তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই পর্ব_৩১

0
2530

#তুমি_আছো_হৃদয়ে_তাই
#শোভা_আক্তার(লাভলী)
#পর্ব_৩১

সকাল ৯ টায় আধুনিক্তার ঘুম ভাঙলো। ধীরে ধীরে চোখ খুলে বুঝতে পারলো তার ঘাড়ে গরম নিশ্বাস লাগছে। আধুনিক্তা ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে মাশরাত তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। পেটের কাছ থেকে মাশরাতের হাত সরিয়ে উঠে বসলো৷ ঘড়ির সময় দেখে নিশ্চিন্ত হলো। সে ভেবেছিল দেরি করে উঠেছে। মাশরাত নড়েচড়ে আবার ঘুরে ঘুমালো। আধুনিক্তা মাশরাতকে কাঁথা উড়িয়ে দিয়ে বিছানা ছেড়ে নামলো। তার জামা কাপড় এখনো গুছানো হয় নি। ড্রেসিংটেবিলের সামনে তার লাগেজ রাখা। লাগেজ খুলে জামা নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। এরই মাঝে মাশরাতের ঘুম ভাঙলো। পাশে আধুনিক্তাকে না পেয়ে উঠে বসলো। বাথরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। আধুনিক্তা বাথরুমে আছে বুঝতে পেরে হেলান দিয়ে বসলো। কিছুক্ষণ বসে থেকে বিছানা ছেড়ে নেমে আড়মোড়া ভাঙলো। ভাবলো ঘর পরিস্কার করে নিলে ভালো হয়৷ চারপাশে গোলাপ ফুলের পাপড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আধুনিক্তা হঠাৎ বিছানা ঝাড়ার শব্দ পেল। বাথরুমের দরজা হালকা ফাঁকা খুলে উঁকি দিয়ে দেখে মাশরাত ঘর গুছাচ্ছে। আধুনিক্তা মুচকি হেসে দরজা বন্ধ করলো। ঘর পরিস্কার করে মাশরাত খাটে বসলো। কিছুক্ষণ পর আধুনিক্তা বের হলো। মাশরাত মুচকি হাসি দিয়ে আধুনিক্তার দিকে তাকিয়ে রইলো। আধুনিক্তা ড্রেসিংটেবিলের সামনে এসে বলল-
“কি দরকার ছিল এত কষ্ট করার? আমি এসে পরিষ্কার করতে পারতাম না।”
“ব্যাপার না, প্রতিদিন আমিই আমার ঘর ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করি।”
আধুনিক্তা আর কিছু বলল না। তার লজ্জা লাগছে খুব। মাশরাতের দুষ্টুমি কথা বার্তা ঘুরছে৷ উঠে গিয়ে আধুনিক্তার পাশে দাঁড়াল। আয়নার দিকে তাকিয়ে আছে মাশরাত। আধুনিক্তা মাশরাতের দিকে তাকাল। মাশরাত কি যেন দেখছে নিজের চেহারায়।
“নিজেকে এত দেখে কি লাভ?”
“ওয়েট এ মিনিট”
মাশরাত আয়নার কাছে গিয়ে বলল-
“পেয়েছি”
“কি পেয়েছ”
মাশরাত আধুনিক্তার দিকে ঘুরে গলা হালকা ঘুরিয়ে বলল-
“দেখো দেখো আমার ঘাড়ে তুমি কি করেছো? আমি বাহিরে যাব কি করে? মালিহা তো দেখেই বুঝে যাবে। পরে তোমার সাথে মজা করলে আমার দোষ নেই বলে দিলাম।”
আধুনিক্তা ভালো মতো দেখে অবাক হয়ে বলল-
“আমি এটা করি নি। মানে ইচ্ছে করে কিছু করি নি।”
মাশরাত দুষ্টুমি হাসি দিয়ে আধুনিক্তার দিকে ঝুঁকে কিছু বলতে নিলো। তার আগেই আধুনিক্তা মাশরাতের মুখ চেপে ধরে বলল-
“দয়া করে কিছু বলো না। আমার লজ্জা করে।”
বলেই আধুনিক্তা মাথা নিচু করে ফেলল। মাশরাত হেসে উঠলো। আধুনিক্তা হাত সরিয়ে আয়নার দিকে ঘুরে দাঁড়াল। মাশরাত আধুনিক্তার ঘাড়ে থুতনি ঠেকিয়ে বলল-
“আচ্ছা বলবো না, আমার বউটা লজ্জা পেলে টমেটোর মতো লাল হয়ে যায়। একটা কথা বলি?”
