তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই পর্ব_৩৩

0
2383

#তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৩৩

দেখতে দেখতে কেটে যায় ৩ বছর। আধুনিক্তা আগেই সুস্থ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু তার রেস্ট নেওয়া খুব প্রয়োজন। তাই দাদাই বলেছিলেন এখন ট্রাভেল করতে না৷ আধুনিক্তার মধ্যে একটা সমস্যা দেখা দেয়। তা হলো সে প্রায়ই অনেক কিছু ভুলে যায়। এমনটা কেন হয় ডাক্তার নিজেও বুঝতে পারছেন না। কিছুুদিন আগের ঘটনা আধুনিক্তা সবাইকে চিনছে কিন্তু নিজের নাম ভুলে গিয়েছিল। বিষয়টা আধুনিক্তার কাছে হাস্যকর মনে হলেও ডাক্তার বলেছে বিষয়টা ভবিষ্যতে সিরিয়াস কোনো রূপ নিতে পারে। তাবাসসুমকে বাসায় এনে ফেলা হয় হসপিটাল থেকে। একজন নার্স আর পরিবারের সদস্যরা মিলে তার খেয়াল রাখে। আধুনিক্তা প্রতিদিন তাবাসসুমের পাশে বসে কথা বলতো একা একা৷ ধীরে ধীরে তাবাসসুম ও আধুনিক্তার বাবা মায়ের মধ্যে সম্পর্ক গড়ে উঠে। আধুনিক্তার বাবা তাবাসসুমের বাবার সাহায্য করে সেখানে ব্যবসা শুরু করতে। উনি আর পারে নি আধুনিক্তার বাবার উপর রাগ করে থাকতে। এই তিন বছরে দুজনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠে। একদিন আধুনিক্তা তাবাসসুমের ঘরে বসে বই পড়ছিল। হঠাৎ তার নজর পড়ে ড্রয়ারে। ড্রয়ারটা হালকা খোলা। আধুনিক্তা উঠে গেল ড্রয়ারের দিকে। বন্ধ করার সময় সে একটা ডায়েরি দেখতে পায়। হাত বাড়িয়ে ডায়েরিটা নেয় আধুনিক্তা। তখনই তাবাসসুমের মা আসলেন।
“কিছু খুঁজছ আধু?”
“না আন্টি, ড্রয়ার খোলা ছিল।”
“হ্যাঁ আমি গাড়ির চাবি বের করার পর বন্ধ করতে ভুলে গিয়েছি।”
“আন্টি এই ডায়েরি কার?”
“তাবাসসুমের”
“আপু ডায়েরি লিখতো?”
“হ্যাঁ ওর কবিতা লিখার খুব শখ।”
“আমি কি কবিতাগুলো পড়তে পারি?”
তাবাসসুমের মা হেসে বললেন-
“এতে পারমিশন নেওয়ার কি আছে? পড়ো।”
আধুনিক্তা দ্রুত খাটে বসে ডায়েরি খুললো। প্রথম পৃষ্ঠায় লিখা-
“প্রথম দেখা, কিছুদিন দিন আগে একজন অচেনা মানুষের সাথে পরিচয় হলাম। জানি না কেন তার সাথে কথা বলার পর খুব আপন মনে হচ্ছিল। সে তার প্রতি কথায় একটি করে হাসি দিচ্ছিল। সত্যি মুগ্ধ হলাম কারো হাসি দেখে। আমি এই হাসির সাথে প্রতিদিন পরিচয় হতে চাই।”
আধুনিক্তা পৃষ্ঠা উল্টালো।
