#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ৬ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে অভিক ব্রাশ করে নেয়। বাইরে ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। অভিক নীরার রুমের দরজার সামনে এসে দরজায় আওয়াজ করে নীরাকে কয়েকবার ডাক দেয়। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছেনা নীরার। অভিক দেখে নীরার রুম বাইরে থেকেই লক করা। অভিক এবার চিন্তায় পরে যায়। নীরা কি তবে ভেতরে নেই? তাহলে কোথায় গেল নীরা? অভিক ম্যানেজারকে কল দিয়ে নীরার রুমের ডুপ্লিকেট চাবি নিয়ে আসতে বলে। ম্যানেজার দ্রুত অভিকের কথায় চাবি নিয়ে আসে।
অভিক ম্যানেজার-এর কাছ থেকে চাবি নিয়ে দরজা খুলে দেখে নীরা রুমের কোথাও নেই। বারান্দায়ও নেই আবার ওয়াশরুমেও নেই। অভিক উত্তেজিত হয়ে ম্যানেজারকে বলে।
‘আশ্চর্য আপনারা কই থাকেন? একটা মেয়ে কিভাবে উধাও হয়ে যেতে পারে?’
ম্যানেজার অভিককে বলে,
‘স্যার, উনি হয়তো দরজা লক করে বাইরে গেছেন। আপনি বাইরে গিয়ে খুঁজুন।’
ম্যানেজারের কথায় অভিক সব জায়গায় নীরাকে খুঁজতে লাগে। খুঁজতে খুঁজতে অভিক হোটেলের বাইরে চলে আসে। তখনই সামনে একটা মেয়েকে তার চোখে পড়ে।
হোটেলের সামনেই বিশাল এক সবুজ ঘাসওয়ালা মাঠ। মাঠের মাঝখানে দাঁড়িয়ে দু’হাত দুই দিকে মেলে, উপরের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টির ফোটা গায়ে মাখছে নীরা। চোখ বন্ধ করে অনুভব করছে এই মুহুর্তটাকে। অভিক এক ধ্যানে নীরার দিকে তাকিয়ে আছে। হোটেলের নিচ থেকে কেউ গান চালিয়ে দিয়েছে। নীরার কানে পৌঁছুতেই সে বৃষ্টিতে ভিজে গানের সাথে তাল মিলিয়ে নাচ শুরু করে। অভিক শুধু নীরার কার্যকলাপ দেখছে। এতোক্ষণে অভিকের জান যায় যায় অবস্থা। আর নীরা এসেছে নাচ করতে। অভিক ভাবতে থাকে, নীরাকে আনন্দ করতে দিবে নাকি একটা চড় দিয়ে নিয়ে আসবে?
অভিক চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আচ্ছা, কারো সামনে আসায় যদি হৃদয়ে কম্পন শুরু হয় তাহলে সেটাই কি প্রেম? কাউকে দেখে যদি এক নিমিষেই মন ভালো হয়ে যায় তবে সেটাই কি প্রেম? সেটাই যদি প্রেম হয়, তাহলে অভিক প্রেমে পড়েছে। নীরার প্রেমে!