“বলো”
“তোমায় খুব সুন্দর লাগছে, আমি শুনেছিলাম বিয়ের পর মেয়েরা আরো সুন্দর হয়ে যায়। আজ দেখেও নিলাম।”
“সবাই তো সুন্দর হয় না। কিছু কিছু মেয়েরা মোটা হয়ে যায়। আচ্ছা আমি যদি বিয়ের ৫/৬ মাস পর মোটা হয়ে যাই তুমি আমাকে ভালোবাসবে?”
“বোকাদের মতো প্রশ্ন করো না। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি তারপর একসাথে নাস্তা করতে যাব। আমার এমনিতেও ক্ষুধা পেয়েছে।”
বলেই মাশরাত আলমারির দিকে হেটে গেল। আধুনিক্তা হাসলো, মাশরাতের দিকে তাকাল আয়না দিয়ে। মাশরাত জামা দেখছে। আধুনিক্তার জামার রং এর সাথে ম্যাচ করে গেঞ্জি বের করলো। কালো রং এর থ্রি কোয়াটার প্যান্ট নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। আধুনিক্তা মাথা মুছে তৈরী হয়ে নিলো। বাড়ির নতুন ও একমাত্র বউ এখন সে। পরিপাটি হয়েই শ্বাশুড়ি মায়ের সামনে যেতে হবে। খাটে বসে বাবাকে কল করলো। আজ তাদের বৌভাতের অনুষ্ঠান। বাসায় যাবে ২ দিনের জন্য। বিয়ের পর অনেক নিয়ম কানুন রয়েছে। সেগুলো পালন করতে হবে। আজ সে আর মাশরাত আধুনিক্তাদের বাসায় যাবে। মাশরাত ফিরে আসলেও আধুনিক্তার আড়াই দিন সেখানে থাকতে হবে। মাশরাত তিন দিনের দিন আধুনিক্তাকে গিয়ে নিয়ে আসবে। আধুনিক্তা বাসার সবার সাথে কথা বলে নিলো। মাশরাত এখনো বের হয় নি। এত সময় নেয় ছেলেটা। হঠাৎ আধুনিক্তার চোখ গেল মাশরাতের মোবাইলের দিকে। একবার বাথরুমের দরজা দেখে আবার মোবাইলের দিকে তাকাল। নিবে কি নিবে না, ভাবতে ভাবতেই মোবাইল হাতে নিয়ে গ্যালারিতে ঢুকলো। পার্সোনাল ফোল্ডারে গিয়ে দেখে কোনো ফোল্ডার শো করছে না। আধুনিক্তা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। হঠাৎ বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনতেই তারাহুরো করে মোবাইল জায়গারটা জায়গায় রেখে দাঁড়িয়ে গেল। মাশরাত মাথা মুছতে মুছতে এগিয়ে এসে খাটে বসে তোয়ালে আধুনিক্তার দিকে দিয়ে ইশারায় বলল মাথা মুছে দিতে। আধুনিক্তা মুচকি হেসে মাশরাতের মাথা মুছে দিতে লাগলো।
“আজও পার্লারের লোক আসবে?”
