তুমি নামক প্রশান্তি দ্বিতীয় খন্ড পর্ব ২ +৩

0
488

#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_দ্বিতীয়_এবং_তৃতীয়

ডান পাশের গালটা খানিক ফুলে আছে৷ ফর্সা গালে হাতের ছাপ স্পষ্ট। লাল বেনারসিটা ভিজে একাকার অবস্থা। চুলগুলো এলোমেলো। মুখের মেকাপ পানিতে ধুয়ে গিয়ে বিশ্রি অবস্থা। চোখের কাজল লেপ্টে আছে। প্রিয়জনের থেকে ধোকা সহ্য করার মতো শক্তি বোধহয় পৃথিবীর কোনো প্রেমিকার নেই। গলার স্বরটা ক্রমশ কমে আসছে বেলীর। প্রায় খন্টা হয়ে আসল বেলী ভিজে অবস্থায় আছে। শরীর ঠান্ডা বরফ হয়ে আছে। ক্রমশ অবশ হয়ে আসছে শরীর। তবুও বুকের ক্ষতটার জ্বা°লা এক বিন্দু কমেনি। বরং প্রতি সেকেন্ডে, প্রতি মিনিটে বেড়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো থেকে অঝোরে পানি ঝরছে। অনেকক্ষন ধরে নিশ্চুপে বসে আছে। দরজার ওপাশ থেকে এতক্ষন বিভিন্ন রকম আওয়াজ আসলেও এখন কমে গেছে। সবাই হয়ত ক্লান্ত হয়ে চুপ করে গেছে। এটাই ভালো। একটু একা থাকা প্রয়োজন মেয়েটার। নিজের সাথে নিজের অনেক হিসেব মিলানো বাকি৷ দেয়ালের সাথে মাথাটা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করতেই কিছু স্মৃতি ভেসে উঠল। কাল রাতেও মানুষটা কত খুশি ছিলো। তাহলে আজ হঠাৎ কি হলো?
“খোঁজ নেওয়ার দরকার নেই। ভেবে নিস, ম°রে গেছি”
কথাটুকু মনে উঠতেই মাথার দুই পাশের শিরা ফুলে উঠল। প্রচন্ড ব্যাথায় ছটফট করে উঠল। পা°গলের মতো চিৎকার করে বলতে শুরু করল,
“আমাকে এমন করে ছেড়ে না গেলেও পারতেন, নীলাভ্র ভাই। কী দোষ ছিলো আমার? আপনার বেলীপ্রিয়া আপনাকে ছাড়া বাঁচতে পারবে না। আপনি তো সব জানেন। আপনার বেলীপ্রিয়া আপনাকে ছাড়া অসহায়। বড্ড অসহায়! তবুও ছেড়ে গেলেন। কেন? কেন? কেন? আপনি তো আমার মানসিক প্রশান্তি ছিলেন। আর সেই আপনি আমাকে এতটা মানসিক যন্ত্রণায় ফেলে চলে গেলেন? ক্ষমা করব না আপনাকে। কোনোদিন ক্ষমা করব না। আপনার বেলীপ্রিয়া আপনাকে ক্ষমা করবেনা।”
কান্নায় গলা আটকে আসছে। শব্দ বের হচ্ছেনা। তবুও শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে আরো একবার চিৎকার করে উঠল,
“নীলাভ্র ভাই, শুনতে পারছেন আপনি। আপনাকে ক্ষমা করব না আমি।”
আর শব্দ বের হলো না। শরীর আর সাঁয় দিলো না। চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসল। আঁকড়ে ধরে রাখা খন্ডিত চিঠির টুকরোটা রয়ে গেলো হাতের ভাঁজে। সেটা ভিজে ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম।


ড্রয়িং রুমে পায়চারি কয়ে যাচ্ছে ইশু আর মেরিনা। সীমাকে সামলাচ্ছে আইরিন। আর রিতা সোফার এক কোনায় বসে আছে পাথরের মতো। নীলাভ্রর বাবাও তার পাশে বসে আছে। অনেক ক্ষণ হয়ে গেছে সবার মাঝে নিরবতা। এবার আর ইশু কিছুতেই চুপ থাকতে পারল না। অধৈর্য কণ্ঠে বলে উঠল,
