তুমি অতঃপর তুমিই
২৭
Writer Taniya Sheikh
মুখোমুখি তিনজন বসে আছে লিভিং রুমে। সবার মুখ গম্ভীর, ম্লান। মোবারকের সকল ভাবনা এলোমেলো হয়ে আসছে৷ শানের মুখের দিকে চাইতেও তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। একটা মানুষ যখন দ্বারে দ্বারে ধোঁকা আর অবহেলা পায় তখন কেমন লাগে! মোবারকের ভাবতে তো বুক কাঁপে। ইমা সেই যে নত মুখে বসে আছে তো আছেই। মোবারক মৃদু কেশে গুমোট গম্ভীরভাব কাটানোর চেষ্টা করে। ইমা অসহায় মুখটা তুললেও শান আগের মতোই চোখ বন্ধ করে কপাল ধরে বসে আছে। আড়চোখে শানের দিকে তাকায় ইমা। চোয়ালের পেশি টান টান, ঠোঁট শক্ত করে বসে আছে সে। গত চারবছরের বিশ্বাস এক নিমেষেই ভেঙে গেল আজ।এই মিথ্যা বিশ্বাসের যন্ত্রণা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আনন্দ যেমন হচ্ছে, তেমনি কষ্টও হচ্ছে মিথ্যা আঁকড়ে ধরে থেকেছিল বলে। একে একে স্মৃতির পাতায় ভাস্বর হচ্ছে নিজের ভুল,শানের উপর করা অন্যায়। চোখের কোনা ছাপিয়ে জল উপচে পড়ে। সে শানকে ভালোবাসত একথা আজ বলতেও জিহ্বা আড়ষ্ট হয়ে আসছে,মস্তিষ্কে সূক্ষ্ম পীড়া অনুভব করছে ভাবতে গিয়ে। লজ্জায় মুখ নুয়ে নীরবে কাঁদছিল ইমা। মোবারক সেটা দেখতে পেয়ে বলল,
” ভাবি, কাঁদবেন না প্লিজ, আপনার আর কী দোষ?”
” আমারই সব দোষ, মোবারক ভাই, আমারই সব দোষ। আমি যোগ্যই না কারো। আমার মরে যাওয়া উচিত। ঘৃণা হচ্ছে নিজের উপর। এতো বোকা কেন? কেন সহজে সবার কথা বিশ্বাস করি? আমার কঠিন শাস্তি হওয়া উচিত।” ইমার কণ্ঠস্বর কেঁপে কেঁপে ওঠে। ফুঁপিয়ে ওঠে মুখে ওড়না চেপে। ইমাকে হতবিহ্বল করে শান আচমকা টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে ভুলে যায় ক্ষণিকের জন্য ইমা। শান এখনো চোখ মেলেনি। একইভাবে আধবসা হয়ে ব্যথাবিদির্ণ স্বরে বলে,
” মোবারক ঠিকই বলেছে। নিজেকে দোষী ভেবো না ইমা। যেখানে আমার মতো মানুষকে ওরা দিনের পর দিনের ধোঁকা দিয়েছে, সেখানে তুমি আর কী!”
এই সান্ত্বনার মাঝেও প্রবল অভিমান খুঁজে পেল ইমা। এতোকাছে থেকেও অভিমানের দেয়াল দুজনের মাঝে। ইমা দাঁত চেপে কান্না গিলে চুপচাপ বসে রইল শানের এক বাহুডোরে। মোবারক এদের দুজনকে বেশ চেনে। মিলন মাঝের এই শৈত্যপ্রবাহ ওর নজরে এড়ায় না। তারচেয়েও বড়োকথা শানের এই কঠিন নীরবতা, মোবারকের কিছুতেই হজম হয়না। শানের মতো মানুষ,যেকি’না নিজের উপর অন্যায় কিছুতেই বরদাস্ত করতে পারে না। সে দুই দুইবার এমন গুরতর বিষয় নীরবে মেনে নিল! যারা তার সব শেষ করে দিল তাদের এতো সহজে ক্ষমা করে দিচ্ছে সে? মোবারক কিছু বলবে ভেবেও ইমাকে দেখে চুপ করে রইল। একটু পর শান ইমাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
” কিছু খাবে তোমরা?”