“মালিহা তো গতকাল রাতে বলেছিল আসবে।”
“বেশি সাজুগুজু দরকার নেই। বিশ্বাস করো তুমি অতিরিক্ত ফর্সা হওয়ার কারণে মেকআপ করলে একদম ভালো দেখায় না তোমাকে। আমি গতকাল যখন স্টেজের দিকে এসেছিলাম অবাক না হয়ে পারি নি। মনে হয়েছে একটা পেতনি বসে আছে।”
“হয়েছে হয়েছে আর বলতে হবে না।”
“সত্য তেতো হয়।”
আধুনিক্তার মাশরাতের চুল টেনে ধরলো। মাশরাত আধুনিক্তার হাত ধরে বলল-
“সরি সরি আর বলব না প্লিজ ছেড়ে দাও ব্যাথা পাচ্ছি। জান না ভালে ছেড়ে দাও।”
আধুনিক্তা মাশরাতের চুল ছেড়ে বিরক্ত হয়ে বলল-
“শুনো, আমার যে নাম আছে সেটাই ধরে ডাকো। জান, প্রাণ, কলিজা এসব শব্দ আমার অপছন্দের।”
“তুমি আমাকে একবার জান বলেছিলে তাই না?”
“হয় তো বলেছিলাম, আমি আর বলবো না তুমিও বলবে না।”
“ওহ তো আপনার আমার নাম ধরে ডাকার ইচ্ছা?”
আধুনিক্তা ড্রেসিংটেবিলের উপর রেখে চিরুনি নিয়ে মাশরাতের চুল আছড়িয়ে দিতে দিতে বলল-
“না, যেহেতু তুমি আমার স্বামী তাই আমি যথেষ্ট সম্মান দিব তোমাকে। তোমার নাম ধরে আমি আর ডাকবো না। তুমি ডাকতে পারো আমার নাম ধরে, বুঝলে মিস্টার?”
মাশরাত হেসে আধুনিক্তার হাত ধরে কোলে বসিয়ে নাকে নাক ঘষে বলল-
“ওকে মিসেস বুঝলাম, এখন একটা গুড মর্নিং কিস দাও।”
“এইগুলো অভিনয় জগতেই মানায় আসল জীবনে না।”
“আমরা তো স্বামী-স্ত্রী”
মাশরাত ঠোঁট ভেটকালো৷ আধুনিক্তা হেসে দিলো মাশরাতের এক্সপ্রেশন দেখে। মাশরাতের গালে হাত রেখে কপালে চুমু দিলো। মাশরাত আফসোসের সুরে বলল-
“উনি যেন কিছুই বুঝে না।”
“আমি সবই বুঝি, কিন্তু মিস্টার কপালে চুমু দেওয়াতে আলাদা মায়া কাজ করে।”
মাশরাত কিছু বলল না। আধুনিক্তাকে সরিয়ে হাসি মুখে উঠে দাঁড়াল।
“চলো বাহিরে যাওয়া যাক।”
আধুনিক্তা মাথা নাড়াল। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে ওড়না ঠিক করে মাশরাতের হাট ধরে হাটা ধরলো। দুজন ঘর থেকে বের হয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে গেল। মালিহা বসে নিউজপেপার পড়ছে আর মা নেই, হয় তো রান্না ঘরে। মালিহা কারো উপস্থির টের পেয়ে ঘাড় ঘুরালো। মাশরাত আর আধুনিক্তাকে দেখে হাসিমুখে সালাম জানালো। মাশরাত চেয়ার টেনে বসে সালামের জবাব নিলো। মালিহা আধুনিক্তাকে বসতে বলল কিন্তু আধুনিক্তা তাদের বসতে বলে রান্নাঘরে গেল। মা একা কাজ করছে। আধুনিক্তা গিয়ে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে সালাম দিলো। মা আধুনিক্তাকে দেখে সালামের উত্তর দিলো।
“এত তারাতাড়ি উঠে গেলে যে?”
