তুমি আমার অভিমান পর্ব ২০

0
1028

#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ২০ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি

আজ ফাহাদ শুভ্র আর প্রীতি এসেছে নীরাদের বাসায়। সেদিন ফাহাদ নিজেই জেনিকে বের করে দেয় তার বাসা থেকে। এর দুইদিন পর নীরা ওদের ইনভাইট করে ওদের বাসায় আসার জন্য। আজ আবার অভিকও আসছে সিঙ্গাপুর থেকে। নীরা আজ নিজের হাতে সবার জন্য রান্না করছে। পোড়া হাত নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকেছে সে। প্রীতি বারবার বলেছে সে সাহায্য করবে। কিন্তু না, নীরা তা শোনেনি। একাই সব করছে।

শুভ্র, ফাহাদ আর প্রীতি সোফায় বসে আড্ডা দিচ্ছে। এদিকে রান্না শেষ করে নীরাও ওদের সাথে আড্ডা দিতে বসে যায়। কিছুক্ষণ আড্ডা দেওয়ার পর ওদের খাবার সার্ভ করে দেয় নীরা। সবাই মিলে একসাথে বসে খাবার খায়।

বিকেল হওয়ার আগেই ফাহাদরা নীরাকে তাড়া দিয়ে বলে,

‘চলো নীরা। অভিক যখন আসবে তোমাকে নিয়ে আসবে।’

‘না ভাইয়া। উনি তো আজ আসছেন। তাহলে ও বাড়ি যাবো কেন?’

‘অভিক আসতে বোধয় লেইট হবে। আমরা দেখা করতে পারবো না বাড়িতে কাজ আছে একটু।’

‘তাহলে আপনারা চলে যান আমি আছি।’

শুভ্র বলল,

‘একা একা থাকতে পারবে?’

‘আর একটু পরেই তো উনি আসবেন বোধয়। থাকতে পারবো।’

নীরার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ওরা সবাই চলে যায়। নীরা দরজাটা লাগিয়ে উপরে তার রুমে চলে যায়। রুমে এসে নীরা ভেবে পাচ্ছেনা সে কি করবে! আলমারি থেকে একটা সবুজ শাড়ি বের করে চট জলদি পড়ে নেয়। চুলগুলো খোঁপা করে তাতে গাজরা লাগিয়ে দেয়। চোখে গাঢ় কালো কাজল দেয়। ঠোঁটে গোলাপি লিপস্টিক দেয়। ছোট ছোট কয়েকটা চুল চোখের সামনে ফেলে দেয়। কানে বড় বড় ঝুমকো পড়ে। হাতে সবুজ রঙের চুড়ি পড়ে। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই লজ্জা পায় খুব। অভিককে সে কতদিন পর দেখবে। আচ্ছা, অভিকের এই সাজ পছন্দ হবে তো?

কলিংবেল এর আওয়াজ পেয়ে নীরার বুক ধক করে উঠে। অভিক এসেছে? নীরা দ্রুত পা চালিয়ে নিচে নামে। একরাশ হাসি নিয়ে দরজাটা খুলে দেয়। কিন্তু দরজা খুলতেই নীরার সব হাসি, আনন্দ মিলিয়ে যায়।

.
সময় তখন ৩:০০ টা। এয়ারপোর্ট থেকে বেড়িয়ে একটা ফুলের দোকানে ঢুকে অভিক। একটা গোলাপের বুকি নিয়ে মুচকি হাসে। মনে মনে বলে,

‘পাগলীটা আজ অনেক খুশি হবে আমায় দেখলে। এ কয়েকটা দিন যেন এক বছরের মতো কেটেছে আমার। আজ ওকে মন ভরে দেখবো।’

অভিক ওখান থেকে গাড়ি নিয়ে নিজের বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পাঁচ দিন পর সে বাসায় ফিরছে। বাসায় ফিরে নীরাকে দেখবে এটাও জানে। কারণ শুভ্ররা সবাই নীরার সাথে তার বাসায় এসেছে। অভিকের খুশির শেষ নেই।

২০ মিনিট পর বাসায় পৌঁছে যায় অভিক। গাড়ি থেকে নেমে গেইট এর কিনারায় দেখে বাসার দারোয়ানকে কেউ আঘাত দিয়ে চলে গেছে। অভিকের আশ্চর্য লাগলো। হঠাৎই নীরার কথা মনে হতেই বাসার সামনে এসে দেখে দরজা খোলা। ভিতরে এসেই আর এক দফা চমকে যায়। হাত থেকে ফুলের বুকিটা পড়ে যায় অভিকের।

