” তুমিময় আমি। ”
“ মার্জিয়া খাঁন নিহা। ”
পর্ব : ৭।
বাইরে জুম বৃষ্টি। বৃষ্টির তোড়ে বাইরের সবকিছু ঝাপসা লাগছে। তবু জান এক দৃষ্টিতে বাইরে তাকিয়ে। তীব্র বৃষ্টির ক্ষুদ্র ফোঁটা টুপ করে কদমের গা ছুঁয়ে যাচ্ছে। হলদেটে সাদা কদম হাওয়ার তালে দুলছে। আবার কিছু কদম অনড় থাকতে চেয়েও হাওয়ার তোড়ে স্থির থাকতে পারছে না। জান চোখ মুখ শক্ত করে সেদিকে তাকিয়ে। কানে আশেপাশে একটা মশা বার বার শব্দ করছে। বার বার কানে মশার মত হৃদয়ের তখনকার কথাগুলো ভ্যান ভ্যান করছে। অসহ্য লাগছে তার। প্রচন্ড জেদে খপ করে দুহাতের মাঝে মশাটাকে পিষে ফেলল। মশার মত হৃদয়কেও পিষতে পারলে ভালো লাগত।
রাতের খাবারের পর জান ফুফির ঘরে যাচ্ছিলো। ভেতরের আওয়াজ শুনে দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। ভেতর থেকে হৃদয়ের গলা শোনা যাচ্ছে।
” এসব ন্যাকামি না করলে হয় না? ”
চমকে উঠে নূরজাহান আহমেদ বললেন,
” কোনটা ন্যাকামি? ”
” এসব ন্যাকামি নয়তো কি? এত বড়ো মেয়েকে তিনবেলা মুখে তোলে খায়িয়ে দিতে হয়। নিজে খেতে পারে না।নিজের হাত নেই ওর? ”
জুঁই অসন্তুষ্ট গলায় বলল,
” ওকে বাসায় সবাই খায়িয়ে দেয়। ”
” হুম সারাজীবন সবাই তাকে খায়িয়ে দেবে, চাকর রাখছে তো। ”
তেঁতে উঠে হৃদয়ের জবাব।
” প্রয়োজন পড়লে রেখে দেবে। টাকার কম আছে নাকি? ”
” হ্যা, টাকার গরম দেখাতেই শিখছে। অন্য মানুষতো কাজ না পারলে খেতেতো পারে। এ তো সেটাও পারে না। ন্যা,,কা। শরীর,রূপ দিয়ে কিছু হয় না সাথে গুন ও লাগে। এই মেয়েকে বিয়ে করার জন্য তুমি আমায় জোর করলে, মা? ”
নূরজাহান আহমেদ অসহায় দৃষ্টিতে হৃদয়ের দিকে তাকিয়ে। ছেলেটাকে মেয়েটাকে নিয়ে সমস্যা কোথায় তিনি বুঝতে পারছেন না৷ প্রতিনিয়ত খারাপ ব্যবহার করছে। শুধুই কি জোর করে বিয়ে করানো হয়েছে বলে! নাকি অন্যকিছু? তার মাথা ঝিম করে আছে। কিছু ভাবতে পারছেন না। চুপ করেই রইলেন।
হৃদয়ের কথায় জুঁই প্রচন্ড রেগে গেল।
” হৃদয় ঠিক করে কথা বল। ও সবই করতে জানে। আর না জানলেও সমস্যা ছিল না। জানকে এমনিতেই সবাই মাথা তুলে রাখবে, কিছু করার প্রয়োজন নেই। ”
” আদর পেয়ে পেয়ে বাদর তৈরী হয়েছে। ”
হৃদয় জেমটা মেরে বেরিয়ে গেল। হৃদয়কে বেরুতে দেখেই নিহান সরে দাঁড়িয়ে ছিল। অতঃপর নিঃশব্দে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াল। নূরজাহান আহমেদের বুক চিড়ে বেরিয়ে এলো দীর্ঘশ্বাস।
সবটা শোনার পর জানের প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। গলা অবধি সব উপচে আসছে। নিজেকে উপস্থাপনের চেষ্টা সে করেনি। তবুও ছেলেটা অকারণে বার বার তাকে ছোট করছে। প্রচন্ড রাগ নিয়েই সে শুয়ে পড়ল।
সকালে নাস্তার টেবিলে জান নিজেই চামচ দিয়ে খেতে লাগলো। নূরজাহান আহমেদ জানের হাতের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলেন।