“কোথায় এত তারাতাড়ি? ৯ টায় উঠেছি।”
“হ্যাঁ কিন্তু তোমার এত তারাতাড়ি ঘুম থেকে ওঠার অভ্যেস নেই।”
“আছে আছে ভার্সিটি যাওয়ার জন্য সকাল ৭ টায় উঠতাম। কি করছেন আপনি?”
“নাস্তা বানাচ্ছি, তুমি গিয়ে বসো আমি আসছি ১০ মিনিটের মধ্যে।”
“এভাবে বলবেন না আমার ডায়াবেটিস হয়ে যাবে।”
“কেন আমি কি করলাম?”
আধুনিক্তা মাকে জড়িয়ে ধরে বলল-
“আমার শ্বাশুড়ি মা এত সুইট হলে আমার তো ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে।”
মা শব্দ করে হেসে উঠলেন। আধুনিক্তার গাল ধরে টেনে কপালে চুমু দিলেন। আধুনিক্তা মায়ের হাত থেকে চামচ নিয়ে বলল-
“আপনি গিয়ে বসুন এটা আমি দেখছি।”
“তুমি তেমন কিছু পারো না। আমি ধীরে ধীরে তোমাকে সব রান্না শেখাব। এখন তুমি গিয়ে বসো।”
“আপনি আমার শ্বাশুড়ি মা হোন। তো শ্বাশুড়ি মাদের মতোই কথা বলুন, এত ভালো হওয়া কি দরকার?”
শেষের কথাটা আধুনিক্তা নিচু সুরে বলল। মা আবার না হেসে পারলেন না। এই মেয়ে উনাকে হাসিয়ে মারবে উনি বুঝতে পারলেন।
“এটা গোশতের ভুনা তাই নাড়াচাড়া দিতে হবে। নাহলে তালুতে লেগে যাবে। প্রায় হয়েই গিয়েছে। তুমি গিয়ে বসো, যাও।”
“তাহলে ওয়াদা করুন আমাকে রান্না শেখানোর পর আমাকেই রান্না করতে দিবেন।”
“দিব বাবা দিব এখন যাও।”
“ওকে আমি পরোটা গুলো নিয়ে যাই।”
মা হেসে মাথা নাড়ালেন। আধুনিক্তা ডাইনিং টেবিলে ফিরে এসে চেয়ার টেনে বসলো৷ মাশরাত আর মালিহা নিউজপেপারের দিকে বড় বড় চোখ করে কি যেন পড়ছে। আধুনিক্তা আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“এই তোমরা কি পড়ছো এত মনোযোগ দিয়ে?”
মালিহা আর মাশরাত আধুনিক্তার দিকে তাকাল। মালিহা বলল-
“আমরা এমনই, ক্রাইম নিউজ গুলো মনোযোগ দিয়ে পড়ি।”
মাশরাত বলল-
“হ্যাঁ, বেশ করে বউ এর নির্যাতনের নিউজগুলো পড়ি আমি।”
আধুনিক্তা চোখ ছোটো ছোটো করে মাশরাতের দিকে তাকাল। মালিহা শব্দ করে হাসতে হাসতে নিউজপেপার ভাজ করে পাশে রাখলো। মা এগিয়ে আসতে আসতে বলল-
“আমি কিন্তু সব শুনেছি মাশরাত।”
মাশরাত জিহ্বায় কামড় দিয়ে মাথা নিচু করে ফেলল। চেয়ার টেনে বসে রাগী কন্ঠে বললেন-
“তুই দুষ্টুমি করছিস এখন আমরা জানি কিন্তু এসব থেকে দূর থাকবি।”
“মা, আমার উপর বিশ্বাস রাখো। আমি কখনো ওর গায়ে হাত তুলা তো দূরের কথা বকতেও পারবো না। ওর বাবা মেরেই ফেলবে।”
আধুনিক্তা ভ্রু কুঁচকে বলল-
“আব্বুর ভয়ে তুমি.. দেখলেন মা আপনার ছেলে কি বলছে। আমার আব্বু না থাকলে আমার উপর নির্যাতন করতো।”
“ছি ছি আমি এমনটা কখন বললাম?”