মোবারক, ইমা পরস্পরের দিকে তাকায় শানের অভিব্যক্তিহীন রূপ দেখে। মানুষটার মনে কী চলছে কিছুতেই ঠাহর করতে পারল না৷ শান দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করে না ওদের দিকে তাকিয়ে। চুপচাপ গিয়ে দাঁড়ায় কিচেনে। ইমা দেখছে শানকে। শান ফিরেও তাকাচ্ছে না এদিক। ওর মুখে আষাঢ়ের মেঘ। বৃষ্টি নামতে চেয়েও যেন নামছে না৷ কালো,ঘন কালো মেঘে পৃথিবী ঢেকে গেলে যেমন দিনরাত ঠাহর করা যায়না,ঠিক তেমনটা শানের ক্ষেত্রে এমুহূর্তে। ইমা এভাবে বসে থাকতে নারাজ। সে এই রূঢ় নীরবতার অবসান চায়। তাতে যা হোক! তবুও শান মনের অনুক্ত কথা প্রকাশ করুক। ইমা উঠে দাঁড়াতেই মোবারক ভীত কণ্ঠে বলে,
” ভাবি এখন যাবেন না।”
” কেন?”
” আপনি জানেন কেন নিষেধ করছি। স্যারকে একটু সময় দিন। আপনার এখন ওখানে যাওয়া আগুনে ঘি ঢালার সমতুল্য হবে।”
ইমা চোখ রাঙিয়ে তাকায় মোবারকের দিকে। মোবারক ঘাড় গুঁজে নিচু গলায় বলে,
” প্লিজ ভাবি, এই একটা কথা শুনুন আমার। স্যারের অশান্ত মনকে একটু শান্ত হতে দিন। উপরে স্যার যতই নির্লিপ্ত ভাব ধরে থাক ভেতরে কিন্তু মোটেও এমনটা নেই তার। আর এ কথা যেমন আমি জানি,আপনিও জানেন বৈকি!” মোবারক অনুরোধ করে ধৈর্য্য ধরতে। ইমা অনিচ্ছা মনে বসে পড়ল। অস্থির চিত্ত তার বার বারই মিমাংসা চাচ্ছে। সব সত্যি জানার পর শানের দুরত্ব কিছুতেই বরদাস্ত হচ্ছে না। অধৈর্য্য মানুষদের নিয়ে যদি কোনো প্রতিযোগিতা হত তবে নিশ্চিত তাতে ইমা ফার্স্ট হতো। এই মেয়েটার মধ্যে প্রচণ্ড ধৈর্য্যশক্তির অভাব। এও বলা যেতে পারে আজ ওর এবং শানের এই দুরত্ব আংশিক ইমার অধৈর্য্যতারই ফল। ধারণা খুবই খারাপ জিনিস। তারচেয়েও খারাপ যাচাই বাছাই ছাড়া বিশ্বাস করা। ইমার সামনে যা তুলে ধরা হয়েছে সে তাই বিশ্বাস করেছে। একটিবার প্রয়োজনবোধ করেনি শানের মুখোমুখি হওয়ার। যতই ফুলন দেবী সেজে থাকুক। আদৌতে সে প্রচণ্ড আবেগী এক রমণী। এমন ধরনের আবেগী, যার আবেগকে ব্যবহার করে সহজেই তাকে কন্ট্রোল করা যায়। সামিরার মতো ধূর্ত নারীর এটুকু বুঝতে অবশ্য কষ্ট হয়নি। ইমার সবচেয়ে বড়ো দূর্বলতা ছিল ওর মা। বলতে গেলে ওর পৃথিবী ছিল। সামিরার প্রথম টার্গেট তিনিই ছিলেন৷ ওর জন্য প্লাস পয়েন্ট ছিল ইমতি, সামিরার কলেজ জীবনের প্রেম। সামিরার জীবনে বহুপুরুষ এসেছে, গেছে। এই আসা যাওয়ার মধ্যে ইমতিও ছিল একজন। উঠতি বয়সের প্রেম প্রচণ্ড আবেগময় হয়। ইমতির মতো সহজ-সরল ছেলের সেই আবেগকে সহজেই বশ করেছিল ধনীর দুলালী সামিরা। সামিরা