#তুমি_আমার_অভিমান❤
|| পর্ব – ১৯ ||
#লেখনীতে_বিবি_জোহরা_ঊর্মি
সকালের মিষ্টি রোদের আলো কাচের জানালা ভেদ করে নীরার চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় নীরার। নীরা উঠে আগে ওয়াশরুমে গিয়ে মুখ ধুয়ে আসে। তারপর রুমে এসে বিছানা ঘুছিয়ে নেয়। মাথা আছড়িয়ে পরিপাটি হয়ে নেয়। এরপর দরজাটা খুলে ড্রয়িংরুমের দিকে অগ্রসর হয়।
সকাল সকাল ফাহাদের বাসার বড়রা রান্নার কাজে লেগে পড়ে। এতো মানুষের জন্য চা পরটা আবার যে যা খায় তা-ই করতে হচ্ছে তাদের। নীরা রান্নাঘরে ঢুকে দেখে মহিলাদের বেহাল দশা। নীরা নিজেও তাদের সাথে হাত লাগায়। তারা বারবার না করে নীরাকে কাজ করতে। কিন্তু নীরা তাদের কথা না শুনেই তাদের সাহায্য করতে লেগে পড়ে।
এদিকে সোফায় বসে জেনি নীরার এসব দেখছে আর গরম হয়ে যাচ্ছে। শুভ্র ফোনে গেইম খেলছিল। জেনি শুভ্রকে নীরার বিষয়ে বলতে থাকে।
‘অভিকের চয়েস এতো বাজে, ছিঃ। কোত্থেকে কাজের, থার্ড ক্লাস মেয়ে একটাকে বিয়ে করেছে। পোশাক দেখেছ? শাড়ী? আর ইউ ক্রেজি? অভিকের বউ এতো শাড়ী পড়ে থাকে কিভাবে? আর অভিক তা সহ্য করেই বা কি করে। ইশ!’
শুভ্রর নজর এতক্ষণ ফোনেই ছিল। কিন্তু যেই জেনি নীরার নামে এসব ওর কানের কাছে এসে বলে, তখনই শুভ্রর রাগ উঠে যায়। শুভ্র রাগী চোখে জেনির দিকে তাকিয়ে বলে,
‘হাউ ডেয়ার ইউ জেনি! নীরার ব্যাপারে এসব বলার সাহস পেলে কোথায় তুমি? ইউ নো হোয়াট? তুমি দেশের বাইরে থেকে একেবারের ওই দেশের মানুষ হয়ে গেছ। নিজের দেশের সংস্কৃতি সম্পর্কে বিন্দু মাত্রও ধারণা নেই তোমার। সবসময় তো দেখি ছোট ছোট পোশাক পরে অভিকের চারপাশে ঘুরে বেড়িয়েছ। কই! অভিক তোমায় পাত্তা দিয়েছে? তুমি আমাদের বন্ধু বলে তোমার সব কথাই যে আমাদের শুনতে হবে তা কিন্তু না। নিজের সীমার মধ্যে থাকো।’
শুভ্র উঠে ওখান থেকে চলে গেল। এতো কিছু বলার পরেও জেনির মতলব পাল্টায়নি। নীরাকে ও ছাড়বে না। নীরার জন্যই অভিক আর শুভ্র ওকে এতো কথা শুনিয়ে দিল।
.
বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রীতিকে জড়িয়ে ধরে আছে ফাহাদ। অনেক অপেক্ষার পর প্রীতিকে কাছে পেয়েছে সে। তাই কিছুতেই ছাড়তে নারাজ। ফাহাদ প্রীতির কোমর জড়িয়ে ধরে গান গেয়ে উঠে।
‘তুমি আর তো কারো নও শুধু আমার।
যত দূরে সরে যাও রবে আমার।
স্তব্ধ সময়টাকে ধরে রেখে,
স্মৃতির পাতায় শুধু তুমি আমার।’
ফাহাদের গান গাওয়ার মাঝেই শুভ্র ওখানে ঢুকে পড়ে। শুভ্রকে দেখেই প্রীতি ফাহাদকে একটা ধাক্কা দিয়ে দূরে সরে যায়। এক মুহুর্ত না দাঁড়িয়ে বাইরে বেড়িয়ে যায়। শুভ্র মাথা চুলকিয়ে বলে,
‘উফফস স্যরি। জানতাম না তোরা রোমান্স করছিস। আর ভাই, দরজাটা তো লাগাবি নাকি? নাহলে যে কেউই ঢুকে পড়বে।’
ফাহাদ কথা ঘোরানোর জন্য বলে,
‘কি জন্য এসেছিস শুনি।’
শুভ্র ফাহাদের কাছে এসে গম্ভীর হয়ে বলে,
‘তুই জেনিকে কেন ডাকলি এখানে?’
ফাহাদ ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করে,
‘আমাদের বন্ধু হয় শুভ্র। তাই আমার বিয়েতে আসতে বলেছি। কি হয়েছে?’
‘আসার পর থেকেই দেখছি নীরাকে সহ্য করতে পারেনা। আজে বাজে কথা বলছে নীরার সম্পর্কে। তুই ভাব, নীরা যদি এসব শুনে তাহলে কতটা কষ্ট পাবে বলতো? আর অভিক? রাগ কি পরিমাণে বাড়বে জানিস? রেগে গেলে যে কি করবে আল্লাহ’ই জানেন। অভিক এখন নেই। জেনি যদি এই সুযোগে নীরার ক্ষতি করে দেয় তখন?’
‘আরে তুই বাজে চিন্তা করছিস। নীরার কিচ্ছু করতে পারবে না ও। আমরা আছি না।’
শুভ্র খোঁচা মেরে ফাহাদকে বলে,
‘হ্যাঁ। তুমি তো আছ বউ নিয়া।’
‘চুপ থাক। তোর হলে বুঝবি।’
.
রান্না শেষ করে সবাইকে খাইয়ে তারপর নীরা খেতে বসে। খাওয়া শেষ করে নিজের রুমে চলে আসে। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে ৬০ টা কল মিসড কল। নীরা চমকে যায়। কলগুলো যে অভিকই দিয়েছে তা ভালোভাবেই বুঝতে পেরেছে নীরা। অভিক নীরাকে আবার কল দেয়। নীরা সাথে সাথেই কল রিসিভ করে। ভিডিও কল দিয়েছে অভিক। অভিকের ফেইস দেখে বোঝাই যাচ্ছে সে কি পরিমাণ রেগে আছে। নীরা অপরাধীর মতো নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। অভিক বলে,
‘আমার দিকে তাকাও।’
অভিকের ধমক মারাত্মক। নীরা ভর পেয়ে অভিকের দিকে হালকা চোখ তুলে তাকায়। অভিক বলে,
‘কোথায় থাকো? বনে বাজারে নাকি কবরস্থানে?’
নীরা অভিকের কথা শুনে হা করে তাকিয়ে আছে।
‘এন্সার মি ড্যামিট।’
নীরা বুঝতে পারে, অভিক রেগে আছে খুব। নীরা কাঁদো মুখ নিয়ে বলে,
‘রাগ করবেন না প্লিজ। নিচে গিয়েছিলাম, দেখলাম খালাম্মারা ব্রেকফাস্ট বানাচ্ছেন তাই তাদের একটু হেল্প করেছি। মোবাইলটা এখানে রেখে গিয়েছিলাম। স্যরি।’
অভিক শান্ত হয়ে বলে,
‘আচ্ছা ঠিকাছে। এখন নিজের রুমের দরজাটা লক করো ভিতর থেকে। জরুরী কথা বলবো।’
নীরা দরজাটা লক করে বিছানায় বসে আছে। অভিক বলছে,
‘মিস করোনা আমায়?’
নীরার কাঁন্না চলে আসে। চোখের কোণে জল জমে যায়। নীরা বলে,
‘আর কতদিন লাগবে? খুব মিস করছি আপনাকে।’
‘খুব শিগ্রই আসবো। অপেক্ষা করবে তো?’