“তোমরা কি সবাই এখানে চুপ করে বসে থাকবে? মেয়েটা এক ঘণ্টা যাবৎ ওয়াশরুমে রয়েছে। ভেতরে কি অবস্থায়? কি করছে? কেউ জানিনা। তোমরা সবাই এভাবেই বসে থাকো। এবার বেলী সাড়া না দিলে দরজা ভে°ঙে ফেলব। তবুও চুপ করে বসে থাকব না।”
বলে বেলীর রুমের দিকে পা বাড়াল। মেরিনা ও ছুটল সেদিকে। রিতার যেন এবার হুশ ফিরল। সত্যিই তো মেয়েটার অনেক ক্ষণ যাবৎ কোনো সাড়া শব্দ নেই। বুকের ভেতরটা ভয়ে দুমড়ে এলো। ইশু আর মেরিনার পিছুপিছু ছুটল সে। ইশু আর মেরিনা দুজনেই ডেকেই চলেছে একাধারে। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া শব্দ নেই। রিতার ভয়টা যেন দ্বিগুণ হয়ে গেলো। কাঁপা স্বরে ডাকতে শুরু করল,
“বেলী, মা আমার। দরজাটা এবার খোল, মা। তুই তো জানিস, আমার তুই ছাড়া কেউ নেই। তোর কিছু হয়ে গেলে আমি কি করে বাঁচব? দরজাটা খোল, মা। আমার ভয় হচ্ছে অনেক।”
নাহ! এবারও সাড়া নেই। কোনো শব্দ নেই। তিনজনের ভয়টাই যেন এবার আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরল চারদিক থেকে। ভয়ে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে সবার। এর মাঝে রুমে উপস্থিত হলেন নীলাভ্রর বাবা। হাঁক ছেড়ে বললেন,
“তোরা সরে যা। আমি দেখছি।”
তিনি এসেও উচ্চস্বরে ডাঁকা শুরু করল। কিন্তু ফলাফল প্রতিবারের মতোই শূণ্য। মেরিনা ভয়ে চো°টে ফট করে বলে উঠল,
“বেলী আবার উল্টা-পাল্টা কিছু করে বসল না তো?”
রিতার কানে কথাটা যেতেই সে কয়েকপা পিছিয়ে গেলো। ইশু সাথে সাথে তাকে আকঁড়ে ধরে মেরিনার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাল। ধমকের স্বরে বলল,
“কী আবোল-তাবোল বলছিস তুই? একদম বাজে কথা মুখে আনবি না। আমাদের বেলী এতটাও দূর্বল না। এইসব ভুল সিদ্ধান্ত কখনো নিবে না। এটা আমার বিশ্বাস।”
কথাগুলো বলতে ইশুর গলাও কাঁপছিল। তবুও মনে সাহস রেখে বাবার উদ্দেশ্য বলে উঠল,
“বাবা তুমি কিছু একটা করো, প্লিজ। দেরি হয়ে যাচ্ছে। সময় চলে যাচ্ছে। ভেতর থেকে এখনো পানির শব্দ আসছে। এতক্ষণ যাবৎ মেয়েটা ভিজে অবস্থায় থাকলে ম°রে যাবে। প্লিজ, কিছু করো।”
উপায়ন্তর না পেয়ে নীলাভ্রর বাবা দরজা ভেঙে ফেলার চেষ্টা করতে লাগল। আশ্চর্যজনক ভাবে দুই-তিনবার দরজায় আঘাত করতেই দরজাটা খুলে যায়। দরজাটা খুলে যেতেই বেলীকে সেন্সলেস অবস্থায় দেখে সবার হার্টবিট থেমে যাওয়ার উপক্রম। রিতা সাথে সাথে চিৎকার করে দৌড়ে গেলো বেলীর কাছে। ওদের চিৎকার শুনে সীমা আর আইরিনও রুমে এসে হাজির হলো। সীমার মুখে একরাস বিরক্ত ছাড়া আর কিছু নেই। ইশু আর মেরিনা ঠাঁই দাঁড়িয়ে। কিছু