#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ৪ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
প্রায় এক সাপ্তাহ কেটে গেছে। নীরা অভিকের পিছনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে হাফিয়ে গেছে। খুব সকালে উঠে অফিসে এসে পৌঁছাতে হয় তাকে। অভিকের কেবিন গুছিয়ে রাখতে হয়। তারপর অভিক এলেই অভিকের কথামতো সব করতে হয়।
আজো নীরা অভিকের কেবিনে এসে সব গুছিয়ে রেখেছে। কেবিন থেকে বের হতে নিলেই কারো সাথে ধাক্কা খায় নীরা। ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে নিলেই কেউ নীরার কোমর জড়িয়ে ধরে। নীরা তাকিয়ে দেখে অভিক তাকে ধরে আছে।
অভিক মাত্রই অফিসে এসেছে। নীরা কাঁপা গলায় বলে,
‘ছা-ড়ু-ন।’
অভিক নীরাকে ছেড়ে দিতেই সে ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে যায়। নীরা ‘আহ্’ শব্দ করে উঠে। কোমরে ব্যথা লাগে। অভিক একটা চেয়ার টেনে বসে নীরার সামনে। একটা সিগারেট ধরিয়ে খেতে শুরু করে। নীরা সিগারেটের গন্ধ একদমই সহ্য করতে পারে না। ফ্লোর থেকে কোনমতে উঠে নীরা অভিকের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
‘আপনি এমন কেন? আমাকে ফেলে দিতে পারলেন?’
অভিক ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বলে,
‘তুমিই তো বললে তোমায় ছেড়ে দিতে। তাহলে প্রশ্ন করছো কেন এতো?’
নীরার শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। সিগারেটের তীব্র ধোঁয়ায় নীরা কাশতে শুরু করে। অভিককে বলে,
‘প্লিজ সিগারেটটা ফেলে দিন। আমি নিঃশ্বাস নিতে পারছিনা।’
নীরা কাশতে কাশতে নিচে বসে যায়। অভিক নীরার এই অবস্থা দেখে উঠে সিগারেটটা জানালা দিয়ে ফেলে দেয়। তারপর দ্রুত নীরার কাছে গিয়ে দেখে নীরা অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। অভিক খুব ভয় পেয়ে যায়। নীরাকে পাজ কোলে তুলে তার কেবিনের ছোট সোফায় শুইয়ে দেয় অভিক। এক গ্লাস পানি নিয়ে হাত দিয়ে ছিটিয়ে দেয় নীরার চোখে। তারপর হাত দিয়ে আলতো করে নীরাকে চড় দিয়ে বলে,
‘নীরা? উঠো। কি হয়েছে তোমার? এই দেখো আমি সিগারেট ফেলে দিয়েছি। উঠো না।’
অভিক আবারও পানি ছিটিয়ে দেয় নীরার চোখে। নীরা আস্তে করে চোখ খোলে।
চোখ খোলার পর নিজের খুব কাছে অভিককে দেখে ভড়কে উঠে।
‘তুমি ঠিকাছ?’
অভিকের কথা শুনে নীরা ছোট করে বলে,
‘হুম।’
অভিক নীরার দু গালে হাত রেখে বলে,
‘আ’ম সরি নীরা।’
নীরা এক ঝটকায় অভিকে হাত সরিয়ে উঠে যায়।
‘ছোবেন না আমাকে। খুব খারাপ আপনি।’
অভিক নীরার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়।
‘গেট লস্ট। এক্ষুণি বেরিয়ে যাও আমার কেবিন থেকে।’
নীরা অভিকের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘চলে যাচ্ছি। কি হবে আপনার চাকরি না করলে? টাকা দিতে না পারলে জেলে দিবেন? বেশ! আমি জেলে যেতেও রাজি। অন্তত ওখানে আপনার মুখ টা তো আর দেখতে হবে না আমাকে।’
অভিক রেগে নীরার দু গাল হাত দিয়ে চেপে ধরে বলে,
‘সমস্যা কি তোমার? নিজেকে কি বেশী সুন্দরী মনে করো তুমি? তোমার মতো মেয়েরা অভিকের পেছনে ঘোরে। আর তুমি?’
‘আপনার মতো খারাপ লোকের পিছনে যারা ঘোরে, তারা পাগল ছাড়া আর কিছুই নয়। ছাড়ুন আমাকে।’
নীরা কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে যায় ওখান থেকে।
অভিক টেবিলে থাকা সব জিনিস রেগে ফ্লোরে ফেলে দেয়। কাঁচের সাথে লেগে অভিকের হাত কেটে যায়। রক্ত টলমল করে গড়িতে পড়ছে। অভিকের সেদিকে খেয়াল নেই। অভিক মনে মনে বলছে।
‘কি নেই আমার মধ্যে? ওই মেয়েটার এতো ঘৃণা কেন আমার প্রতি?’