অভিক দ্রুত হেটে নীরার কাছে যায়। বড় হওয়ার পর যে কোনো দিন বৃষ্টিতে ভিজেনি, সে এখন নীরার জন্য বৃষ্টিতে ভিজছে। নীরা বৃষ্টির পানি হাতে নিয়ে উপরে ছিটকে দিচ্ছে বারবার। অভিককে দেখেই নীরা জড় বস্তুর মতো দাঁড়িয়ে যায়। কোনো নড়চড় নেই। অভিক দু’হাত বুকে ভাজ করে নীরার দিকে তাকিয়ে আছে। দুজনের শরীর বৃষ্টিতে ভিজে একাকার! অভিক খেয়াল করে নীরার চোখের পাপড়ি ভিজে এক স্নিগ্ধতা ভর করেছে। বিন্দু বিন্দু পানি ঠোঁটে পরে ঠোঁট ভিজিয়ে দিয়েছে। অভিক শুধু নীরার দিকে তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছে করছে। একটা মেয়ের এতো রুপ হয় কিভাবে? এদিকে নীরা অভিকের ভয়ে জমে আছে একদম। অভিক নীরাকে উদ্দেশ্য করে বলে,
‘কি ম্যাডাম! বৃষ্টিতে ভেজা শেষ আপনার? এবার চলুন। আপনার কি অবস্থা করি আমি দেখবেন।’
অভিক নীরার হাত ধরে মাঠ থেকে হোটেলের দিকে আসতে থাকে। পাশাপাশি হেটে যাচ্ছে ওরা। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে আকাশ ডাকতেই নীরা চিৎকার দিয়ে অভিককে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে। নীরা খুব ভয় পেয়ে গেছে। এদিকে অভিক স্তব্ধ! এ কেমন অনুভূতি হচ্ছে তার মনে? আগে কতো মেয়েই ওকে জড়িয়ে ধরেছে, কই এমন অনুভূতি তো কখোনো হয়নি! আজ নীরার জড়িয়ে ধরাতে অভিকের এতো ভালো লাগছে কেন? তাহলে কি নীরাই সে-ই মেয়ে, যার জন্য অভিক এতোদিন অপেক্ষা করছিল? অভিকেরও ইচ্ছে হচ্ছে নীরাকে জড়িয়ে ধরার। কিন্তু অভিক চাইলেও সেটা করতে পারবেনা।
নীরা যখন বুঝতে পারলো সে অভিককে জড়িয়ে ধরে আছে দ্রুত ছেড়ে দিয়ে দূরে সরে দাঁড়ালো। অভিক নীরাকে শান্তভাবে বলে,
‘কাপড় চোপড় এর অবস্থা তো যা তা। এখন কি করবেন ম্যাম? এভাবে তো ভিতরে আপনাকে আমি যেতে দিতে পারিনা।’
নীরা অভিকের দিকে করুন চোখে তাকিয়ে আছে। অভিক নীরাকে হুট করেই কোলে তুলে নিল। নীরা হাত পা ছোড়াছুড়ি করছে আর বলছে,
‘অভিক স্যার, কি করছেন। সবাই দেখছে।’
অভিক নীরাকে নিয়ে হোটেলের সিড়ি দিয়ে তাদের রুমে যেতে নেয়। নীরা বারবার অভিককে বলছে তাকে নামিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু অভিক নীরার কথা শুনতে নারাজ। অভিক নীরাকে নিয়ে তার রুমে আসে। কোল থেকে নামিয়ে নীরার দিকে রাগী দৃষ্টি আরোপ করে। নীরা অভিকের চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে যায়। অভিক বলে,
‘কাল পা মুচড়ে গেছে আর আজই বৃষ্টিতে ভিজতে চলে গেছেন? তারউপর আজ আমাদের মিটিং আপনি জানেন না? এখন যদি আপনার জ্বর উঠে, বাই ইনি চান্স, কি করবেন আপনি? নাকি আপনি ঠিক করেই নিয়েছেন যে নিজের মতো চলবেন, কারো কথা শুনবেন না! কোনটা?’
অভিকের কথা শুনে নীরা কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
‘আ-আপ-আপনি আমাকে আপনি করে বলছেন কেন?’
অভিক ধমক দিয়ে নীরাকে বাথরুমে যেতে বলে, নীরা অভিকের ধমক খেয়েই শাড়ি নিয়ে বাথরুমে চলে যায়। অভিক নিজেও ভিজে গেছে। নীরার রুমের দরজা বন্ধ করে সে নিজের রুমে চলে যায়। নিজে ফ্রেশ হয়ে পরিপাটি হয়ে নেয়। মিটিংটা যে কেন এখানে করতে চান ওনারা। অভিক কনফিউজড।
অভিক ব্রেকফাস্ট নিয়ে নীরার রুমে গিয়ে দেখে সে এখনো ওয়াশরুমে। অভিক খাবারটা বিছানায় রেখে আবারো নিজের রুমে চলে আসে। ব্রেকফাস্ট করে একটা লম্বা ঘুম দেয়।
.