“দ্বিতীয় দেখা, আবার দেখা হলো তার সাথে। তার অসুস্থতার কথা শুনে আমার বেশ চিন্তা হয়েছিল। কিন্তু এতদিন তাকে দেখে ভীষণ ভালো লাগছে। আমার লিখা কিছু কবিতা আমি তাকে আবার পড়ে শোনালার৷ আমার মনে হচ্ছিল তার কবিতা ভালো লাগে নি। মিথ্যে প্রশংসা করছিল সে৷ কিন্তু তার মিথ্যে প্রশংসা-ই আমাকে কাবু করে ফেলছে।”
আধুনিক্তা মুচকি হাসলো৷ তাবাসসুমের দিকে এক নজর দিয়ে ভাবলো এই মানুষটা তাহলে কাওকে ভালোবাসে। তিন বছর হয়ে আসছে সে জীবিত লাশ হয়ে পড়ে আছে। তার মানে ছেলেটা কি আপুর অপেক্ষায় আছে? তাদের তো যোগাযোগ হয় নি৷ যদি আপুকে ভুল বুঝে? আধুনিক্তা আবার পৃষ্ঠা উল্টালো।
“এসএসসি এক্সাম শেষ, আমি বেশ মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। হয় তো গোল্ডেন এ প্লাস না পেলেও ভালো নাম্বারে পাশ করতে পারবো। আমি আমার স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। দুনিয়াতে যত মন অসুস্থ মানুষ আছে তাদের সবাইকে সুস্থ করতে চাই। সে মানুষটার সাথে আমার দেখা হয় প্রায়ই। সে আমাকে অনেক ভালো ভালো পরামর্শ দেয়। শুধু তাই না, আমার পড়াশোনাতেও অনেক সাহায্য করেছে। আমার পাশ করার পেছনে তার হাত-ই থাকবে।”
আধুনিক্তা ভাবছে সে মানুষটার নাম কি হতে পারে? নাম বা নাম্বার পেলে আধুনিক্তা তার সাথে যোগাযোগ করে জানাবে। এমনও তো হতে পারে সে মানুষটা আপুকে পাগলের মতো খুঁজে বেড়াচ্ছে। আধুনিক্তা পৃষ্ঠা উল্টালো।
“ডায়েরি লিখা আমার শখ না, কিন্তু তার সম্পর্কে লিখতে ভালো লাগে। তার রূপ ও গুনের বর্ণনা দিতে গেলে পুরো ডায়েরি শেষ হয়ে যাবে। কারণ সে মানুষটাই এমন, তার একটা বিষয় আমাকে খুব টানে। তা হলো তার এলোমেলো চুল। সবসময় চুলগুলো এলোমেলো হয়ে থাকে, শার্টের কলার উঁচু। হাতা কাটা গেঞ্জি পড়লে তার উপর শার্ট পড়বে। শার্টের সব বোতাম খুলে রাখবেন জনাব। শুধু তাই না, এলাকায় মস্তানিও করেন। আমি প্রায়-ই দেখি। সত্যি বলতে তার ব্যবহার খারাপ না। শুধু একটুখানি রাগী।”
আধুনিক্তা হেসে দিলো। তার সেই মানুষটার সম্পর্কে জেনে বেশ কৌতুহল জাগছে মনে। আরো জানতে ইচ্ছে করছে তার সম্পর্কে। পৃষ্ঠা উল্টালো।
“আজ আমার মন যেন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল। একটা মেয়ের হাত ধরে সে রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল। কে সে মেয়ে? তার প্রেমিকা? কেন মন মানতে চাইছে না? আমি চেষ্টা করছি তার মায়ায় না জড়ানোর। কিন্তু পারছি না। তার সাথে কথা বললেই যেন আমি হারিয়ে যাই। নিশ্চয়ই পরে দেখা হলে জিজ্ঞেস করবো মেয়েটা কে।”