মা ধমকের সুরে বলল-
“একদম চুপ, কোনোদিন আধুনিক্তা ভুল করলে তাকে তার ভুল ধরিয়ে দিবি। কিন্তু ভুলেও মারধরের কথা ভাববি না।”
আধুনিক্তা বলল-
“হ্যাঁ হ্যাঁ বউকে সম্মান দিতে শিখো বেয়াদব ছেলে।”
“আর আপনিও, স্বামীর বিরুদ্ধে গিয়ে কখনো কিছু করবেন না। সবসময় স্বামীর পরামর্শ নিবেন, বুঝলেন?”
মায়ের কথায় আধুনিক্তা দাঁত বের করে হাসলো। মা লম্বা নিশ্বাস ফেললেন। এই মেয়ে তো নিজের মর্জির মালিক। মাশরাত বলল-
“আমি যেটা বলবো সেটা শুনতে হবে। আমার বিরুদ্ধে গেলে তোমার খবর আছে।”
“কি করবে শুনি?”
“আম্মুর কাছে বিচার দিব।”
আধুনিক্তা হা হা করে হেসে উঠলো। তারপর আবার হাসি থামিয়ে বলল-
“হ্যাঁ হ্যাঁ দিও, মা আমাকে বকাঝকা করলেও আমার সমস্যা নেই। কিন্তু তুমি কিছু বলে তো দেখো।”
মা হাসতে হাসতে বলল-
“আচ্ছা আচ্ছা অনেক হয়েছে। এইবার সবাই খাবারে মনোযোগ দিন।”

বিকালের সময় পার্লার থেকে লোক এসেছে আধুনিক্তা আর মালিহাকে সাজাতে। মাশরাত তাদের সাফ সাফ বলে দিয়েছে আধুনিক্তার মেকআপ যাতে একদম সিম্পল হয়। মালিহার ঘরে সাজুগুজুর ব্যবস্থা করেছে। মাশরাত ড্রইংরুমে বসে টিভি দেখছে। মা মাশরাতের ঘরে ব্লেজার স্যুট রেখে আসলেন। সময়ের মতো যাতে পড়তে পারে মাশরাত। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে আসতে মা মাশরাতকে বলল ঘরে গিয়ে তৈরী হয়ে নিতে। মাশরাত ঘরে চলে আসলো। ফ্রেশ হয়ে জামা বদলে নিলো। কিছুক্ষণ পর মা আসলেন। মাশরাত আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে টাই বাঁধার চেষ্টা করছে। আজ যেহেতু রিসেপশন টাই তো পড়তেই হবে তাহলেই সুন্দর দেখাবে।
“আমি পড়িয়ে দিব?”
মাশরাত আয়নায় দিয়েই মায়ের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল। মা দিয়ে মাশরাতের পাশে দাঁড়াল। উল্টা পাল্টা বেঁধে রেখেছে টাই।
“এত বড়ো হয়ে গিয়েছিস তবুও টাই ঠিক মতো বাঁধতে পারিস না।”
“টাই পড়তে আমার ভালো লাগে না একদম। কম পড়ি তাই অভ্যেসও হয় নি তেমন।”
মা হেসে মাশরাতকে টাই বেঁধে দিলেন। মাশরাত কিছুক্ষণ মায়ের দিকে তাকিয়ে থেকে জড়িয়ে ধরলো। মা মুচকি হেসে মাশরাতের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল-
“আমার ছোট্ট ছেলেটা এত তারাতাড়ি বড়ো হয়ে গেল কবে জানলামও না। মনে হয় কিছুদিন আগেই তো তুই খেলতে যাওয়ার জন্য বায়না ধরতি।”
“মাঝে মধ্যে ভাবি সেই ছোটোবেলাই ভালো ছিল। বড়ো হয়ে যাওয়ার পর তোমার আঁচল ধরে ঘুমাতে পারি না।”
মায়ের চোখে পানি জমে গেল। কিন্তু এই সুখের মুহূর্তে কান্না করা বেমানান। মাশরাতকে ছেড়ে চোখ মুছে বললেন-
“থাক আর ইমোশনাল কথা বলতে হবে না। তারাতাড়ি তৈরী হয়ে নে। আধুনিক্তার সাজ হয়ে গিয়েছে।”
“পেতনি বানিয়ে দিলো হয় তো আমার বউটাকে। আর কি করার ও কোনো ভূতনি থেকে কম না।”
মা হেসে মাশরাতের গালে আস্তে করে থাপ্পড় দিলো। তখনই মালিহা আসলো। মালিহাকে দেখে মাশরাত হেসে বলল-
“ওই দেখো আমার ছোটো বোন যে আর এক ভূতনি ভুলেই গিয়েছিলাম।”
“ভাই একদম মজা নিবি না। টাকা দে তারাতাড়ি উনারা চলে যাবেন।”
“তোর কাছে নেই?”