বলার শক্তি পাচ্ছে না। তবুও এগিয়ে গেলো বেলীর কাছে বেলীর সারা শরীর ভিজে ফ্যাকাসে হয়ে আছে। শরীরে হাত রাখতেই ঠান্ডায় কেঁপে উঠল ইশু। বরফের মতো ঠান্ডা শরীরটা। তাড়াতাড়ি করে পার্লস চেক করতেই দেখল খুব স্লো চলছে পার্লস। নিঃশ্বাসটাও ঠিক ভাবে পড়ছে না। রিতা বেলীকে সেই অবস্থায় ঝাপটে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ল। ইশুর এবার জোরেই বলে উঠল,
“ফুপ্পি, ছাড়ো বেলীকে। এখন কান্নাকাটি করার সময় না। ওর পার্লস খুব স্লো চলছে। এক্ষুনি হসপিটালে নিয়ে যেতে হবে। প্লিজ, বাবা তুমি গাড়ির ব্যবস্থা করো। তাড়াতাড়ি, প্লিজ।”
সবাই মিলে বেলীকে তুলে এনে খাটে রাখল। ইশু আর মেরিনা মিলে তাড়াতাড়ি বেলীর জামাকাপড় বদলে দিলো। হাতে-পায়ে তেল মালিশ করা শুরু করল। তবুও শরীর গরম হচ্ছে না কিছুতেই। গাড়ি আসতেই রওনা হলো হসপিটালের উদ্দেশ্য।

বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে শুরু করেছে চারদিকে। প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা পর বেলীর জ্ঞান ফিরেছে। বেলীর মাথার কাছেই রিতা, ইশু বসে আছে। কিন্তু, কোনো শব্দ করছে না। বেলী এক নজরে উপরের দিকে তাকিয়ে। কিছু একটা ভাবছে। রিতা মেয়েকে এমন অবস্থায় সহ্য করতে না পেরে প্রশ্ন করার জন্য মুখ খুলল। বলল,
“এখনো কথা বলবি না?”
বেলী সাথে সাথেই উত্তর দিলো,
“বলছি তো? বলো, কী বলবে?”
সাথে সাথে ইশু কান্নারত স্বরে প্রশ্ন করল,
“কতটা ভয় পেয়েছিলাম, জানিস?”
এবার বেলী দৃষ্টি ঘুরাল। ইশুর দিকে শান্ত নজর রেখে মুখে হাসি টানল। খানিকটা হেসে বলল,
“কেন? ভেবেছিলি আমি ম°রে গেছি।”
ইশু এবার অবাক হলো। বেলীর এমন কথায়। কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
“বেলী, ইয়ার্কি করছি না তোর সাথে। এতক্ষণ যাবৎ কেউ ভিজে অবস্থায় থাকে? শরীরের কি হাল করেছিস দেখ?”
বেলী হাসল। কেমন যেন হাসিটা। এই হাসিতে প্রাণ নেই। স্নিগ্ধতা নেই। আছে শুধু তাচ্ছিল্য। হাসি বন্ধ করে গম্ভীর স্বরে বলে উঠল,
“এইযে এখন থেকে কয়েক ঘন্টা আগে যেই বেলী ছিলো। সে ম°রে গেছে। এখন যেই বেলীকে দেখছিস, সে নতুন কেউ। আগের বেলী বো°কা ছিল। অল্পতেই সবাইকে বিশ্বাস করে ফেলত। তাইতো বার বার ঠকেছে। আজ থেকে বেলী স্বার্থপর হবে। খুব স্বার্থপর। যে শুধু নিজের কথা ভাববে। নিজের ভালোর কথা ভাববে। অন্যের কথা ভেবে সময় নষ্ট করবে না। আর নিজের ক্ষ°তিও করবে না।”
বেলীর কথাগুলোতে ইশু স্পষ্ট রাগ দেখতে পেলো। রিতাও অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে মনে প্রানে চায় তার মেয়েটা সত্যি সত্যি এবার শক্ত হয়ে ঘুরে দাঁড়াক। শিরদাঁড়া সোজা করে চলুক। মাথা উঁচু করে বাঁচুক। কেউ তাকে আর ঠকাতে পারবে না। কেউ আঘাত করে ভেঙে দিতে পারবে না। ইশু বলে উঠল,