মায়ের ডাকে আধুনিক্তার হুশ ফিরলো। ডায়েরি বন্ধ করে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মা দাঁড়িয়ে আছে।
“খেতে আসো”
“আমি এখন খাবো না”
“এইভাবে বলে না মা তোমার ঔষধ আছে।”
আধুনিক্তা তাবাসসুমের মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো-
“আন্টু আমি ডায়েরিটা নিই? পড়া হলে দিয়ে দিব।”
“জিজ্ঞেস করা লাগবে না নাও তুমি। আর একটা হয় তো ডায়েরি আছে সেটাও নিও। সব পৃষ্ঠায় শুধু কবিতা-ই কবিতা।”
আধুনিক্তা মুচকি হেসে মাথা নাড়াল। সে ভাবলো আন্টি হয় তো জানে না তাবাসসুম তার ভালোবাসার মানুষটার সম্পর্কে লিখেছে। জানলে অবশ্যই ডায়েরি নেয়ার পারমিশন দিতেন না। কারোর পার্সোনাল ডায়েরি পড়া ভালো না। কিন্তু আধুনিক্তা কি করবে? ডায়েরিতে লিখা প্রত্যেকটা কথা তার মন ছুঁয়ে ফেলেছে।

রাতে আধুনিক্তা বারান্দায় গেল ডায়েরি নিয়ে। ঘরের লাইট বন্ধ করে বারান্দার লাইট জ্বালালো। বারান্দার চেয়ারে বসে ডায়েরি খুলল আবার।
“আমি কি পাগল? কি ভাবলাম কি হলো। মেয়েটা তো তার আপন বোন হয়। ইশশ কত লজ্জার বিষয় তার বোনকে আমি কি না কি ভেবেছি৷ উপর ওয়ালা মাফ করুক। যাই হোক, আগামী ১ সপ্তাহর পর রেজাল্ট দিবে৷ ভয় করছে খুব। যদিও আজ সে হঠাৎ আমার হাত ধরে বলেছে আমি নিশ্চয়ই পাশ করবো। সে যেন আমার হাত না আমার মন ধরে ফেলেছে।”
আধুনিক্তা পৃষ্ঠা পরিবর্তন করলো।
“আজ তার সাথে ঘুরতে গিয়েছিলাম। দুজন মিলে আইসক্রিম খেয়েছি। সে না-কি আইসক্রিম অপছন্দ করে
কিন্তু আমার জন্য খেয়েছে। কেও আমার জন্য তার অপছন্দের খাবার খেয়েছে। আবারো মুগ্ধ করলো মানুষটাকে দেখে।”
পরের পৃষ্ঠা,
“রেজাল্ট দিয়েছে, বিশ্বাস হচ্ছে না আমি গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছি। আমার স্বপ্ন পূরণের আর একটা ধাপ পাড় করলাম। কলেজে এডমিশন নিব। সে আমাকে এমন এক কথা বলেছে যেটা শুনে আমার খুব লজ্জা করেছে। বলেছে সে আমাকে প্রতিদিন কলেজ নিয়ে যাবে আবার নিয়ে আসবে। জানি না এই সামান্য কথা আমাকে কেন লজ্জায় ফেলল। আমাদের সম্পর্ক এখন বন্ধুত্বে সীমাবদ্ধ। আমি জানি না ভবিষ্যতে আমাদের সম্পর্কের নাম কি হবে। কিন্তু আমার ওয়াদা রইল আমাদের সম্পর্কে কখনো অপবিত্র প্রবেশ করবে না।”
পরের পৃষ্ঠা,