“আছে কিন্তু আমি দিব না, টাকা দে।”
মাশরাত লম্বা নিশ্বাস ফেলে মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে দিলো। মা মাশরাতকে আসতে বলে মালিহার সাথে চলে গেলেন। মাশরাত তৈরী হয়ে বাহিরে গেল। ড্রইংরুমের সোফায় আধুনিক্তা বসে আছে। মাশরাত আধুনিক্তাকে দেখে মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো। সিম্পল মেকআপে সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। আধুনিক্তা মাশরাতকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখল। পুরো হিরোদের মতো সেজে এসেছে মাশরাত। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা বেরিয়ে গেল সেন্টারে যাওয়ার জন্য।

আরমান চেয়ারে বসে পা দুলাচ্ছিল। যখন শুনেছে বর কনে এসে পরেছে সে দৌড়ে দরজার দিকে গেল। আধুনিক্তা আরমানকে আসতে দেখে হালকা ঝুকলো। আরমান দৌড়ে এসে আধুনিক্তাকে জড়িয়ে ধরলো।
“আমার ছোটুটা কেমন আছে?”
“অনেক ভালো, জানো মাম্মাম বাবা এসেছে। উনারা এখন উনাদের বাসায় কাল আমাদের বাসায় আসবেন দেখা করতে তোমার সাথে।”
বাবার কথা শুনে আধুনিক্তা অপ্রস্তুত হলো। মাশরাত যদি জিজ্ঞেস করে কোন বাবা? হয় তো চারপাশে শব্দের কারণে মাশরাত শুনতে পায় নি তাই জিজ্ঞেস করেনি। মাশরাত আরমানকে কোলে তুলে নিলো। তারা এগিয়ে গেল ভেতরে। মাশরাত আর আধুনিক্তাকে স্টেজের সোফায় বসানো হলো। শুরু হলো আবার ফটোসেশান। মাশরাতের এই বিষয়টা খুব খারাপ লাগে। রাত সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান চলল৷ আধুনিক্তার ঘুমে চোখ লেগে আসছে। মা আর মালিহা মাশরাত আর আধুনিক্তাকে বিদায় জানিয়ে বাসায় চলে গেলেন। আধুনিক্তার অস্থির লাগছে। আরমান বলল বাবা এসেছে। যদি এটা সত্যি হয় তাহলে সকালবেলায়-ই কোনো গন্ডগোল
হবে। আধুনিক্তাকে দেখে মাশরাত জিজ্ঞেস করলো-
“কি হয়েছে তোমার?”
“কই কিছু না”
“ঘুম আসছে তাই না?”
“হ্যাঁ খুব বেশী”
“তুমি সেন্টারে কিছু খেতে চাও না কেন?”