” তোর হাতে কী হয়েছে? ”
টেবিলের সবার নজর তখন জানের হাতের দিকে। জান একবার নিজের হাতে চোখ বুলালো। গতরাতেই সে হাতে ঔষধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করেছে। কারো আশায় বসে থাকা বোকামি। জান স্বাভাবিক কন্ঠেই উত্তর দিলো,
” পুড়ে গেছে। ”
তখনি বাশার আহমেদ প্রশ্ন করলেন,
” হাত পুড়লে কীভাবে? তুমি কি রান্না ঘরে গিয়েছিলে? নূরজাহান আহমেদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
আর তুমি ওকে রান্না ঘরে যেতে দিলে কেন? ”
” ওতো কোনো রান্না করেনি। ”
চিন্তিত গলায় নূরজাহান আহমেদের জবাব।
” ফুফা, ফুফি এত চিন্তার কিছু হয়নি। আমি রান্না করতে গিয়ে হাত পুড়িনি। কেউ গরম কফি ফেলে দিয়েছিলো হাতে৷ বেশি লাগেনি। আমি ঔষধ লাগিয়ে নিয়েছি। ”
নূরজাহান আহমেদ সরোষ দৃষ্টিতে হৃদয়ের দিকে তাকালেন। তিনি ঠিকই বুঝতে পেরেছেন কাজটা হৃদয়ের। রাগি গলায় বললবেন,
” হৃদয় কাজটা তুমি ঠিক করলে? ”
জান বাদে টেবিলের সকলের দৃষ্টি এখন হৃদয়ের উপর। হৃদয় হকচকিয়ে গেল। জানের হাত পুড়েছে শুনে তারও কিছুটা খারাপ লেগেছে। কিন্তু সবার সামনে এভাবে ফাঁসিয়ে দেবে তা ভাবেনি। মুহুর্তেই রাগটা মাথা চাড়া দিয়ে তৈরি। হৃদয় জেদি গলায় বলল,
” বেশ করেছি। আমার আশেপাশে আসলে এমনই হবে। ”
পরমুহূর্তেই টেবিল ছেড়ে ওঠে গেল। নূরজাহান আহমেদ ছেলে ব্যবহারে হতাশ। বাশার আহমেদও বলার মত কিছু খুঁজে পেলেন না।
——————————-
হৃদয় তেতো মুখে গাড়ি চালাচ্ছে। পাশে বসে জান কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছে। হৃদয় বেরুনোর সময় অনেকটা জোর করেই নূরজাহান আহমেদ জানকে তার সাথে পাঠিয়েছে। হৃদয় বস্তির পাশের একটা গলিতে জানকে নামিয়ে বলল,
” এখানে থাকো চুপচাপ। আমি একটু পর আসছি। ”
জানকে নামিয়েই হৃদয় সস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। যাক আপদটাকে রেখে এসেছে। এখন নিশ্চিন্তে বন্ধুদের সাথে যেতে পারবে।
হৃদয় দুপুরের দিকে বাড়ি ফিরল। মা জানের কথা জিজ্ঞেস করতেই হৃদয়ের বোধ হলো। জানের কথা সে বেমালুম ভুলে গিয়েছিলো। হৃদয় দ্রুত বেরিয়ে পড়ল জানের খুঁজে। কোথায় খুঁজবে ভেবেই দিশেহারা। পরমুহূর্তেই ফোন করার কথা ভাবতেই মনে পড়ল, জানের নাম্বারটাই তার কাছে নেই। হৃদয় রাগে নিজের মাথা চেপে ধরল।
জান বস্তির পাশের গলিটায় দাঁড়িয়ে। ভ্যাপসা গরম। সূর্যের তাপ কাটার মতোই শরীরে বিঁধছে। পাশের নর্দমা থেকে আর্বজনার বিচ্ছিরি গন্ধে ভেতরের সব বেরিয়ে আসতে চাইছে। জান দম আটকে দাঁড়িয়ে। জায়গাটা তার অচেনা। দাঁড়িয়ে থেকে পা ব্যথা করছে। তার উপর চারজন ছেলে তখন থেকে নানা রকম বাজে ইশারায় ব্যস্ত। জানের নিজের উপর রাগ হচ্ছে। হৃদয়কে বিশ্বাস করার শাস্তি পাচ্ছে সে। তখন তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে ফোনটাও গাড়িতে রয়ে গেছে। অস্বস্তিতে জানের হাসফাস লাগছে। জান চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই পেছন থেকে ভরাট পুরুষ নালি কন্ঠে থমকে দাঁড়াল।