নীরাকে কারা যেন আঘাত দিয়েছে। কপালে আঘাতের চিহ্ন। মেঝেতে রক্ত গড়াগড়ি খাচ্ছে। হাত পায়ে আঘাতের চিহ্ন। মনে হচ্ছে খুব মেরেছে কেউ ওকে। অভিকের প্রাণ পাখি যেন উড়ে যাচ্ছে। অভিক নীরার কাছে গিয়ে তার মাথাটা নিজের কোলে রাখে। অসহায়ের মতো নীরা নীরা বলে চিৎকার করতে থাকে৷ অভিক নীরার পেটের দিকে তাকিয়ে দেখে পেট থেকে রক্ত বের হচ্ছে। তারমানে ওকে পেটেও আঘাত করা হয়েছে? অভিক নীরার গালে আলতো হাত রেখে ডাকতে থাকে। কিন্তু নীরার কোনো সাড়া শব্দ নেই। অভিকের কলিজাটা মোচড় দিয়ে উঠে। সে ফাহাদদের ডাকতে থাকে।

‘ফাহাদ, শুভ্র। কোথায় তোরা। প্লিজ আয় এখানে। আমার নীরা…।’

অভিক বাচ্চাদের মতো কাঁদতে থাকে। নীরাকে কোলে নিয়ে গাড়িতে বসায়। দারোয়ানকেও পিছনের সিটে বসায়। ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে নীরাকে বসিয়ে সিট বেল্ট বেঁধে দেয় অভিক। ড্রাইভ করতে করতে শুভ্রকে কল দিয়ে বলে,

‘তোরা যেখানেই থাক। মেডিকেল এ আয় জলদি।’

শুভ্র অভিকের কল পেয়েই ফাহাদকে কল করে। ওরা ঘাবড়ে যায়। হঠাৎ মেডিকেলে কেন ডাকলো অভিক? নীরার কি কিছু হয়েছে?

.
অভিক স্প্রিডে গাড়ি চালিয়ে ঢাকা মেডিকেল হসপিটালে ওদের নিয়ে আসে। লোক ডেকে দারোয়ান কে একটা কেবিনে শিফট করায়। দারোয়ান এর চেয়ে নীরার আঘাতই প্রচুর। নীরাকে কোলে নিয়ে হসপিটালের ভিতর ঢুকে ডাক্তারকে ডাকতে থাকে অভিক। পাগল পাগল লাগছে অভিককে। ডাক্তার নীরাকে দেখেই বলে পুলিশ কেইস। অভিক রেগে যায়। ডাক্তারকে ইচ্ছেমতো কথা শোনায়। ততক্ষণে ফাহাদ আর শুভ্রও এসে গেছে। ফাহাদ ডাক্তারকে বলে সে পুলিশকে খবর দিবে। কিন্তু আপাতত নীরার চিকিৎসার প্রয়োজন। নীরাকে ভিতরে নিয়ে যাওয়া হলো। প্রীতি দূর থেকে তাকিয়ে সব দেখছে।

অভিক ফ্লোরে বসে পড়ে। ফাহাদ আর শুভ্র ওকে ধরে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছিল? অভিক তখন সব কিছু বলে।

ফাহাদ চমকে বলে,

‘তারমানে আমরা যাওয়ার পরপরই এসব হলো।’

শুভ্র বলে,

‘বারবার নীরাকে বলেছিলাম একা থেকো না। আমাদের সাথে চলো। কিন্তু না। নীরা বলল সে একা থাকতে পারবে কিছুক্ষণ পর তুই চলে আসবি।’

অভিক ফাহাদ আর শুভ্রর হাত ধরে বলে,

‘আমার নীরাকে আমার কাছে ফিরিয়ে দে না দোস্ত। আমার ওকে চাই। প্রতিটা নিঃশ্বাসে আমার ওকে প্রয়োজন। আমার নীরাকে প্লিজ তোরা আমার কাছে ফিরিয়ে দে। আমি ওকে এ অবস্থায় দেখতে পারছিনা।’

অভিক হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। অভিককে আজ পর্যন্ত কেউই কাঁদতে দেখেনি। একটা ছেলে ঠিক কতটা আঘাত পেলে কাঁন্না করে তা অভিককে দেখলেই বোঝা যায়।