“আমিও চাই, তুই লাভ্র ভাইকে ভুলে নতুন করে সবটা শুরু কর। যে তোকে ঠ…।”
কথাটা শেষ করতে পারল না ইশু। তার আগেই বেলী বিরক্তির স্বরে বলে উঠল,
“নীলাভ্র? নীলাভ্র কে? আমি কোনো নীলাভ্রকে চিনিনা। না আমার লাইফে এই নামে কেউ ছিলো না। আমার লাইফে একজন বিশ্বাসঘাতক ছিল। তাকে আমি যতটা ভালোবেসেছিলাম। আজ থেকে তার থেকেও দ্বিগুণ ঘৃণা করব। ম°রে গেছে সে।”
কথাগুলো ইশুর সহ্য হলো না। যতই হোক ভাই বলে কথা। তবুও সহ্য করে নিলো। কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। বেলী শান্ত স্বরে পুনরায় বলল,
“আমাকে একটু একা থাকতে দাও, মা। তোমরা এখন আসো।”
বেলীর কথা শেষ হতে না হতেই ইশু বেড়িয়ে গেলো। রিতাও কিছু না বলে বেড়িয়ে গেলো। তারা চলে যেতেই বেলীর দুই চোখ বেয়ে দুই ফোটা পানি গড়িয়ে পড়ল। কিন্তু আবার সাথে সাথেই বেলী মুছে নিলো। শক্ত কণ্ঠে নিজে নিজেই বলতে লাগল,
“আজ থেকে নতুন বেলীর জন্ম হলো। যার সাথে আগের বেলীর কোনো মিল থাকবে না। তবে হ্যাঁ, নীলাভ্র ভাই আপনি যেখানেই থাকেন। শুনে রাখেন, বেলী আপনাকে কোনোদিন ক্ষমা করবে না। আপনি যেদিন ফিরে আসবেন। সেদিন বেলীর চোখে আর ভালোবাসা দেখবেন না। দেখবেন শুধু এক রাশ ঘৃণা। আপনার জন্য আমি যতগুলো তীক্ত কথা হজম করেছি। তা সব সুধে আসলে ফেরত দিব আপনাকে। কাল থেকে শুরু হবে বেলীর নতুন লড়াই। বেঁচে থাকার লড়াই। মাথা উঁচু করে বাঁচার লড়াই।”

#চলবে

[ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। আজকের পর্বটা একটু প্যাঁচালো হয়েছে জানি। ক্ষমা করবেন। হ্যাঁ, কাল থেকে সত্যি সত্যি অন্য বেলীকে দেখবেন। আর আপনাদের কী মনে হয় বলুন তো, নীলাভ্র কোথায় যেতে পারে?]

#তুমি_নামক_প্রশান্তি
#লেখনীতে_জেনিফা_চৌধুরী
#দ্বিতীয়_খন্ড
#পর্ব_তৃতীয়

হসপিটালে রাতের অন্ধকারে কেউ হঠাৎ বেলীর গলার চে°পে ধরল। শক্তপোক্ত হাতে গলা চে°পে ধরায় বেলীর নিঃশ্বাস মুহূর্তেই আটকে এলো। ঘুমের মধ্যেই যন্ত্রণায় ছটফট করতে লাগল বেলী। শরীর সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে ছাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। চোখ দুটো খুলতেই যেন, শরীরটা অবশ হয়ে আসল। শক্তপোক্ত হাতের মানুষটা যে বড্ড চেনা। লাইটের হালকা আলোয় নীলাভ্রর রাগান্বিত চেহারাটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে বেলী। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা এই মুহূর্তে থামিয়ে দিয়েছে বেলী। কিন্তু, সামনে থাকা মানুষটার হাত এখনো বেলীর গলা চে°পে রেখেছে। এই মুহূর্তে শারীরিক যন্ত্রণার চাইতে, মানসিক যন্ত্রণাটা বেশি হচ্ছে। কিছুতেই যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। কিন্তু মন মস্তিষ্ক বার বার বিভিন্ন প্রশ্ন করে চলেছে। চোখ দুটো নীলাভ্রর মুখ পানে স্থির হয়ে আছে। বেলীর দুই চোখ বেয়ে অশ্রুকণা গড়িয়ে পড়ছে। হঠাৎ করেই নীলাভ্র বেলীর গলা ছেড়ে দিলো। গর্জন করে বলে উঠল,