মাহিবেরই ফিমেল সংস্করণ। চারিত্রিক দিক দিয়ে চাচাত ভাইবোন দুজন কেউ কারো চেয়ে কম নয়৷ আর ঠিক এ কারনেই এদের বাগদান সম্পন্ন হওয়ার পরও ব্যক্তিগত জীবন একই রকম ছিল,আছে। কেউ কারো লাইফে ইন্টারফেয়ার করেনা,জানে দিন শেষে একই পথের পথিক হবে। দোষ ধরার, নিষেধ করার মতো যুগল এরা নয়৷ সবসময় যেন প্রতিযোগিতায় থাকে কে কার চেয়ে বেশি অপকর্ম করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে অবশ্য মাহিব সামিরাকে কখনোই টেক্কা দিতে পারে না। তবে হ্যাঁ জেতার চেষ্টা, সামিরার সামনে ক্ষমতার দাপট দেখানোর চেষ্টা মাহিবের আগেও ছিল,এখনো আছে। তেমনি একটা ঘটনা ঘটে সামিরা কলেজে পড়াকালীন। সামিরা ইমতিকে ফাঁসিয়েছিল মাহিবকে জ্বালাবে বলে। উদ্দেশ্যে সফলও হয়েছিল। মাহিব জ্বলেছিল। ইমতি এবং ওর বাবা মাহিবের গায়ে হাত তুলেছে এমন একটা অভিযোগ করে বড়ো আব্বার কাছে। একমাত্র ছেলের রক্তারক্তি চেহারা কিছুতেই সহ্য করেননি মঈন খান৷ শান নিজেও তখন ছাত্র। সে মাহিব,সামিরার এই পৈশাচিক খেল কোনোদিন বোঝেনি৷ শানের চোখে ওরা দু’জন ছিল পরস্পরের শত্রু।শুধু শান কেন বাড়ির সবাই এমনটা ভাবত। শানকে আদেশ করা হয় বাপ ছেলেকে বন্দুকের ভয় দেখিয়ে তুলে আনার। এই একবিংশ শতকে এসেও যে কেউ নিজেকে দাস ভাবে,শানকে তখন না দেখলে বোঝার উপায় ছিলনা৷ বলিবা মাত্রই করিতে বাধ্য থাকিবে,কথার মতোই তৈরি করে মঈন খান ওকে। অপরিণত বয়সী শান সেদিন জানত না এই দুজন তার প্রিয়তমার পরমাত্মীয়। মাহিব সুকৌশলে বাপ ছেলেকে খুন করে। এই খুনটাকে ক্রসফায়ারের নামে চালিয়ে দেওয়া হয়। কাজটা করে ওদেরই হয়ে কাজ করা এক পুলিশ অফিসার। মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় নিরাপরাধ মৃত ইমতি এবং ওর বাবাকে। মৃত্যুরও পরও যাতে এ নিয়ে ওদের পরিবার কোনো একশন নিতে সাহস না করে সেজন্য হয়রানি শুরু করে। বিধবা বিভাকে নানা ভাবে অপদস্থ করা হয়। এই সব কিছু সচক্ষে দেখে ইমা। এরপর থেকেই পুলিশ নামক পেশাটার প্রতি যেমন ওর ঘৃণা তেমনি ভয়। বলেনা পৃথিবীতে খারাপ যেমন আছে ভালোও তেমন আছে। এক হাবিলদার ওদের সাহায্য করে। আসল ঘটনা বিভাকে খুলে বলে। এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। স্বামী -সন্তান হারিয়ে বিভা একেবারে অসহায় হয়ে পড়ে। মামলা মোকাদ্দমায় যাওয়ার সাহস পায়না। তাই হাবিলদারের পরামর্শ মতো চলে আসে বাপের বাড়ি। বটগাছ তুল্য পিতার ছায়া ছাড়া পৃথিবী কতটা স্বার্থপর,নিষ্ঠুর ইমা ধীরে ধীরে জেনেছে। কোমল হৃদয় তারই কারনেই হয়ে ওঠে কঠিন,রুক্ষ। সেই রুক্ষ জমিনে শ্রাবণ ধারা হয়ে এসেছিল শান। কতোটা মধুর ছিল দিনগুলো! ইমার চোখের কোনে জল চিকচিক করে। সেই দিনগুলো আবার ফিরে পেতে ছটফট করে মনটা। মোবারকের সামনে কাঁদতে চায়না আর ইমা। উঠে চলে আসে রুমে। বালিশ বুকে জড়িয়ে মুখ গুঁজে কাঁদতে কাঁদতে বলে,