🌼
রাত আটটার দিকে নীরা একটু বাইরে বেরিয়েছে কিছু জিনিস ক্রয় করার জন্য। আশ্রমের পাশেই একটা মার্কেট আছে। নীরা যখন জিনিসগুলো নিয়ে মার্কেট থেকে বের হলো, ঠিক তখনই একটা ছেলেকে দেখলো নীরা। ছেলেটা নীরাদের আশ্রমে থাকা সেই ছেলে, যে নীরাকে বিরক্ত করতো সবসময়। ওর নাম ফাহিম। এই ফাহিম এখানে কি করছে সেটাই ভেবে পাচ্ছেনা নীরা।
হুট করেই ফাহিম এসে নীরার হাত ধরে। নীরা অবাক হয়। ছাড়তে বলে, কিন্তু ফাহিম শয়তানি হাসি দিয়ে নীরার কাছে আসতে নিল। নির্জন রাস্তায় একা দাঁড়িয়ে আছে নীরা। ফাহিমের মতলব বুঝতে পেরে নীরা ধাক্কা দিয়ে ফাহিমকে ফেলে উল্টো দিকে দৌড় লাগায়। নীরার পিছনে ফাহিমও দৌড়ে আসছে।
দৌড়াতে দৌড়াতে নীরা একটা ডুপ্লেক্স বাড়ির সামনে চলে আসে। উপায় না পেয়ে সোজা বাড়ির ভিতরে চলে যায়। বাড়ির বাইরে একজন দারোয়ান ছিল, সে ঘুমুচ্ছিল। এই সুযোগে নীরা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। কি আশ্চর্য! বাড়ির দরজা খোলা রয়েছে। নীরার ভয় করলেও এখন ফাহিমের কাছ থেকে বাঁচতে হলে এখানে লুকিয়ে থাকতে হবে। অন্যদিকে ফাহিমও দৌড়ে বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে।
.
নিজের হাতে আঁকা নীরার ছবির দিকে অপলকভাবে তাকিয়ে আছে অভিক৷ এই মেয়েটির মাঝে কি এমন আছে যে প্রথম দিনই তার ছবি এঁকে ফেললো অভিক? এ মেয়ে ঝগড়া ছাড়া আর কিছুই বোঝে না। রাগী আর বোকা।
এসব ভেবে হাসছে অভিক নিজে নিজে। নিচ থেকে কিছু পড়ার শব্দে ভাবনা থেকে বেরিয়ে এলো অভিক। সে দ্রুত নিচে চলে গেল। অভিক এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখে সোফার পিছনে কারো ওড়না দেখা যাচ্ছে। অভিক আস্তে করে সেখানে গেল। আর গিয়ে যা দেখলো তার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা অভিক। অভিক দেখে নীরা তার বাড়িতে ঢুকে সোফার পিছনে লুকিয়ে আছে। অভিক নীরাকে ডাকে।
‘নীরা তুমি?’
নীরা অভিকের গলার আওয়াজ শুনে অভিকের দিকে তাকায়। নীরা দাঁড়িয়ে যায়। নীরা কি তাহলে অভিকের কাছে সাহায্য চাইবে? সকালেই তো কতগুলো কথা শুনিয়ে দিল অভিককে। এখন অভিকের উদ্দেশ্য খারাপ হয় যদি? নীরা কিছু না বলে বেরিয়ে যেতে নিলেই অভিক পিছনে হাত ধরে ফেলে নীরার।
ফাহিমকে ঢুকতে দেখে নীরা অভিকের পিছনে লুকিয়ে পড়ে। ফাহিম এসে অভিকের পিছন থেকে নীরার হাত টেনে নিয়ে যেতে চাইলে অভিক বলে,
‘হাতটা ছাড়! ও কি তোর বাবার সম্পত্তি যে নিয়ে যেতে চাইছিস?’
ফাহিম বলে,
‘ও আমার বউ। আমি ওকে নিয়ে যাবো, বাঁধা দেওয়ার তুই কে?’