‘হুম। খেয়েছেন?’
‘হ্যাঁ। তুমি খেয়েছ?’
‘বললাম না। আচ্ছা, ওখানে কয়টা বাজে এখন?’
‘ঢাকায় সকাল ১০ টা বাজলে এখানে রাত ১০:১০ বাজছে।’
‘অহ, ওখানে এখন রাত?’
‘হুম। আমি একটা কথা ভাবছি জানো?’
‘কি কথা?’
‘এই যে, আমি তোমার উপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকতে পারিনা।’
নীরা মুচকি হাসে। তারপর অভিক বলে,
‘সুন্দর করে একটা হাসি দাও তো।’
‘হাসার মতো কিছু পাচ্ছিনা।’
‘তুমি বললে আজ দু’জনে নীল রঙা বৃষ্টিতে ভিজবো।’
নীরা হেসে উঠে। অভিক আর বৃষ্টি?
‘আপনি তো বৃষ্টিতে ভিজলে রেগে যান।’
কিছুটা অভিমানী সূরে বলল নীরা। অভিক মুচকি হেসে বলে।
‘তুমি চাইলে সব করতে রাজি আমি। কারণ, ডুবেছি আমি তোমার চোখের অনন্ত মায়ায়।’
‘গানগুলো আমার ভিষণ পছন্দের।’
‘তুমি জানো তুমি আমার কাছে কি?’
‘কি?’
‘তুমি আমার অভিমান। তোমার চোখের কান্না আমি সহ্য করতে পারিনা। আমার বুক চিড়ে ক্ষত বিক্ষত হয়ে যায় হৃদয়। তোমার অভিমানী মুখ দেখলে আমার ভিষণ খারাপ লাগে। তাই তুমি আমার অভিমান, চেনা সুরে লিখে পাঠালাম। যত না বলা কথার উড়ো খাম।’
নীরা স্তব্ধ হয়ে যায় অভিকের কথা শুনে। অভি ওকে এতোটা ভালোবাসে? চোখে জল এলো তার। কিন্তু অভিককে তা বুঝতে না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে সে বলল,
আচ্ছা, আমি রাখছি হ্যাঁ?’
‘কি করবে শুনি?’
‘আজ ফাহাদ ভাইয়ার রিসিপশন না? প্রীতিকে সাজাতে হবে।’
‘আচ্ছা ঠিকাছে। আমায় একটা কিস দাও তারপর রাখবো।’
‘কিইইইই?’
‘চমকে উঠলে যে?’
‘আ..আমি যাচ্ছি।’
‘উঁহু। আগে কিস দিবে তারপর যেতে দিব।’
‘যা ইচ্ছা তাই করুন।’
‘সত্যি বলছ? ভেবে বল।’
‘হ্যাঁ। সত্যি বলছি। রাখুন। আল্লাহ হাফেজ।’
‘ঠিকাছে। এর শোধ তো আমি নিবই।’
অভিক কল কেটে দেয়। নীরা নিচ থেকে হৈচৈ এর আওয়াজ শুনে নিচে যায়।’
.
রান্নাঘরে কাজ করছিল নীরা। তেমন কেউই ছিলনা তখন রান্নাঘরে। এর সুযোগ নিয়ে জেনি আসে রান্নাঘরে। নীরাকে জিজ্ঞেস করে,
‘কি করছ তুমি?’
নীরা জবাবে বলে,
‘নুডলস রান্না করছি সবার জন্য। আপনি খান?’