নীরার শরীর থেকে ব্লাড যাওয়ায় ওকে অনেক রক্ত দিতে হয়েছে। শুভ্রর রক্তের গ্রুপ আর নীরার রক্তের গ্রুপ এক ছিল। তাই শুভ্র নীরাকে রক্ত দিয়েছে। ডাক্তার এখনো কিছুই বলেননি। অভিক ডাক্তারের পিছনে দৌড়ে যাচ্ছে। আবার হতাশ হয়ে ফিরে আসছে। এদিকে ফাহাদ পুলিশে কমপ্লেইন করে আসে। প্রীতি একপাশে গুটিশুটি মেরে বসে আছে। নীরার জন্য নিরবে চোখের পানি ঝড়ছে তার।

কিছুক্ষণ পর ডাক্তার এসে বলেন নীরার জ্ঞান ফিরেনি। তবে অবস্থা খুব খারাপ ছিল। আর পনেরো মিনিট লেইট হলে হয়তো রোগী কে বাঁচানো যেত না। ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। ঘুমুচ্ছে। কিছু ঔষধ অভিককে আনতে বলে একটা স্লিপ ধরিয়ে দিল ডাক্তার। অভিক গিয়ে ডাক্তারের দেওয়া ঔষধগুলো নিয়ে আসে। শুভ্র যেতে চেয়েছিল কিন্তু অভিক শুভ্রকে রেস্ট নিতে বলে।

সন্ধ্যার সময় নীরার জ্ঞান ফিরে। অভিক দৌড়ে আসে নীরার কাছে। নীরার সমস্ত মুখে পাগলের মতো চুমু দিতে থাকে। হাত ধরে কাঁন্না জুড়ে দেয়। এসব দেখে নীরা হতভম্ব হয়ে যায়। অভিক নীরাকে জিজ্ঞেস করে।

‘তোমার এ অবস্থা কে করেছে নীরা? শুধু একবার তার নাম বলো। ছাড়বো না আমি।’

নীরা বলে,

‘আপনি এসেছেন ভেবে দরজা খুলতে গিয়ে দেখি কালো পোশাক পড়া কিছু লোক মুখে মাস্ক লাগানো। ওরা ভিতরে ঢুকেই আমার চুল ধরে দেওয়ালের সাথে বারি দেয়। আমাকে চড় থাপ্পড় দিতেই থাকে। তারপর আমার পেটে ওরা লাথি দেয় অনেক।’

নীরা কাঁদতে থাকে। ডাক্তার এসে অভিককে চলে যেতে বলে। কারণ এই মুহুর্তে প্রেসেন্ট এর সামনে বসে কাঁন্না করা ভালো নয়। তাছাড়া প্রেসেন্টও কেঁদে চলেছে। এতে প্রেসেন্ট এর ক্ষতি হতে পারে।

অভিক চলে আসে। শুভ্র ওকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে যায়। অভিক ভেবে পাচ্ছেনা কে বা কারা নীরার এই অবস্থা করেছে। কারো সাথে তো শত্রুতা নেই তার।

অভিক রাস্তায় দাঁড়িয়ে এসব ভাবছে আর হঠাৎ করেই একটা বাইক অভিকের চারপাশে ঘুরতে শুরু করে। অভিকের চোখে বাইকের লাইটগুলো পড়েছে। অভিক চোখে হাত দিয়ে রেখেছে। কিছু একটার শব্দে অভিক চমকে উঠে। শুভ্র ওকে ধাক্কা দিয়েছে। শুভ্রের ধাক্কায় অভিক নিচে পড়ে যায়৷ কালো পোশাক পড়া দুটো লোক ছিল বাইকে। বাইকটা মুহুর্তেই চোখের সামনে দিয়ে চলে যায়। অভিক শুভ্রর দিকে তাকিয়ে দেখে শুভ্র বুকে হাত দিয়ে বসে আছে। গড়গড় করে রক্ত পড়ছে শুভ্রর হাত বেয়ে। অভিক দ্রুত শুভ্রর কাছে এসে শুভ্রকে ধরে।

‘এই শুভ্র, কি হয়েছে? রক্ত কোথা থেকে এলো?’