অভিক নীরার দিকে তাকাতেই নীরা মাথা নাড়ায়, যার মানে ছেলেটা মিথ্যে বলছে। অভিক নীরার হাত ছাড়িয়ে ফাহিমকে মারতে শুধু করে। লাথি ঘুষি যা পারছে দিয়েই যাচ্ছে। নীরা এসব দেখে অভিককে থামতে বলে, কিন্তু অভিক নীরার কথা কানে নেয় না। রক্ত ঝড়িয়ে আধমরা করে সিকিউরিটিকে দিয়ে ফাহিমকে বাড়ির বাইরে বের করে দেয়। অভিকের মাথা প্রচন্ড গরম হয়ে আছে। নীরা বলে,
‘আপনি কি মানুষ? এভাবে কাউকে মারতে আপনার হাত কাঁপলো না?’
‘নাহ্। ও তোমার গায়ে হাত দিবে কেন? নোংরা লোকদের আমি এভাবেই শাস্তি দেই।’
নীরা বলে,
‘ওকে নোংরা বলছেন। আপনি কি সেটা নিজে ভেবেছেন? আপনিও তো নোংরা। আগে নিজে ভালো হন। তারপর অন্যদের খারাপ বলুন। অন্যদের দোষ পরে ধরবেন।’
অভিক রেগে বলে,
‘কি বললে তুমি? আমি নোংরা লোক?’
‘আপনি আপনার গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্ত্বেও অন্য মেয়েদের নিয়ে অফিসে আসেননি? তাদের সাথে নোংরামি, অসভ্যতা করেননি? আপনি আপনার গার্লফ্রেন্ডকে ঠকিয়েছেন। এসব কি ভালো? তাছাড়া, আপনি অফিসেই এসব করেন না জানি বাসায়…ছিঃ।’
অভিক একটু শান্ত হয়ে বসে। তারপর নীরাকে শান্তভাবে বলে,
‘আমার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই। আর ওই মেয়েগুলো আমার কাছে এসেছে ঠিকি। কিন্তু এতটা কাছে আমি ওদের আসতে দেইনি৷ আমি শুধু সবার সাথে টাইমপাস করি ব্যাস। তাছাড়া অভিক কোনো মেয়েকে নিজের এতটা কাছে আসতে দেয়নি এখনো পর্যন্ত। কারণ অভিক জানে, সবাই তার লুকস আর সম্পত্তি দেখেই তার কাছে আসে। ভালোবেসে নয়। আর ওদের মধ্যে সবাই সুযোগ খুঁজেছে বদনাম ছড়িয়ে দেওয়ার। কিন্তু অভিক সেটা হতে দেয়নি। অভিক কোনো মেয়েকে নিজে থেকে এখনো ছুঁয়ে দেখেনি। তুমি বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা তবে, অভিকের অফিসে এখন আর কোনো মেয়ে আসেনা।’
নীরা এতক্ষণ অভিকের সব কথা শুনেছে। অভিক কি আসলেই সব সত্যি বলছে? নাকি ভালো সাজার অভিনয় করছে? নীরাকে ভাবনায় দেখে অভিক বলে,
‘জানো নীরা, এ পৃথিবীতে তোমারও যেমন কেউ নেই ঠিক তেমনি আমারও কেউ নেই। ছোট বেলায় সবাইকেই হারিয়েছি। শুধু বাবার সম্পত্তি ছিল। আর বাবার ব্যবসা নিয়েই এখন পড়ে থাকি। সবাই শুধু আমার টাকার পিছনেই পড়ে আছে। আমাকে বোঝার বা ভালোবাসার কেউ নেই। আমি একা, বড্ড একা।’
নীরা বলে,
‘আমি আশ্রমে যাবো।’
অভিক নীরার কথা শুনে নীরাকে একটু ওয়েট করতে বলে নিজে উপরে যায়। তারপর উপর থেকে কিছু একটা নিয়ে এসে নীরাকে দিয়ে বলে,
‘এটা তোমার! সেদিন ছিঃ বলে চলে যাওয়ার সময় পড়ে গেছিল।’
নীরা হাতে নিয়ে দেখে তার হারানো ঝুমকো। নীরা অবাক হয় বেশ। তারমানে অভিক সব জানে? আচ্ছা! অভিক কিভাবে বুঝলো যে ঝুমকোটা নীরার?
অভিক নীরাকে নিয়ে আশ্রমে দিয়ে আসে। আর আশ্রমে গিয়ে ফাহিমকে আশ্রম থেকে বের করে দিতে বলে। অভিক আশ্রমে অনেক অর্থ দেয়, নীরার সেটা অজানা ছিল। অভিকের কথায় তারা জানায় হাসপাতালে থেকে ফাহিম ফিরলেই তাকে আর এ আশ্রমে ঢুকতে দেওয়া হবেনা। যাওয়ার সময় অভিক নীরাকে এক পলক দেখে যায়।
চলবে…