার খরচ আমি দিব। কিন্তু উনারা না বলেছেন। অনেক রেগে আছে আমার উপর।”
মা ফুপিয়ে কেঁদে উঠলেন।
“আরে পাগল কাঁদছো কেন? আমি কোনো না কোনো ভাবে উনাদের মানিয়েই নিব। ইনফ্যাক্ট, আমি ভেবেছি আধুনিক্তাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর চলে যাব। সেখানেই দুজনের চিকিৎসা হবে।”
“হ্যাঁ ডাক্তার বলেছে সেখানে প্রফেশনাল সার্জনরা রয়েছে। সেখানে গিয়ে সার্জারী করালে আধুনিক্তা সুস্থ হতে পারে।”
“তাহলে আর দেরি কিসের? চলো সিঙ্গাপুর চলে যাই আমরা।”
আধুনিক্তার বাবা আর দাদাই মিলে খুব কষ্টে তাবাসসুমের বাবাকে মানায় চিকিৎসার খরচ উনারা দিবে বলে। বাবা কিছুতেই রাজি হচ্ছিলেন না। ২ দিনের মধ্যে বাড়ি-ঘর বিক্রি করে ফেলে। কিন্তু চিকিৎসার জন্য টাকা কম পরছিল। এক সময় ভেবে নেয় আধুনিক্তার বাবার অফারে রাজি হয়ে যাবে। মেয়ে একবার সুস্থ হয়ে গেলে অন্য চাকরি করে হলেও সব টাকা শোধ করে দিবে। ১ সপ্তাহর মধ্যে উনারা সবাই সিঙ্গাপুর চলে যায়। আধুনিক্তা সিটে হেলান দিয়ে বসে ছিল। তার বুক ব্যাথা করছে খুব। সে খেয়াল করলো তার সামনে একটা মেয়ে বসে আছে চুপচাপ। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে অবাক হলো। মেয়েটা চোখের পর্যন্ত ফেলছে না। তার পাশে বসা এক ভদ্রমহিলা তার সিট হালকা নিচু করে দিলো। মেয়েটা একদমই নড়ছে না। যেন সে একটা পুতুল। আধুনিক্তা মাকে ডাকলো।
“কিছু বলবে?”
“ওদিকে একটা মেয়ে বসে আছে। আমি খেয়াল করেছিলাম এয়ারপোর্টে উনি হুইলচেয়ারে বসে ছিল। আব্বু উনাদের সাথে কথাও বলেছিলেন। আচ্ছা ওই আপুটা চুপচাপ কেন? উনাকে নড়তে পর্যন্ত দেখিনি আমি।”
“ওর নাম তাবাসসুম, ওর পুরো বডি প্যারালাইজড হয়ে গিয়েছে। আধুনিক্তা, তোমাকে একটা কথা বলি। তোমার আ..আব্বু ভুলে ওর এক্সিডেন্ট করে ফেলেছে। তুমি হসপিটালে জানার পর উনার মাথা ঠিক ছিল না।”
“তার মানে আপুর চিকিৎসা করাতে নিয়ে যাচ্ছে আব্বু?”
“হ্যাঁ, দোয়া করো আম্মু যাতে ও একদম সুস্থ হয়ে যায়। এই মানুষটার কিছু হয়ে গেলে ওর বাবা মা বাঁচতে পারবে না। যেমন তোমার কিছু হয়ে গেলে আমরা সহ্য করতে পারবো না তেমন তার বাবা মা-ও।”
“চিন্তা করো না আম্মু, আপুর কিছু হবে না। আমরা কি এক হসপিটালেই থাকব?”