“তুই আমাকে ঠকিয়েছিস, বেলীপ্রিয়া৷ তুই আমাকে ঠকিয়েছিস। ভীষন বাজে ভাবে ঠকিয়েছিস। তোকে আমি বাঁচতে দিব না।”
বলে আবার গলা চে°পে ধরল। হিংস্রভাবে চে°পে ধরল এবার। নিঃশ্বাসটা এই বুঝি বন্ধ হয়ে গেলো? শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে গলা ফা°টিয়ে চিৎকার করে উঠল বেলী,
“নীলাভ্র ভাই, আমি আপনাকে ঠকাইনি।”
কথাটা লাফ দিয়ে বলেই উঠে বসল। বেলীর চিৎকারে কড়িডোর থেকে ছুটে আসল রিতা আর ইশু। রুমে ঢুকেই দেখে বেলী কাঁপছে। থরথর করে কাঁপছে। সারা শরীর ঘেমে একাকার অবস্থা। চোখ দুটো থেকে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়ছে। রিতা বেলীর এই অবস্থা দেখে ‘থ’ মে°রে দাঁড়িয়ে আছে। ইশু গিয়ে ছুটে বেলীকে বুকে জড়িয়ে ধরল। বেলী অনবরত বলতেই আছে,
“আমি আপনাকে ঠকাইনি। বিশ্বাস করুন, ঠকাইনি।”
ইশু বুঝতে পারছে বেলী কিছু একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছে। তবুও বেলীকে স্বান্তনা দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছে না। বার বার বেলী একই কথা বলে যাচ্ছে। মেয়েটা মুখে যতই নিজেকে শক্ত প্রমাণ করার চেষ্টা করুক না কেন? ভেতর থেকে মেয়েটা ভে°ঙে গেছে। সম্পূর্ণ ভে°ঙে গেছে। নিজেকে শক্ত করতে একটু তো সময় লাগবেই। ইশু বেলীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। নমনীয় কণ্ঠে বলল,
“খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস? এত ভয় পাওয়ার কিছু নেই। শান্ত হয়ে যা, প্লিজ। এতটা ভে°ঙে পড়তে নেই, বোন।”
বেলী কথাগুলো শুনল কি-না ? কে জানে? আগের ন্যায় বলল,
“তুই নীলাভ্র ভাইকে বল, প্লিজ। আমি তাকে ঠকাইনি।”
বলে হুহু করে কান্না করে উঠল। ইশুকে শক্ত করে চে°পে ধরে কাঁদতে লাগল। ইশুর চোখের কোনেও পানি। বেলীকে কিছু বলে স্বান্তনা দেওয়ার সাহস পেলো না। শুধু চোখ বন্ধ করে মনে মনে বলে উঠল,
“ভাইয়্যু দেখ, কী অবস্থা করেছিস মেয়েটার? মেয়েটা যে জীবন্ত লা°শ হয়ে গেলো ভাইয়্যু। তুই কোথায় ভাইয়্যু? ভালো আছিস? তুই তো তোর বেলীপ্রিয়াকে ছাড়া থাকতে পারিস না। তাহলে, এভাবে কেন ছেড়ে গেলি? প্লিজ ফিরে আয় ভাইয়্যু। ফিরে এসে প্রমাণ করে দে, তুই ঠকাসনি তোর বেলীপ্রিয়াকে। প্লিজ ফিরে আয়, ভাইয়্যু। প্লিজ।”