” আ’ম সরি শান। আ’ম সরি।”
কিচেনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে শান। চুলায় গরম পানি শুকিয়ে তলানি ছুঁই ছুঁই। দেরি দেখে লিভিং রুম ছেড়ে উঠে এসেছে মোবারক। যা ভেবেছিল তাই! শান ঠিক নেই,ঠিক হতেই পারেনা এতোকিছুর পরে। থমথমে মুখে স্থির দৃষ্টি মেলে বাইরে চেয়ে আছে।
” স্যার, ঠিক আছেন?” মোবারকের কণ্ঠস্বরে পলক ফেলে শান। তার মনের অস্থিরতা বাহিরে প্রকাশ পাচ্ছে এবার। চুলা নিভিয়ে আবার জ্বালাচ্ছে,কফির কৌটা সামনে রেখে এদিক ওদিক খুঁজছে। খুব খারাপ লাগল এসব দেখে মোবারকের। ইতস্তত করে শানের কাঁধ চেপে ধরতেই চিৎকার করে ওঠে শান,
” মোবারক আমার অপরাধ কী? কেন বার বার আমার সাথেই এমন হয়? আমার বিশ্বাস নিয়ে সবাই এভাবে কেন খেলে? আমি তো কাওকে বিশ্বাস করতে চাইনা,ভালোবাসতে চাইনা। কেন সবাই আসে আমার জীবনে? কেন এভাবে ভেঙেচুরে দেয় আমার হৃদয় বার বার!” শেষটা বলে শক্ত করে শরীর শান। কাঁদছে না সে। ধড়া কণ্ঠস্বর ক্রোধে,অভিমানে থমকে থমকে যাচ্ছে। মোবারক বিষন্ন মুখে বলে,
” সামিরা,,,। কথাটা বাড়েনা শানের ধমকে।
” নাম নিবি না ওর। ভেবেছিলাম ঐ বাড়িতে ও আমাকে বোঝে,আমাকে বন্ধু ভাবে,আপন ভাবে। কিন্তু না, মঈন খানেরই তো রক্ত। ধোঁকা ওদের রক্তে মিশে আছে। আমাকে এতিম করেছে,পদে পদে অপমান করেছে আর এখন শুনছি আমার ভূত ভবিষ্যতও নষ্ট করেছে। দারুন তাই না, বল?” কাষ্ঠহাসি হাসি হাসল কঠিন মুখে।
” ভবিষ্যত নষ্ট হয়েছে বলছেন কেন,স্যার? ভাবি,,”
মোবারকের কথা থামিয়ে দেয় শান হাত উঁচু করে৷ চোয়াল শক্ত করে বলে,
” আমাকে একা থাকতে দে।”
” স্যার!”
” মোবারক তোকে কী বলেছি আমি? একা থাকতে দে আমাকে। যা আমার সামনে থেকে।” মোবারক যায়না। শান অগ্নিদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,
” তবে থাক তুই। আমিই যাচ্ছি।” শান বেরিয়ে যায় বাসা ছেড়ে। মোবারক পিছু নেয় গেট পর্যন্ত। উত্তর দিকে যাচ্ছে দেখে থেমে যায়। পাশে কৌতূহলে চেয়ে আছে মতিন।