শুভ্র নিঃশ্বাস টেনে নিল।

‘ওরা তোকে গুলি করতে চেয়েছিল অভিক। ওদের তুই ছাড়িস না।’

অভিকের হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে।

‘কি বলছিস তুই এসব? তুই কেন গুলির সামনে আসতে গেলি? আমি এক্ষুণি তোকে হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছি।’

শুভ্র বাধা দিয়ে বলে,

‘এখন আর কিছু হবে না দোস্ত। নীরাকে দেখে রাখিস।’

অভিক জ্ঞান শূন্যতায় ভুগছে। সে এখন কি করবে মাথায়ই আসছে না।

‘গুলি করলে আমায় করতো তুই কেন আমাকে বাঁচালি দোস্ত।’

শুভ্র হেসে বলে,

‘নীরার তো তুই ছাড়া আর কেউ নেই। তোর কিছু হলে নীরা কি নিয়ে বাঁচবে? আমার কিছু হলে কারো কিছু যায় আসবে না।’

অভিক শুভ্রকে নিয়ে হসপিটালে যেতে থাকে। শুভ্রর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। ও অভিকের কোলেই নিস্তেজ হয়ে যায়। অভিক চিৎকার দিয়ে উঠে। শুভ্র শুভ্র বলে ডাক দিতে থাকে। কিন্তু শুভ্র আর চোখ খোলে না। অভিক চ্যাঁচিয়ে বলে,

‘শুভ্র! তুই এভাবে আমাকে হারিয়ে চলে যেতে পারিস না। ওঠ শুভ্র। শুভ্র….!’

ডাক্তারের কাছে পৌঁছুতেই ডাক্তার শুভ্রকে চেক করে জানায় ওর আর প্রাণ নেই। অভিক যেন ওখানেই থমকে যায়। ফাহাদ আর প্রীতি এসেই চিৎকার দিয়ে উঠে। শুভ্রকে অনেক ডাকাডাকি করতে থাকে। কিন্তু শুভ্র তো আর কখনোই জবাব দিবে না।

.
শুভ্রকে তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। চারিদিকে কাঁন্নার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। শুভ্রর মা ও বাবা বাচ্চাদের মতো কাঁদছেন। অভিক যেন পাথর হয়ে গেছে। নীরাকে এখনো পর্যন্ত কিছু জানানো হয়নি। প্রীতি আর ফাহাদও চোখের পানি ফেলছে। কি থেকে কি হয়ে গেল। শুভ্রকে কাল সকালে কবর দেওয়া হবে। ততক্ষণ পর্যন্ত শুভ্রকে ফ্রিজিং গাড়িতে রাখা হবে। অভিক শুভ্রর মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করছে।

রাত ১১ টার দিকে অভিক হসপিটালে আসে৷ নীরা কিছু খেতে চাইছে না। সবাই ওকে রেখে কোথায় যেন চলে গেল। আর অভিককে না দেখলে সে খাবেই না। নার্সদের সাথে জোড়াজুড়ি শুরু করেছে। অভিক আসার পর শান্ত হয়ে যায়। অভিক নীরার মুখের সামনে খাবার তুলে ধরে। নীরা কিছুক্ষণ অভিকের দিকে তাকিয়ে বলে,

‘কি হয়েছে আপনার? এতো মন মরা হয়ে আছেন কেন? আর চোখটাও তো ফুলে গেছে।’

অভিক মলিন হেসে বলে,

‘তেমন কিছুনা। নাও খাও।’

নীরা অভিকের হাত থেকে খেতে শুরু করে।

‘আমার পেটে খুব ব্যথা করছে। খেতে ইচ্ছে করছে না। খাবো না।’

‘আর একটু খেয়ে নাও।’

অভিক নীরাকে পরম যত্নে খাইয়ে দিচ্ছে। শুভ্রর কথা মনে পড়লেই বুক ধক করে উঠে। খুব কাছের বন্ধুকে হারিয়ে ফেললো সে। নীরাকে এখন কিছুতেই এসব বলা যাবে না। নাহলে নীরাকে সুস্থ করা যাবে না। অভিক নীরাকে খাইয়ে ঘুম পারিয়ে দেয়। তারপর নীরার পাশে বসে বসে ভাবতে থাকে কে এসব করলো। মনে মনে বলে,

‘শুভ্রকে যে খুন করেছে, আর নীরার এ অবস্থা যাদের জন্য হয়েছে। তাদের খুঁজে এক এক করে যতদিন না উপযুক্ত শাস্তি আমি দিতে পারছি। ততদিন আমি দু’চোখের পাতা এক করবো না। কথা দিলাম।’

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here