” কীগো কার অপেক্ষা করছো? ”
জান এক নজর তার দিকে তাকিয়েই দৃষ্টি ফিরিয়ে ফেলল। শার্টের উপরের তিনটে বোতাম খোলা, হাতে বেনসন, নাক,মুখ ফেঁড়ে বেরিয়ে আসছে বিষাক্ত ধোঁয়া, মুখে বাজে হাসি। জান নিঃশব্দে সামনে পা বাড়াল। কিন্তু এগোতে পাড়ল না। আরেকটা ছেলে সামনে এসে দাঁড়াল।
” আমাদের সাথে চলো। কষ্ট করে অপেক্ষা করতে হবে না। ”
” ঠিকঠাক পেমেন্ট করবো আর পুষিয়ে দেবো। ”
পাশের ছেলেটির বাজে ইঙ্গিত। হৃদয়ের চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো। জানের খোঁজে সে এখানে এসেই এসব শুনেছে। হৃদয় রেগে গাড়ি থেকে নামতে গিয়েই সামনে তাকিয়ে হতবিহ্বল হয়ে গেল।
জান ছেলেটার কাছে গিয়ে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে দিলো।
” কী বললি আবার বল? ”
কথা বলছে আর থাবড়াচ্ছে। ছেলেটাকে থাপড়াতে দেখে বাকি দুজন প্রথমে চমকে গেল। পরমুহূর্তেই জানের দিকে তেরে আসল। জান পাঞ্চ মেরে ফেলে দিল একটাকে, অন্যটাকে কিক করলো। তিনটাকে নিচে ফেলেই বেধম পেটাচ্ছে। তেজি গলায় বলে উঠল,
” নাক, মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের করে নিজেকে কী মনে করিস, ইটের ভাঁটা? বাসায় মা-বোন নেই?তোদের বোনকে কেউ এভাবে বললে তোদের কেমন লাগতো? ”
জান কথা বলছে আর থাপ্পড় মারছে।
ছেলেগুলোর একজন মার খেয়ে জানের এক পা ধরে বলল,
” আম্মা ভুল হয়ে গেছে, এবারের মত মাফ দেন। ”
জান ছেলেটাকে লাথি মেরে দ্রুত পায়ে স্থান ত্যাগ করল। ফর্সা মুখটায় রাগের প্রতিচ্ছবি ঠিকরে পড়ছে। হৃদয়ের রাগটাই এদের উপর ঝেড়ে ফেলেছে।
হৃদয়ের আর সামনে এগোনোর সাহস হলো না। গাড়ি নিয়ে সোজা একাডেমিতে চলে গেল। হৃদয় একাডেমির মাঠেই স্টান করে শুয়ে পড়ল। সাব্বির দেখতে পেয়েই এগিয়ে এলো।
” কীরে কী হয়েছে? ”
” আমি জীবনায়ু শেষ, দোস্ত। ভুল করলে মাফ করে দিস। ”
” কিসব আবোলতাবোল বকছিস? ”
” আমার কপালে দুঃখ আছে। ”
” সালা, কী হয়েছে বলবি? ”
তারপর রিদয় আজকের সব খুলে বললো।সাব্বির শুনেও অবাক। হৃদয় হতাশ গলায় বলল,
” ভাব ভাই, ওদের এতো মারছে আর আমি যে ওরে এতো কথা শুনালাম আমার কী অবস্থা করবে? আমি ভেবেছিলাম ও পাল্টে গেছে। কিন্তু ছোটবেলার মতোই আছে। আগুন! ”
” ভাবি ছোটবেলাও এমন ছিল নাকি? ”
” হুম। কথা কম বলতো মারতো বেশি। ভাইয়ের আহ্লাদী। এখন আমার কী হবে? ”
” মামা, যা করার করেই ফেলেছো। এখন যা হওয়ার তাই হবে। ”
হৃদয় বিরবির করে বলল,
” আমি পাগল হয়ে যাবো, আমি পাগল হয়ে যাবো। ”
চলবে,