দূরের মসজিদ থেকে আজান এর ধ্বনি কানে আসতেই অভিকের ঘুম ভেঙে যায়। দুপুর এক টা বেজে গেছে। অভিক উঠে আগে নিচে যায়। পাশের কয়েকটি মার্কেট ঘোরাঘুরি করে কিছু কিনে নিয়ে আসে। হোটেলে আসতেই সোজা নীরার রুমে গিয়ে দরজায় নক করে অভিক। নীরা দরজা খুলে দেয়। অভিক ভিতরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। নীরা আজ সবুজ শাড়ি পরেছে। নীরার মাথায় ঘোমটা দেওয়া দেখে অভিক জিজ্ঞেস করে,
‘মাথায় ঘোমটা দিলে যে?’
‘নামাজ পড়ছিলাম তাই। আসুন।’
অভিক এসে নীরাকে একটা শপিং ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলে,
‘আজ মিটিং এ এই ড্রেসগুলোর মধ্যে একটা পরবে। আর তোমাকে শাড়ি পড়তে হবে না।’
নীরা ব্যাগ হাতে নিয়ে দেখে খুব সুন্দর দুটো চুরিদার কিনে নিয়ে আসছে অভিক। নীরা খুশি হয়ে বলে,
‘থ্যাঙ্কিউ স্যার।’
অভিক নীরাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কেন ভিজেছ বৃষ্টিতে?’
‘বৃষ্টি আমার খুব পছন্দের। জানেন, আল্লাহ যখন খুব খুশি হন তখন বৃষ্টি দেন। বৃষ্টিতে ভেজা সুন্নত। বুঝলেন?’
অভিক কিছু বলে না। নীরাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যায়। খেয়ে ওখান থেকে আবার চলে আসে। ওখানের অনেকেই তো বলাবলি করছিল দুজনকে খুব মানিয়েছে। কে উত্তর দিতে যাবে তাদের কথায়? নীরাও এড়িয়ে গেছে আর অভিকও।
.
সন্ধ্যায় রেড়ি করে অভিক আর নীরা একটা ফাইভ স্টার হোটেলে এ যায়। অভিকের দুজন ক্লায়েন্ট আসেন ওখানে। নীরা এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। অভিকের ফাইলগুলো নীরার কাছে। নীরা একটা একটা করে অভিককে ফাইল দিচ্ছে আর অভিক সেগুলো দেখে তার ক্লায়েন্টদের দেখাচ্ছে। তাদের মধ্যে একজন নীরাকে দেখে জিজ্ঞেস করে কে ও। অভিক জানায় নীরা তার পিএ। তারা কথা না বাড়িয়ে অভিকের কথা শুনছেন। ক্লায়েন্টর সাথে অভিকের বন্ধুসুলভ আচরণ যেন নীরাকে মুগ্ধ করে। নীরা ভাবছে, অভিক এতো সুন্দর করে কথা বলে? নীরার সাথেই শুধু ঝগড়া করে, রেগে কথা বলে।
.
অভিকের সাথে তারা আলোচনা করে অভিকের কথায় রাজি হয়। অভিকের হ্যাঁ তে হ্যাঁ মিলায়। অভিক তাদের ধন্যবাদ দেয়। তাদের ডিনারের অফার করে। কিন্তু তারা তাড়া দেখিয়ে চলে যায়। অভিক খুশি হয়ে নীরাকে বলে,
‘অনেকদিনের একটা প্রোজেক্ট আটকে ছিল নীরা, ফাইনালি আবার সেটা চালু করতে পেরে খুব ভালো লাগছে আমার।’
খুশিতে নীরাকে জড়িয়ে ধরে অভিক। নীরার চক্ষু চড়কগাছ। কিন্তু নীরা কিছু বলে না। অভিকের যখন হুশ ফিরে তখন নীরাকে ছেড়ে তারা হোটেলের দিকে বেরিয়ে পড়ে। যেতে যেতে অভিক বলছে,
‘কাল চলে যাবো। ব্যাগ গুছিয়ে নিও।’
নীরা অভিমানী কন্ঠে বলে,
‘কক্সবাজারে এলাম, অথচ সমুদ্রেই গেলাম না।’
‘আচ্ছা যাও, নিয়ে যাবো।’
খুব খুশি হয়ে যায় নীরা অভিকের কথা শুনে। ওরা হোটেলে ফিরে হালকা নাশতা করে ঘুমিয়ে পরে যে যার রুমে।
চলবে…