“ভিডিও করার সময় আমার খেতে অসহ্য লাগে। সবাই কিভাবে ছবি তুলতে থাকে।”
“সেটা তো স্বাভাবিক, বাসায় গিয়ে কিছু খেয়ে নিবে বুঝলে?”
“হ্যাঁ দাদীকে বলবো খাইয়ে দিতে।”
আধুনিক্তা মাশরাতের বুকের সাথে লেপ্টে চোখ বন্ধ করলো। বাসায় পৌঁছে তারা ড্রইংরুমের সোফায় বসলো। দাদী আর দাদাই অনুষ্ঠানে যায় নি। দাদাইর শরীর কিছুটা অসুস্থ লাগছিল তাই দাদীও যায় নি দাদাইর সাথে। নাতনি বাড়িতে ছিল না বাড়ি খুব খালি খালি লাগছিল। দাদী আধুনিক্তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। আধুনিক্তা কোনো মতো দাদীকে মানালো। দাদীর হাতে খাবার খেয়ে নিজের ঘরে গেল। আধুনিক্তার ঘরও ফুল দিয়ে সাজানো। মাশরাত খাটে বসে হাসিমুখে বলল-
“আজও কি আমরা বাসররাত মানাবো?”
“পিটাবো তোমাকে, আমার ঘুম পাচ্ছে খুব।”
“ঠিক আছে জামা বদলে নাও। আর তোমার আটা ময়দা ধুয়ে আসো।”
“রেস্পেক্ট মি এন্ড মাই মেকআপ ওকে?”
মাশরাত শব্দ করে হাসলো। আধুনিক্তা জামা নিয়ে বাথরুমে চলে গেল। মাশরাত ঘরেই জামা বদলে নিলো। আধুনিক্তা বের হতেই মাশরাত গিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আসলো। বেরিয়ে দেখে আধুনিক্তা খাটের মাঝে বসে গোলাপের পাপড়িগুলো হাতের মুঠোয় নিচ্ছে আর নিজের উপর উড়িয়ে মারছে। মাশরাত মুচকি হাসলো। হাত-মুখ মুছে খাটে বসে বলল-
“হয়েছে আপনার দুষ্টুমি? ঘুমান এখন।”
আধুনিক্তা মাশরাতের দিকে এসে মাশরাতের পাশে বসে বলল-
“আমার ঘুম উড়ে গিয়েছে।”
“এটা বললে চলবে না, ঘুমাও।”
আধুনিক্তা হাতের মুঠোয় ফুলের পাপড়ি নিয়ে মাশরাতের চেহারায় মারলো। মাশরাত হেসে আধুনিক্তার কোমড় জড়িয়ে ধরে টেনে নিজের কাছে নিয়ে আসলো৷ আধুনিক্তা নেশাগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাশরাতের দিকে। মাশরাত মুচকি হেসে আধুনিক্তাকে বুকের মাঝে নিয়ে নিলো।

পরেরদিন..….
আধুনিক্তার আগে আজ মাশরাত উঠেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে ১০ টা বাজে। তারাতাড়ি বিছানা ছেড়ে নামলো৷ ড্রেসিং টেবিলের উপর জামা রাখা তার৷ জামা নিয়ে তারাতাড়ি বাথরুমে চলে গেলে। গোসল করে বের হয়ে দেখে আধুনিক্তা আলমারির সামনে দাঁড়িয়ে জামা খুঁজছে।
“উঠে গেলে কেন?”
“ঘুম ভেঙে গিয়েছে তাই।”
মাশরাত চারপাশে চোখ বুলিয়ে বলল-
“ঘর তুমি পরিষ্কার করলে?”