“কলেজে এডমিশন নিয়ে নিয়েছি। বাসা থেকে কিছুটা দূর কলেজ। সেখানে বাবা যাতায়াত করেন না। তার সাথে দেখা করতে সুবিধা হবে। দিন দিন চোর হয়ে যাচ্ছি। বন্ধুর সাথে না-কি চুপি চুপি দেখা করতে হবে, ছি ছি।”
আধুনিক্তা ফিক করে হেসে দিলো। তার হাসি থামছে না। পরের পৃষ্ঠা উল্টালো।
“কলেজের প্রথমদিন ভালো গিয়েছে। কিন্তু সবচেয়ে ভালো গিয়েছে কলেজ শেষ হওয়ার পরের মুহূর্তগুলো। তার সাথে রমনা পার্ক গিয়েছিলাম। একটা বিষয় বেশ খারাপ লেগেছে তার কাছে মাত্র ২০ টাকা ছিল। তাই হেটে এসেছিল আমার কলেজে। আমি কিছুটা বকাঝকা করেছি তাকে। কেন সে কষ্ট করে রোদ দিয়ে হেটে আসলো। আমরা চাইলে ছাদে দেখা করতে পারতাম। থাক আর কি করার ছিল? মানুষটা তো খানিকটা পাগল। সে ২০ টাকা থেকে ১০ টাকার ঝাল মুড়ি কিনে খাইয়েছে আমাকে। সে সময়টায় দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী মেয়ে মনে হচ্ছিল নিজেকে। শেষে দুজন হেটেই বাসায় ফিরলাম।”
আধুনিক্তা মুখ লটকালো। এত সুন্দর ভালোবাসায় কেন নজর লাগলো? একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলে পরের পৃষ্ঠা উল্টালো।
“শেষ আমি, আজ তাকে দেখতে কোনো নায়ক থেকে কম মনে হচ্ছিল না। আমার ফ্রেন্ডরা তাকে পছন্দ করে না। কারণ তার গায়ের রং। আরে ওই মাথা মোটা গুলো জানে না সে আমার চোখে দেখা সবচেয়ে সুদর্শন যুবক। যার চেহারায় মায়া ভরপুর। আর আমি কি সুন্দর? গায়ের রং উজ্জ্বল হলেই সুন্দর হওয়া যায় না। তাকে বলেছিলাম আমি সাউথ ইন্ডিয়ান হিরো আল্লু অর্জুনকে খুব পছন্দ করি। সে সেই হিরোর চুলের স্টাইল করে শার্ট প্যান্ট পড়ে এসেছিল। প্রথমবার আমার ফ্রেন্ডরা তার প্রশংসা করেছে। এতেই বুঝা যায়, একটা মানুষকে যত্ন করলে সেও ফুলের মতো ঝলমলে উঠে।”
পরের পৃষ্ঠা,
“ভালো লাগছে না কিছু। আজ সারাদিন তার সাথে দেখা হয় নি। খুব চিন্তা হচ্ছে। সে সুস্থ আছে তো? চোখ ঠেলে পানি বের হতে চাচ্ছে কিন্তু আমি কাঁদবো না। আমার অভিমান হয়েছে তার উপর। সে কি জানে না আমার মন তার প্রতি খুব দুর্বল? না-কি জেনেও না জানার ভান করে? একবার দেখা হোক তার খবর আছে।”
পরের পৃষ্ঠা,
“আজ পুরো ১ মাস তার সাথে আমার দেখা হয় নি। তার সাথে দেখা না হলে আমার ডায়েরি লিখতে মন চায় না। কিন্তু আমি আর পারছি না সহ্য করতে। মনের কথা কারো সাথে শেয়ার না করতে পারায় দম বন্ধ হয়ে আসছে। আজকাল হঠাৎ হঠাৎ কান্না আসে। রাতে না কান্না করলে মন হালকা হয় না। সে কি আমাকে ভুলে গেল?”