কথাগুলো শেষ হতে না হতেই ইশুর ভেতর থেকে কান্নাগুলো তীব্র বেগে বেরিয়ে আসল। বেলীর সাথে সাথে ইশুও কাঁদছে। আর রিতা দরজার সামনে দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চোখ ভর্তি নোনাজল নিয়ে মেয়ের দিকে অসহায় চাহনী দিয়ে আছে। কিছু সময় রুমের ভেতরে নিরবতা চলল। বেলী হেচকি তুলে কাঁদছে। ইশু দুই হাতে চোখের জলটুকু মুছে নিলো। শান্ত, শীতল কণ্ঠে বেলীকে শুধাল,
“জানিস তো বেলী? আমরা কেউ কাউকে ঠকাই না। উল্টা আমরা নিজেরাই ঠকে যাই। সময় আর পরিস্থিতির কাছে। সময় আর পরিস্থিতির উপর আমাদের কারোর হাত নেই। তারা আমাদের ঠকিয়ে যায়। ভালোর জন্য বোধহয়। আমাদের ভালো হলেও আমরা কিছু বলতে পারিনা। আবার খারাপ হলেও বলতে পারিনা। শুধু ঠকে গিয়ে শান্ত হয়ে যাই। নিরব হয়ে যাই। যখন আমরা নিরব হয়ে যাই। তখন সেই সময়েই আবার আমাদের নিরবতার পুরষ্কার দেয়। তখন আমরা বুঝতে পারি, আসলে যা হয়েছে ভালোর জন্য।”
বেলী কথাগুলো শুনল। মন দিয়ে শুনল। কিছুটা মাথায় গেঁথে নিলো। তারপর ইশুকে ছেড়ে দিলো। সামলে বসল নিজেকে। চোখের অশ্রু ফোটা মুছে নিলো। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আসলে একটা খারাপ স্বপ্ন দেখেছিলাম। তাই একটু ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। চিন্তা করিস না। আমি ঠিক আছি।”
ইশু যেন একটু স্বস্তি পেলো। মেয়েটা মুহূর্তেই চট জলদি নিজেকে সামলে নিলো। রিতা এবার কাছে এসে বসল বেলীর। আলতো হাতে মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলল,
“কিছু খাবি, মা?”
বেলীর মুখে আগের মতোই হাসি রইল। বলল,
“না। আচ্ছা এখন কয়টা বাজে মা?”
ইশু সাথে সাথে উত্তর দিলো,
“রাত ৯টা বাজে। তুই ঘুমিয়েছিলি বলে, আজ রাতটা ডাক্তার হসপিটালেই থেকে যেতে বলেছে। কাল সকাল সকাল আমরা বাসায় চলে যাব।”
বেলী গায়ের ওড়নাটা ঠিক করতে করতে বলে উঠল,
“তোরা বাসায় চলে যা। আমি একা থাকতে পারব। কোনো সমস্যা নেই।”
রিতা আর ইশু কিছুতেই বেলীকে একা রেখে যেতে চাইছিল না। কিন্তু বেলীর জোড়াজুড়িতে বাধ্য হয়ে চলে যেতে হলো। তারা চলে যেতেই বেলী বিছানা থেকে নিচে নেমে দাঁড়াল। রুমের পশ্চিম দিকে জানালাটা খুলে দিলো। সাথে সাথে শীতল হাওয়া এসে লাগল বেলীর গায়ে। খানিকটা কেঁপে উঠল মেয়েটা। জানালার গ্রীলে মাথা ঠেঁকিয়ে ডুব দিলো অতীতে। ভয়ঙ্কর সেই অতীত…
“দুই মাস আগের সেই দুপুরে”
রাকিবের ফোন কে°টে দিয়েই বেলী ফোন দিলো তানিশাদের বাসায়। অনেকবার রিং হওয়া স্বত্তেও কেউ ধরল। তবুও বেলী হাল ছাড়ল না। আবার ট্রাই করার সাথে সাথে কেউ ফোনটা রিসিভ করল। কণ্ঠস্বরটা বেলী ঠিক চিনল না। তবুও প্রশ্ন করে বসল,
“তানিশা। তানিশা কোথায়? প্লিজ তানিশাকে একটু ফোনটা দিবেন?”