‘ওইসব তৈলাক্ত খাবার খাইনা।’
জেনি শুধু সুযোগ খুঁজছে কিভাবে নীরাকে শায়েস্তা করা যায়। অবশেষে সে পেয়েই গেল একটা ফাঁদ। নীরা মাত্র গরম পানি চুলো থেকে নামালো। এটা দেখে জেনি নীরাকে ইচ্ছে করে একটা ধাক্কা দিল। নীরা ধাক্কা খেয়ে তার হাত পড়লো গরম পানির পাতিলে। নীরা চিৎকার দিয়ে উঠে।
নীরার চিৎকার শুনে শুভ্র দৌড়ে আসে ওখানে। নীরার হাত টেনে দেখে হাত পুরো লাল হয়ে গেছে। নীরার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে। জেনি তখন বলে,
‘উফফ’স স্যরি নীরা। খেয়েল করিনি আমি।’
এই বলে জেনি পাশ কাটিয়ে চলে যায়। শুভ্র নীরাকে বলে,
‘বুঝেছি, জেনি এটা করেছে তাই না? ওর ব্যবস্থা আমি পরে করছি। আগে আসো তোমার হাতে বরফ লাগিয়ে দেই।’
শুভ্র নীরাকে নিয়ে সোফায় বসায়। ফ্রিজ থেকে বরফ এনে নীরার হাতে আলতো করে লাগিয়ে দেয়। জেনি এসব দেখে কয়েকটা ছবি তুলে নেয়। কিছুক্ষণ বরফ লাগানোর পর পোড়ার মলম মালিশ করে দেয়। হাত যাতে বেশি না জ্বলে। এদিকে সবাই নীরার অবস্থা দেখে বলছে সাবধানে থাকতে। সে যাতে আর রান্নাঘরে না যায়। কিন্তু শুভ্র তো জানে এসবের পিছনে কে আছে।
শুভ্র অভিককে কল দিয়ে সবটা বলে। অভিক ঘুমে ছিল। হোয়াটসঅ্যাপ এ কল পেয়ে রিসিভ করে। আর তখনই শুভ্রর কথা শুনে অভিকের রাগ চরম সীমানায় পৌঁছে যায়।
এদিকে জেনিও সেই মুহুর্তে অভিকের হোয়াটসঅ্যাপ এ শুভ্র আর নীরার কিছু পিক পাঠায়। আর সেখানে মেসেজ দিয়ে লিখে।
‘দেখো অভিক। তোমার বউ তোমার অনুপস্থিতিতে শুভ্রর সাথে কি করছে।’
অভিক এমনিতেই রেগে ছিল তারউপর জেনির কাজ দেখে সে মাত্রাতিরিক্ত রেগে আগুন। সে সঙে সঙে জেনিকে কল দিয়ে বলে,
‘তুমি কি মনে করো নিজেকে জেনি? নীরার নখের সমানও তুমি হতে পারবে না। শুভ্রর সাথে নীরার ছবি দেখে ভাবছ আমি নীরার উপর রেগে যাবো? তুমি কি করেছ? নীরাকে ধাক্কা দিয়ে গরম পানির উপর ওর হাত ফেলে দিয়েছ। তুমি ওকে কষ্ট দিয়েছ। আমি ওখানে থাকলে তোমার অবস্থা যে কি হতো তুমি নিশ্চয়ই ভাবতে পারছ? চুপচাপ ওই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাও।’
অভিক কলটি কেটে দিয়ে শুভ্রকে কল লাগায়। নীরাকে ভিডিও কলে দেখতে থাকে। নীরা ঘুমিয়ে গেছে এক প্রকার। সেটা প্রীতির রুমে। হাতটা দেখে ভিষণ খারাপ লাগে অভিকের।
রিসিপশনের কাজ সম্পূর্ণ হয়। নীরার হাতে ব্যান্ডেজ থাকায় সে মন খারাপ করে বসে থাকে। তাকে কিছুই করতে দেওয়া হয়নি। শুধু কয়েকটা ছবি তুলেছে প্রীতি আর ফাহাদের সাথে। প্রীতিকে সাজানোর কথা ছিল তার সেটাও হলোনা। ডান হাত পুড়ে যাওয়ায় ফাহাদের মা নীরাকে খাইয়ে দিয়েছে। এসবের মধ্যে দিয়ে অভিককে বড্ড মিস করেছে নীরা।
চলবে…