“হ্যাঁ, গতকাল তুমি করেছিলে আর আজ আমি।”
মাশরাত হেসে দিলো। আধুনিক্তা জামা নিয়ে বলল-
“আমার আসতে দেরি হবে। তুমি বাহিরে চলে যাও।”
“আমি কিন্তু চলে যাব বাসায়।”
“হ্যাঁ জানি, নাস্তা করে তারপর যাবে।”
“ঠিক আছে তুমি আসো আমি যাই।”
মাশরাত বাহিরে চলে আসলো। বাবা মাত্র ঘুম থেকে উঠে ঘর থেকে বের হলেন। বাবার সাথে দেখা হতেই মাশরাত সালাম দিলো। বাবা সালামের উত্তর নিয়ে সোফায় বসলেন। মাশরাতকে বসতে বলে আধুনিক্তার মাকে উঁচু গলায় বললেন মেহমানরা আসছেন। উনারা আসলে একসাথে নাস্তা করবে সবাই।
“আধুনিক্তাও কি উঠে গিয়েছে?”
“হ্যাঁ বাবা, ওর আসতে না-কি দেরি হবে। তাই আমি বাহিরে চলে আসলাম।”
“ভালো করেছো, চা খাবে?”
“না আমি নাস্তা খাওয়ার পরে চা খাই।”
“আমার উল্টো অভ্যেস। নাস্তা খাওয়ার আগে চা খাই।”
মা এসে বাবাকে চা দিয়ে গেলেন। মাশরাত আর বাবা নিজেদের ব্যবসা নিয়ে কথা বলতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর দাদাই এসে তাদের সাথে যোগ দিলেন। শুরু হলো উনাদের ব্যবসা নিয়ে আলাপ। দাদী আর মা হাসছে। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দ আসলো। মা এসে দরজা খুলে হাসিমুখে সালাম দিয়ে ভেতরে আসতে বললেন। মাশরাত দরজার দিকে তাকাল। কে এসেছে সে দেখতে পারছে না। বাবা উঠে দ্রুত হেটে গেলেন। কাকে যেন জড়িয়ে ধরে কথা বলছেন। মাশরাত চুপচাপ বসে রইলো। হঠাৎ ভূত দেখার মতো চমকে উঠে দাঁড়াল। তার কলিজা মোচড় দিচ্ছে। হাত পা কাঁপছে থরথর করে। মনে হচ্ছে এখনই হৃদয়ে বিস্ফোরণ ঘটবে। আধুনিক্তার বাবা বললেন-
“ভাইয়া, আধুনিক্তার স্বামী। ওর নাম…”
“মাশরাত তোফাজ্জল হোসেন।”
মাশরাত হাতমুঠো শক্ত করে ফেলল। হঠাৎ রাগে তার গা জ্বলে উঠলো। এই মানুষটাই তার চোখের সামনে বেল দিয়ে তাবাসসুমকে মেরেছিল। মাশরাত হেটে গেল উনার সামনে। মাশরাতের চোখে রাগ স্পষ্ট দেখতে পারছে তাবাসসুমের বাবা।
“এইভাবে কি দেখছো তুমি আমার দিকে?”
“আপনাদের সাথে মজুমদার পরিবারের কি সম্পর্ক আমি জানি না। আপাতত একটা প্রশ্নের উত্তর চাই। যে প্রশ্ন আমাকে ৪ বছর তিলে তিলে শেষ করেছে।”
“তুমি তোমার শ্বশুর মশাই এর সামনে তোমার অতীত খুলতে চাচ্ছো। আমি বার বার অবাক হই তোমার সাহস দেখে।”
“কথা ঘুরাবেন না, তাবাসসুম কোথায়?”
আধুনিক্তার বাবা মা একে অপরের দিকে তাকাল। তারা চেয়েছিল এসব মাশরাতকে জানাবে না। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সব জেনে যাবে মাশরাত।
“আমি কিছু জিজ্ঞেস করছি। জবাব দেন তাবাসসুম কোথায়?”
“তোমার পেছনে”
“মজা করছেন আপনি আমার সাথে?”
“না, তাবাসসুম সত্যি তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।”
মাশরাত পেছনে ফিরলো। আধুনিক্তা দাঁড়িয়ে আছে।

চলবে…….

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here