আধুনিক্তার মন খারাপ হলো। পরের পৃষ্ঠা উল্টে পড়তে শুরু করলো-
“ইচ্ছে করছে ভারী পাথর দিয়ে নিজের মাথা ফাটিয়ে ফেলি। আমি এত নেগেটিভ ভাবি কেন? বেচারা তো ৪০ দিনের জন্য জামাতে গিয়েছিল। আল্লাহ আমাকে মাফ করুক। তাকে দেখে আমি আবার মুগ্ধ হয়েছি। এই ৪০ দিনে তার চাপ দাঁড়ি গজিয়েছে। তাকে দেখতে ইদানীং বেশ লাগে। আমি আমার পছন্দের উপর গর্বিত, হা হা হা।”
আধুনিক্তা মুচকি হাসলো। এই প্রেমের কাহানী পড়ে সে যেন হারিয়ে যাচ্ছে। যত পড়ছে তত আগ্রহ জাগছে পড়ার। পরের পৃষ্ঠা উল্টালো।
“ভ্যালেনটাইন্স ডে, আমি কল্পনাও করি নি এত বড়ো সারপ্রাইজ পাবো। সে আমাকে প্রপোজ করেছে। তার মুখ থেকে ভালোবাসি কথা শুনে আমি আনন্দে কেঁদে উঠেছি। প্রথমবার তাকে জড়িয়ে ধরে খুব কেঁদেছি। যেন জনম জনম ধরে যা চেয়েছি তা আজ পেয়েছি। ভেবেছি আব্বুকে না হলেও আম্মুকে সব জানিয়ে রাখবো। কারণ হঠাৎ উনারা জানলে আমি তাকে পাবার রাস্তা হারিয়ে ফেলব। ভবিষ্যতে আম্মু আমাকে সাহায্য করতে পারবে। এই মানুষটাকে ছাড়া আর কাওকে ভালোবাসবো না। এই ওয়াদা আমি নিজেকে করলাম।”
পরের পৃষ্ঠা,
“আজ আমি অনুভব করেছি আমার শ্রেষ্ঠ অনুভূতি। আমি সবাইকে বলতে চাই, বৃষ্টি অনুভব করে দেখো। সেটা তোমার অনুভব করা শ্রেষ্ঠ অনুভূতি হবে। বিকজ রেইন ইজ দ্যা মোস্ট বিউটিফুল পার্ট অফ নেইচার। আই এম ইন লাভ এগেইন এন্ড এগেইন এন্ড এগেইন। তার সাথে আমি বৃষ্টিতে ভিজেছি। সে হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খাচ্ছিল আমার কান্ড দেখে। আমি অবুঝ নই, আমি ইচ্ছে করে তার সামনে বাচ্চামি করি। যাতে সে আমাকে বকাঝকা করে। তার মুখে তুই শব্দটা আমার পছন্দ। আমিও মাঝেমধ্যে তুই করে বলি। তারও না-কি ভালো লাগে আমি তুই করে বললে। সম্পর্কে ভালোবাসা থাকলে সব শব্দে স্যাটিস্ফাই হওয়া ভালো। এতে সম্পর্ক টিকে থাকে।”
পরের পৃষ্ঠা,
“তার সাথেই আমার সব সময় কেটে যায়। ডায়েরি পর্যন্ত লিখতে পারি না। কারণ মন চায় না ডায়েরিতে অনুভূতি লিখতে। কিছু কিছু স্মৃতি হৃদয়ের গহীনে থাকাই ভালো। আমাদের সম্পর্কের ৮ মাস চলছে। দুজনই যার যার পড়া নিয়ে ব্যস্ত আছি। সে মাস্টার্স ডিগ্রী নেয়ার পর আমরা বিয়ে করবো। অবশ্যই দুই পরিবারের সম্মতি থাকবে আমাদের বিয়েতে। সে বলেছে তার পরিবারকে আমার সম্পর্কে জানাবে। আমি না করেছি, কারণ আমার ভয় করছে।”
পরের পৃষ্ঠা,
“অবাক হলাম, পাগলটায় সবাইকে বলে দিয়েছে আমাদের সম্পর্কে। তার পরিবারের সাথে দেখা করলাম আজ। এত ভালো কেন তারা? যাক, একটা বোঝা মন থেকে নামলো। তার পরিবার রাজি। এখন শুধু আমার বাবা মাকে মানাতে হবে।”
পরের পৃষ্ঠা,