মৌটুসি ব্যাগ হাতে মেইন রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে। আপাদমস্তক সেই গ্রাম্য সহজ-সরল সাজ। বার বার হাত ঘড়িটায় নজর বুলাচ্ছে। খবর মোতাবেক মিনিট দুইকের মধ্যে এই পথ দিয়ে যাবে ইমরোজের বাইক। একমিনিট ইতোমধ্যে পার হয়েছে বাকি এক মিনিটে যদি না দেখা মেলে! তবে আবার নতুন প্লান কষতে হবে। মৌটুসি বিরক্ত হচ্ছে ইমরোজের এমন এটিটিউডে। মাহিবকে বশ করতেও এতো ভোগান্তি পোহাতে হয়নি যতটা এই পুলিশটার মন গলাতে হচ্ছে। একবার ভাবে, এসব গ্রাম্য সাজের কারনেই হয়তো ভাও দিচ্ছে না। একটু বোল্ড সাজ দিলে সহজেই বশ করতে পারত। মাহিবটার জন্য সেটাও তো হবেনা। মাহিবের আচরণে মনে মনে তৃপ্ত হলেও মনে একটা শঙ্কা এখনো রয়ে গেছে। এই শঙ্কাটা পুরোপুরি না কাটানো পর্যন্ত লক্ষ্যে পৌঁছান যাবে না৷ মাহিবকে পাগল হতে হবে ওর জন্য, মৌই হবে আকাঙ্খার মানুষী। খানিকটা তো হয়েছে সে, বাকিটাও মৌটুসি করবেই। ঠোঁটের পার্শ্ব কঠিন হয়ে ওঠে মৌটুসির। সেটা সহসা সহজ হয় অদূরে ছুটে আসা ইমরোজের বাইক দেখে৷ চট করে মুখ ঘুরিয়ে অসহায় ভাব ফুটিয়ে শূন্য রাস্তায় তাকিয়ে রয়। ইমরোজ প্রথমে চিনতে পারেনা। কারফিউয়ের মধ্যে মেয়েটিকে একা দাঁড়ানো দেখে বাইক থামিয়ে নামে। ভালো করে তাকাতেই চিনতে পারে। একপ্রস্ত হাসি হেসে বলে,
” আপনি এখানে।”
মৌ এমনভাবে তাকায় যেন ইমরোজকে সে চিনতে পায়নি। একটু ভাবুক হওয়ার ভান ধরতেই ইমরোজ বলে,
” চিনতে পারলেন না?”
” ওহ, আপনি?” প্রসস্থ হাসি হেসে মুহূর্তে মুখটা কালো করে ফেলে। নত মুখে তাড়াতাড়ি ব্যাগ খুলছিল। তা দেখে ইমরোজ বলল,
” কী করছেন?”
” আপনার ব্লেজার বের করছি।”
” সবসময় ওটা নিয়ে ঘুরে বেড়ান বুঝি?”
ইমরোজের কৌতুকে মৌ মনে মনে রাগ হলেও দেখায় লজ্জিত ভাব। লজ্জায় চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। ইমরোজ ব্যাগের দিকে তাকিয়ে বলে,
” কোথাও যাচ্ছিলেন নাকি?”
মৌ কথা বলেনা। মুখটা আরো নামিয়ে নেয়। ইমরোজ হঠাৎ রুক্ষ গলায় বলে,
” আপনি জানেন না দেশের পরিস্থিতি? এই অবস্থায় বাইরে বেরিয়েছেন কোন আক্কেলে?”
মৌ এবার নিচু গলায় বলে,
” আমি বাড়ি ফিরে যাব।”
” বাড়ি ফিরে যাবেন বললেই হলো! গাড়ি বন্ধ জানেন না?”
” ওহ! তাহলে হেঁটে যাব।” ব্যাগ থেকে ইমরোজের ব্লেজারটা বের করে দিয়ে, ব্যাগ হাতে উল্টো দিকে হাঁটা ধরে মৌ। রাগ হচ্ছে এই ইমরোজের উপর। কেমন রূঢ়লি বিহেভ করে হঠাৎ হঠাৎ লোকটা! ইচ্ছা করে গুলি করে দিতে হৃদপিণ্ড বরাবর। এদিকে মনে ভীষণ অস্থিরতা বিরাজ করছে প্লান বিফলে যাচ্ছে দেখে। সেই অস্থিরতা একনিমিষে উত্তরের হাওয়া হয়ে গা হিম করে দিল ইমরোজ হাত ধরতেই।
” কোথায় যাচ্ছেন?”