সঙ্গে সঙ্গে ওপাশ থেকে কান্নারত স্বরে উত্তর আসল,
“তানিশা তো নেই। তানিশা আজ মা°রা গেছে।”
আর কিছু শোনার মতো শক্তি হলো না বেলীর। মাথাটা সাথে সাথে ঘুরতে শুরু করল। হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। কয়েক সেকেন্ডের মাথায় ঘুরে পড়ে গেলো নিচে। আর যখন জ্ঞান ফিরল তখন নিজেকে বিছানায় আবিষ্কার করল। পাশে অসহায়, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখে বসে আছে নীলাভ্র। বেলীর জ্ঞান ফিরে আসতেই মুহূর্তেই সব মনে পড়ে গেলো। চিৎকার করে উঠে বসল। নীলাভ্রর আকঁড়ে ধরে পা°গলের মতো বলতে শুরু করল,
“তানিশা। তানিশা। তানিশা…। ”
আর কিছু বলতে পারছে না। উচ্চারণ হচ্ছে না বিষা°ক্ত শব্দটা। নীলাভ্র এতক্ষণে সবটা জেনেছে। রাকিবের থেকে খবর পেয়েই ছুটে এসেছিল। আর এসেই বেলীকে সেন্সলেস অবস্থায় দেখতে পায়। বেলীকে শান্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু বেলী কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। খালি পাগলের মতো বলে যাচ্ছে,
“ওরা সবাই মিথ্যা কথা বলছে, নীলাভ্র ভাই। আমাকে প্লিজ তানিশার কাছে নিয়ে চলুন। আমি এক্ষুনি যাব ওর কাছে।”
নীলাভ্র কিছুতেই বেলীকে শান্ত করতে পারল না। বাধ্য হয়ে ওই মুহূর্তেই রিতাকে সবটা জানিয়ে ছুটল তানিশাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। প্রায় ৩/৪ ঘন্টা জার্নি করে বিকেল ৪টায় এসে পৌঁছাল তানিশাদের বাসায়। সারাটা রাস্তা বেলী এক মুহূর্তের জন্যও কান্না থামায়নি। পা°গলের মতো কেঁদেছে। তানিশাদের বাড়িতে পা রাখতেই বেলী থেমে গেলো। আর পা চলল না। বাড়ি ভর্তি লোকের সমাগম দেখে বুকের ভেতরটা আরো একবার কেঁপে উঠল। কয়েকপা পিছিয়ে পড়ে যেতে নিলেই, নীলাভ্র ধরে ফেলল। একটু কঠিন স্বরে বলল,
“তুই কি তানিশাকে দেখতে চাস না-কি চাস না? যদি তুই আর একবার কান্না করিস তাহলে এক্ষুনি তোকে নিয়ে আমি চলে যাব। নিজেকে শক্ত রাখ। সব ঠিক হয়ে যাবে।”
বেলী প্রতিউত্তরে শুধু অসহায় চাহনী দিলো নীলাভ্রর দিকে। নীলাভ্র বেলীর হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ভেতরে নিয়ে গেলো। বাড়ির উঠানে ভীড় ঠেলেই ভেতরে ঢুকতেই চোখের সামনে সাদা কাফনে প্যাঁচানো লা°শ দেখতে পেলো। একজন মহিলা লা°শটার মুখের কাপড় সরাতেই, তানিশার ঘুমন্ত চেহারাটা বেলীর চোখের সামনে ভেসে উঠল। মুহূর্তেই বেলী জোরে ‘তানিশা’ বলে চিৎকার করে উঠল। হাটু ভে°ঙে নিচে বসে পড়ল। এবার আর নীলাভ্র ধরল না। নীলাভ্র নিজেই এই দৃশ্যটা সহ্য করতে পারছে না। হাসি-খুশি মেয়েটা আজ লা°শ হয়ে সুয়ে আছে। নাহ! এ দৃশ্য সহ্য করা বড্ড কঠিন!….

#চলবে

[ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন দয়া করে। এখন থেকে কয়েক পরেব অতীত চলবে। একটু ধৈর্য নিয়ে না পড়লে কিছু বুঝবেন না। যাদের ধৈর্য নেই তারা দয়া করে শেষ হলে পড়ুন। নয়ত ভালো লাগবে না।
আসসালামু আলাইকুম ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here