“দ্বিতীয় বর্ষের পড়াশোনা চলছে আমার। আজকাল তার ব্যবহার আমাকে চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। কথায় কথায় রেগে যায়। খুব ভয় করছে আমার। সে কি পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে? আমি তাকে বলেছি বিয়ের আগে আমি তার ঠোঁটে চুমু দিতে পারবো না। কারণ আমাদের ভবিষ্যত এক না হলে আমার মনে একটা দাগ রয়ে যাবে। আমি খুব সেনসিটিভ মানুষ। কথায় কথায় ইমোশনাল হয়ে যাই আমি। আচ্ছা সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার জন্য চুমুর কেন প্রয়োজন হবে? তাকে আমি সবার থেকে আলাদা ভেবেছিলাম। হয় তো এটাই আমার ভুল হয়েছে।”
আধুনিক্তা কলিজার বা পাশ মোচড় দিয়ে উঠলো। তার মনে হচ্ছে ঘটনাগুলো তার চোখে ভাসছে। এই সম্পর্ক ভেঙে গেলে আধুনিক্তা কাঁদতে কাঁদতে শেষ হয়ে যাবে। পরের পৃষ্ঠা উল্টালো।
“আজ তাকে কাঁদতে দেখেছি। আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। এতদিন তার খিটখিটে মেজাজ থাকার কারণ ছিল তার দূর সম্পর্কের এক চাচা। তার মা উনার থেকে কিছু টাকা ধার নিয়েছিলেন। সেটা নিয়েই ঝামেলা হয়েছে। সে মানুষটা না-কি তার মাকে খুব অপমান করেছিল। তাই আর রাগ মাথায় চড়ে ছিল। সে টিউশনি খুঁজছে, টাকা যেভাবেই হোক শোধ করতে চায় সে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে তার জন্য।পাগলটাকে বলেছিলাম আমার থেকে টাকা নাও। কিন্তু ও নিবে না। নিজের যোগ্যতায় ঋণ শোধ করবে। খুব ভালো লেগেছিল তার এই জেদ দেখে। আর আমি জানি সে পারবে ঋণ শোধ করতে।”
পরের পৃষ্ঠা,
“আব্বু প্রথমবার আমার গায়ে হাত তুলল। উনি আমাদের একসাথে দেখে ফেলেছেন রাস্তায়৷ আমি সেটার ভয় পাচ্ছি। কারণ আমি জানি আব্বুকে মানাতে পারবো। আম্মু আগের থেকেই সব জানে তাই আমি নিশ্চিন্ত। কিন্তু আমার মোবাইলটা ভেঙে ফেলেছে আর বলেছে বাড়ি পরিবর্তন করে ফেলবে এক সপ্তাহর মধ্যে। এই এক সপ্তাহ আমার বাসা থেকে বাহির হওয়া নিষেধ। শুধু তাই না, আমি ছাদে পর্যন্ত যেতে পারবো না। আব্বুকে মানাবো কি করে আপাতত তা নিয়ে ভাবছি।”
পরের পৃষ্ঠা,
“আব্বুকে কোনো মতো মানালাম তার সাথে দেখা করতে। আমরা সেই বাসা ছেড়ে অন্য বাসায় শিফ্ট হয়েছি। আসার সময় তাকে দেখেছিলাম। সে আহত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিলাম। ইশারায় বলেছি নিজেকে শক্ত রাখতে। কারণ আমাদের ভেঙে পরলো হবে না। সে আগামীকাল আসবে, জানি না কি হতে চলেছে আগামীকাল।”
পরের পৃষ্ঠা,
“হার মানলাম আমি, আমি আর বাবাকে মানাতে পারবো না। তার সামনে বাবা আমাকে বেল্ট দিয়ে মেরেছে। সে প্রতিবাদ করেছে বলে তাকে যা তা শুনিয়েছে। সে না-কি টাকার লোভে আমার সাথে প্রেম করছে। হায় রে টাকা, তুই যার কাছে যাস সেই অন্ধ হয়ে যায়।”
আধুনিক্তার মনে হলো সেও এই কথাটার সাথে পরিচিত। তার বাবাও তো টাকার পেছনে অন্ধ। যদিও কখনো কাওকে ছোটো করে নি নিজেকে বড়ো রেখে। পরের পৃষ্ঠা উল্টালো।