” যেদিকে দু-চোখ যায়। আপনি হাত ছাড়ুন।” ইমরোজ হাত ছেড়ে সরি বলে। মৌ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর পলক নামা মুখটায়। চোখের সীমানা পেরিয়ে ঠিক মনে গিয়ে ছুঁয়ে এলো এই দেখার অনুভূতি। নিজেকে সামলে নিল মৌ। ছদ্মবেশের খোলস ছেড়ে কিছুতেই বেরোতে দেবে না নিজেকে সে। যদি বেরোয় তবে সেদিন হবে ওর মৃত্যুদিন। অভিনয় বহাল রেখে অভিমানী কণ্ঠে বলে,
” আর হ্যাঁ, এরপর থেকে কাওকে সাহায্যের অঙ্গিকার করার পূর্বে একটু ভেবে নেবেন। আপনাকে আমি শুধু ব্লেজার ফিরিয়ে দেব বলে কল করেছিলাম, অন্য কিছু নয়।” আরেকবার পূর্ণ দৃষ্টি মেলে দুজন দুজনকে দেখে। মনের রুদ্ধ কবাট সহসা খুলে যায় ফাগুন হাওয়ার দোলে। সংকেত পেলেও দু’জনই প্রাপ্ত বয়স্ক, নিজের অনুভূতির লাগাম টানতে সিদ্ধহস্ত। মৌ কিছুদূর হেঁটে সামনে গিয়ে ভাবে,
” এই লোককে পটাতে আর কত দেরি হবে? উফ!” বিরক্তির রেশ কাটতে না কাটতেই ইমরোজ বাইক চালিয়ে পাশে এলো। বলল,
” আচ্ছা সরি।”
” সরি বলার প্রয়োজন নেই।”
” খুব রেগেছেন দেখছি।”
” না,মোটেও না।” মুখ ঘুরিয়ে বলতেই ইমরোজ হেসে ওঠে। বলে,
” চলুন আমার সাথে।”
” কোথায়?” চলতে চলতেই প্রশ্ন করল কিন্তু ফিরেও তাকাল না মৌ। ইমরোজ ওর সামনে বাইক থামিয়ে বলল,
” আমার বাসায়।”
” আপনার বাসা! কেন?” চমকে তাকায় মৌ। এতো সহজে চাওয়াটা পূরণ হবে সে ভাবেইনি। ইমরোজ সহজ গলায় বলে,
” কী যাবেন তো?”
” আমার মতো একজন অচেনা -অজানা মেয়েকে বাড়ি কেন নিতে চাচ্ছেন আপনি? পুলিশ হিসেবে এটা কী আপনার বোকামি হচ্ছে না?” কথাটা বলে নিজেই নিজেকে বকলো মনে মনে। ইমরোজ বাইক থেকে এমন ভাবে নামল যে, মৌ কিছুটা ঘাবড়ে গেল। ইমরোজ চিবুক চুলকে চোখ ছোটো করে বলল,
” কথা তো ঠিকই বলেছেন আপনি। তো কী করা যায় বলুন?”
” আ-আমি কী জানি? আমি আসছি।”
মৌ দু’কদম এগোতেই ইমরোজ এক হাত টেনে কাছে নিয়ে আসে।
” কোথায় পালাচ্ছেন ম্যাডাম? চলুন।”
একপ্রকার জোর করে বাইকে বসিয়ে বাসায় নিয়ে এলো মৌকে। আমেনা বেগম,আশা বিস্ময় চোখে চেয়ে আছে ছেলে এবং তার সাথে আগত অচেনা মেয়েটির দিকে। তবে কী ছেলে বিয়ে করে ফেলেছে? আমেনা বেগম কষ্ট পেলেও মুখে হাসি ফুটিয়ে এগিয়ে গেলেন।
” মা, উনি আমাদের মেহমান। কিছুদিন এখানে থাকবেন।” এরপর মা এবং বোনের সাথে মৌকে পরিচয় করে দিয়ে বেরিয়ে যায় ইমরোজ। আমেনা বেগম গম্ভীরমুখে মৌকে দেখেন। মেয়েটা সুন্দর তবে তার তেমন পছন্দ হলো না। এরচেয়ে ঐ বোনের মেয়েটাকেই বেশি মানায় ছেলের সাথে। এই মেয়েটির এখানে থাকা তিনি পছন্দ করলেন না। কিন্তু কিছু বলতেও পারলেন না মুখের উপর,ছেলের মেহমান বলে কথা। আশাকে রুম দেখাতে বলে অন্য রুমে চলে গেলেন। আশা হাসি মুখে নিজের রুমে নিয়ে এলো মৌকে। আশার মুখটা দেখে ছোটো বোনটার কথা মনে পড়ে গেল হঠাৎ মৌটুসির। আশার দিকে চেয়ে চেয়ে অজান্তেই কেঁদে ফেলল। মায়ের ডাকে আশা তখনই বাইরে চলে যাওয়ায় এ দৃশ্য দেখতে পেল না। এই ঘর- এই পারিবারিক পরিবেশে মৌ বার বার নিজের অতীত খুঁজে ফেরে। বার বার চোখ ভরে আসে জলে। একদিন এমন সুন্দর একটা পরিবার ছিল, আনন্দ ছিল। আজ কিছুই নেই।
চলবে,,,,