মা মুচকি হেসে মাথা নাড়াল
সিঙ্গাপুর পৌঁছে ডাইরেক্ট হসপিটাল চলে যায়৷ আধুনিক্তা আর তাবাসসুমকে এডমিট করিয়ে পাশাপাশি কেবিনে রাখা হয়। আধুনিক্তার বাবা সেখানে বাড়ি ভাড়া নিয়ে নেয়। তাবাসসুমের বাবা মাকেও উনারা নিজের সাথে সেই বাসায় নিয়ে যায়। ১ সপ্তাহর মধ্যে সবকিছু সেটেল করে নেয়। আধুনিক্তা আর তাবাসসুমের চিকিৎসা ডাক্তাররা আগেই শুরু করে দেয়। আধুনিক্তা ধীরে ধীরে সুস্থ হতে থাকে। তার বুকের ঘা ঔষধের মাধ্যমেই ঠিক হতে থাকে। কিন্তু ডাক্তাররা তাবাসসুমের চিকিৎসা করে চিন্তায় ডুবে যাচ্ছিলেন। কোনো মতেই মেয়েটাকে ১% ও সুস্থ করতে পারছিলেন না। দিন দিন তার অবস্থা বিগড়ে যাচ্ছিল। তাবাসসুমের মা মেয়ের পাশে বসে ছিলেন গালে হাত দিয়ে। তখনই কেও দরজা খুলে প্রবেশ করে। উনি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে আধুনিক্তা। মেয়েটাকে দেখলে উনার মায়া হয়। মেয়েটা তো তাবাসসুম থেকে ২/৩ বছরের ছোটো হবে৷ তাবাসসুমের মা ইশারায় কাছে আসতে বলল। আধুনিক্তা এগিয়ে এসে তাবাসসুমের পাশে দাঁড়াল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল-
“আন্টি, আপু একদম আপনার মতো দেখতে তাই না?”
“হ্যাঁ, সবাই বলে তাবাসসুম আমার মতো দেখতে। তুমি আসলে কেন? ডাক্তার বলেছে তোমাকে রেস্ট নিতে।”
“ঘুমিয়ে থাকলে আমার পিঠ ব্যাথা হয়ে যায়। আম্মুর থেকে পারমিশন নিয়ে তারপর এই কেবিনে এসেছি।”
“তুমি বসো দাঁড়িয়ে থেকো না।”
আধুনিক্তা বসলো তাবাসসুমের পাশে। তাবাসসুমকে দেখে তার ভীষণ মায়া লাগছে। আধুনিক্তার তাবাসসুমের মায়ের দিকে তাকাল। উনার দৃষ্টিতে আধুনিক্তা অনেক কষ্ট খুঁজে পেল। হঠাৎ আধুনিক্তাকে দেখে তাবাসসুমের মা মুচকি হাসলো।
“কিছু বলবে তুমি?”
“তিন মাস ধরে আপু এইভাবেই শুয়ে আছে। আপনার খুব কষ্ট হয় তাই না?”
তাবাসসুমের মা জবাব দিলেন না। সত্যি তো কষ্ট হয়। কিন্তু কি করবে? ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে।
“আমার আব্বুকে মাফ করে দিন আন্টি।”
তাবাসসুমের মা মুচকি হেসে বললেন-
“আমি অনেক আগেই মাফ করে দিয়েছি তোমার আব্বুকে। জানো তো মা ভাগ্যে যা থাকে তাই হয়। তোমার আব্বুর হাতে না হলে অন্য কারোর হাতে হতো।”
“আপনার মতো করে সবাই যদি ভাবতো। অন্য কারোর মেয়ের এক্সিডেন্ট হলে হয় তো উনি আমার আব্বুকে মেরেই ফেলতেন।”
তাবাসসুমের মা হাসলেন। আধুনিক্তা তাবাসসুমের দিকে তাকিয়ে বলল-
“আপু, ডাক্তার বলেছে তুমি সব শুনতে পাও। আমাকেও কি শুনতে পাচ্ছো? আমার আব্বুর কারণে আজ তোমার এই অবস্থা হয়েছে। হতে পারে উনি ইচ্ছে করে করেনি কিন্তু। কিন্তু এক্সিডেন্ট তো হয়েই গিয়েছে। তুমি যখন সুস্থ হয়ে যাবে আমার সাথে রাগ করে থেকো না। আমাকে নিজের বন্ধু বানাবে তো?”
তাবাসসুম তাকিয়ে আছে। সে তার চোখের মণি পর্যন্ত নড়াতে পারছে না। আধুনিক্তা মুচকি হেসে উঠে দাঁড়াল। হয় তো তাবাসসুম একদিন সুস্থ হয়ে এই প্রশ্নের উত্তর দিবে।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here