“পালিয়ে যাব, হ্যাঁ আমি পালিয়ে যাব। তার সাথে অনেক দূর চলে যাব। আমি আর এই জাহান্নামে থাকতে চাই না। আব্বু আমার বিয়ে ঠিক করতে চাচ্ছে। আমি ওকে ছাড়া আর কাওকে বিয়ে করবো না। আব্বু কেন বুঝতে পারছে না সে ছাড়া আমি আর কাওকে বিয়ে করতে চাই না। হতে পারে সে দরিদ্র, কিন্তু সে খুব ভালো। আমি তাকে ভালোবাসি বলে বলছি না। সে সত্যি খুব ভালো মানুষ। ভালোবাসি আমি তাকে। খুব ভালোবাসি।”
আধুনিক্তা পরের পৃষ্ঠা চেক করে দেখে কিছু লিখা নেই। পরের সব পৃষ্ঠায় চোখ বুলালো। আর কিছু লিখা না পেয়ে মন খারাপ হলো। সেই ছেলেটার সম্পর্কে কোনো ডিটেইলস আধুনিক্তা পেল না। তারা ১০ দিন পর বাংলাদেশে ফিরবে। ভেবেছিল সেই মানুষটাকে খুঁজে বের করবে। কিন্তু এখন হয় তো সম্ভব না। তাবাসসুম যেভাবে ছেলেটার সম্পর্কে লিখেছে আধুনিক্তার মন ঠিক এমনই কাওকে চাইছে। ডায়েরিটা সামনের ছোটো টি টেবিলের উপর রেখে হেলান দিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ বসে থেকে ডায়েরি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঘরে গিয়ে ডায়েরিটা তার ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ঘুম এসে তার চোখে বিরাজ করছে ধীরে ধীরে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গেল আধুনিক্তা।

আজ আধুনিক্তারা দেশে ফিরবে। আধুনিক্তার বাবা তাবাসসুমের বাবাকে সবার আড়ালে নিয়ে বলেছে উনি প্রতি মাসে টাকা পাঠিয়ে দিবে। আধুনিক্তা এসব বিষয়ে তেমন কিছু জানতো না। তাবাসসুমের বাবা মায়ের মন খারাপ। কারণ এই তিন বছরে আরমান ও আধুনিক্তার প্রতি খুব স্নেহ জমেছে মনে। আধুনিক্তা তাবাসসুমের পাশে বসে আছে। তাবাসসুমের চোখদুটো খোলা। ধীরে ধীরে নিশ্বাস চলাচল করছে। আধুনিক্তা তাবাসসুমের এক হাত৷ নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল-
“আপু, তুমি কিছুদিন আগে চোখ নাড়িয়েছিলে। জানো আমি এতে খুব খুশী হয়েছি। আমি জানি তুমি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে যাবে। আমি চলে যাচ্ছি বলে মন খারাপ করো না। তুমি যেদিন সুস্থ হবে আমি সেদিনই আবার ফিরে আসবো সিঙ্গাপুর। আর আমি তোমার ‘সে’ কে নিশ্চয়ই খুঁজে বের করবো। তাকে বলবো তোমার অসুস্থতার কথা। তুমি ভাবছো আমি জানলাম কি করে? সরি, তোমার ডায়েরি আমি পড়ে ফেলেছি। আমি কিন্তু জিজুর উপর ক্রাশিতো। ওকে ওকে রাগ করো না। আমি দুষ্টুমি করছি। আঙ্কেল আন্টি যেহেতু রাজি ছিলেন না তাই উনাদের এই বিষয়ে কিছু জিজ্ঞেস করবো না আমি। তুমি ভালো থেকো আপু। আল্লাহ হাফেজ।”
আধুনিক্তা তাবাসসুমের হাতে চুমু দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ঘর থেকে বের হয়ে তাবাসসুমের মা বাবাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় জানিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে গেল।

চলবে……..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here